প্রচন্ড গরম। হাতে নোটখাতা, প্রশ্নতালিকা অনবরত হাতড়াচ্ছি। সামনে উতসুক চেহারা নিয়ে বসে আট-দশজন মহিলা। অভিভাবকের ভঙ্গি নিয়ে বসে আছেন একজন পুরুষ, মহিলাদের কারো স্বামী হবেন। ইন্টার্ভিউ যদিও শুধুমাত্র মহিলাদেরই নেবার কথা ছিল, বেশিরভাগ উত্তর দেবার দায় স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনিই নিচ্ছিলেন।
গ্রামটা কক্সবাজারের সাবরাং এ, মানব পাচারের জন্য খ্যাত, বা বলা যায় রীতিমত 'সুখ্যাত'। সমুদ্র-উপকুলবর্তী এই জায়গাগুলো চাষের জন্য অনুকুল নয় খুব একটা, পরিবারগুলোয় আয়-উন্নতিতে নেই স্বচ্ছলতা। পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্রের অভাবে বেকারত্বও প্রবলভাবে জেকে বসেছে। এই অবস্থায় কেউ যদি এসে বলে তাদের অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে সমদ্রের ওপার করে দেবে অনায়াসে, সারা জীবনের রুজি-রোজগারের গতি করে দেবে, তবে কার না চোখ চকচক করে উঠবে? পন্থাটা নিরাপদ নয়, সবাই জানে। যেতে যেতে পথে দু' একজন মাঝে মধ্যে মারা যায় বটে, তবে সে ত তারই কপাল। আর তাছাড়া যিনি ব্যবস্থা করে দেবেন বলছেন, তিনি ত পুরোপুরি অচেনা নন, তারই দূর সম্পর্কের চাচা, পাড়াতো ভাই, ভাইয়ের বন্ধু- একেবারে অন্যায় কিছু ত আর করবেন না।
মহিলাদের মুখ থেকে খসে পড়া কথাগুলো নিয়ে টুকরো টুকরো যে তথ্য মেলে তাতে গোটা চিত্র এই-ই। ভেতরে কি যেন নড়ে গিয়েছিল আমার- কি অসহায় মানুষ! নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অনেকে সে পথে পা বাড়াতে পিছপা হয় না, লুকিয়ে লুকিয়ে পরিবার-পরিজন সকলকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় 'সন্ধ্যার ফ্লাইটে', ছোট ছোট ঘাটে নৌকা নিয়ে বসে থাকে দালালের দল। নৌকা পৌঁছে দেবে মাঝ সাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজে। সে জাহাজে লুকিয়ে আছে মৃত্যু, হয়ত। আর যদি সব ভাল থাকে তবে উঁচু বেতনের কাজ, স্বাধীনতা- দা গুড লাইফ! জীবন নিয়ে কি নির্বিকার নির্মম জুয়া খেলা!
সবাই জানে দালাল কারা। এমনকি সাবরাং এ দালাল পাড়া নামে এক আলাদা পট্টিই আছে। পুলিশ-বিডিআর রুটিন করে রেইড করে, দালালদের বাড়ি ঘর না, উপকূলের কিছু সন্দেহজনক জায়গা যেখানে মধ্যবর্তী সময়ে 'বস্তা' (পাচারকৃতদের স্থানীয়ভাবে এই নামে ডাকা হয়, আরো অনেক নাম আছে) জমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু কোনবারই কেউ ধরা পড়ে না।
বিকেল হয়ে আসছে প্রায়, কিছু খাওয়া হয়নি। শেষ ইন্টারভিউ এর জন্য নতুন একটা বাড়িতে ঢুকলাম। কয়েকজন মহিলা জড়ো করে আলোচনা শুরু করেছি কেবল। হঠাত জানা গেল আমরা এসেছি শুনে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এক মহিলা ছুটে এসেছেন বাড়িতে। তিনি ভেবেছেন তার পাচার হওয়া ছেলের কোন সন্ধান নিয়ে এসেছি আমরা। যখন শুনলেন আমরা নেহাতই এঞ্জিওকর্মী, চোখ দিয়ে টসটসে জল গড়িয়ে পড়ল। ছেলে হারিয়েছেন দু' বছর হল, পুলিশের কাছে বার-বার ধর্না দিয়েও কিছু হয়নি। মায়ের চোখের জলও আর ফুরায় না, আত্মীয় প্রতিবেশীরা মহিলার শোকের বিবরণ দেন মলিন মুখে। তার দরকার ছিল না, যতক্ষণ ছিলাম তার রোদনে কোন যতি পড়েনি। এক মাকে হতাশ করে আমি নিজেও কিছু বিব্রত, এরই মধ্যে আরেক মহিলা এগিয়ে আসেন তার ছেলেটিকে নিয়ে। ছেলেটি দু' বছর হল হাটতে পারে না, আমি এর কোন সমাধান দিতে পারি কি। তাকেও হতাশ করে জানাতে হল আমি স্বাস্থ্যকর্মী নই। আমার কাজ গবেষণার, তার ছেলের রোগের ওষুধ আমার জানা নেই। প্রশ্ন এল- এই গবেষণা করে কি হবে? সমাজের রোগমুক্তি ঘটবে, মানুষের সমস্যাগুলো সমাধানের নতুন পথ বেরোবে...
এই কাজটা আমার প্রথম গবেষণার চাকরি ছিল। সদ্য পাশ করা গ্র্যাজুয়েট, প্রথম মাঠপর্যায়ে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান ফলাবো (ফলিত নৃবিজ্ঞানী বলে কথা!), এর আনন্দই ছিল আলাদা। কাজটি শেষ করার প্রায় ১০ মাস হয়ে গেছে। গতকালের পত্রিকায় এসেছে থাইল্যান্ডে পাচারকৃতদের গণকবর উদ্ধারের খবর, সাথে ছবি। মাটি খুঁড়ে বের করা সারিবদ্ধ কফিন। পরিবার মুক্তিপণ মেটাতে পারেনি, নির্যাতনে অনাহারে মারা গেছে পাঁচশো মানুষ।
আমার কেবল ঘুরেফিরে গ্রামের সেই ঘুপচি ঘরে গাদাগাদি করে বসে থাকা উতসুক মুখগুলো মনে পড়ে। ওই পাঁচশো মৃতের মধ্যে তাদের স্বজনও কি নেই। কেন যেন মনে হয় আছে। কেউ ভাই-স্বামী-সন্তানহারা হয়ে অঝোরে অশ্রু বিলাচ্ছে। আর ভাবছে, সবই 'নিয়তি'।
রাজা যায় রাজা আসে, কিছুই বদলায় না। এঞ্জিও যায়, এঞ্জিও আসে; পালটায় না কিছুই।
------------
ফারাবী
৫।৫।২০১৫
মন্তব্য
সচলে নিবন্ধন করে ফেলুন, নিয়মিত লিখুন।
ভাইয়া, এই নিয়মিত হওয়াটাই হয়ে ওঠে না আসলে। আমি সচলে আসি, লেখাও পড়ি, অনেক সময় অজ্ঞাত যান্ত্রিক গোলযোগে মন্তব্যটাও করতে পারি না।
মূলত সিনেমা নিয়ে লিখি, তবে সচলে দেয়া হয়নি সেগুলো। যাই হোক, চেষ্টা করব লিখতে। নারী সপ্তাহের জন্য একটা লেখা দেবার ইচ্ছে আছে।
-------
ফারাবী
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যগুলো নিয়ে কোথাও লিখেছিলেন?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমি মাঠকর্মী হিসেবে ছিলাম প্রজেক্টটায়। না, প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে কোথাও লিখিনি আগে।
ভাল বিষয় তুলে এনেছেন।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ। ওই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে না পারার অক্ষমতা থেকেও স্বান্তনামূলক এই লেখা। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তারা জেনে-শুনেই, নিজেদের প্রবোধ দিয়ে মৃত্যুর হাতে নিজেদের তুলে দিচ্ছে।
সাহসী লেখা, ভাল লেখা।
পাতাল সুড়ঙ্গের অলি-গলি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে এনেছেন আপনি! দামী কাজ, কলজের জোর লাগে।
তথ্যগুলো কোথাও প্রকাশিত হয়েছিল?
পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ। কাজটা একটু ঝুঁকিপূর্ণই ছিল বটে। প্রশ্নগুলো অনেক কায়দা করে করতে হয়েছে। বিডিয়ারের কাছ থেকে বেশিরভাগ সময়ই সহায়তা পাইনি, পর্যাপ্ত তথ্যও মেলেনি তাই। আর দালালদের ত এপ্রোচই করা যায়নি, বেশিরভাগ অতীব ধুরন্ধর কিংবা ধরা-ছোয়ার বাইরে। এ তাদের কাছে নিছক ব্যবসা, তাদের কাছ থেকে যা তথ্য পাওয়া যেত তা দিয়ে বড়জোর হয়ত পুলিশের সাহায্য হয় গবেষণার না। তবে যা বুঝেছি, সব জেনে-শুনেও সবাই চুপচাপ। এদেশের আর সবকিছুর মতই।
তথ্যগুলো আমি প্রকাশ করিনি আগে কোথাও। রিপোর্ট লিখে জমা দিয়েছিলাম। যাদের প্রজেক্ট তারা হয়ত সেগুলো নিয়ে কিছু প্রকাশ করতে পারে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই মানব পাচার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও সেসব কি কাজে আদৌ লাগছে, সেটাই প্রশ্ন।
আপনার কাছে ভালো কিছু লেখা আশা করছি। নিবন্ধন করে ফেলুন। নিয়মিত লেখা চাই।
প্রেরণার জন্য অনেক ধন্যবাদ। নিবন্ধন করে খুব লাভ হয় না, নিয়মিত হতে পারি না যে। তবু, চেষ্টা করব
হাত খুলে লিখতে থাক। সচলে নিয়মিত লেখা দে এখন থেকে। ফিল্ম নিয়ে লেখ, সমাজ নিয়ে লেখ, আশপাশটা নিয়ে লেখ। তোর অনুবাদেরও ঝোঁক আছে, সেটাও করতে পারিস নিয়মিত বিরতিতে
ডাকঘর | ছবিঘর
চেষ্টা করব ভাইয়া। তুমি বলেছিলে বলে এখানে এটা দেয়া, নইলে এটাও ফেবু নোটেই রয়ে যেত।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
আপনার হাতে বিস্তারিত তথ্য থাকুক আর না থাকুক, আপনার যা যা মনে আছে সেগুলো লিখে ফেলুন। এই ব্যাপারটা নিয়ে সরকারের (আজতক সব সরকার) উদাসীনতা আমাদেরকে ক্ষুদ্ধ-হতাশ করে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সরকার ত আরো কত বিষয়েই উদাসীন। অনেকগুলো ইন্টারেস্টিং (পড়ুন বীভৎস) কেসস্টাডি পেয়েছিলাম। সেগুলো নিয়ে লিখব সময় পেলে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
এই লেখগুলো জরুরী।
নৃবিজ্ঞানের অন্যান্য অভিজ্ঞতা নিয়েও লিখুন।
নারী সপ্তাহের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ইচ্ছে আছে লেখার। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
নতুন মন্তব্য করুন