আসেন ভাই, ভুলে যাই...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২২/০৫/২০১৫ - ৬:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা ভুলে যাই। কারণ লজ্জার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চে’, ভুলে যাওয়া অনেক সহজ। তাই আমরা প্রতিদিন আড্ডা দেই- রাজনীতি,ধর্ম আর ক্লাব ফুটবল নিয়ে ঝগড়া করি; মিথলজির মত চিত্তাকর্ষক বিষয়ের সাথে পার্থিব পলিটিক্স আর জাতিগত ইতিহাসের মত জটিল বিষয় মিলিয়ে অব্যার্থ ভাবে প্রমাণ করি আমরা এক এক জন জ্ঞানের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন। তক্কে তক্কে অপেক্ষা করে বসে থাকি- কোন ব্লগার মরলেই, কোন নারীর উপর অন্যায় হলেই আমরা ফেসবুকে আর ব্লগে দেশপ্রেমের বন্যা বাইয়ে দিই- সে বন্যা বিটিভির উন্নয়নের জোয়ার কেও ভাসিয়ে নিয়া যায়; কথায় আচরণে আমরা এক একজন নীতি আর দর্শনের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে উঠি। তারপর কি হয়? তারপর ফেসবুক-ব্লগ বন্ধ করে আমরা অন্যকিছু করি। ইন্টারনেটে হিজাব পরা ইরানী/ইরাকি মেয়েটার পর্ণ সাইট খুঁজে বের করি, ঘন্টার পর ঘণ্টা এনিমে আর সিরিজ দেখে কাটাই, মুভির একটর থেকে ডিরেক্টর থেকে প্রোডিউসর পর্যন্ত নাম মুখস্ত করে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করি, টিউশনি করাতে যাই সুন্দরী কম বয়স্ক কোন মেয়েকে বেছে, বোকাসোকা একটা মেয়ের সাথে প্রেম করে তাকে ক্যাম্পাসে ঝোপের আড়ালে ডাক দেই, সামান্য টাকা পয়সা আর তার চেয়েও সামান্য একটু সাহস থাকলে কমদামী কোন হোটেলের লুকানো ক্যামেরার বন্ধ ঘরে। কিন্তু সবচে’ বড় কথা আমরা ভুলে যাই।

কারণ নতুন খবরটা সবসময়ই পুরনো খবরের চে’ অনেক বেশী আকর্ষনীয়; তাই ২০১৫’র ১৪ই এপ্রিলের কথা বেমালুম ভুলে যেয়ে আমরা মোহাম্মদপু্র প্রিপারেটরি স্কুলের শিশু ধর্ষক গোপাল কে নিয়ে মেতে উঠি... তার পর গোপালের কথাও ভুলে যাই, আমরা অভিভাবক হয়ে বিক্ষোভ করি, আবার শিক্ষক হয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল কে বরখাস্ত করার জন্য অভিভাবকদের উপর চড়াও হই। তারপর অভিভাবক আর শিক্ষকদের মারামারি তে ক্লান্ত হয়ে যাই, শিক্ষার্থী হয়ে খবরের কাগজের লোকেদের বলি সব মিথ্যা কথা, বানোয়াট, গাঁজাখুরি গালগল্প; ছাত্রী হয়রানী তে কেউ মরেনি, কারও বাবা মা সন্তান হারায়নি, ক্লাস ফাইভে পড়া একটা বাচ্চা মেয়ে ধর্ষিত হয়ে ICU তে মানসিক যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে মারা যায়নি- সব ভুয়া কথা, স্কুলের বদনাম করার জন্য কিছু ফাজিল মানুষের অতি কল্পনা। তারপর আবার অভিভাবক হয়ে এই ছেলে মেয়েদের এমন কথা সহ্য করতে না পেরে যখন সব কটার গালে চড় দিই, তখন ছাত্রছাত্রী হয়ে তাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে স্কুল বিল্ডিং এর দোতলায় উঠে নাচন কুঁদন করি। সবশেষে “কর্তব্যে অবহেলার জন্য” গোপালকে যে সাময়িক ছুটি দেয়া হয়েছে- যৌনাঙ্গে তেল দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে সেই ছুটি উপভোগ করছে সে; সারা রাস্তার সমস্ত শিশু কেও যদি সে ধর্ষন করে তাতেও আমাদের কারও বাবার ক্ষমতা নাই তার নাভির নিচের একটা চুলও বাঁকা করতে পারে। যতক্ষণ না সে কোন ক্ষমতাবান নেতা (এই মুহূর্তে অবশ্যই শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের); কিংবা পুলিশ-বিজিবি-র্যা ব-আর্মির অনেক বড় কোন হর্তা-কর্তা; কিংবা অনেক টাকা ওয়ালা প্রভাবশালী ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, দুতিনটা BMW, মার্সিডিজ ওয়ালা কোন লোকের বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে বাজারের সমস্ত সরিষার তেল তার সারা অঙ্গে ডলে শেষ করে ফেললেও, যৌনাঙ্গ নাচিয়ে উত্তর আর দক্ষিণ ঢাকার এই বিশাল দ্বৈত শহরের রাস্তায় রাস্তায়, প্রান্তরে প্রান্তরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ালেও তার কিছুই হবেনা। কারণ আমরা গোপালকেও ভুলে যাব। কারণ ভুলে না গেলে মারা যাব যে, নিজেকে ঘৃণা করতে করতে; আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে থু থু ফেলতে ফেলতে পানিশূণ্যতায় মারা যাব, লজ্জা-রাগ-ক্ষোভ গিলে হজম করতে করতে বদহজমে মারা যাব।

আমরা এর আগে ১৪ই এপ্রিল ভুলে গেছি, তার আগে একুশে বইমেলা ভুলে গেছি, ভুলে গেছি শহীদুল- ইস্লামিক স্টাডিজ বর্ষ ৩, আরিফ IR বর্ষ৩, বেনজীর পলিটিকাল বর্ষ৩, আর লতিফ রনির মতো জানোয়ারের কথা, ভুলে গেছি থারটি ফার্স্ট নাইট, ভুলে গেছি ভিকারুন্নেসায় ধর্ষক পরিমলের কথা, ভুলে গেছি কুষ্টিয়ার পান্না মাষ্টারের কথা, ভুলে গেছি পথশিশুদের নিয়ে পর্ণোগ্রাফির ব্যাবসা করা লেখক(!) টিপু কিবরিয়ার কথা, ভুলে গেছি জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসীমুদ্দিন সেঞ্চুরিয়ান মানিকের কথাও... এত কথা ক্যামনে মনে রাখি? গোলাম আযম, নিজামি- এদের কথাই ভুলে ছিলাম চল্লিশ বছর, আর এসব তো চুনোপুঁটি। আরও চল্লিশ বছর কাটুক তারপর নাহয় দেখা যাবে। আরেকটা জাগরণ মঞ্চ করব, সেখানে লাকি না থাকলে রাখি থাকবে, রাখি না থাকলে পাখি থাকবে; তাঁকে ধর্ষণ করে আবার নাহয় ভুলে যাব। তারপর দেখা হবে আরও চল্লিশ বছর পর। ততদিন বাঙালী ভাল থেকো, মনের সাধ মিটিয়ে ধর্ষণ করো।

নিশাচর জীব।


মন্তব্য

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মার্চ এসে ফেব্রুয়ারীকে ভুলিয়ে দেয়, এপ্রিল এসে মার্চ ভুলে যাই। আমাদের চারপাশে এত বেশী ইস্যু তৈরী হচ্ছে যে পুরোনো ইস্যুগুলো খুব তাড়াতাড়িই সমাধিস্থ হয়ে যায়। নতুন হুজুগে বাঙালী চিরকালই ভেসে বেড়িয়েছে। ভুলতেই পারে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু যাদের কাজ করার কথা, ওই ইস্যুগুলো সমাধান করার কথা, তারা ভুলে গেলেই বিপদ। দুঃখজনকভাবে আমরা সেই রকমের বিপদগুলো ঘাড়ে নিয়েই আছি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা ভুলে যাই--------আমরা মৌসুমী বাঙ্গালী তাই। নিজেও আছি ভুলের যাওয়ার দলে
এ্যানি মাসুদ

রানা মেহের এর ছবি

আপনার ক্ষোভ বুঝতে পারছি, কিন্তু ক্ষোভের অডিয়েন্স বুঝতে পারছিনা।
আমরা কিন্তু কেউ আলাদা নই।
এভাবে ক্ষোভ না ঝেড়ে আমাদের উচিত লেখালেখি জারি রাখা।
লেখা খুব শক্ত একটা প্রতিবাদ।

তাই লিখুন। প্রতিবাদের জারি রাখুন।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

ক্ষোভের অডিয়েন্স আসলে আমি নিজেই, অথবা আপনি, অথবা আপনার পাশের জন। মূলত ছা-পোষা সে মানুষ গুলা, যাদের কোন কিছুতেই কোন ভূমিকা নেই, আবার আপাত ভাবে সব কিছুতেই আছে; কোন কিছুতেই যাদের কিছু যায় আসেনা, আবার সব কিছুতেই আসে। প্রত্যেকটা ঘটনা নিয়ে আমাদের কিছু না কিছু বলার থাকে, লেখার থাকে- কিন্তু করার থাকেনা কিছুই। নতুন প্রত্যেকটা ঘটনা ঘটে আর একে একে পুরনো ভুলে যাওয়া স্মৃতি গুলো ফেরত আসে। আমি শুধু চেয়েছি মানুষ যেন ভুলে না যায়, অপরাধের শাস্তি হোক না হোক- কোন মূল্যেই যেন ভুলে না যায়। যাতে আজ না হলেও একদিন, তা সে চল্লিশ বছর পরেই হোক না কেন, শাস্তি যেন হয়। হয়তো। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যো যদি আমরা ভুলে যাই, এসব কিছুকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিই; for granted একটা ঘটনা হিসেবে মেনে নেই- সেই মুহূর্ত থেকে জানোয়ার গুলো মাফ পেয়ে যায়, তাদের শাস্তি নিরর্থক হতে শুরু করে। এটা প্রতিদিনের হাজারো কাজের মধ্যে শুধু একটা রিমাইন্ডার, নিজের স্বত্তা হারিয়ে যেন না ফেলি।
নিশাচর জীব।

রানা মেহের এর ছবি

নিশাচর জীব, আপনার চাওয়া অতি যৌক্তিক। এইজন্যই লেখালেখি জারি রাখুন।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।