সেই সকালটাও আর দশটা সকালের মতোই সুন্দর নির্মল ছিল, পড়তে বসতে না চাওয়া পিচ্চি আমিটা সাত সকালেই গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা জবা দু’টো গুঁজে রাখছিলাম বেড়ার ফাঁকে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদ পড়লে জবার কুঁড়ি নিজে নিজে ফুল হয়ে ফোটে-এটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম মাত্র কিছুদিন আগে । মা চা বানাতে আর বাবা আগের দিনের বাসি খবরের কাগজটা পড়তে ব্যস্ত, ছোটটা ওঠেনি ঘুম থেকে-সব মিলিয়ে সেই সকালটা আর দশটা সকালের চেয়ে খুব আলাদা কিছু ছিল না। এমন বৈচিত্র্যহীন সাদামাটা সকালটাই হঠাৎ করে বদলে গিয়েছিল একটা খবরে, একেবারে আচমকা যখন পাড়াতো বৌদি আমাদের ঘরদোর মুছতে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে খবর দিল-“মেনানগরোত কী হইছে মা জানেন!”
মাইলদুয়েক দূরের মেনানগরে কী ঘটেছে-মা যে জানে না, সেই বৌদি তা ভালোভাবেই জানতো কিন্তু এমন উত্তেজনাকর খবর না দিয়ে কী করে পারা যায়, তাই এইটুকু ভণিতা। হাইস্কুলে পড়ুয়া আমি তখন একটা কৌতুহলের বাক্স রীতিমতো। জবার কুঁড়ি গুঁজে দিয়ে রীতিমতো সেই বৌদির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মা চায়ের কাপটা হাতে করে এসে দাঁড়ালো-দু’জনের কথা থেকে আমি তারপর সারমর্ম পেয়ে গেছি। মেনানগর গ্রামের এক নারী রাতে একা শুয়েছিলো, রোজকার মতোই, তার বর বোধকরি রাতে করে শহরে রিকশা চালাতে যেত। বেড়ার ঘরের দরজা কীভাবে যেন খুলে ঘরে এক লম্পট ঢুকেছিল, তারপর বিছানার কাছে যেতেই সেই নারী বালিশের নিচে রাখা দা দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে জায়গামতন এক কোপ! তারপর?
তারপরের কাহিনীর জন্য আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। ব্যাটা তুই মরলে মর! আমি কেবল মেনানগর গ্রামের ঐ অদেখা বৌটার কথাই ভাবছিলাম। কী অদ্ভুত! কী সাহস! গ্রামের এক গরিব বৌ, হয়ত লেখাপড়াই করেনি কোনোদিন, বর বাড়িতে নেই কিন্তু কী অপরিসীম সাহস! সেই ছোট্টবেলায় এই ঘটনা এতটাই ছাপ ফেলেছিল আমার মনে, মাঝেমাঝেই আমিও শিথানে দা রেখে ঘুমাতাম।
গ্রামের অন্য সব ঘটনার মতোই এই ঘটনা সর্ম্পকেও ভাষ্য বদলে গিয়েছিল কিছু পরেই। পরে শোনা গিয়েছিল দা নয়, ভদ্রমহিলার মাথার নিচে ছিল কাস্তে আর কোপ খেয়ে সেই হারামির বাচ্চা আহতও হয়েছিল বটে, হাসপাতালে নিতে হয়েছে তাকে, বাড়ি পাড়াতেই, পরিবারের মানুষই হাসপাতালে নিয়েছিল। সে যাক, কেন সে রাতের অস্ত্রটি কাস্তে না হয়ে দা হলো না কিংবা সেই লম্পট মরে না গিয়ে কেন শুধু আহত হয়েছিল-এইসব ব্যাপারের চাইতে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাকে কোপাতে পারার সাহস। আর কেবল আমার কাছেই বা কেন-আমাদের পাড়ায় এই ঘটনা প্রধান আলোচ্য ছিল পরপর কয়েকদিন ধরে, কারও কাছে কখনও শুনিনি ভদ্রমহিলা কাজটা ‘খুব খারাপ’ করেছে বা সেই অপরাধী নিছক একটু ‘দুষ্টুমি’ করেছে। পাড়ার নারী-পুরুষ কেউই একটাও প্রশ্ন তোলেনি তার পোশাক বা চরিত্র সম্পর্কে। অন্য কত ঘটনায় মেয়েদেরকে দায়ী করেছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই কিন্তু এই একটি ঘটনায় সবাই ছিল এক কাতারে।
তারপর একসময় আলোচনা ঝিমিয়ে পড়েছিল। এমনকী হাসপাতাল থেকে ফেরার পর সেই ধর্ষকামী লোকটার কোনো বিচার হয়েছিল কি না কিংবা সেই সাহসী মানুষটারই বা কী অবস্থা হয়েছিল পরিবারে, সবাই তাকে বাহবা না ধিক্কার দিয়েছিল, জানা যায়নি কিছুই ঠিকমতো। আমি নিশ্চিত সেই ঘটনা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য আর পাওয়া যাবে না এখন। তবুও এতদিন পরেও সেই ঘটনা এবং তারপর সবার প্রতিক্রিয়া আমার স্পষ্ট মনে আছে। মনে আছে পরের কিছুদিন আমার মাথার নিচে দা রেখে ঘুমাতে যাওয়ার কথা।
জানি, অস্ত্র কোনো সমাধান নয় বা অস্ত্র সাথে থাকলেই যে সবসময় তা ব্যবহার করা যাবে-এমনটাও নয়। মেয়েদের প্রতি যৌন হয়রানি আর ধর্ষনগুলো এমনভাবে করা হয় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাথে থাকা কোনোকিছু ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায় না। তারপরও নিরাপত্তার আশঙ্কায় থাকতে থাকতে মনে হয় সবসময় সাথে একটা কিছু থাকলে হয়ত পথেঘাটে সাহস পাওয়া যেত আর কিছুটা। আর একটা জিনিসের খুব অভাব বোধ করি-ঘটনার শিকার মেয়েগুলোর প্রতি সব দর্শন আর মতামত নির্বিশেষে সহমর্মিতা আর সহযোগিতার হাত। অপরাধী আমার দলের, এলাকার বা আত্মীয়, তাকে রক্ষা করার সুমহান দায়িত্ব আমার-এমন মনে করবার মতো মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে কিংবা ভাগ্যিস, আমার নিজের পরিবারের কারও সাথে এমনটা ঘটেনি, যার ব্যাপার, সে বুঝুক গে’-বলবার মতো শান্তিপ্রিয় মানুষও আছেন নেহাত কম না। সেই সাথে মেয়েটার নিশ্চয়ই এই দোষ, সেই দোষ, ছাই দোষ কিছু তো ছিলই ছিল টাইপের মানুষও অনেক আশেপাশে। হলিক্রসের মতন স্কুলের ধর্ম পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রীতিমতো ইচ্ছে করেই পোশাক আর চলাফেরা নিয়ে শালীনতা বিষয়ক সৃজনশীল প্রশ্ন করা হয়!
দেখেশুনে খুব খারাপ লাগে, মন খারাপ হয়, রাগ হয় কখনও কখনও, কখনও কান্না পায়। আর তখন আরও বেশি করে সেই অচেনা সাহসী মানুষটার কথা মনে পড়ে আর মনে হয় আমার গ্রামের অল্প পড়ালেখা জানা কিংবা একেবারে না জানা মানুষগুলোর একজনও সেদিন তার দোষ দেয়ার চেষ্টা করেনি বা অপরাধীর অপরাধ কমানোর মতো বুদ্ধিবৃত্তিক অপরাধের চেষ্টাও করেনি। চেষ্টা করেনি ঘটনার শিকার হতে যাওয়া যে মানুষটা নিজের বুদ্ধি আর সাহসের জোরে বেঁচে গেল, তাকে কোনোভাবে কোণঠাসা করে ফেলতে। আজ তবে মানুষের চরিত্র এত পাল্টে গেল কেন? অথবা মানুষের চরিত্র বরাবর এমনই ছিল কেবল আমার গ্রামটার চাষাভুষো মানুষগুলো সেই সময়ে আদতে মানুষ ছিল না!
দেবদ্যুতি
মন্তব্য
আপনার গ্রামের সেই মানুষদের সাথে আজকের শহুরে কুযুক্তিশীল মানুষের পার্থক্যটা যুগের নয়, স্থানের নয়, পাত্রের নয়। পার্থক্যটা নষ্ট হয়ে যাওয়া মগজের!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সে কথাটাই আমারও মনে হয় বটে আর ভাবি মানুষের মগজ নষ্ট হয়ে গেলে সে নিজে তা বুঝতে পারে না কেন?
দেবদ্যুতি
কিছু বলার নেই ...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কেন, সত্য'দা?
দেবদ্যুতি
আমার অবস্হাও সত্যনন্দের মত
প্রিয় আয়নামতি, তোমার অবস্থা অমন হলে হবে? সত্য'দার অবস্থাটাই বুঝতে পারছি না, আবার তুমিও?
দেবদ্যুতি
সিরিকাস পুস্টে সিরিকাস থাকাই উত্তম! কিন্তুক সত্যনন্দ কিডা?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মানুষের চরিত্র এতো পাল্টে গেল কেন?
খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমরা কি শিখছি?
সাদা কালোর ফারাক ও যেন করতে পারিনা।
সেই অদেখা নারীকে সালাম।
জোছনা
দেবদ্যুতি
চলমান অবস্থা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়- মানুষ একটা উপমা শুধু। আদতে এমন কিছু নাই।
স্বয়ম
দেবদ্যুতি
নতুন মন্তব্য করুন