১)
গুলশানের আবাসিক এলাকার ভেতরে শিমুলের অফিস। অফিসে যাওয়ার জন্য বনানীতে নেমে সে রিকশায় উঠে। মিনিট পনেরো পর রিকশা থামে একটা গলির মোড়ে। এখান থেকে অফিসের দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিট। এই রাস্তাটুকুও রিকশায় করে পাড়ি দেওয়া যায়। কিন্তু শিমুল এখানে নেমে হাঁটা শুরু করে। এতে টাকাও বাঁচে, ব্যায়ামও হয়। তবে এগুলো আসল কারণ নয়। সবচেয়ে বড় কারণ হল, এই গলি থেকে অফিস পর্যন্ত রাস্তাটুকু শিমুলের ভীষণ প্রিয়। ওর ধারণা, এই গলিতে যত ধরণের দেশী বিদেশী ফুল গাছ আছে, তত ধরণের ফুল গাছ ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনেও পাওয়া যাবে না।
শুধু রঙ বেরঙের ফুলই নয়, বিভিন্ন ঋতুতে রাস্তায় পড়ে থাকে কামরাঙা, জামের মতো ফল। দেখলে এত কুড়াতে ইচ্ছা করে! কিন্তু বড়োলোকগুলোর বোধহয় সুপার মার্কেট থেকে কেনা ফল ছাড়া পোষায় না! তাই ওগুলো কেউ কুড়ায় না; একসময় রাস্তায়ই পচে যায়। অনেকবার কুড়াতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নিয়েছে শিমুল। কী এক সংকোচ যেন জড়িয়ে ধরে বারবার। মনে হয়, কেউ যদি দেখে ফেলে, তাহলে কী ভাববে? কী ভাববে যদি দেখে, কর্পোরেট আউটফিটের এক যুবক মাটি থেকে ফল কুড়িয়ে প্যান্টে মুছে টপ করে খেয়ে ফেলছে? ভাবতে ভাবতে শিমুলের আর ছোটবেলার মত ফল কুড়ানো হয় না। কিন্তু একদিন ঘটে গেলো অস্বস্তিকর এক ঘটনা।
সেদিন পায়ের কাছে টসটসে জাম পড়ে থাকতে দেখে শিমুল নিজেকে সামলাতে পারলো না। সকালে যে সময় সে গলির ভিতর দিয়ে হাঁটে, সে সময় ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙ্গে না। তাই বারান্দা বা রাস্তায় কেউ থাকে না। এখনকার দারোয়ানেরাও বড়লোকি চালের। আগে দেখা যেত ওরা গেটের বাইরে বসে পাহারা দেয়। ইদানীং সিস্টেম উল্টে গেছে। এখন গেটের ভেতরে দারোয়ানদের বসার জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ থাকে। অনেক সময় গেটের সাথেই ছোট একটা ঘর বানিয়ে দেওয়া হয় কাঁচের জানালাসহ। সেখানে গিয়ে বলতে হয়, ‘অমুকের সাথে দেখা করতে এসেছি। অনুগ্রহ করে ভেতরে ঢুকতে দিতে আজ্ঞা হয়।’ এরপর দারোয়ান ইন্টারকমে ফ্ল্যাটের মালিককে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়, তারপর ঢুকতে দেয়।
ঐদিন সকালেও জামগাছের আশেপাশের রাস্তায় কেউ ছিল না। গাছের আশেপাশের কোনো ফ্ল্যাটের বারান্দায়ও কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে পরিবেশ আরও থমথমে করে দিয়েছে। এখন সুখী মানুষেরা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, আর শিমুলের মতো কামলারা মাসের শেষে বেতন নিশ্চিত করতে আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে ছুটছে। কী এক আইরনি! বেতনের টাকা দিয়ে আরাম করার জন্যেই নাকি আরাম বাদ দিয়ে এই ছুটে চলা।
ভাবতে ভাবতে রাগে দুঃখে জগৎকে একটা গালি দিয়ে শিমুল উপুড় হল জাম কুড়াতে। পাঁচ ছয়টা কুড়িয়ে নিয়ে যখন সোজা হল, তখন ওর চেহারায় ইচ্ছা পূরণের সন্তুষ্টি। আবারও আশেপাশে চোরা চাহনি দিয়ে দেখে নিলো, কেউ দেখেছে কিনা। নাহ। কিন্তু... ও কী? রাস্তার যে পাশে জামগাছ, তার ঠিক উল্টো দিকের দালানের তিন তলায় একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে ঠিক শিমুলেরই দিকে। অ্যাঁ! এটা কী হল? কোনো পুরুষ দেখতে পেলেও কথা ছিল। কিন্তু এই অবস্থায় একটা মেয়ের কাছে ধরা?
শিমুল বোকা বোকা একটা হাসি দিলো। কিন্তু বোঝা গেল না, মেয়েটা সেটা দেখল কিনা। মুখের ভাব ওর একটুও বদলালো না। শিমুলের কয়েক মুহূর্ত লাগলো পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে। নাহ, জামগুলো সে ফেলবে না। যেহেতু মেয়েটা দেখেই ফেলেছে, তাই আর বাড়তি লজ্জার কিছু নেই। তাই জামগুলো টিস্যুতে মুড়ে পকেটে নিয়েই শিমুল রওনা হল অফিসের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর ফিরে তাকাল জানালার দিকে। মেয়েটা জামগাছের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে এখনো। কে জানে কয়টা জাম ধরেছে, সেটা গুনছে কিনা।
২)
পরের দিন সকালে আর ঐ গলি দিয়ে অফিসে গেলো না শিমুল। আবার যদি ও মেয়েটার চোখে পড়ে যায় আর মেয়েটা ওকে দেখে হাসাহাসি করে, শিমুলের লজ্জার শেষ থাকবে না। কিন্তু অফিস শেষে সন্ধ্যার দিকে ঐ গলি দিয়েই হাঁটা শুরু করলো ও। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটা এখনো জানালার পাশে বসে আছে কিনা। অন্ধকারে মেয়েটা শিমুলকে দেখবে না, কিন্তু শিমুল ঠিকই দেখবে ওকে।
হ্যাঁ, মেয়েটা আগের জায়গাতেই বসে আছে। কানে একটা হেডফোন লাগানো। চোখ বন্ধ করে শুনছে। শিমুল জামগাছের নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটার ঘর অন্ধকার। গতকালও অন্ধকারই ছিল। এটা কি মেয়েটার বেডরুম? শিমুল ভাবতে লাগলো, মেয়েটা কী শুনতে পারে। হিন্দি গজল? নাকি ইংরেজি র্যাপ? নাকি আধুনিক বাংলা গান? নাকি এসবের কিছুই না, বরং মেয়েটা আইইএলটিএস-এর লিসেনিং প্র্যাকটিস করছে? হাহাহা! নিজের রসিকতায় নিজেই মজা পেলো ও। হঠাৎ খেয়াল করলো মেয়েটা চোখ খুলেছে। তাকিয়ে আছে গলির মোড়ের দিকে। শিমুল ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলো সেদিকে। ভাবতেই ভালো লাগছে যে, মেয়েটা একটু পর শিমুলের পিঠ দেখতে পাবে। তারপর দেখবে শিমুলের লম্বা চওড়া দেহটা মিলিয়ে যাচ্ছে গলির অন্ধকারে। একটু হলেও মেয়েটার মনে দোলা দিতে পারবে ও। চকিতের জন্যে হলেও মেয়েটা চিন্তা করবে, কে যায়?
৩)
শিমুলের নেশা ধরে গেল। গত একমাস ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ও মেয়েটার বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। যদিও জানে এই ঘুরঘুট্টি আঁধারে জামগাছের ভূতটাকে মেয়েটা দেখবে না, তবুও এটা একটা খেলা। শিমুল দেখতে চাচ্ছে, কবে মেয়েটা ওকে খেয়াল করে! কিন্তু প্রতিদিন তো আর শিমুলের অফিস ছুটির সময় মেয়েটা জানালার ধারে বসে না। যেমন গত সপ্তাহে মাত্র একদিন দেখা গেছে ওকে। তার আগের এক সপ্তাহে একবারও না। তবে এই সপ্তাহে টানা তিনবার মেয়েটাকে দেখেছে শিমুল। আজ নিয়ে চারবার।
‘এই যে স্যার, এখানে কী করতেছেন?’
দারোয়ানের ডাকে জানালা থেকে চোখ সরাল শিমুল। সামলে নিয়ে বলল, ‘এই তো চাচা, জাম দেখছিলাম। কত জাম ধরেছে, দেখেছেন?’
দারোয়ান সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এত রাতে জাম ক্যামনে দেখতেছেন স্যার? সকালে আইসেন।’
শিমুল অপ্রস্তুত হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
এক মাসে এই প্রথম দারোয়ানকে দালানের বাইরে দেখল শিমুল। ব্যাটা বের হওয়ার আর সময় পেল না।
তবে দারোয়ানও কম চালাক নয়। শিমুলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকাল তিন তলায়। তখনই বুঝল, শিমুল কোন জাম দেখছে। গাছের নাকি ফ্ল্যাটের।
‘লাভ নাই স্যার। আফাটা আন্ধা।’ গলা খাঁকড়িয়ে বলল সে।
শিমুল বুঝল না। ‘কী বললেন?’
‘আফনের জাম। চোখে দেখে না। আফনে যতই খাড়ায়া থাকেন, সে আফনেরে দেখবে না।’
এত বড় ধাক্কা শিমুল আশা করে নি। হতচকিত হয়ে সে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। কতক্ষণ লেগেছে ঘোর কাটতে, জানে না। কিন্তু একসময় শুন্য মাথা নিয়েই হাঁটতে শুরু করলো।
৪)
এরপর থেকে শিমুল ওই গলিতে যাওয়া বন্ধ করে দিলো। মেয়েটির প্রতি ওর সমস্ত মোহ কেটে গিয়েছে। সেই সাথে নতুন লজ্জা হিসেবে যোগ হয়েছে দারোয়ানটা। সে যদি শিমুলকে দেখলে হাসাহাসি করে, শিমুলের লজ্জার অন্ত থাকবে না!
.
- নির্ঝর রুথ।
মন্তব্য
গল্প এগিয়েছে ঝরঝর করে। আর, শেষের অদৃশ্য থাপ্পড়টা - অসাধারণ! ৫ তারা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পাচ তারা!
ধন্যবাদ আপনাকে।
গল্প ভালো লাগলো, শেষটা চমকপ্রদ।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
ধন্যবাদ!
চ্যাপলিনের সেই অন্ধ ফুলওয়ালী মেয়েটার সিনেমার কথা মনে করিয়ে দিল গল্পটি। ভাল লিখেছেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সিনেমাটি দেখা হয় নি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
"সিটি লাইটস"
দেখা না থাকলে দেখে নিয়েন সময় করে। অসাধারণ সিনেমা।
আর হ্যাঁ, গল্প ভালো লেগেছে অনেক।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ঝরঝরে লেখা... লিখতে থাকুন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ দাদা!
লিখতে আছি। এখন পালা ছাপতে থাকার
শিমুলের ভিশন তো দেখি ২০/২০!
শিমুল ভাইকে দুইখান কথা মনে রাখতে হবে
১। মেয়েরাও মানুষ।
২। লজ্জা, ঘেন্না, ভয় তিন থাকতে নয়।
আপনার লেখার হাত বেশ ভালো। নিয়মিত বিরতিতে হাত পা খুলে লিখতে থাকুন।
ধন্যবাদ!
চেষ্টা করছি সব্যসাচী হতে। পারলে পরবর্তী পরীক্ষা হবে ঠ্যাং নিয়ে। তখন সত্যিই হাত পা খুলে...
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
আহা রে শিমুল! আন্ধা শুনেই জামটাম সব বাদ! দারুণ! শিমুলদের কাছ থেকে অন্য কিছু আশা করতে চেয়েছিলাম... লিখেছেন দারুণ, লিখতে থাকুন
দেবদ্যুতি
বাস্তবের শিমুলরা এমনই হয়। শারীরিক এবং মানসিকভাবে অক্ষমদের ভালোবাসতে পারাটা এতো সোজা নয়!
অবশ্য আমিও সফল একটা পরিণতি দিতে চেয়েছিলাম। পরে চিন্তা করলাম, বাস্তবতা নিয়েই লিখি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
এটাই বলতে চেয়েছিলাম।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ভাল লেগেছে...
ডাকঘর | ছবিঘর
অনেক ধন্যবাদ।
বেশ। লেখালেখি চলুক।
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
ধন্যবাদ।
বাহ্!! চমৎকার লাগলো। আমিও হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ফল কুরানোর দিনগুলো পিছু টানছিল।
জোছনা
অনেক ধন্যবাদ।
আমারও এমন হয় মাঝে মাঝে। হারিয়ে যাই ছোটবেলায়।
ভাল লাগলো। লেখা চলতে থাকুক।
ধন্যবাদ আপনাকে!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
বৃদ্ধাঙ্গুলির জন্য একটা, হাততালির জন্য আরেকটা ধন্যবাদ!
কর্পোরেট শিমুল তখ্নই ছোটবেলার মত সহজ হয়েছে ।যখ্ন জামের টস টসা রুপ দেখেছে ..…।সাথে সাথেই কুড়ানোর জড়্তা ভেঙ্গে দিয়েছে। পুরাই কর্পোরেট
এ্যানি মাসুদ
হা হা হা! পুরাই ধুয়ে দিয়েছেন।
সচলে আমার প্রধান আকর্ষণ গল্প। মোবাইল থেকে পড়েছিলাম আপনার গল্প, লগইন করিনি। ভাল লেগেছে। লিখুন আরো গল্প। ব্যস্ততাকে ফাঁকি দিয়ে ঠিক ঠিক পড়ে নিবো।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
এত সুন্দর অনুপ্রেরণায় আমি মুগ্ধ!
দারুন লেগেছে। মেদহীন গল্প।
অন্ধত্বটা অনুমান করা গেলেও, শিমুলের নতুন লজ্জার পাঞ্চটা ভালো লাগছে দারুন।
স্বয়ম
এই ব্লগে বেশ কিছু অসাধারণ লেখা আর লেখক আছেন। তাঁরা বাক্যের গাঁথুনিতে শব্দের প্রয়োগ অনন্যসাধারণ ভাবে করেন। আমি শুধু পাঠ করি। ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। আপনার লেখাটিও পড়ে ভালো লেগেছে। তবে আরও ভালো হতে পারতো।
একটি জায়গা উল্লেখ করি,
লাইন দুটিতে গাছের আশেপাশের শব্দগুচ্ছ একবার ব্যবহৃত হলে বোধকরি আরো ভালো লাগতো।
শেষকথায়, অনেক অনেক শুভকামনাসহ অপেক্ষায় থাকলাম।
গৌতম হালদার
নতুন মন্তব্য করুন