অতঃপর বোবা তরুদের দেশে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০২/০৬/২০১৫ - ৯:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঠের বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাস দেখলেই তার ইচ্ছে করে সেখানে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে। এভাবে আকাশ দেখতে দেখতেই তার ভেতর মানুষ হয়ে জন্ম নেবার আক্ষেপটা প্রকট হয়ে ওঠে। সে ভাবে এরকম দু’পেয়ে মানুষ হবার চেয়ে বরং সে যদি গাছের সবুজ কচি পাতা হয়ে বছরান্তে একবার জন্ম নিতো আবার ঝরে যেতো। এই বারবার জন্ম নেওয়া এবং ঝরে পড়ার নিষ্পাপ পৌনঃপুনিক প্রাকৃতিক ক্রীড়াচক্র অনাবিল প্রশান্তিতে বুক ভরে দেয়। এই জনাকীর্ণ রেসকোর্স ময়দানে রুপক ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগীতায় হোঁচট খাওয়া তারপর টালমাটাল হয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে আগাম দৌড়যুদ্ধের জন্য নিজেকে শানিয়ে নেবার অমানবিক খেলায় বাধ্যতামূলক নাম লেখানোর ভেতর কোনোরুপ নিষ্পাপ কারুকার্য নেই। তাইতো গাছে গাছে কচি সবুজ পাতা দেখলেই তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। এরুপ একনিষ্ঠ যোগাযোগ কিংবা আত্মার সংযোগে ভাষার প্রয়োজন একেবারেই নেই। এভাবেই একদিন কী এক বিচিত্র কারণে তার মনে হয় একমাত্র মৃত্যুই মধ্য দিয়েই প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া যায়। মানুষে মরে গেলে রক্ত মাংস পঁচে তা একসময় মাটি, হয় যা থেকে গাছ হয়। এমনও তো হতে পারে এইসব মৃত মানুষের আত্মার সমষ্টিই হয়তো গাছের শাখায়, পাতায়, ফুলে মিলেমিশে সৃষ্টি করে সীমাহীন বৈচিত্র। তার এখন প্রতিদিন একবার করে তার মরে যেতে সাধ হয়। কিন্তু এই প্রাকৃতিক নিয়মে মৃত্যুর সময়সীমা যেমন একেবারেই অনিশ্চিত তেমন ভয়াবহ রকমের পরাজয়মিশ্রিত। মানুষ বুড়ো হলে তাকে অপর মানুষের দয়া, করুণার উপর নির্ভরশীল হতে হয়। সূদীর্ঘ পথশ্রমে যা কিছু অর্জন তার হিসেব চুকে-বুকে যায় খুব অল্প সময়েই। শেষের পথটুকুর পুরোটা জুড়েই জুজুর মতো চেপে বসে থাকে ভয়, কৃত্রিম উদারতা, উপেক্ষা, পরাজয়। প্রাপ্য যে কয়েকফোটা চোখের জল তাও দৃষ্টি নিভে যাবার দরুন দেখবার জো থাকে না। এর চেয়ে গাছের পাতারা দেখো কেমন বীরদর্পে ডানপিটের মতো ক্রমশ বেড়ে ওঠে,পৃথিবীর এই মনোক্রমির রুপের উপর তারা এক ঝটকায় মেলে দেয় বাহারী রংয়ের প্রলেপ। আর সবুজ ঘাসের বুক আহা! সেও কী এক মহৎ আশ্রয়। সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে তার বুকের ভেতরের পাথরটা গলে তরল হয়ে যায়, মুখের ভাষাটাকে মনে হয় অপ্রোয়জনীয়। আকাশের দিকে বড় বড় চোখ মেলে সে বিড় বিড় করে বলে “আকাশ তুমিও তো পারো আমাকে টেনে নিতে,আমি না হয় তোমার রাত্রীকালীন নক্ষত্রবাগানের একটা নেহায়েত ফুল হয়ে ফুটে থাকতাম।" সুনির্দিষ্ট কোন একজন মানুষের আচমকা স্বভাবের বিচিত্রতা ও তা থেকে উৎসরিত সকল প্রকার নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক আচার আচরণের প্রভাব পড়ে তার চারপাশে বসবাসকারী বন্ধু-অবন্ধু, পরিবার-পরিজন, অথবা পরিচিতদের প্রতি। একারণেই কারো স্বভাবে সহসা বিচিত্রতা দেখা দেয়া মানেই আজ কিংবা কাল তার সুনিশ্চিত সন্ন্যাসবৃত্তির সূত্রপাত। তখন এদিক-ওদিক বিভিন্ন মানুষের মুখ থেকে এলোমেলোভাবে ছুটে আসা কথাবার্তা, আলোচনা, সমালোচনা তার ইচ্ছে অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে একেবারেই গা ঘেষে গেলেও শুধুমাত্র তার কথা অন্যান্যদের কর্ণকুহর দিয়ে মরম অব্দি পৌঁছানোর আগেই গুড়োগুড়ো হয়ে বাতাসে মিশে যায়। একেই কি ঠিক অস্পৃশ্যতা বলে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা নাহলে ভীড়ের ভেতর এই যে লোকটার হঠাৎ হঠাৎ দুম করে উধাও হয়ে যাবার কি এমন কার্যকারণ থাকতে পারে? তবে এই অন্তর্ধানটা অবশ্যই শরীরি নয় বরং মানসিক। তার মনে হয় আশপাশের সবাই তাকে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে যাচ্ছে নাকি কেউ তাকে আদৌতেও দেখতে পাচ্ছে না। ব্যপারটা বেশ খানিকটা সিনেম্যাটিক। তার অনেকদিন আগে দেখা একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে, যেখানে নায়ক কি এক বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা নিরীক্ষা নিজের উপর চালাতে গিয়ে আচমকাই নিজেকে আবিষ্কার করে শরীরহীন একটা অবয়বে। সে সকলকেই ঠিকঠাক দেখতে পায় কিন্তু অন্যরা কেউই তাকে দেখতে পায় না একদম। প্রথম প্রথম সে ব্যপারটাকে দারুণভাবে উপভোগ করলেও একসময় প্রগাঢ় একাকিত্ব তাকে আপাদমস্তক গিলে খেতে শুরু করে। তবে তার ক্ষেত্রে অবশ্য এমনটি হবার সম্ভাবনা নেই কেন না সে নিজের উপর কোন বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োগ করেনি। শব্দকে এড়িয়ে যেতে যেতে একসময় অন্ধকারকে ভালোবাসতে শেখাটা মোটেও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয় বরং সম্পূর্ণ প্রকৃতিগত। প্রকৃতিই তার প্রয়োজনে কাউকে না কাউকে বেছে নেয়। এইবার লোকটার ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। স্বভাবে গোলমাল দেখা দেবার আগ পর্যন্তও লোকটা সম্পর্কে তার আশপাশের মানুষগুলোর খুব একটা পরিষ্কার ধারণা না থাকার কারণটা খুবই স্বাভাবিক। যতক্ষণ না পর্যন্ত কারো আচরণে বড় ধরনের অসংগতি ধরা পড়ে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া কাউকে নিয়ে মেতে থাকাটা আধুনিক মানুষের স্বভাব বহির্ভূত। এখন কথা হলো এক্ষেত্রে অসংগতি বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে? কোন একদিন মন খারাপ করা বিকেলে সে বসে ছিলো নদীর কিনারে। দক্ষিণ দিক থেকে সাই সাই করে ছুটে আসা কোমল বাতাস সেই সাথে একনাগাড়ে বয়ে চলা নিরালম্ব নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দার্শনিক হেরাক্লিটাসের বিশ্বের অবিচ্ছিন্ন পরিবর্তনশীলতা বিষয়ক দর্শনের কথা মনে পড়ে যায়, যেটি ছিলো “একই নদীতে দু’বার অবগাহন সম্ভব নয়, কেন না প্রতিটি মুহূর্তে নতুন স্রোতের সৃষ্টি হচ্ছে। সৃষ্টির মাঝেই ধ্বংসের বীজ নিহিত, লয় থেকেই হয় পুনঃসৃজন।" ভাবনা শুরুটা এই স্রোত বিষয়ক হলেও পরিবর্তিতে তা মস্তিকের কোটরে সংরক্ষিত অন্যান্য বিষয়াদির ভেতরেও অচিরেই ডালপালা মেলে দেয়। তাইতো অতীতে যা কিছু দৃষ্টিগাহ্য হলেও অযাচিত বলেই নিছক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে ওঠে নাই সে সকলই এখন মহিরুহের মতো গুরত্বসহকারে দেখা দিতে শুরু করে। চাইলেও তখন থেকে তার পক্ষে ছোট-বড় কোন দৃশ্যকল্পই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তার সামান্য তে অসামান্যতা খুঁজে পাওয়া এবং তা ফলশ্রুতিতে আখিপল্লবে সর্বক্ষণ ঝুলে থাকা বিহ্বলতা তার আচরণ আচরণের ভেতরও বেশ বড়সড়ো একটা পরিবর্তন এনে দেয় যেটা তার আশপাশের মানুষজনের কাছে অসংগতি হিসেবেই ধরা পড়ে। কখনো কখনো সে খাতা কলমে কিছু একটা লিখতে বসে যেটি আপনি আপনিই কবিতার আকার ধারণ করে। সে ভেবে আশ্চর্য্য হয় যে দর্শন মানেই কি কবিতা? নাকি কবিতাই দর্শন? আবার এও মনে হয় সকল দার্শনিকগণ তো কবিতা আকারে দর্শন লিপিবদ্ধ করে যান নাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের যুক্তির প্রকাশটা একেবারেই মেদহীন ঋজু। শুধু তার ক্ষেত্রেই কেনো তবে এমন হচ্ছে এই ভেবে সে দিশেহার হয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন পর তার মনে পড়ে সেই কেবল এই রোগে আক্রান্ত নয়, তার প্রিয়কবি জীবনানন্দ দাশ নিজে ছিলেন এই রোগে আক্রান্ত। তাইতো তিনি লিখেছিলেন

"কেন আমি গান গাই?
কেন এই ভাষা
বলি আমি এমন পিপাসা
বারবার কেন জাগে?
পড়ে আছে যতটা সময়
এমনিতো হয়।"

কবিতা লেখাটা এক সময় কৌলিন্যর পরিচায়ক হলেও সময়ের সাথে সাথে কবি ও কবিতা বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণাও পাল্টেছে বহুল। বর্তমানে তারা কবিতা বুঝুক আর নাই বুঝুক, কবি ও কবিতাকে দূর্বোধ্য ছাইপাশ, নিষ্কর্মা কাজ বলে অভিহিত করে। ঠেস দেবার প্রবণতা যেন তাদের মজ্জাগত যেটা সুযোগ পেলেই সাপের মতো ফোঁস করে ছোবল দিতে চায়। তার নোটবুকে লেখা কয়েকছত্র কবিতা না পড়েই তারা তার নামের সাথে “কবি” শব্দ জুড়ে দিতে বিন্দুমাত্র সময়ের অপচয় করে না। নিজের নামের আগে কবি তকমাটা জুটে যাবার পর থেকে তাকে প্রায়শই বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিচিতজনের কাছে থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়। তার ভেতর কতক বিব্রতকর আবার কতক নিতান্তই অপমানজনক। বিষয়টা এমন যে কবি হওয়াটা একেবারেই যাচ্ছেতাই এবং নিষ্কর্মা একটা ব্যাপার। সর্বসাধারণের কাছে ধারণা এমন যে কবিমাত্রই অলস, উদাসীন, পলায়নপর এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে খানিক অসামাজিকও বটে। রাস্তা-ঘাট, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে, বাসে-ট্রামে পরিচিত মুখের কেউ সামনে পড়লেই প্রায়ই যে প্রশ্নটা শুনতে হয় তাহলো “কি কবি সাহেব, তোমার পাঞ্চাবির পকেটে কি? কবিতা? নাকি অন্য কিছু? প্রথম প্রথম সে হয়তোবা খানিকটা বিনয়ে কিংবা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যেতো। কি বলবে তা ভাবতে ভাবতেই অপরপক্ষ থেকে ছুড়ে দেওয়া বিদ্রুপমার্কা টাইপের হাসি কিংবা কটুক্তি তাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ফেলবার জোগাড়জন্ত করে ফেলতো। আজকাল অবশ্য এসব প্রশ্নের বিপরীতে তাকে বিব্রত হবার বদলে বেশ সপ্রতিভ হতে দেখা যায়। মুখে সাইনবোর্ড মার্কা একখানা হাসি ঝুলিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সে জবাব দেয় “আমার পকেট ভর্তি চাঁদের আলো।" প্রশ্নকর্তা সেক্ষেত্রে পরিবর্তী প্রশ্ন করে আলোচনাটা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আগ্রহ ও মনোবল দু’টোই হারাতে বসে। কি বলবে খুঁজে না পেয়ে সে হয়তো তখন মনে মনে গালি দেয় “মিয়া ভাওতাবাজি করবার আর জায়গা পাইলা না?” কবি'র অবশ্য এতে কিছু আসে যায় না। অলৌকিক কিনা জানা নেই তবে কবি হবার পর থেকে সে ক্রমশই মানুষের ভেতরটাকে স্পষ্ট পড়তে পারে। মানুষের চোখ, ঠোঁট ও মুখমন্ডলের কম্পন, বক্রতা কিংবা সংকোচন-প্রসারণ তার সামনে অন্তরমধ্যস্থ যাবতীয় রহস্যের জট খুলে দেয়। অনেকদিন আগে রুমাল দিয়ে সে যেদিন রেবেকার চোখ বেঁধে দিয়েছিলো, এরকম পাগলামীতে রেবেকা শুরুতে হেসেছিলো, অনেকক্ষণ পার হয়ে যাবার পর কবি তার অপরিবর্তিত ঠোঁটের বিন্যাসে আতঙ্কের ছাপ দেখে চমকে উঠেছিলো। চোখ থেকে রুমাল খুলে দিয়ে রেবেকাকে জিজ্ঞেস করেছিলো সে “তুমি এমন ভয় পেলে কেন?" রেবেকে আনতমুখে ডানহাতের পাতায় চোখ ডলতে ডলতে উত্তর দিয়েছিলো “আমি অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পাই।” অথচ এতোদিন তার ধারণা ছিলো যে মানুষের ভাবের প্রকাশটা সমস্ত শরীরের সমন্বয়। এর ভেতর কোন একটার ঘাটতিতে তা কেবল অসম্পূর্ণই নয়, বরং অসম্ভব। কোন কোন দিন রেবেকার সাথে শরীরি আলাপে পরাজিত হবার আগমুহূর্তে তার চোখেমুখে জ্বলজ্বল করে উঠতো সবুজ পত্রপল্লব দেখবার তৃষ্ণা। এসব তো গেল সূচনার কথা। এরপর কোন এক সোমবার বিকেল পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রেবেকা যে দিন নাক কুচকে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করার মতো করে বলেছিলো “ইদানিং তোমার গা থেকে কেমন গা গোলানো মেছো মেছো গন্ধ পাই।" কবি সেদিনই ঠিকঠাক বুঝে ফেলে যে সময় ও কবিত্ব রেবেকাকে পুরোদস্তুর পাল্টে ফেলেছে। রেবেকা আর হয়তো তার বুকের সাথে মুখ ঘষে অলৌকিক ঘ্রাণের মৌতাতে মরিয়া হয়ে উঠবে না। কিন্তু এই যে তার পকেটভর্তি চাঁদের আলো নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, এ বিষয়ের সত্যতা খুঁজতে এবারে একটু-আধটু বিভ্রান্ত হওয়া যাক। তুই পকেটভর্তি চাঁদের আলো খেয়েই বেঁচে থাক। কবির ঢং ধরে বসে বসে আমার অর্জিত অন্ন ধ্বংস করা থেকে এইবার একটু ক্ষান্তি দে” বলে মেজো ভাই তার দিকে ধারালো দৃষ্টিবান ছুড়ে দিলে তার বলতে ইচ্ছে করে “গ্রহণের ভেতর যতটুকু না প্রশান্তি তার চেয়ে অধিক প্রশান্তি নিঃশব্দে কাউকে সবটুকু উজাড় করে দেবার মাঝে। ঐ ফলবান সবুজ গাছগুলোকে দেখো, কেমন করে নিঃশব্দে আমাদের শূন্যপাত্র ভরে দিচ্ছে অপরিমাণ দাক্ষিণ্যে। শুধুমাত্র দেবার ভেতরেই যেন ওদের বৃক্ষজন্মের সারঃকথা নিহিত। আমরা কি গাছের মতো এমন উদার হতে পারি না?” কথাগুলো বুদবুদের মতো গলার কাছে এসে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকে। কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না, যেমনটি বলে হয়ে ওঠেনি রেবেকাকে তার একটুখানি সবুজের জন্য অপরিসীম তৃষ্ণার আদ্যপান্ত। পকেটভর্তি চাঁদের আলো নিয়ে হয়তো বা সে ঠিকই ঘুরে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু তা দেখবার মতো দৃষ্টি আছেই বা কজনার? তারমতো করে কেই-বা এমন বিহ্বল হবার কৌশল রপ্ত করতে পেরেছ? যেদিন ফাল্গুনের ভরা পূর্ণিমার ঝির ঝির রাতে বাতাস ও নারকেল পাতার অমন মায়াবী অভিসার দেখতে দেখতে তার মনে হলো চাঁদের দেশে পাড়ি দেওয়া নভোচারীদের মনে বস্তুত চন্দ্রাভিযানের আনন্দের সাথে সাথে চাঁদ বিষয়ক রুপকথার মায়াবী গল্পটা মিছে হবার দরুন কোথাও কি একটু আধটু বিষাদ লেপ্টে ছিলো কিনা। সেদিনই তার মনে হয়েছিলো সে বরং লোরকার কবিতার কামারশালার দেবদূতের মতো সেই ছোট্ট বালকটির মতো হোক, যাকে প্রেয়সী চাঁদ তার বুকে করে উড়িয়ে নিয়েছিলো উর্দ্ধাকাশে। সেদিন রাতেই সে পকেটভর্তি চাঁদের আলো নিয়ে ঘরে ফিরেছিলো। ঘুমোতে যাবার আগে এ হাত থেকে ও হাতে চাঁদের আলো নিয়ে খেলেছিলো বহুক্ষণ। বালিশের সাথে প্রাণপণে মুখে গুজে কেঁদেছিলো মৃত মায়ের কথা ভেবে যে কিনা সেই কবেই নক্ষত্র হয়ে গেছে। তার পকেট ভর্তি চাঁদের আলো বিষয়ক অলিক গল্পটার সূচনা সেদিন থেকেই আস্তে আস্তে তার প্রকট বিশ্বাসে রুপান্তরিত হয়েছিলো। এখন সে অন্যদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন অসম্ভব জেনেও হয়তো বা নিতান্তই স্বভাবশত অন্যদের উদ্দেশ্যে আওড়ে যায়। এটাকে এড়িয়ে যাবার সহজ পন্থা বললেও ভুল হবে না হয়তো। কবিদের ক্ষেত্রে ইনসমনিয়াকে ঠিক ব্যধি বলা যায় না। কবিমাত্রই সাধারণত ভাবুক, সেক্ষেত্রে ভাবনার স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ইনসমনিয়া হতে পারে নানাবিধ শিল্পসৃষ্টির অন্যতম প্রধান উপায়। গতকাল স্বপ্নে নিজেকে সে আবিষ্কার করেছিলো এক ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটির কবরখানায়, লম্বা আলখাল্লা পরিহিত একদল মানুষকে দেখা যাচ্ছিলো ক্রুশচিহ্নের মতো বিশালাকৃতির ভারি কিছু একটাকে কাঁধে বহন করে সারি বেঁধে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। কবরখানার বাইরে একদঙ্গল কুকুর বিভৎস স্বরে হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছিলো। প্রচন্ড ভয়ে হার্টবিট চরমে উঠে গিয়েছিলো তার। কাছেপিঠে কারা যেনো চিৎকার করে বলছিলো “প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর ও শয়তানের বাস একই সমতলে, একবারে পাশাপাশি; বন্ধু কিংবা সহচরের মতো।" ঝাঁপসা অন্ধকারে আচমকা প্রবলবেগে বৃষ্টি আরম্ভ হলে সে প্রাণপনে কবরস্থান ছেড়ে পালাতে দৌড় দিয়েছিলো এই ভেবে যে তার পেছনে পেছনে শিকারী সিংহের মতো ছুটে আসছে শয়তান। এই দৌড়যুদ্ধে পরাজয় মানেই মৃত্যু নিশ্চিত। এভাবে মৃত্যু থেকে পালাতে গিয়ে তার স্বপ্নের ভেতরই মনে পড়ে গিয়েছিলো সে তো গাছ হতে চেয়েছে বরাবর। সুতরাং মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে তা থেকে পালিয়ে যাবার কি এমন মানে থাকতে পারে? নাকি সে আসলে বাঁচতেই চেয়েছে বরাবর? মুক্তি ও ঔদার্যের সাথে মানুষরুপে বেঁচে থাকতে চাওয়ার ভেতর কি এমন সম্পর্ক থাকতে পারে? ভয় এবং ভাবনা একের পর এক পরষ্পরকে বয়কট করা শুরু করলে সে ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলো। মূর্তির মতো বিছানার কোণে জড়োসড়ো হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসা থাকতে থাকতে তার প্রচন্ড জলতৃষ্ণা পেয়েছিলো। টেবিলের উপর রাখা জগভর্তি পানির অর্ধেকটা মুহূর্তে গলার ভেতর চালান করে দিয়েছিলো সে। অস্থিরভাবে পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে তার নিজেকে মনে হয়েছিলো সহায় সম্বলহীন এক নিঃস্ব ভিখারী। জানলার বাইরে ঘুটঘুটে অমাবশ্যার অন্ধকারে তার পকেটবন্দি চাঁদের আলোটুকু হারিয়ে যাওয়ার দুঃখে সে কাতর হয়ে পড়েছিলো। আজ সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তার মনের ভেতর থেকে এক একটু একটু করে দ্বিধার মেঘ কেটে গেলে সে ভাবে এ রকম স্থবির একটা গল্পকে অযথাই সে টেনে টেনে প্রলম্বিত করছে। এরকম জরজবস্তি করে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া শরীরটা প্রতিদিন সময়ের কাছে ঋণের বোঝাটাই বাড়িয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তার গাছ হবার বাসনাটা পূরণ করবার জন্য আর এক মুহূর্ত দেরি করাটা উচিত হবে না। “মিয়া এরকম জোয়ানমর্দ একখান শরীর নিয়া খালি রাস্তায় রাস্তায় না ঘুইরা কিছু একটা কাম কাইজ করলেও তো পারো। মাইনষে কইতাছে তুমি নাকি আইজকাল গাছ-গাছালির লগে কতাবার্তা চালাইতাছো? ঘটনা কি?” পাড়ার এক মুরুব্বি তাকে এমনটা জিজ্ঞেস করলে সে রেগে যাবার পরিবর্তে ভ্যাবলার মতো একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিয়েছিলো “চাচা, ঠিকই কইছেন। কিন্তু কাম কাইজ যে করি না এইডাও ঠিক না। যা করতাছি এইডাও তো একটা কাজ। এখন কথা হইলো গিয়া একেকজনের কাজ একেক রকম।" এমন উত্তরে মুরুব্বি বেশ রেগেমেগে পুনরায় জিজ্ঞেস করেছিলো “কিন্তু এইডা কইরা টেকা-উকা কিছু আহে? ভাওতাবাজি তো ভালোই শিখছো। তোমার বাপে তো বেশ সহজ সরল ভালো কিসিমের মানুষ। তাইলে তুমি খালি এমন হইলা ক্যা? কবি জানে এ প্রশ্নের উত্তর সে যেটা দেবে বলে ঠিক করেছে তাতে করে মুরুব্বিকে থামানো যাবে না বরং পরবর্তি প্রশ্নে উৎসাহিত করা হবে। সে তার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার ভঙ্গিতে বলেছিলো “চাচা, চা খাইবেন নাকি? অর্ডার দেই? এরকম তিক্ত কথার বিনিময়ে চা খাবার আহ্বানে মুরুব্বি একদম দমে গিয়েছিলো। কবির মনে হয়েছিলো ভাষাটা যেহেতু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় কাজেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, সুতরাং মানবজাতি বৃক্ষের মতো বোবা হলে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি স্বাধীনতার খানিক অংশ আপনা আপনিই সুপ্রতিষ্ঠিত হতো। “এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন হওয়াতে তোমার ভেতর আদৌ কি কোন অনুশোচনা কাজ করে না?” চলে যাবার আগে রেবেকা এরকমই বলেছিলো। আপাতদৃষ্টিতে এরকম প্রয়োজনীয় কথার প্রতিউত্তরে রেবেকার সাদা তুলতুলে হাতের পাতায় চুমু খাবার অনুমতি প্রার্থনা করাটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক ছিলো কবি আজও তা ভেবে পায় না। এরপর রেবেকাকে আর ফেরানো যায়নি। মাঝরাতে নক্ষত্র হয়ে যাওয়া মায়ের অভাববোধে অবোধ শিশুর মতো কান্নার সাথে মিশে গেছে রেবেকাকে হারানোর কান্না। সে আস্তে আস্তে বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিলের ভেতর পা গুজে পড়ে থাকা শূন্য চেয়াটায় গিয়ে বসে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিয়ে বহুদিনের পুরোনো নোটবুকটায় লিখে ফেলে স্বীকারোক্তির মতো কিছু কথা-

“স্কুলে পড়বার সময় গাছের সাথে আমার সখ্যতা নিয়ে বরাবর যে সকল বন্ধু-সহপাঠীরা মুখ ভেংচি কেটেছিলো তাদের অনেককেই ইদানিং তুলতুলে বালিশের গোপন কাঠিন্যে ইনসমনিকদের দলে ভীড়ে যেতে দেখছি। সেইসাথে সেই আমার অবুঝ শৈশবের দার্শনিক স্বভাবগ্রস্থতায় আপনা আপনিই আমার শার্টের কলার ফুলে ফেঁপে উঠছে। একবার লুকোচুরি খেলতে গিয়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে নিচে পড়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। আমার বাবা সেদিন আমাকে মাটি থেকে তুলবার আগে বাঁশের কাঁচা কঞ্চি দিয়ে পেটাতে ছুটে এসেছিলেন। আমি সেদিন ভীষণ কেঁদেছিলাম, তবে সেটা ব্যথা ও ভয়ের যৌথ পীড়নে নয় বরং আমার সবচেয়ে নিরাপদ মানসিক আশ্রয়ের এমনতর বিপ্রতীপ আচরণে। কিন্তু পরবর্তীতে এই না থেকেও থাকা অস্থায়ী বাসটুকুর মর্যাদা সময়ে কেবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। গাছের কাছ থেকেই শিখেছি আশ্রয়ের বহুবিধ রুপের স্বরূপ সন্ধানের গোপন উপায়। খেঁজুর পাতা দিয়ে বানানো চর্কি হাতে যে ভোদৌড় দিয়েছিলাম সেদিন, তার প্রতিটি পদক্ষেপে রচিত হয়েছিলো জীবনের অমোঘ সত্যপ্রলাপ। একারণেই হয়তো শেষমেশ এই জনাকীর্ণ অথচ ব্যক্তিসর্বস্বতায় ভরপুর সমতল ছেড়ে চলে যাচ্ছি বোবা তরুদের দেশে।"

ভাজ না ভাঙ্গা পাঞ্চাবী-পাজামা পরে এই কাক ডাকা ভোরে কবি বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। বৈদ্যুতিক তারে বসে থাকা গোটা চারেক দাঁড়কাক একযোগে কা কা করে ডেকে হয়তো তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানায়। এই মফস্বল শহরে সকালেবেলায় গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যাবে না দেখে সে পায়ে হেঁটেই যাত্রা শুরু করে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে এ শহরে কবির বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়স্বজন, পরিচিতজন সবার কাছেই অজনা থেকে যাবে কবি আদৌ তার গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিলো কিনা। কেন না তাদের কারো সাথেই কবির সাক্ষাৎ হবে না কোনদিন।

@জিল্লুর রহমান সোহাগ


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

শব্দের কুহক ভালো লাগলো। যদিও প্যারা না থাকায় পড়তে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু শব্দের ছড়াছড়ি দেখলে আমি কষ্ট করেও পড়ে ফেলি আর সাথে রাখি পেন্সিল, নোটবুক। নিয়মিত লিখুন। প্যারা স্পেস ঠিক রাখুন। শুভকামনা রইল।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলে এইটা আমার প্রথম পোষ্ট। তাছাড়া এডিটের অপশান খুঁজে পাচ্ছিলাম না বিধায় এমন হয়েছে।
কষ্ট করে পড়বার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা জানবেন

@জিল্লুর রহমান সোহাগ

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

লিখতে থাকুন। পড়তেও থাকুন নিয়মিত। সব খুঁজে পাবেন, বুঝতেও পারবেন। সচলের সাথে সুন্দর সময় কাটুক।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। স্পেসটা খেয়াল রাখবেন। আর কিছু বাক্যে অসম্পূর্ণতা থেকে গেছে, শুরুর দিকটাতে। এখানে এডিট করা যাবে না এখন। তবু বলা পরের সতর্কতার জন্য।

শুভকামনা।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক শুভকামনা জানবেন স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুপ্রেরণা দেবার জন্য শুভকামনা নিরন্তর আয়নামতি

আয়নামতি এর ছবি

সচলে স্বাগতম। প্রথম লেখায় ভুলত্রুটি হতেই পারে।
আপনার মধ্যে লেখার ঝোঁকটা আছে। চলুক লেখালেখি। শুভকামনা।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক । লিখুন আরও। ভালো হয়েছে লেখা হাসি

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক শুভকামনা দেবদ্যুতি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।