আজ ৩১-০৫-১৫ তারিখের বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় একটি খবর দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকার রামপুরা এলাকা থেকে মনির হোসেন নামে একজন লোককে নিজের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। মেয়েটার বয়স মাত্র ১২ বছর। গত ৩ মাস ধরে লোকটি নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করে আসছে প্রতিনিয়ত। মেয়েটি গর্ভবতি হওয়াতে তার মায়ের চোখে পড়ে বিষয়টা এবং তিনি চাপ দেয়ায় মেয়েটি স্বীকার করে সবকিছু। এই ধরনের মানসিক বিকৃতির খবর সাধারণত চটি বইয়ে পাওয়া যেত। আজ সেটা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এসব ? এর জন্য দায়ি কারা ? একটি মেয়ে ধর্ষিত হবার পিছনে আসল অপরাধী কে ?
একটি মেয়ে প্রথম যৌন হয়রানির স্বীকার হয় তার নিজের ঘরেই। মামা,চাচা,চাচাতো ভাই,মামাতো ভাই আরো অনেকেই আছেন যাদের চোখ প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে যায় মেয়েটিকে। বিভিন্ন সময় আদর করার ছলে গায়ে হাত দেয়ার সুযোগ নেয় অনেকেই। মেয়েটি বিব্রত বোধ করলেও সেটা দেখার কেউ নেই। প্রাইভেট শিক্ষক যখন গায়ে বাজে ভাবে হাত দেয়,আত্মিয়রা যখন চকলেটের লোভ দেখিয়ে কোলে বসিয়ে শরীরের উপর হাত বুলায়,বাজে ইঙ্গিত করে,মেয়েটি তখন কি করবে ? অনেক মেয়েই আছে বুঝতে পারে না বিষয়টা। কেউ কেউ আবার ব্যথা পেয়ে ছুটে যায় মায়ের কাছে। মা বলে চুপ থাক। এসব কথা কাউকে বলতে নেই। কিংবা কেউ ভাবে পড়া ফাঁকি দেয়ার পায়তারা করছে কিংবা এসব বলে দুষ্টামী করছে। মেয়েটাও অসহায় হয়ে চুপ করে থাকে।
এরপর সে বাইরে আসে। সামাজিক কিছু দোপেয়ে জন্তু তাকে চলার পথে ধর্ষণ করে যায় লোক চক্ষুর অন্তরালেই। সেটা শুধু ঐ মেয়েটাই অনুভব করতে পারে। রাস্তায়,বাসে,ট্রেনে,সব জায়গাতেই প্রতিনিয়ত নোংরামির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। কারণ মায়ের নিষেধ আছে। ওসব বলতে নেই। লোকে মন্দ বলবে। আমাদের সমাজ এমন মেয়েদের মাঝে কতোজনের খবর নিচ্ছে ? মানসিক ভাবে একটি মেয়ে রোজ কতোবার ধর্ষিত হচ্ছে তার খবর কতোজন নিচ্ছে ?
এভাবেই একদিন মেয়েটি সত্যি সত্যি শারীরিক ভাবে ধর্ষিত হয়। ঘরে,রাস্তায়,বাসে,ট্রেনে,ক্ষেতের মাঝে,খোলা মাঠে, যেকোন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায় ধর্ষিতা মেয়েটির দেহ। কেউ উঠে সাহায্যের জন্য হাত উঠায়,আবার কেউ লাশ হয়ে পড়ে থাকে। ধর্ষণের জন্য মেয়েটির বয়স কতো হবে সেটা ধর্ষক দেখে না। তার কাছে একটি মাংস পিন্ড প্রয়োজন। আর কিছুই না।
ধর্ষণ কেন হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে অনেক জন অনেক ভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। কেউ বলেন ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব,কেউ বলেন ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল,কেউ কেউ স্বয়ং সেই মেয়েটির চরিত্র আর পোশাক নিয়েই প্রশ্ন তুলে বসেন। আসলেই কি যুক্তিগুলো যথার্থ ?
ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব সেটা যথার্থ মনে হয় না। কারণ,প্রায়ই দেখা যায় মসজিদের ইমাম,মাদ্রাসার শিক্ষক,বাসায় ধর্মীয় শিক্ষা দিতে আসা শিক্ষক সহ অনেকেই ধর্ষণের সাথে জড়িত হচ্ছেন। মাদ্রাসার শিক্ষক জোর করে বাধ্য করছেন তার ছাত্র বা ছাত্রীকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে। মসজিদের ছাদে ধর্ষিত হচ্ছে ইমামের হাতে। এসব ঘটনা দেখলে কি মনে হয় ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবের কারণে ধর্ষণের হার বাড়ছে ? কারণ ধর্ম গুরুরাইতো এসবের সাথে জড়িত।
গ্রামে গঞ্জে যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কই ঠিক মত পাওয়া যায় না সেখানে গ্রামের মানুষ ইন্টারনেট পাবে কোথায় ? শহরের চেয়ে গ্রামেই কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে। তাহলে সেটা কি যথার্থ যুক্তি ?
মেয়ের পোশাক আর চরিত্রই যদি মূল কারণ হয়ে থাকে তাহলে দিন দিন শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে কেন ? হিউম্যান রাইটস মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ সালে ৪৫৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়। এদের মধ্যে ২০২ জন নারী ও ২৫২ জন শিশু। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৪৫৬ জনের মধ্যে ২১৩ জন ছিল নারী ও ২৪৩ জন শিশু। ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা ছিল ২৯৯ জন ও শিশু ৪৭৩ জন। শিশুদের কি চরিত্র খারাপ থাকে ?
শিশু ধর্ষণের সংখ্যাই কেন দিন দিন বাড়ছে ? আমার ধারণা মতে,একজন জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন মেয়ে অত্যাচারীত হলে তার পক্ষে স্বাক্ষী দেয়ার একটা সুযোগ থাকে। সে অপরাধীকে চিনতে সক্ষম। তার প্রতিবাদের শক্তি এবং সাহস দুটোই থাকে। কিন্তু পক্ষান্তরে একটি শিশু বুঝতেই পারে না তার সাথে কি হচ্ছে। সে শুধু ব্যথা অনুভব করে। যে তাকে অত্যাচার করছে,যদি পরিচিত কেউ না হয় তাহলে পরবর্তিতে তাকে শিশুটি চিনবে না। শিশুটি হয়তো তার মাকে গিয়ে বলবে,কিন্তু মাও প্রমাণ বা মূল আসামীকে ধরতে পারবে না। আদালতে সেই শিশুটির স্বাক্ষী কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তাই অযথা ঝামেলা করে সমাজে লজ্জার মুখে পড়তে চাইবে না। ফলাফল ধর্ষক নিরাপদ।
এতোকিছুর মাঝে কিন্তু কেউ ধর্ষণের এবং ধর্ষণ পরবর্তি সময়ে মেয়েটির পুনর্বাসনের পিছনে সমাজের মানুষের দায় স্বীকার করতে চায় না। একটি মেয়ে ধর্ষিত হবার পিছনে কি সমাজের কোন দায় নেই ? ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তি সময়ে ভিকটিমের প্রতিনিয়ত মানসিক ধর্ষণের মূল কারণ কি আমাদের সমাজ হতে পারেনা ? হয়তো ভাবছেন সমাজ কেন ধর্ষণের জন্য দায়ি হবে ? তাহলে চলুন একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা খুঁজে নেই সমাজের দায়বদ্ধতার।
একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে তার জন্য কি করে সমাজ ? ধর্ষিতার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুদিন প্রতিবাদ,শাস্তি দাবি,গ্রেফতার দাবি,অতঃপর নিরব হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া। পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন ভাল কথা,কিন্তু তার পুনঃর্বাসনের ব্যবস্থা কে করবে ? সমাজে তার আগের সম্মানটা কে ফিরিয়ে দিবে ? সমাজ কি তাকে সম্মানের সাথে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে ? সবাই ধর্ষণের বিচার নিয়ে ব্যস্ত। ধর্ষণ রোধ করা বা এর স্থায়ি সমাধান নিয়ে কেউ বলছে না। কেউ বলছে না ধর্ষিতা মেয়েটির পরে কি হবে ? ধর্ষকের শাস্তি যদিও হয়েও যায়,এরপরে ঐ মেয়েটির কি হবে ?
একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে গিয়েও তাকে আরো ৪(চার) বার ধর্ষিত হতে হয়। সেই খবর কি আমরা কেউ রাখি ?
১) প্রথমে পুলিশের কাছে তাকে তার ধর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে মানসিক ভাবে আবার ধর্ষিতা হতে হয়। কে করেছে,কিভাবে করেছে,কাপড় খুলে করেছে নাকি কাপড় পড়া অবস্থায় করেছে,কতোজন ছিল,ব্যথা লেগেছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি জঘন্য প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আরো একবার সে ধর্ষিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তো পুলিশই নেমে আসে ধর্ষকের ভূমিকায়। কিছু বলা যাবে না। না হলে মামলা দুর্বল করে দিবে পুলিশ।
২) এরপর ডাক্তারী পরীক্ষা করতে গিয়ে কাপড় খুলতে হবে ডাক্তারের সামনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ডাক্তার থাকেন পুরুষ। একবার জোর করে কাপড় খুলে তাকে ধর্ষণ করা হলো,আবার সেই ধর্ষণের প্রমাণ জোগার করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় কাপড় খুলতে হলো। ডাক্তার যা বলবে তাই তাকে করতে হবে। না হলে ডাক্তার ধর্ষিতার পক্ষে রিপোর্ট দিবে না। তাই তার বিচার পাওয়া না পাওয়ার ভাগ্য পরীক্ষা তাকে আবারও ডাক্তারের কাছে দিতে হয়।
৩) এরপর যখন মামলা হয়,বিচার চাইতে আদালতে যায় মেয়েটি তখন ধর্ষককে সাধু প্রমাণ করতে গিয়ে আসামী পক্ষের উকিল আবার সবার সামনে মেয়েটির চরিত্রের ধর্ষণ করা শুরু করে। আবারও জনসম্মুখে উলঙ্গ করা হয় মেয়েটিকে। আইনের ফাঁক কাজে লাগিয়ে সেই মেয়েকেই দুশ্চরিত্রা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে।
৪) সব শেষে যদি কোন রকমে দোষ প্রমাণিত হয় তখন শুরু হয় আরেক হাস্যকর খেলা। আসামী সাজা কাটতে জেলে ঢুকে ঠিকই কিন্তু মেয়েটিকে আমাদের সমাজ ঐ ধর্ষণের কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে প্রতিনিয়ত। ঐ অবস্থার কথা মনে করে করে মানসিক ভাবে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হতে থাকে মেয়েটি।
যৌন নির্যাতন করছে স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা শিক্ষক,বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,ডাক্তার,কর্মচারী,পুলিশ,আত্মীয়,চাচা-মামা-খালু,দুলাভাই, কেউ বাদ যাচ্ছে না। এরা কি সমাজের বাইরের মানুষ ? এদের নিয়েই তো সমাজ।
এবার চলুন জেনে নেই আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্ষণের শাস্তি কিঃ- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে—
ধারা ৯(১): কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও তাকে দেয়া যেতে পারে।
ধারা ৯(২): ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পড়ে অন্য কোন কাজের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষণকারী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এছাড়াও তাকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ৯(৩): একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং ধর্ষণের কারণে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে তাহলে ধর্ষকরা প্রত্যেকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও তাদেরকে অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ৯(৪): যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে
(ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
(খ) যদি ধর্ষণের চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
ধারা ৯(৫): পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোন নারী ধর্ষিত হলে, যাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্ত ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ উক্ত নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরি দায়ী হবেন। এবং তাদের প্রত্যেকে অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
স্বাক্ষ্য আইনঃ- ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া সম্পাদিত স্বাক্ষ্য আইন,১৮৭২ বইয়ের ৬৭৪ পৃষ্ঠায় স্বাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, "কোনো লোক যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হয়,তখন দেখানো যেতে পারে যে,অভিযোগকারিনী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা রমনী’।"
নারী ও শিশু দমন আইনে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ ৩০ বছর। তার মানে একটি মেয়েকে সারা জীবনের জন্য কারাবাসে পাঠিয়ে ধর্ষক ভোগ করবে মাত্র ৩০ বছরের কারাদন্ড !!! অভিযোগকারিনী দুশ্চরিত্রা ! তারমানে দেহ ব্যবসা যদি কেউ করে থাকেন তাহলে তার ক্ষেত্রে ধর্ষণ করা জায়েজ। আবার যিনি ধর্ষণের শিকার হলেন তিনি যত ভদ্রই হোন না কেন,তিনি দুশ্চরিত্রা বলেই প্রমাণিত হবেন। হাস্যকর লাগলেও এটাই সত্যি। এটাই আমাদের প্রচলিত আইন। সমাজের প্রতিটি মানুষ বলে দুর্বল আইন। কিন্তু কেউ এর সংশোধনের জন্য কথা বলে না। রাষ্ট্রকে বাধ্য করে না আইন পরিবর্তন করতে। এটা কি সমাজের দুর্বলতা বা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না ?
একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হবার পর সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করলাম। চাপে পরে হয়তো ধর্ষক গ্রেফতার হলো,শাস্তিও পেল। কিন্তু এরপরে ? মেয়েটি কি সমাজে তার আগের মতো স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় ? আমরা কি তাকে সেই সুযোগ দেই ? বাসায় থাকলে সবার খারাপ ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। তোর জন্য আমাদের নাক কাটা গেছে শুনে শুনে ভিতরে ভিতরে ভাংগতে থাকে মেয়েটি। পাড়ার লোক,আত্মিয় স্বজন বাঁকা চোখে থাকায়। এমন ভাব করে যেন মেয়েটি অস্পৃশ্য হয়ে গেছে। বান্ধবীরা দূরে সরে যায়। কলেজ ভার্সিটিতে গেলে সবার অবহেলা,দূরে দূরে থাকা,বাজে মন্তব্য,মেয়েটিকে প্রতিনিয়ত অভিশাপ দেয়। ধর্ষণের কথা মনে করিয়ে দেয়। কাউকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়া কি ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে না ?
অত্যাচারিত মেয়েটির মানসিক অবস্থার কথা আমরা কি অনুভব করি ? মেয়েটির সব স্বপ্ন,ইচ্ছা,আকাঙ্খা সব এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায় একটি ঘটনায়। প্রতিনিয়ত সে নিজের চোখের সামনে ঐ পশুদের ছায়া অনুভব করতে থাকে। ঘুমের মাঝে বারবার চিৎকার দিয়ে উঠে। কথা কম বলে,চুপ থাকে সবসময়। পড়াশুনা,কাজকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে প্রতিনিয়ত। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখে। তারউপর যখন পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে নানান বাজে মন্তব্য শুনে, তার যন্ত্রণা আরো বাড়তে থাকে। মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়। এমন অবস্থা থেকে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কেউ মারা যায় আবার কেউবা পাগল হয়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার এমন করুণ পরিণতির জন্য কি তার পরিবার বা সমাজ দায়ি নয় ?
ধর্ষণের পরে মেয়েটির পরিবারের ভাবনাঃ- চুপ থাকো,এসব কথা কাউকে বলতে নেই। সমাজে নাক কাটা যাবে। বিচার পাবে না আর পেলেও তোমার বিয়ে হবে না। সারাজীবন একা থাকতে হবে। সমাজ তোমাকে গ্রহণ করবে না।
ধর্ষকের পরিবারের ভাবনাঃ- প্রথমেই ছেলেটির বাবা দৌড়ে যান থানায়। ছেলে দোষী কি না তা জানার আগেই ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। টাকা পয়সা খরচ করে বড় বড় উকিল নিয়োগ করেন ছেলের জন্য। ভিকটিমের বাসায় আপোষের প্রস্তাব পাঠান। রাজি না হলে বিভিন্ন ভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে থাকেন।
আমাদের সমাজের ভাবনাঃ- মেয়েটির সব দোষ। সবই তার পোশাকের দোষ। মেয়েটি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে কেন ? কেন পর্দা করে চলে না ? মেয়েটির চারিত্রিক সমস্যা আছে। এর আর স্বাভাবিক ভাবে চলার কিছু নাই। এই মেয়ে বাইরে বের হচ্ছে কেন ? ঘরে বসে থাকতে পারে না ? সমাজের অন্য সব ছেলেদের নষ্ট করবে নাকি ? এই মেয়েকে বিয়ে করবে কে ? নষ্ট মেয়ে,এই মেয়ের সাথে থাকলে অন্য মেয়েরাও নষ্ট হবে। তাই একে গৃহ বন্দী করে রাখো।
বাবা হয়ে যখন ধর্ষক ছেলের পাশে তার সর্বস্ব নিয়ে কেউ দাঁড়ায়,তখন ছেলেটি কি উৎসাহ পাচ্ছে না ? যখন সে দেখে ভয় ভীতি দেখিয়ে মামলা ঠান্ডা করা যায়,তখন কি সে সাহস পাচ্ছে না ? রাষ্ট্রীয় দুর্বল আইন যখন ছেলেটিকে উপযুক্ত শাস্তি দিচ্ছে না,তখন কি আর শাস্তি পাবার কোন ভয় তার মনে কাজ করবে ? ধর্ষক শাস্তি ভোগ করে বের হয়ে আসলে সমাজের মানুষ ঠিকই তার কু-কর্মের কথা ভুলে যায়। সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু সেই মেয়েটি কিন্তু সারা জীবনের জন্য অন্ধকারে নিক্ষেপিত হয়। এই সুযোগটা কি তাকে পরবর্তি শিকারের খোঁজে হাঁটতে উৎসাহিত করছে না ?
মেয়েটি এবং তার পরিবার যেমন সমাজের অংশ,তেমনি যে ধর্ষক তার পরিবারও সেই সমাজেরই অংশ। অংশ আমরা সবাই। কিন্তু ধর্ষক এবং ধর্ষিতার প্রতি আমাদের বৈষম্য মূলক আচরণ কি ধর্ষককে সাহস যোগাচ্ছে না ? যে পশু এই পাশবিক কাজটা করলো তাকে কি চোখে দেখছে সমাজ ? তার পরিবারকে কি করছে ? শাস্তি পাক আর না পাক ধর্ষক কি গৃহ বন্দী জীবনে বাধ্য হচ্ছে আমাদের সমাজে ? তার পরিবার কি ধর্ষিতার পরিবারের মত পদে পদে হেনস্তা হচ্ছে ? হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না ? কেন এই বৈষম্য ? অপরাধ না করেও মেয়েটি সমাজের কুৎসিত মানসিকতা সহ্য করতে না পেরে লজ্জায় আত্মহত্যা করছে,না হলে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে,না হলে নিজেকে অন্ধকার ঘরে বন্দী করে ধুকে ধুকে মরছে। আর সেই ধর্ষক অপরাধ করেও বীর দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ধর্ষককে ঘৃণা করবেন ঠিক আছে,কিন্তু সেই ধর্ষিতা মেয়েটির সম্মান ফিরিয়ে দেয়া কি সমাজের দায়িত্ব না ? মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কি সমাজের না ? ধর্ষক ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি রেখে আইনের হাতে তুলে দেয়া কি একজন বাবা হয়ে আপনার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না ? আপনারওতো মেয়ে আছে। সে যদি একদিন ভিকটিম হয় তাহলে আপনি কি আপনার মেয়ের ধর্ষককে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করবেন ?
খবরের কাগজ খুললে বা বিভিন্ন জরিপ ঘাটলে বছরে বছরে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই ? নাকি মেয়েরা লজ্জা ভেঙ্গে,ভয় ভেঙ্গে প্রতিবাদ করছে,বাইরে আসছে,বিচার চাইছে বলেই ধর্ষণের ঘটনা গূলো সামনে আসছে। আর আমাদের কাছে মনে হচ্ছে ধর্ষণ বাড়ছে।
মেয়েরা জাগছে,তাদের জাগতে দিন। জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ হারানো মেয়েটিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে না দিয়ে আসুন তাকে স্ব-সম্মানে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখাই। তাঁকে প্রতিবাদ করতে শিখাই,জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার মন্ত্র শিখাই। নির্যাতিতা মেয়ে এবং তার পরিবারকে হেনস্তা না করে বরং তাদের পাশে দাঁড়ান। আর ঐ ধর্ষককে শুধু শাস্তি না দিয়ে বরং তার পুরো পরিবারকে একঘরে করে রাখুন। কারণ ধর্ষণ করে সে যেমন অপরাধ করছে,তেমনি তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে তার পরিবারও সেই অপরাধে সমান অপরাধী হচ্ছে।
জাগো সমাজ জাগো। মৃত মানুষকে না মেরে,অত্যাচারীকে মারো। ধর্ষককে ঘৃণা কর,ধর্ষিতাকে নয়। না হলে মেয়েটির কাছে ধর্ষক নয়,বরং আসল অপরাধী হিসেবে আজীবন ধিক্কার পেয়ে যাবে আমাদের এই সমাজ।
- মিস্টার জিরো
মন্তব্য
মুশকিল হলো একজন ধর্ষকের কাছে ধর্ম, সমাজ, চক্ষুলজ্জা, নীতির কোন মূল্য নেই আর যখন ধর্ষক আমি বা আমার আপন জন তখন আমরাও লাফিয়ে উঠে ধর্ষিতার দোষ খুজতে শুরু করি যেখানে প্রয়োজন তার উল্টোটা করার ।
সেটাই। ধর্ষক যখন জানবে সে কু-কর্ম করার পরেও তাকে বাঁচানোর জন্য তার পরিবার পাশে থাকবে,সমাজে তার কোন সমস্যা নাই,তার পরিবার নিরাপদ থাকবে,সবচেয়ে বড় কথা তাকে কোন সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে না,তখনই সে নিশ্চিন্ত মনে ধর্ষণের মত নিকৃষ্ট কাজে উৎসাহ পায়। তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে তার পরিবার। পরিবার যদি তার পাশে না দাঁড়ায়,ভিকটিমকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়,সমাজ যদি ধর্ষককে চিরতরে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে তাহলেই কেবল সে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছুটা হলেও পিছিয়ে যাবে। সবার আগে জাগতে হবে সমাজকেই। সকল পরিবার থেকে রব উঠুক আমরা ধর্ষকের নয় ধর্ষিতার পাশে আছি।
সমাজটাই যে অপরাধের উর্বর ক্ষেত্র তাতে আর সন্দেহ কী। এই বিদ্যমান আইন নিয়ে কিছুদিন আগে এক সাংবাদিক বন্ধু ইন ডেপথ নিউজ করতে চাইলে তাকে তার নিউজ এডিটরের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে- বর্তমান প্রেক্ষিতে এটা উস্কানিমূলক হবে। উল্লেখ্য ওই পত্রিকাটি দেশের সবচেয়ে বড় দুটি অনলাইন পত্রিকার একটি।
এই হলো অবস্থা।
স্বয়ম
বড় পত্রিকাতে নিউজ করতে না পারলে উনার উচিত ছিল অন্য কাউকে দিয়ে অন্য কোন পত্রিকায় নিউজটা করানো। মানুষকে জানাতে হবে। কেউ করতে চাইবে না সেটা ভুল ধারনা। কেউ না কেউ তো নিউজ করতোই।
আমাদের সমাজের নীতি নৈতিকতার খুটি এত শক্ত না যে তা রক্তের বন্ধনকে উপেক্ষা করে আগে আসবে। সবাই নিজের পরিবারের বেলায় 'আমার কেস আলাদা' বলে সাফাই গায়। কিন্তু সবাই পরিবারের 'সম্মান' বাচাতে মরিয়া, এ কারণেই মেয়েটিকে চুপ করিয়ে দিয়ে তিলে তিলে হারিয়ে যেতে দেয়া হয় যাতে পরিবারের ভাবমূর্তির গায়ে দাগ মিলিয়ে যায়। কাজেই পরিবার থেকে ধর্ষককে রক্ষা করার চর্চা বন্ধ হবে যখন সমাজ সমস্বরে পরিবারসুদ্ধ ধর্ষককে হেয় করবে, অচ্ছুৎ ঘোষণা করবে। পরিবারের ভাবমূর্তির গায়ে কালি লাগলে পরেই কেবল পরিবার অপরাধীকে ছায়া দেয়া বন্ধ করবে।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
সেটা ঠিক। কিন্তু পরিবর্তন আসছে। খুব ধীর গতিতে আসছে। কিন্তু পরিবর্তন কিন্তু আসছে। গারো মেয়েকে যে ছেলেগুলো ধর্ষণ করেছিল তাদের মধ্যে একজনের বাবা ছেলের মায়া ত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন,এমন কুলাঙ্গার ছেলের উনার প্রয়োজন নেই। এটা একটা পজেটিভ কথা। এই সৎ আদর্শ সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক এটাই আমার প্রত্যাশা।
আইনের ফাঁকফোঁকর তো আছেই, অপরাধী নিজের পরিবারের হলে তার জন্য মমতা আর অন্য কেউ হলে ঘটনাটিকেই এড়িয়ে যাবার প্রবণতাও খুব বেশি আমাদের। কিন্তু ঘটনার শিকার মেয়েটিকে ঘটনা ভুলে যাবার সময়, সুযোগ কেউ দেয় না। যেখানে ধর্ষককে তার ধর্ষকামীতার জন্য ছিছিক্কার করবার একটাও মানুষ নেই প্রকাশ্যে সেখানে ধর্ষিতার প্রতি তীব্র টিটকারির পাশাপাশি সহানুভূতি দেখাবার ছলে হলেও বারবার তাকে সেই ঘটনা মনে করিয়ে দেবার মানুষের অভাব নেই।
দেবদ্যুতি
তার সন্তান যখন খুব ছোট ছিলো, এই লোক কোনোদিন কি সন্তানকে পিতৃস্নেহে কোলে নিয়েছিলো? আদর করেছিলো?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পিতৃ স্নেহ কি জিনিস সেটাই কি এই নরপশুটা জানে ভাই ?
একজন মেয়ের জন্য তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ কি তার virtue?
যাইহোক, আমাদের সমাজটা এমন যে কোনও মেয়েকে কেউ ফোনে বিরক্ত করলেও সেই মেয়েটিকেই শুনতে হয় যে তুমি নিশ্চই খারাপ, তোমাকেই সবাই ফোন করে কেন? তুমি নিজেকে কি মনে করো, ঐশ্বর্য রায়? সেখানে ধর্ষনতো অনেক বড় ইস্যু, তাতে কাপড়চোপড় থেকে চরিত্র, সব কিছু নিয়েই টানাহেঁচড়ার অনেক জায়গা থেকে যায়! :/
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু।
না শুধু মেয়ে কেন,কোন মানুষের জন্যই সম্মানটাই তার সবচেয়ে সম্পদ না। কিন্তু আমি বলেছি আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট বিচারে। আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মেয়েই এটা মনে করে। যারা এই তথাকথিত সামাজিক চিন্তা ধারা থেকে বেড়িয়ে আসতে পেরেছেন তারাই আপনার মত চিন্তা করতে পারছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। আপনি ১০০ জন মেয়ের সাথে কথা বললে দেখবেন অন্তত ৯৫ জন মেয়েই বলবে সম্মানটাই তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই প্রেক্ষাপট থেকেই কথাটা বলা।
আমাদের সমাজে ঘুরে ফিরে সব দোষ মেয়েদের ভাগেই যায়। কারণ সমাজ মেয়েদেরই দুর্বল ভাবে। আর দুর্বলদের উপর সবলদের অত্যাচার সেই আদি কাল থেকেই চলে আসছে। আর এই ধারনা পাল্টানোর জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র চেষ্টা।
নতুন মন্তব্য করুন