“স্কুলশিশুকে ধর্ষণের দায়ে স্কুল শিক্ষকের যাবজ্জীবন” এই শিরোনামের একটি সংবাদ [১] থেকে এই লেখার সূত্রপাত।সংবাদটি থেকে যা যা জানতে পারলাম তা হল-- ক) অপরাধের ঘটনাস্থল, কাল, অপরাধীর নাম, বয়স, শিশুটির বয়স, খ) আদালতের অভিমত এবং রায়, আর গ) মামলার পূর্বের অপরাধীর এক সময়ের বাসস্থানের ঠিকানা (স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে জেলা এবং মামলার পূর্বের যেখানে বাস করত সেই এলাকার নাম)। একটু পর মাথায় এলোমেলো কিছু ভাবনা এল,শিশুটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও, যৌন অপরাধী সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার কিছু জানতে পারলাম না।
সংবাদপত্রগুলো যত উৎসাহ নিয়ে নিপীড়িতের পরিচয় প্রকাশ করে, নিপীড়িতের পরিচয়ের ক্ষেত্রে ততটা উৎসাহ দেখা যায় না কেন? বিশেষ করে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ধর্ষকের ছবি সহ পূর্ণ পরিচয় প্রকাশে কোন বাধা আছে কি? প্রচলিত আইন অনুসারে মাননীয় আদালত রায় দিয়েছেন, পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশুকে যৌন নিপীড়নের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২ লাখ টাকা জরিমানা,অনাদায়ে আরও তিন বছরের কারাদণ্ড। আদালত জরিমানার ২ লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ টাকা মেয়েটির পরিবারকে দিতে বলেছে। অপরাধীর শাস্তির রায় হয়েছে ভাল কথা, কিন্তু এই শিশুটির জীবনের বাকি সময়টুকুর কতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত হল? যাবজ্জীবন তো অনধিক চৌদ্দ বছরের,এরপর অপরাধী একই অপরাধ করবে না তার নিশ্চয়তা কী? এই অপরাধী সম্পর্কে আমি আরো জানতে চাই, শুধু নামধাম না, তার বাসস্থল, কর্মস্থল বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল থাকতে চাই। ভাবনা সারমর্ম করে দুটো বিষয় পেলাম, এক) তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে যৌন অপরাধীকে আরো সামনে নিয়ে আসা, এবং দুই) তথ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিপীড়িতকে রক্ষা করা।
এই ভাবনা থেকে গুগল করতে খোঁজ পেলাম Sex Offender Registry বা যৌন অপরাধী নিবন্ধনের। যৌন অপরাধী নিবন্ধন " হচ্ছে যৌন অপরাধীদের বাসস্থান এবং কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ এবং অনুসরণের একটি ব্যবস্থা[২]। এই ব্যবস্থাতে অপরাধীদের পরিচয়, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদির হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যবস্থা চালু আছে। এই দেশগুলোর মাঝে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই এই ডেটাবেজে পাবলিক আক্সেস আছে [৩] [৪]। বাকি দেশগুলোতে শুধু আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা প্রবেশের এখতিয়ার রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় যৌন অপরাধী নিবন্ধন চালু করা হয় ২০০৬ সালে Adam Walsh Child Protection and Safety Act [৫] পাশ করার মাধ্যমে। এই ব্যবস্থায় অপরাধের মাত্রার ভিত্তিতে যৌন অপরাধীদের তিনটি স্তরে ফেলা হয়। প্রথম স্তরের অপরাধীদের ১৫ বছর ধরে নিবন্ধিত থাকতে হয় এবং প্রতি বছর তথ্য হালনাগাদ করতে হয়। দ্বিতীয় স্তরের জন্য ছয় মাস পর পর ২৫ বছর আর তৃতীয় স্তরের জন্য তিন মাস পর পর যাবজ্জীবন (পুরো আয়ুস্কাল) নিবন্ধিত থাকতে হয়। নিবন্ধন ঠিকমত হালনাগাদ না করা অপরাধ বলে বিবেচিত হয়, যার জন্য জেল-জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অপরাধীদের নাম-পরিচয়-ছবি-ঠিকানা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণকে পাবলিক ওয়েবসাইট, সংবাদপত্র, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে জানায় [৪]। এর মাধ্যমে শিশুদের অভিভাবকেরা এলাকার যৌন অপরাধীদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারেন। তবে এই নিবন্ধন ব্যবস্থার সমালোচনাও আছে। কিছু গবেষণায় দেখা যায়, এই নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করায় যৌন অপরাধের মাত্রা হ্রাস পায় নি। অপরদিকে, এসব অপরাধীদের বাসা খুঁজে পেতে সমস্যা হয় এবং মানসিক চাপ তাদের জীবনে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। এসব অপরাধীদের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনও নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এই হল প্রাথমিক ঘাটাঘাটির সারসংক্ষেপ।
চোখ ফেরালাম দেশের আইনের দিকে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত আছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩ [৬]। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ১৪ ধারাতে আছে ,
সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধানিষেধ
১৪৷ (১) এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।
(২) উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
দেখা যাচ্ছে, আইন থাকা স্বত্ত্বেও সংবাদ মাধ্যম এ ধরনের নির্যাতনের খবর আইনের ভেতর থেকে পরিবেশন করছে না বা করতে পারছে না। সাংবাদিকদের দোষ দেয়ার আগে প্রশ্ন করিঃ আসলে সাংবাদিকদের জন্য কি এই বিষয়ে কোন গাইডলাইন আছে? এ ধরনের রিপোর্ট কিভাবে লিখতে হয় এ ব্যাপারে কি তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়? সাংবাদিকদের কি উপরে উল্লেখ করা ধারা সম্পর্কে ধারণা আছে?
যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে অনেকেই ভাবছেন এবং কাজ করছেন। যৌন অপরাধী নিবন্ধন এবং যৌন অপরাধ রিপোর্টিং বিষয় দুটি তাদের এজেন্ডাতে থাকার কথা। এই বিষয়ে আমার দুই পয়সাঃ
প্রথমত, যৌন অপরাধী নিবন্ধনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে আইনবিশেষজ্ঞ আর আইনপ্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারেন। দরকার হলে শিশুদের পৃথক আইন প্রণয়নের চিন্তা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি পাবলিক ডাটাবেজ গড়ে তুলতে পারে। যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের এরকম একটা ওয়েবসাইট খুঁজে পেলাম এখানে [৭]।
তৃতীয়ত, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ধারা ১৪ মেনে তার যথাযথ প্রয়োগের দিকে নজর দিতে হবে।
চতুর্থত, সংবাদ মাধ্যমের জন্য যৌন অপরাধ রিপোর্টিং বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে দিতে হবে। এখানে একটা নমুনা পেলাম [৮]। নিয়মিত কর্মশালা করে সংবাদকর্মীদের এই বিষয়ে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে হবে।
আশা করছি এসব বিষয়ে আপনাদের অভিমত আর মন্তব্য থেকে আরও জানতে পারবো।
- হুঁকোমুখো হ্যাংলা
তথ্যসূত্রঃ
[১] http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article973518.bdnews
[২] http://en.wikipedia.org/wiki/Sex_offender_registry
[৩] http://www.fbi.gov/scams-safety/registry
[৪] http://www.pameganslaw.state.pa.us/Main.aspx
[৫] http://www.gpo.gov/fdsys/pkg/PLAW-109publ248/html/PLAW-109publ248.htm
[৬] http://bdlaws.minlaw.gov.bd/bangla_pdf_part.php?id=835
[৭] http://ukpaedos-exposed.com/
[৮]http://www.mncasa.org/assets/PDFs/2013MediaManual.pdf
মন্তব্য
ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
দরকারী পোস্ট
লাইনটায় কিছু গড়বড় আছে না? আলোচনা চলুক। পরে আবার পড়বো(একটু তাড়াহুড়ো করে পড়েছি )
স্পট অন। ভুলে মিস্টেক হয়েছে। পরের 'নিপীড়িত' হবে 'নিপীড়ক'। আরো তাড়াহুড়া করে পড়ে কিছু ভুল বের করে দিন। ধন্যবাদ
জরুরী লেখা।
-সো
ধন্যবাদ।
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
আমরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার প্রজেক্টের জন্য এটির তথ্যপ্রযুক্তিগত দিকটি তৈরি করার কথা বলতে পারি।
ধন্যবাদ শেহাব ভাই।
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
খুব ভালো উদ্যোগ হয় তাহলে। সরকারের অপেক্ষায় বসে না থেকে সচেতন অভিভাবক হিসেবে নিজেরাই একটি ডাটাবেজ/ ওয়েবসাইট রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাগুলোয় চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে। পরে সরকারীভাবে সহায়তা পাওয়া গেলে সেটিকেই সরকারী আওয়াতায় নিয়ে যাওয়া যাবে। কোথাও শুরু হওয়াটা জরুরি প্রথমে।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
ধন্যবাদ শিশিরকণা মতামতের জন্য । মানবাধিকার (মানবাধিকারবারী নয়) সংস্থাগুলো নিশ্চয়ই কোন ডাটাবেজ রক্ষণাবেক্ষণ করে (অনুমান)। তাদের কারো কাছ থেকে ডাটাবেজ যোগাড় করে ওয়েবে প্রকাশ করা যায় (আইনী কোন বাধা আছে কিনা সেটা যাচাই করে)। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় পরীক্ষামূলকভাবে কত তথ্যকোষ চালায় এখানে। এইটা কারো কানে তুলে দিতে পারলে হয়।
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় আলোচিত একটি ঘটনায় সচলায়তনেই এই আইনটি নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু বলাই বাহুল্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই যে নজরুল ভাই আপনার লেখা (মিস করছি)ঃ http://www.sachalayatan.com/nazrul_islam/53607
আমার মত হচ্ছে, শাস্তির বিধান আছে ভাল কথা। আইনের ব্যাখ্যা নিয়েও অনেক আলোচনা সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু তার আগে একটা গাইডলাইন থাকলে কি ভাল হয় না? নাকি আছে ইতোমধ্যে এরকম কিছু আছে? আমার মনে হয় মুখে গাইডলাইন তুলে খাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে রিপোর্টিংগুলো মানুষের মত হবে।
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
খুব জরুরি একটি লেখা। নিপীড়কের পরিচয় প্রকাশ এবং তা সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য তা সবার জন্য সবসময় উন্মুক্ত রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে যেখানে নিপীড়করা মাথা উঁচিয়ে চলাফেরা করে এবং সমাজ কেবল নিপীড়িতের উপর চাপ প্রয়োগ করে তাকে একটা বিকল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।
স্বয়ম
ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
চমৎকার প্রস্তাব তবে বাস্তবায়নের জন্য জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন আর এটিই সম্ভবত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কারণ জনমত ছাড়া কর্তৃপক্ষের টনক নড়ানো অসাধ্য একটা ব্যাপার ।
মোস্তফা কামাল
ধন্যবাদ
-হুঁকোমুখো হ্যাংলা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন