খিলজি ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে আমি বারবার অনেকটা বদভ্যাসের মতো করে হাতঘড়িটার দিকে তাকায়। ঘড়ির কাঁটা সেই কখন থেকে বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মাঝখানে ঝুলে আছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় ঘড়ির কাঁটা বোধহয় থেমে আছে, আমি তখন ঘড়িসুদ্ধ বামহাতটা ঝাঁকি দেই।
পুনঃবার সময় দেখি, সেকেন্ডের কাঁটাটা আলসে ঢংয়ে গড়িয়ে চলে। মাঝে মধ্যে মনে হয় এ কোন অভিশাপ নয়তো আবার?
নাহলে কব্জিকামড়ে পড়ে থাকা হাতঘড়িটাকে পরশুরামের কুঠারের মতো লাগে কেনো?
কখনো কখনো হাতঘড়িটাকে মেরামত করবার কথা ভাবি। আবার মনে হয় সেই মেস্তরিই বা আছে কোথায় যে বদলে দিতে পারে ঘড়ির কাঁটার থেমে থেমে চলার এমন অদ্ভুত আচরণ। সময় ও স্রোত কাহারও জন্য অপেক্ষা করেনা বলে যে তত্বকথা প্রচলিত আছে সে হিসেবে সময়ের শ্লথ আচরণটা কখনোই ব্যক্তিবিশেষের ভাবনাকেন্দ্রিক হবার কথা নয়। অবশ্য ঘড়ি বিষয়ক বহুত অলৌকিক তত্বকথাও যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। ঘড়ির মেকার নামক পরম গুরুর সন্ধানই কারো কারো কাছে মনুষ্যজন্মের সারকথা।
“এমন সাধ্য কার আছে ভাই এই ঘড়ি তৈয়ার করে
যে ঘড়ি তৈয়ার করে ভাই লুকায় ঘড়ির ভিতরে ।
তিন কাঁটা বারো জুয়েলে মিনিট কাঁটা হইল দিলে
ঘন্টার কাঁটা হয় আক্কেলে মনটারে তুই চিনে নিলে।”
আহা! কি কথা? বুঝি আর নাইবা বুঝি তা একেবারে হৃদপিন্ডের ভেতরটাতে গিয়ে ঘাই মারে। প্রকৃত মনকে জানবার মতো পর্যাপ্ত গভীরতা কিংবা প্রজ্ঞা কোনটাই আমার নেই। সময়ের চঞ্চল কিংবা শ্লথ আচরণের ব্যাখ্যা হিসেবে আমি বরং বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের দারস্থ হই। আইনস্টাইন বলেছিলেন সময় ব্যপারটাও ঠিক পরম নয়,স্থান ও গতির সাপেক্ষে সময়েরও নাকি সংকোচন ও প্রসারণ ঘটতে পারে। এই মতবাদই আমাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। আমিও নিজেকে সময়ের সমান্তরাল এক কাঠামো হিসেবে ধরে নেই যা কিনা ভাবনার বন্ধুর অবস্থান দ্বারা পুরোদস্তুর নিয়ন্ত্রিত।
আমার বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকানোর ব্যপারটা খিলজি ভাইয়ের চোখে এড়িয়ে যেতে পারেনা। তিনি তার দীর্ঘ বক্তব্যের সুতো টেনে ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করেন “কি ব্যপার? তোমার তাড়া আছে নাকি আজকে? দেরী করিয়ে দিলাম নাতো?।”
আমি তৎক্ষণাৎ একটু নড়েচড়ে বসে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করি “না, না, ভাই কোন তাড়া নাই। আসলে ইদানিং ঘড়ি দেখাটা আমার বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।” খিলজি ভাই খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন “যাক, তাও ভালো। আমি আরো ভাবলাম বকবক করে তোমার কানমাথা ধরিয়ে দিচ্ছি কিনা। কি করবো বলো? সারাদিন হইল চেয়ারে বসে একটানা বই পড়া ছাড়া আরতো কোন কাজ নেই। তোমার আপা সেই সকালে অফিসে চলে যায়, আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। প্রানখুলে কথা বলার মতো কেউ নেই। তুমি আসলেই একদম মুখের বাঁধনটা আলগা হয়ে যায়। তুমি আবার বিরক্ত হওনা তো?”
শারিরীক বিকলাঙ্গতা অনেকক্ষেত্রে মানুষের জীবন সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনার খোরাক জোগানদাতা। এতে করে অনেকবেশী প্রাক্টিক্যাল মানুষও পুরোদস্তুর তাত্ত্বিক বনে যায়। বহুদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণ একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেয়। কার এক্সিডেন্টে বাম পা'টা হারানোর আগে খিলজি ভাইকে দেশ মানুষ কিংবা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে এতো বেশী বিচলিত হতে দেখিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বামরাজনীতির সাথে একটু আধটু সাথে জড়িত থাকার সুবাদে খিলজি ভাইয়ের সাথে পরিচয়। বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, শ্রেনীসংগ্রাম প্রভূত পরিভাষিক শব্দগুলির সাথে সাথে আমার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার হাতেখড়ি তার হাত ধরেই হয়েছিলো। তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম রাষ্ট্র নামক দমনকারী প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক অসম বিভাজনে হাঁসফাঁস করতে থাকা মানুষগুলোকে মুক্তি দেবার কার্যকরী উপায় কি? অথচ সময় মানুষকে কি অদ্ভুত রকমেই না বদলে দেয়।
অ্যাক্সিডেন্টে পঙ্গু হবার আগে সে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বেশ হোমরা চোমরা কর্তাব্যক্তিতে পরিনত হয়েছিলো। অথচ একসময় এধরনের মানুষকে সে বলতো কর্পোরেট কুকুর। দিনরাত পুঁজির বিকাশকে বিনাশ করবার হাজারটা উপায় বের করতে যে একসময় মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সেই কিনা পরবর্তিতে আবার সময়ের পালাবদলে পুঁজি বিকাশের অন্যতম নিয়ামকে রুপান্তরিত হয়েছিলো। এটাকে অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে অন্তত ঠেকানো অসম্ভব।
আমি অবশ্য বলি অন্যকথা যেটা যুক্তির পাল্লায় কতটুকু টিকে থাকে সে বিষয় আমি বেশ খানিকটা সন্দিহান। আমার মনে হয় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তার জীবনের প্রত্যেকটা ধাপে এক একটা করে মতবাদ দাঁড় করিয়ে তা নিয়ে মেতে থাকে। মানুষ হয়তোবা নৈতিকতার তাড়নায় সচেতনভাবেই বৈপরিত্যের সাথে লড়ে যায়, বিজিত হয়ে গড়ে তোলে একটি নতুন ব্যবস্থা, কিন্তু সেই ব্যবস্থাও কি চিরন্তন? এটিও একসময় ভেঙ্গে পড়ে। এই ভাঙ্গা-গড়ার মাঝেই আমাদের সময় এগিয়ে চলে।
মজার ব্যপার হলো এতো পরিবর্তনের পরেও খিলজি ভাইয়ের চোখের অদ্ভুৎ দ্যুতিটা হারিয়ে যেতে যেতে এখনোব্দি বিকেলের ফিকে হয়ে যাওয়া রোদ্দুরের মতো ঝুলে আছে। হয়তোবা একারণেই অতীতের মতো এখনো সময় অসময়ে তার কাছে আসি, গল্প শুনি। ফিকে রোদের মতোই ফিকে হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে অহেতুক শান দেই। কেননা আমরা দু'জনেই বহুত আগেই ভেজা দেয়াশলাই বাক্সের মতো প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা খুইয়েছি। মাঝে মাঝে ভাবি বস্তুত তার এবং আমার মাঝে কেবলমাত্র শারিরীক প্রতিবন্ধকতার ফারাক থাকলেও আমাদের মানসিক বৈকল্য একই বালিয়াড়িতে হাত ধরাধরি করে হাঁটে।
“কি হলো কি ভাবছো? তোমাকে কি বিরক্তির একেবারে চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গেলাম?”
খিলজি ভাইয়ের কথায় অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নেই “ধুর কি যে বলেন। সত্যিকার অর্থে বাবা মায়ের একটু আধটু ফুটফরমায়েশ খাটা ছাড়া সারাদিনে আমার করবার মতো তেমন কোন কাজ আপাতত নেই। তবে ইদানিং চিন্তা-ভাবনা ক্যান জানি বিক্ষিপ্ত হইয়া যায়তেছে। কোনকিছুতেই বেশীক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারিনা। তবে আপনার কথা বেশ মনোযোগ সহকারেই শুনছিলাম।”
আমার কথা শুনে খিলজি ভাই বিচক্ষণের মতো মাথা নাড়েন “কি করবা বলো? মানুষের মসতিষ্কের আচরণ বেশ অদ্ভুতুড়ে। মনোবিজ্ঞান নিয়ে অবশ্য একটু আধটু জানাশোনা থাকলে হয়তোবা এ ব্যপারে তোমাকে কার্যকরী সাজেশান দিতে পারতাম।” আমি এবারে কিছুটা সহজ হবার চেষ্টা করি “আরে বাদ দেন, দরকার নেই। এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাই আজকে তাইলে উঠি। পরে সময়ে করে আসবো আরেকদিন।”
আমি খিলজি ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বের হই। খিলজি ভাইয়ের বাসা মোহাম্মাদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে। বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য একবার মনে হয় রেনুভাবী ও খিলজি ভাইয়ের সংসারে একটা সন্তান থাকাটা হয়তো জরুরী ছিলো। তাহলে খিলজি ভাইয়ের একঘেয়ে বিরস সময়টা কিছুটা হলেও সজীব ও কোলাহলময় হতো। শিশুরা কিছুটা হলেও সময়ের প্রকৃতি খানিক বদলে দিতে পারে।
আমার দূঃসম্পর্কের এক বোন প্রথমবার এক মৃতসন্তান জন্মদেবার পর ডাক্তারের পরামর্শ মতে দীর্ঘকাল কোন সন্তান গ্রহন করেননি। শেষমেশ অনেকদিন পর তার একটি ছেলে হয় এবং বছরখানেকের মধ্যেই ধরা পড়ে ছেলেটি মানসিক প্রতিবন্ধি। অথচ তাকে দেখে একটিবারও বোঝার উপায় নেই এর জন্য তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ কিংবা হতাশা আছে। সন্তানের মা হয়েছে এতে করেই যেনো সে অনেকখুশী।
এক ধরনের কৌতুহল কাজ করে ভেতরে ভেতরে আচ্ছা রেনুভাবী ও খিলজি ভাইয়ের নিঃসন্তান থাকাটা ইচ্ছাকৃত নয়তো? এরকমটি ভাবতে অবাক লাগে হয়তোবা দু'জনের একজনের মসতিষ্কের সপুষ্পক ভাবনার প্রতুলতা দেহজভাবে তাদেরকে অপুষ্পক করে রেখেছে।
ধুর! মানুষ নিয়ে গবেষণা করতে গেলেই নিজের ভেতর কেমন জট পাকিয়ে যায়। সুতরাং প্রকৃতির উপরই নির্দ্বিধায় সবকিছুর ভার চাপিয়ে দেয়া যাক। প্রকৃতির আচরণ বরাবরই অবোধ্য। ছকবহির্ভূত মানুষগুলোর কাছেই তার যতরকমের বিচিত্র আর বিপ্রতীপ প্রকাশ।
মকবুল হোসেন ডিগ্রী কলেজের সামনে নাক বরাবর যে গলিটা সোজা গিয়ে মোহাম্মাদপুর বাসস্ট্যান্ডে যাবার রাস্তার সাথে মিলিত হয়েছে তার সাথেই সারি সারি লাগোয়া সেলুন, মুদিখানা, স্টেশনারী দোকানের মাঝের দোকানে ‘টাঙ্গাইল’ পিঠা ঘরে'র" সাইনবোর্ড ঝুলছে। শীতকালে এই দোকানে খদ্দেরের লাইন পড়ে যায়।
আগে প্রায়ই আসা হতো এখানে তবে কখনো একা একা নয়, দু'চারজন বন্ধু-বান্ধবসহকারে গরম পিঠা খাবার আমেজটাই অন্যরকম। কনার সাথে সম্পর্কের ইতি টানবার কিছুকাল আগে একবার এইখানে আসা হয়েছিলো তাও সেটা বছর দেড়েকের কম হবেনা। আমার প্লেটে ছিলো ধোঁয়া ওঠতে থাকা গরম ভাঁপা পিঠা আর কনার প্লেটে ছিলো ডিম দিয়ে বানানো এক ধরনের চিতই পিঠা যেটা হয়তো আজঅব্দি এই দোকানের স্পেশাল আইটেম। কনার মেপে চলা সময়ের ট্রামে চড়ে বসবার জন্য আমি ছিলাম এখনকার মতোই অপরিবর্তনীয়, শামুকগতির, শ্লথ। বিষয়বস্তুর সাথে সাথে আমাদের কথাগুলোও এক এক করে ফুরিয়ে যাচ্ছিলো আর স্বাভাবিক ভাবেই আমার প্লেটে ভাঁপা পিঠার অর্ধেকটা পড়ে ছিলো নিঃসঙ্গ, বেতাল রকমের একা।
আজ এই জৈষ্ট মাসের তীব্র গরমে টাঙ্গাইল পিঠাঘরের মাঝবয়েসি পিটা বিক্রেতাকে দেখি শূন্য ডালার সামনে বসে আনমনে হাই তুলতে। গরমকালে পিঠার বিক্রিবাট্রা নেই একেবারে, হয়তো সে এই মুহূর্তে মনে মনে জোর প্রার্থনা করছে কিভাবে টান দিয়ে ক্যালেন্ডার থেকে সরিয়ে ফেলা যায় অলাভজনক গ্রীষ্প, বর্ষা, শরৎ, হেমন্তকে। তার চোখে মুখে ভাসে অন্তহীন এক শীতকালের প্রার্থণা।
আমার বাসা রায়েরবাজার হাইস্কুলের পাশে। মোড় থেকে রিকশার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার হাঁক দেই। বেশকিছুক্ষণ পর একটা রিকশা পেলে তাতে উঠে পড়ি। গতকাল নিউমার্কেটে আচমকাই কনার সাথে দেখা হয়েছিলো। আমি কাঁধে ঝোলানোর জন্য জুতসই ব্যাগ কিনবো বলে ভাবছিলাম। দু' একটা যদিওবা পছন্দ হচ্ছিলো কিন্তু দামে ঠিক ঠাক পোষাচ্ছিলো না বলে এ দোকান ও দোকান ঘুরছিলাম। ৩ নম্বর গেটের কাছে আসতে খেয়াল করলাম পেছন থেকে অতি পরিচিত কন্ঠে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ঘুরে তাকাতেই কনার চোখে চোখ পড়ে যায়।
আমরা অনেকটা আপোষেই আমাদের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বস্তুত আমার সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছিলোনা কখনোই, আজও নেই। কারো জন্য নিজের জীবনকে একটা নির্দিষ্ট পথে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর মতো ওদার্য্য কখনোই আমি অর্জণ করতে শিখিনি। আমাদের সম্পর্কের উন্মাতাল সময়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান কিংবা রমনার প্রশস্ত সবুজ বিকেলগুলোতে কনার কোলে মাথা রেখে আমি যখন দিনের আলোটুকুর ক্রমশ ক্ষয় হয়ে যাওয়া দেখতাম, কনা তখন টুকরো টুকরো স্বপ্নের সুতোয় আমাদের আসন্ন দিনগুলোর এক একটা করে নকশা বুনে যেতো। চাকরি বাকরি কখনোই আমাকে টানেনি। বাবার পেনশন ও ব্যাংকার বড়ভাইয়ের উপার্জনের টাকায় এমন বোহেমিয়ানগীরি দেখানোতে আত্নসম্মানবোধের কতটুকু ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে এসবের হিসেব নিকেশ করবার মতো ধৈর্য্য আমার নেই। আমার সবসময় মনে হয়েছে শুধু দেখবার জন্য কারো না কারো বেঁচে থাকাটা অপ্রয়োজনীয় নয় বরং দরকার।
এলিফ্যান্ট রোড থেকে কেনা সস্তা হাতঘড়ি সরিয়ে সেখানে দামি টাইটান ব্রান্ডের ঘড়িটা কনায় একদিন পরিয়ে দিয়েছিলো। এখন আমি শুধু হাতঘড়ির সেকেন্ড, মিনিট ঘন্টার কাঁটায় সময়ের চলে যাওয়াটা দেখি, এতেই এক ধরনের আনন্দ পাই। কনার সাথে বেশ টুকিটাকি বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়। তার বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক হলো। স্বামী সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার, এমাসের শেষের দিকে সে তার স্বামীর সাথে ওখানেই শিফট করবে। এ জন্যই সে ব্যস্ত এটা ওটা জিনিসপত্র কেনাকাটা নিয়ে। তারচোখমুখ আগের চেয়ে বেশ উজ্জ্বল হয়েছে। সুইজারল্যান্ড গিয়ে কি কি করবে এসবের প্ল্যান বানাতে সে মহাব্যস্ত। কথায় কথায় ঠিক আগের মতোই সে আমাকে প্ল্যানমাফিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবার উপদেশ দিলে আমিও পুরোনো অভ্যাসবশতঃ তা গিলে ফেলি। মনে মনে এটুকু ভেবে আনন্দ হয় যে যাক একজনকে অন্তত বাঁচিয়ে দিয়েছি।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর দায়মুক্তি তাকে বরং কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। কিংবা কিছুটা আঁচড় বা ক্ষত হয়তোবা এখনো রয়ে গেছে, ঢালাওভাবে বিচার বিশ্লেষণে যা দৃষ্টিগাহ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলো, আমি আসলে ঠিক কিভাবে, কি চেয়েছিলাম বা চাই? নিজের কাছে নিজেই উত্তর দিতে গেলে রীতিমত বাকরহিত হতে হয়।
বাসার সামনে পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি দেড়টার মতো বাজে। বাবা এসময় নিশ্চিত বাসায় থাকবেন। যতবার এই লোকটার মুখের দিকে তাকায় ততবারই আমার ভেতর ভেতর একধরনের বিব্রতবোধ কাজ করে। আমার বাবা বিদ্যুত মন্ত্রনালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব। বছর দুয়েক আগে রিট্যায়ার করেছেন। আমাদের ড্রয়িংরুমে ঝুলানো দেয়ালঘড়ি এবং আমার বাবার ভেতর অবস্থানগত কোন ফারাক নেই বললেই চলে। দেয়ালঘড়ি যেমন করে মুখাপেক্ষিহীন বৃত্তাকার পথে গড়াতে গড়াতে নিরলস সময় বলে যায়, আমার বাবাও অনেকটা তেমনি ড্রয়িংরুমে বসে টি.ভি. দেখতে দেখতে কিংবা পেপার পড়তে পড়তে গভীরভাবে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের চালচলন পর্যবেক্ষণ করেন। বাসার কে কি করছে না করছে, কেন করছে এরকম অনর্গল প্রশ্ন করে যান।
আমি সবসময় তার দৃষ্টি বাঁচিয়ে চলবার চেষ্টা করি। বাবা ড্রয়িংরুম থেকে একটু সরলেই আমি সুযোগবুঝে বাসা থেকে বের হই কিংবা ঢুকে পড়ি। শুধু খাবার টেবিলে তাকে এড়াতে পারিনা। অবশ্য খাবার টেবিলে আমার জন্য বাবার নিত্যদিনের বরাদ্দকৃত তিতকুটে জেরাটুকু সামলে ওঠার কৌশল ইতোমধ্যে রপ্ত করা শিখে গেছি। কথায় আছে প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক, যেকোন অপ্রত্যাশিত বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে আলগোছে সটকে পড়ার ক্ষেত্রে মোটামুটি রকমের দক্ষ হয়ে উঠছি দিনদিন।
সৌভাগ্যবশতঃ কিনা জানিনা আজ বাসায় ঢুকতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হতে হয়না। আমি দ্রুত ড্রয়িংরুম পার হয়ে আমার ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দেই। প্রচন্ড গরমে সারা শরীর ঘামে চপচপ করছে। জামাখুলে চেয়ারের উপর রেখে সিলিং ফ্যানের সুইচ অন করে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। ক্লান্তিতে সারা শরীর বিছানার সাথে সেঁটে যেতে চায়। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা একটা বেজে সাইত্রিশ। রান্নাঘর থেকে গ্যাসের চুলোর হিসহিস আওয়াজ আসছে। মা বোধহয় রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। চোখের পাতা ভারি ভারি লাগে, ঘুমিয়েই পড়েছিলাম বোধহয় হঠাৎ মায়ের ডাকে তন্দ্রাচ্ছন্নভাব কেটে যায়।
দরজা খুলতেই মা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বলে “কিরে, কোথায় ছিলি সকাল থেকে?”
আমি বিছানার উপর আধশোয়া হতে হতে উত্তর দেই “এইতো মা, একটু মোহাম্মাদপুরের দিকে গেছিলাম। ক্যানো কিছু হইছে নাকি?”
আমার তৎক্ষনাৎ প্রতিউত্তরে মা কিছুটা ভড়কে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে “না মানে, সকালে তোর ছোটখালা এসেছিলো। ও তোর বিয়ের ব্যপারে কথাবার্তা বলছিলো। তোর জন্য অনেক্ষণ বসেও ছিলো। শেষমেশ তুই আসলি না বলে চলে গেল।”
এমত পরিস্থিতিতে মুখে কুলুপ এটে বসে থাকা ছাড়া আমি আপাতত কোন গত্যন্তর দেখিনা তবুও মাকে খানিক বিভ্রান্ত করবার উদ্দেশ্যেই উল্টো প্রশ্ন করে বসি “আচ্ছা মা, তোমার বড় বউমা কই গেছে?”
মা কন্ঠস্বরে খানিকটা বিরাগ ফুটে ওঠে “কই আর যাবে? দু'দিন পর পরই খিলগাও, বাপের বাড়ি।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবারে বেগ পেতে হয়না। আমি বেশ সহজভঙ্গিতে বলি “তুমি তোমার এক বউমার ধাক্কা সামলাতেই অস্থির, সেখানে আবার খালকেটে কুমির আনতে ভয় করেনা?”
আমি নিশ্চিত মা এবারে পুরোপুরি বিভ্রান্ত, উপযুক্ত কথা না বলে শেষমেশ রাশটেনে দেবার ভঙ্গিতে বলে "তাই বলে কি তুই এভাবে সারাজীবন বিয়ে না করেই থাকবি?”
আমি তাকে যথাসম্ভব আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করি “আচ্ছা মা, আমি কি একবারও বলেছি যে কখনোই বিয়ে করবোনা? চাকরি বাকরিহীন এই বেকার ছেলের সাথে কে মেয়ে বিয়ে দিতে যাচ্ছে বলো?”
আমার কথায় আশ্বস্ত হবার পরিবর্তে মা অধৈর্য হয়ে পড়ে “কিন্তু তোর ভেতর চাকরী করার কোন লক্ষণতো আমি দেখিনা।”
আমি বুঝতে পারি আলোচনা এখন ক্রমেই অপ্রীতিকর দিকে এগুবে। আমি আলোচনাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করি “মা, রান্না কি হইছে ? ক্ষুধা পাইছে ভীষণ। সকাল থেকে এখনো কিছু পেটে পড়েনি।”
মা আর কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। আমিও বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর গোসল করে কোনমতে খাওয়া শেষকরে একটা লম্বা ঘুম দেবার উদ্দেশ্যে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ি।
বিকেলের দিকে জিহাদের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে। জিহাদ একটি বেসরকারী ফাইন্যান্স কোম্পানীর বেশ মোটা বেতনের চাকুরিজীবী। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসাথেই লেখাপড়া করেছি। সাধারণত মতাদর্শের অমিলই বন্ধুত্বের ভেতর ব্যবধান গড়ে দেয়, তারপর কোন একদিন যাবতীয় সম্পর্ক এমনকি নামও ব্যক্তিগত অভিধান থেকে নিঃশব্দে খসে পড়ে। মজার ব্যপার হলো আমাদের পারষ্পরিক ধ্যান-ধারনার মাঝে আকাশুচুম্বি ফারাক থাকা সত্ত্বেও কি এক অজানা অদ্ভুত কারণে আমাদের বন্ধুত্বটা এতো দীর্ঘসময় ধরে টিকে আছে। এই যোগসূত্রটা একটু গোলমেলে কিসিমেরই বলা যায়।
জিহাদ আগাগোড়া ক্যারিয়ারিষ্ট এবং তার প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই পূর্বনির্ধারিত। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে একদম সোজা সাপ্টাই সে স্বীকার করে যে কোন প্রকার উদ্দেশ্য ছাড়া সে কারো পিছে অযথা কালক্ষেপন করতে নারাজ। আমার ক্ষেত্রেও তার অতি ব্যক্তিগত প্রচ্ছন্ন এক স্বার্থজড়িত থাকলেও সেটাকে অন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলার কোন উপায় নেই।
“তোর লগে কতা কইলেই, ক্যান জানি বুকের ভেতরের পাথরখান আতকা নাইমা যায়” জিহাদের মুখে এই বাক্যটা যেন রেকর্ডকরা আছে বহুকাল আগে যেটা সময়ে সময়ে বেজে ওঠে। তবে কথাটা পুরোনো হলেও এটার সত্যতা আমি স্পষ্ট টের পাই।
যদিও আমি এ ধরনের গৎবাঁধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষকে যতদূরসম্ভব এড়িয়ে চলি। কেননা এধরনের মানুষের বদভ্যাস হলো সুযোগ পেলেই তারা নিজেদের চিন্তা-ভাবনা-দর্শন কে অন্যদের ভেতর প্রোথিত করে দিতে চায়। হাতপায়ে বেড়িপরে একধরণের ছকবাঁধা পথে হেঁটে যাওয়ার ব্যধিতে আশপাশের সবাইকে সংক্রমিত করার মহান ব্রতসাধনায় ব্যস্ত এসকল মানুষেরা নিজেদের অধীনতাকে যথাযথ প্রতিষ্টা বিবেচনা করে বাক্সবহির্ভূতদেরকে ঢালাওভাবে সমাজ সংসারের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা দেয় কিংবা একধরণের কপট নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে তাদেরকে লাইনে আনবার প্রচেষ্টাই মরিয়া হয়ে ওঠে।
আমি অবশ্য এসকল মানুষকে বলি রুপকথার গল্পের সেই লেজকাটা শেয়াল যদিও সংখ্যাগরিষ্ট বিবেচনায় তাদের সাথে এই উপমাটা ঠিক যুতসই-যুক্তিযুক্ত নয়। আমার মনে হয় যুক্তি তৈরি করার ক্ষমতা সবশ্রেনীর সকল মানুষের আছে, এটা কেবল ঐ সফেদ পোষাকী মানুষদেরই বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়।
জিহাদের ক্ষেত্রেই আমার ব্যতিক্রম ঘটে কারণ হতে পারে এমন যে সে আজ পর্যন্ত আমার কোন বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দেয় না, হতে পারে সেটা একেবারেই অযৌক্তিক, উদ্ভট। আমি যদি বলি “বন্ধু, ভাবছি ঘরবাড়ি ছেড়ে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।” সে বলবে “খারাপ না, যাইতে পারো। কাউরে না কাউরে তো বিবাগী হইতেই হবে, নইলে প্রকৃতির ব্যালেন্স থাকবে কি করে?”
এমন অসময়ে জিহাদের ফোন পাওয়াটা শুরুর দিকে বেশ অস্বাভাবিকই ঠেকেছিলো। ডিসপ্লেতে চোখ না রেখে কানের কাছে ফোন ধরতেই জিহাদ শীতল কন্ঠে বলে “দোস্ত তুই কি বাসায়?” পারলে এক্ষুণি ধানমন্ডি ১৫ তে চলে আয়। রেহানের অবস্থা খুব খারাপ”। এটা বলেই সে ফোন রেখে দেয়।
জিহাদের কথাটা মাথার ভেতর রিনরিন করে বাজতে থাকে। রেহানের অবস্থা খারাপ, রেহান মরে যাবে কথাগুলো ভাবতেই মসতিষ্কের শিরা-উপশিরা দপদপ করে ওঠে। চূড়ান্ত বাস্তবতাটাকে মেনে নেবার ব্যপারে আমি আদৌ বিকারগ্রস্থদের দলে নই। এইযে জলজ্যন্ত আমি জগতের উচিৎ-অনুচিৎ, উদ্দেশ্য-দায়িত্বের ফের বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একদিন দুম করে নাই হয়ে যাবো, এই অদ্ভুত বিতকিচ্ছিরি ভাবনাটা একসময় আমার সকল তাড়নাকে হীমশীতল করে দিতো।
আমার বিকারহীন জীবনযাপন বেছে নেবার ক্ষেত্রে হয়তোবা এটাই অন্যতম বড় কারণ। তবুও কারো কারো ক্ষেত্রে ব্যপারটা মানিয়ে নিতে এখনো বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়। মনে হয় আমার জীবদ্দশায় এই পাঁচমিশালী দৃশ্যকল্পের যাবতীয় অনিত্যতার ভেতরও অন্তত কিছু নিয়ামকগুলো বেঁচে থাকুক।
রেহান আমার বিশ্যবিদ্যালয়ের বন্ধু, ভারি পাওয়ারের চশমাপরা, স্বভাবে গোবেচারা টাইপের ছেলেটা বিশ্যবিদ্যালয় জীবনে কখনো কারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেনি। আমাদের সকলের মাঝখানে ওর অবস্থানটা ছিলো অনেকটা নিঃশব্দ ছায়ার মতো। আমাদের কয়েকজনের কাছেই ছিলো কেবল রেহানের সংবেদনশীল মনের খবর।
নিজের খাপছাড়া স্বভাবের দরুণ কারো খোঁজখবর রাখতে পারিনা বলার চেয়ে বরং আমি কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইনা বলাটাই সংগত হবে। রেহানের অসুস্থতা সম্পর্কে আমি পুরাপুরিই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। বহুদিন পর রেহানের খবর তাও আবার সেটা দুঃসংবাদ, আমার ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। বিছানা থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে গায়ে কোনরকমে শার্টটা গলিয়ে দেই।
“কিরে অমন তাড়াহুড়ো করে আবার কোথায় যাচ্ছিস?” আমি হাতঘড়িটা পরতে পরতে ঝটপট উত্তর দেই “আমার বন্ধু রেহান অসুস্থ, ওকে দেখতে একটু হসপিটালে যাবো।”
রাস্তায় বের হয়ে ধানমন্ডি ১৫ যাবার উদ্দেশ্যে রিকশা নেই। জৈষ্ঠের বিকেলে পড়ন্ত রোদের ভাপ শরীরের অবশিষ্ট জলটুকুও পারলে একলহমায় শুষে নিতে চায়। রিকশার হুড তুলে না দেওয়ায় মাঝে মধ্যে একটু আধটু বাতাসের ছাঁট গায়ে লাগে তাতে করে বাতাসের রাশভারী মেজাজটা স্পষ্টই টের পাওয়া যায়। রোড ডিভাইডারের মাঝখানে সারি সারি কৃষ্ণচূড়াই কেবল জৈষ্ঠের বৈরিতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাজঘরের ঊর্বসীর মতো চোখের উপর তার আচল মেলে ধরে গ্রীষ্মেরঅসহ্য খরতাকে ক্ষণিক ভুলিয়ে দিতে চায়।
কৃষ্ণচূড়া আমার প্রিয়ফুল। ফুলের ঘ্রাণ-সৌন্দর্য্য মানুষকে বিমোহিত করে। ফুলের পরিচয় নির্দেশক সুনির্দিষ্ট গুনবাচক বৈশিষ্টের ধারধারেনা বলে কৃষ্ণচূড়াকে স্বভাবগতভাবে খাপছাড়াই বলা যায়। ঘ্রাণ বলতে যেটা বোঝায় কৃষ্ণচূড়ার সেটা নেই বললেই চলে, তবে তার সহোদর রাধাচূড়াকে মনে হয় কিছুটা আপোষী স্বভাবের। কৃষ্ণচূড়ার এই দ্রোহী স্বভাবটাই আমাকে আকৃষ্ট করে।
ধানমন্ডি ১৫ তে নেমে কিছুদূর হাঁটতেই জিহাদের কালো রংয়ের টয়োটা এলিয়েন গাড়িটা চোখে পড়ে। ঢাকা শহরে শুধুমাত্র এই একটি গাড়িই আমি বোধহয় যেকোন অবস্থায় সনাক্ত করতে পারি, কারণটা নিয়ে অবশ্য কখনোই মাথা ঘামাইনি। আমি হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির খুব কাছাকাছি পৌঁছুলে জিহাদ পাশ থেকে হঠাৎ উদয় হয়। জিহাদ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে “নে, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বস, পপুলার হসপিটালে যেতে হবে।” আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটাতে উঠে বসে সিটবেল্ট লাগিয়ে নেই। জিহাদ নিজেই গাড়ি ড্রাইড করে।
গাড়ি মেইনরোর্ড ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেলে আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করি “কি হয়েছে বলতো? আমি আসলে রেহানের অসুস্থতার বিষয়টা একদম জানতাম না।” জিহাদ ডানহাত স্টিয়ারিংয়ের উপর রেখে বামহাতে মাথার চুল ঠিকঠাক করতে করতে ভারি গলায় উত্তর দেয় “রেহানের থাইরয়েড ক্যান্সার, লাস্ট স্টেইজ, অলরেডি দু'দুবার কেমো দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরোই নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে”।
আমি ঠিক কি বলবো বুঝে উঠতে পারিনা। প্রায় বছর চারেকেরও বেশী হবে রেহানের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। মাঝে কার কাছ থেকে যেন শুনেছিলাম যে সে নামকরা একটা বিদেশী এনজিওতে চাকরী করছে। তারপর আর কোন খোঁজখবর রাখা হয়ে ওঠেনি।
“কিন্তু তুই খবর পেলি কিভাবে? আমি যদ্দুর জানি তোর সাথেও রেহানের খুব একটা যোগাযোগ হতোনা” আমি প্রশ্ন করলে জিহাদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলে “তা ঠিক, আমার সাথে ওর বহুদিন কোনপ্রকার যোগাযোগ হয়নি। গতকাল আমার অফিসের সামনে ওর বড়ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো। তার কাছ থেকেই বিস্তারিত জানতে পারলাম।”
আমার আর কোনকিছুই জানতে ইচ্ছে করেনা। বাকি পথটুকুতে আমাদের পরষ্পর কোন কথা বলিনা। পপুলার হসপিটালে পৌঁছে জিহাদ রিসেপশান থেকে রেহানের কেবিনের লোকেশানটা জেনে নেয়। আমরা লিফ্টে করে ৪ তলায় রেহানের কেবিনে যাই। রেহানের শারিরীক অবস্থা ভয়াবহ রকমের অবনতি হওয়ায় তাকে আজ সকালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়েছে। শূন্য কেবিনের এক কোনায় একটা চেয়ারে বসে আছে রেহানের আম্মা।
দীর্ঘসময় ধরে কান্নার পর চোখেমুখে যে একধরনের শূষ্কতা লেগে থাকে, রেহানের আম্মার চোখেমুখে আমি সেটা দেখতে পাই। তার ভাবলেশহীন পাথরসদৃশ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার জিহ্বার অসারতা টের পাই। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে তিনি কিছুটা হলেও আমাদের জন্য ব্যস্ততা দেখাতেন, কিন্তু তার চোখের সামনে আমাদের জলজ্যন্ত সুস্থ অবয়ব তার বুকের ভেতর নিজের মুমুর্ষু সন্তানের জন্য হাহাকারবোধটা বাড়িয়েই তুলছে কেবল। কেননা এ বয়সে রেহানের মৃত্যুর সাথে লড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক রকমের বেমানান।
জিহাদ আস্তে করে এগিয়ে তার পাশে বসলে রেহানের আম্মা তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মানুষের মরে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ও চিরন্তন হলেও এই মুহূর্তে আমার পক্ষে এই দৃশ্য চুপচাপ দেখে যাওয়াটা রীতিমত অসম্ভব ঠেকে। আমি সন্তর্পণে কেবিনের দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে এসে হসপিটালের সিড়ির কাছে রেংলিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াই।
বেশ কিছুক্ষণ পর জিহাদ কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। “কিরে তুই অমন করে বের হয়ে এলি ক্যান?” জিহাদ জিজ্ঞেস করলে আমি আমতা আমতা করে জবাব দেই "দোস্ত, আমি অতটা পাথর হতে পারিনি এখনো।” তারপর জিহাদের কাছে রেহানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই। জিহাদ যন্ত্রের মতো করে বলে যায় “রেহানের চলে যাওয়াটা এখন শুধু সময়ের ব্যপার।”
আমি বাকি আর কিছু জানতে চাওয়ার মতো পর্যাপ্ত শক্তি হারিয়ে ফেলি, আমার হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসে। রেহানের চলে যাওয়াটা এখন নেহায়েৎ সময়ের ব্যপার, কথাটা ভাবতেই আমার মাথার ভেতর সময় বিষয়ক ভাবনাটা পুনঃরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কবে কার কাছে যেন শুনেছিলাম ঘড়ির কাঁটার একই ব্যপ্তিতে ব্যক্তিবিশেষের কাছে সময়ের দৈর্ঘ্যের হেরফের ঘটে। কথায় বলে দুঃসময়ের দৈর্ঘটা বরাবরই বেশী।
ছাত্রাবস্থায় পরিক্ষা আসলেই টেনশানে মাথা গুলিয়ে ফেলার বদভ্যাস ছিলো আমার। একদিন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এই সমস্যার ব্যপারে বেশ কার্যকরী একটা উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা হলো “পরিক্ষার মাসখানেক আগে তুমি কখনোই চিন্তা করবেনা যে পরিক্ষার মাত্র ৩০ দিন বাকি আছে। তুমি ভাববে পুরো একমাস সময় তোমার হাতে আছে। দেখবে তোমার টেনশান অনেকখানি কমে গেছে।” উপদেশটার কার্যকারীতা আমি কিছুটা হলেও পেয়েছিলাম। রেহানের ক্ষেত্রে এখন সময়ের বিভাজনটা করতে হবে সেকেন্ডে তাতে করে হয়তো সংখ্যার বিচারে তাকে অনেক বেশী সময় বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
জিহাদ আমাকে আবাহনী মাঠের কাছে নামিয়ে দিলে আমি মেইনরোর্ড ধরে আনমনে হাঁটতে থাকি। সন্ধ্যের অন্ধকার পেরিয়ে ইতমধ্যে রাত নামতে শুরু করেছে। আমি হাতঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটা পৌনে আটটা ছুঁই ছুঁই করছে।
কিছু কিছু সময় এমন হয় যখন করবার মতো অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও কিছুই করা হয়ে ওঠেনা। মনঃসংযোগ বলে যাকে সেটি দুম করে কোথায় উধাও হয়ে যায়, এটাকেই কি সময়ের থেমে যাওয়া বলে? আমি আপাতত কিছুই ভাবতে পারিনা। একটি রিকশা আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আচমকা ধাক্কা দিলে আমি ফুটপাতের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি। বামহাতের কব্জি থেকে হাতঘড়িটা ফিতে ছিড়ে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে। রিকশাওয়ালা কাচুমাচু ভঙ্গিতে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করে। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে হাত দিয়ে ইশারায় তাকে যেতে বলি।
ফুটপাত থেকে উঠে শার্ট-প্যান্ট থেকে ধুলো ঝেড়ে মাটি থেকে হাতঘড়িটা কুড়িয়ে দেখি তার উপরের কাঁচটা মাঝ বরাবর ফেটে গেছে কিন্তু তখনো টিকটিক করে সেকেন্ডের কাঁটাটা নড়ছে। আমি হাতঘড়িটা পকেটে পুরে পাশের গলি দিয়ে বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরি। গলির মুখে দাঁড় করানো একটি প্রাইভেট কারের খোলা কাঁচের ভেতর থেকে অঞ্জণ দত্তের একটি অতি পরিচিত গানের কয়েকটা লাইন ভেসে আসে-
“সময় ছুটে চলে
আমি আটকে পড়ে রই
আমার রাস্তা হাঁটে, আমি হাঁটি না
চোখে নিয়ে স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনেক অনেক কথা
আমার বয়স বাড়ে, আমি বাড়ি না”
আমার মনে হয় আমি নিজেও ঘড়ির কাঁটার আজব প্যারাডক্সে আটকে পড়ে আছি, আমি দু'চোখ বন্ধ করে ফুঁসফুঁস ভরে বাতাস টেনে নেবার উদ্দেশ্যে গাঢ় করে নিঃশ্বাস নেই।
@জিল্লুর রহমান সোহাগ
মন্তব্য
শত ব্যস্ততার মাঝেও গল্প পড়ার লোভ সামলাতে পারি না।
চলছে গাড়ি।
তবে কিছু বিষয় বলছি, কষ্ট পাবেন না যেন।
শারিরীক বিকলাঙ্গতা-শব্দটির ব্যবহার ভাল লাগেনি।
বেশ কিছু কমন টাইপো আছে। একই বানান দুই রকম ভাবেও আছে।
ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। চলুক। লিখতেই থাকুন। আর লেখা পোস্টানোর আগে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিন। শুভকামনা থাকল।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
বানানের ব্যপারে আমার সমস্যা পুরাই ক্ষমার অযোগ্য। তবুও আরও একটু খেয়াল করলে হয়তো কিছু কমে আসতো। তাছাড়া অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুলো লেখা এবং পোষ্ট করা, মনোযোগের ঘাটতিটা একারণেও হতে পারে। একদম শুরু থেকে আমার লেখার সাথে থাকবার জন্য শুভকামনা জানবেন এবং ভালো থাকবেন।
@জিল্লুর রহমান সোহাগ
। আপনার লেখার হাত ভালো। বানানের প্রতি যত্নশীল হবেন আশা করি। কয়েকটা বলে দিই-
কেনো>কেন
মেস্তরি>মিস্ত্রি/মিস্তিরি
তত্বকথা>তত্ত্বকথা
শ্রেণী>শ্রেণি
হৃদপিণ্ড>হৃৎপিণ্ড
আরতো>আর তো
অঞ্জণ>অঞ্জন
এমন আরও আছে বেশকিছু। আর ইয়ে-আমি/আমরা’র সাথে ‘তাকায়’ কেমন হলো না? উচ্চারণ বেশ কাছাকাছি হলেও বানানটা ‘তাকাই’ হবে। ‘তাকায়’ তো নাম পুরুষের সাথে হয়। দ্বিতীয় প্যারার প্রথম বাক্যের শেষ শব্দটার কথা বললাম, ঠিকাছে? লিখতে থাকুন
দেবদ্যুতি
অজস্র ভুল বানানের ছড়াছড়ি করবার জন্য আমি সত্যিকার অর্থেই লজ্জিত এবং সেগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
অনেক অনেক ভালো থাকুন........
ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
শুভকামনা নিরন্তর
”মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তার জীবনের প্রত্যেকটা ধাপে এক একটা করে মতবাদ দাঁড় করিয়ে তা নিয়ে মেতে থাকে” সত্যিই অসাধারণ ।
আমরা আশা করছি ঘড়ির চলা এত তাড়াতাড়ি যেন বন্ধ না হয়, সমস্যা নাই আটকে থাকলেও প্যারাডক্সে তবে থেকে তবু থেমে যেন না যায় ।
মোস্তফা কামাল
"মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তার জীবনের প্রত্যেকটা ধাপে এক একটা করে মতবাদ দাঁড় করিয়ে তা নিয়ে মেতে থাকে"
সত্যিই অসাধারণ
পাঠক হিসেবে চাওয়া যেনো ঘড়ির পথ চলা থেমে না যায়, সমস্যা নাই সে আটকে আছে একটা প্যারাডক্সের মধ্যে তবু চলছে তো ।
মোস্তফা কামাল
গল্পের বর্ণনা সুন্দর, আমি চরিত্রটা একটু আরোপিত মনে হলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন