শহর জুড়ে রাত্রি আসে নিয়নে
চাঁদের চিঠি ভুল ঘরে দেয় পিয়নে
অনেক দূরে কমলাপুরে ট্রেনের বাঁশি
বাস ডিপোতে বৃদ্ধ বাসের হঠাৎ কাশি
নিঝুম শহর কারফিউ দেয় পাহারা
শহরটা কি মরুভূমি সাহারা?
ছোট্ট খোকা স্বপ্ন বোনে কোন খেয়ালে
কি যেন কি হচ্ছে লেখা দেয়ালে
ঘুমায় তারা প্রাণের সাড়া বিহনে
মরণ কাঠি শরীর ছোঁয়াও জিয়নে।
অর্ণবের অসাধারণ গানটা শুনছিলাম। বই পড়ার সময় গান শুনার অভ্যাসটা আমার ভালোভাবেই আছে। কিন্তু এই বইটা পড়া শুরু করতেই গানটাকে ডিস্টার্বিং এলিমেন্ট ছাড়া আর কিছুই মনে হল। কি অসাধারণ শব্দ চয়ন। বুঁদ হয়ে ছিলাম। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম প্যাঁক প্যাঁক করা রানীময়ী হাসের সাথে। অনল আর জ্যোতির কথাগুলো যেন ছুঁতে পারছিলাম! এবং ভাবছিলাম, জহির রায়হানের ছেলে না হলে কি আমি এটা পড়তাম? না পড়লে তো কত যে আফসোস জন্ম নিত সেটাও বুঝতে পারতাম না।
অনল রায়হান। কিছু বুঝতে পারার আগেই বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিল। বাবাকে খুঁজে বেরিয়েছে। মায়ের ছিল দৃঢ় বিশ্বাস, জহির রায়হান মারা যায় নি। সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করছিল অনল। সহকর্মীর ডাক, একটা নতুন গণকবর পাওয়া গিয়েছে, ওখানে চলে যাও। জানো তো, জহির রায়হান মিরপুরেই নিখোঁজ হয়েছিলেন?
আমি বললাম উপন্যাস।
অন্যদিন পত্রিকা ছাপলো স্মৃতিউপাখ্যান।
আমি বললাম উপন্যাস
প্রকাশক দেখলেন জহির রায়হানের চিঠি।
আমি বললাম উপন্যাস
আমার স্ত্রী বললেন সত্যবয়ান।
আমি বললাম উপন্যাস
পাঠক ভাবুক যেমন ভাবুক।
এটা আসলে সবকিছুই। জহির রায়হানের চিঠি বইয়ের ছোট্ট একটা অংশ জুড়ে। আর বাকীটা? হুঁ, কিছু অসাধারণ কবিতার লাইন যেন। নিজের সাথে নিজের কথা। নিজের সাথে বাবার কথা। বাবাকে মিস করার গল্প। ভালো লাগার, খারাপ লাগার, হাহাকারের গল্প।
সুমিতা দেবী। জহির রায়হানের স্ত্রী। শ্বশুরের কথায় ধর্ম, অভিনয় বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করেছিলেন। এতো ত্যাগে পাওয়া জহিরকে ভালোবেসেছিলেন প্রচন্ডভাবে। জহিরের মনে হল শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গেলেন। তাইতো তাদের আর একসাথে থাকা হলো না। সুমিতা দেবীকে লেখা পঁচিশ পৃষ্ঠার এই চিঠিতে ফুটে উঠেছে আক্ষেপ, হাহাকার, অক্ষমতা।
আমরা ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম।
বেঁধেও ছিলাম।
ভেঙেও দিলাম।
কী সুখে ছিলাম আমরা জানি না।
কী দুঃখে ছিলাম তাও জানা নেই।
শুধু জানি,
আমরা আর একসঙ্গে নেই।
আমার আর কোনদিন একসঙ্গে থাকব না।
স্বপ্ন দেখব না।
ভালোবাসব না।
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হঠাৎ কখনো একে অন্যকে কাছে টেনে নেব না।
বৃষ্টির দিনে, আধো অন্ধকার ঘরে বসে দুজনে, নানা কল্পনার আলপনা আঁকব না।
কিংবা, কোন পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ হঠাৎ বাইরে থেকে এসে শুধোব না, আমার রুমালটা কোথায়? শার্টের বোতামটা লাগিয়ে দিতে বলেছিলাম, লাগাও নি যে?
আর বলব বা।
কোন দিনও না।
দেখলে তো, জীবনটা কী নির্মম।
স্ত্রীর সাথে আইনগতভাবে বিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু দুরত্ব তো ছিলোই। আপনি বলা আর সুমিতা না ডেকে মিঠু-বিপুলের মা বলা কি স্বাভাবিক? স্ত্রীর সুখ কামনা করলেন, বিয়ে করার অনুরোধও করলেন, অনুরোধ করলেন বাচ্চাদের তাদের বাবার কথা জানানোর। মনের গহীনে কি তাকে কাছে পাওয়া ইচ্ছেও ছিল?
আমি আর তুমি।
বুড়ো আর বুড়ি।
পাশাপাশি বসে।
দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকব।
আমরা নীরবে কাঁদব।
শব্দ করে হাসব।
আবার দুজন দুজনকে ভালোবাসব।
চিঠিটা পড়ে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। মানুষ এতো সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারে? যেন কোন গল্প পড়ছিলাম! পাঠক অনুভব করতে পারবে তাদের দাম্পত্য জীবনকে। আমি জানি জহির রায়হানের বই পড়া যে কেউ বলতে পারবে এটা যে তারই লেখা। অমন ছোট্ট ছোট্ট বাক্য, মাত্র কয়েকটা শব্দের সমাহার তো তার বইয়েই পড়া।
শমী কায়সারের লেখা বাবার কথা বইয়ে শাহরিয়ার কবিরের তীব্র উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেছিলাম। এতো প্রশংসা যেন ওটার প্রাপ্য নয়। (ওটা আমার মোটেই ভালো লাগে নি।) শাহরিয়ার কবির এই ভূমিকায় লেখকের লেখনী নিয়ে কোন মন্তব্যই নেই। কোন উচ্ছ্বাস নেই এই বলে যে, আমাদের পরিবারে আরেকজন নতুন লেখক এসেছে। (ইন্টারে থাকার সময় যখন শাহরিয়ার কবিরের গল্প ছাপা হয় তখন শহীদুল্লাহ কায়সার কি প্রশংসাই না করলেন। জহির রায়হানকে ডেকে বললেন, আমাদের পরিবারে তাহলে আরেকজন লেখক হতে চলেছে। এটা বলে শাহরিয়ার কবিরও শমী কায়সারের ব্যাপারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।) কিন্তু তাতে কি? আমি জানি না, এটাই অনল রায়হানের প্রথম বই কিনা। শুধু এটাই বলার, অসাধারণ।
শাহরিয়ার কবিরের ভূমিকা বরাবরের মতোই অসাধারণ। জহির রায়হান সম্বন্ধে আছে, আছে তার কাজ সম্পর্কে, তার পারিবারিক ব্যাপারও আছে। প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী সম্পর্কে হয়তো জানতেই পারতাম না এটা না পড়লে। ডিভোর্স না হলেও থেকেছেন আলাদা। প্রচন্ড অভাবের মধ্যে ছিলেন। অভাবের তাড়নায় পেশাদার যাত্রায়ও অভিনয় করেছেন। ভূমিকার কিছু ঘটনার কথা পড়ে আমার কি খারাপই না লাগলো!
শিক্ষত মানুষের এই যে পরিবর্ধনশীল ঢাকা শহর, এখানে কোথায় আমার বাবা? এরা সবাই জহির রায়হানের নাম জানেন। অথচ এই বিশাল নগরমানুষদের নব্বই শতাংশের কাছে "আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব" কথাটার কোন ব্যঞ্জনা নেই। সার্ভে করলে কে জানে, কেউ কেউ নির্ঘাত বলে বসবেন, জহির রায়হান ঢাকা শহরের জনসংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
এই কথাটা ভাবায়, হতাশাও তৈরী করে। আপু বলেছিল, আসছে ফাল্গুনে কচু হবে, দ্বিগুণ না দ্বিখন্ডিত হবে সব। কি যে অবস্থা চারপাশে, দেখে নিও।
* এই বইয়ে বানান ভুল আছে। অনুপম প্রকাশনীর বইয়ে এটা আশা করা যায় না। চিঠির দুইটা মাত্র পৃষ্ঠা স্ক্যান করে দেয়া হয়েছে। তাও লো-কোয়ালিটির। একাত্তর এবং আমার বাবার মতো সবগুলো পৃষ্ঠা এবং ওভাবেই দিলে ভালো হতো।
বইয়ে কিছু পারিবারিক ছবি আছে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো।
* বাংলা ভাষার 'এ-কার' নিয়ে আমি চিন্তিত। ওটা হারিয়ে যাবে নাকি? বলবা, করবা, খাবা এরকম বহু শব্দ আজকাল মানুষের মুখে এবং লেখায়। এরকম কেন? ছাপার অক্ষরে দেখলে তো মেজাজই খারাপ হয়। এই বইয়েও আছে।
যদিও বলা হয়ে থাকে, ভাষা একটা প্রবাহমান নদীর মত। কিন্তু আমার বলবে, করবে বলতেই ভালো লাগে।
বইয়ের নামঃ হঠাৎ বাবার পঁচিশ পাতায়
লেখকঃ অনল রায়হান
প্রকাশনীঃ অনুপম
প্রকাশকালঃ বইমেলা, ২০১৫
গুডরিডস লিংক
যে লেখাটা না পড়লেই নয়ঃ পিতার অস্থি'র সন্ধানে
বইটা পড়ুন প্লিজ। পড়ুন এবং ভালোলাগা বা খারাপলাগা প্রকাশ করুন।
আমি? ইমতিয়াজ হাসান!
মন্তব্য
চমৎকার রিভিউ এবং অবশ্যই পড়া হবে
মোস্তফা কামাল
ধন্যবাদ। পড়ে ফেলবেন কিন্তু তাড়াতাড়ি।
সচলে স্বাগতম ইমতিয়াজ। লিখতে থাকো।
_________________
[খোমাখাতা]
আচ্ছা। লিখার চেষ্টা করবো।
চমৎকার লিখেছেন আপনি।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ধন্যবাদ।
ভালো লেখা, বইটা পড়ার ইচ্ছে জাগানিয়া।
দেবদ্যুতি
চমৎকার রিভিউ। ভালো লাগলো। আপনার কাছ থেকে আরো অনেক অনেক রিভিউ পড়ার আগ্রহ জানিয়ে রাখলাম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
গুড জব ইমতিয়াজ হাসান! আপনার কাছ থেকে নিয়মিত বুক রিভিউ আশা করছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কী চমৎকার রিভিউ। পড়েই বইটা পড়ার তৃষ্ণা জাগলো।
নিয়মিত লিখুন ইমতিয়াজ।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
সচলে স্বাগতম। হাতখুলে রিভিউসহ অন্যান্য লেখাও লিখুন ভাই।
নতুন মন্তব্য করুন