অস্ট্রেলিয়ার টিকিট কাটা ছিল কুয়ালাম্পুর-এডেলেড, পার্থ-কুয়ালাম্পুর অর্থাৎ নামব এডেলেড আর ফিরব পার্থ হয়ে। দু সপ্তাহের ভ্রমণ। পুরো মহাদেশ তো আর এই স্বল্প সময়ে দেখা সম্ভব না, আপাতত দুটো স্টেট দেখে যাই, এরকমটাই ছিল প্ল্যান। টিকিট কেটেছিলাম প্রায় পাঁচ মাস আগে, বাজেট এয়ারলাইন “এয়ার এশিয়া”র মূল্যছাড় অফার থেকে। যাত্রা তারিখের প্রায় দু’মাস বাকী থাকতে এয়ারলাইন এর কাছ থেকে ই-মেল পেলাম যে ওরা এডেলেড এর সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। আমাকে হয় মেলবোর্ন অথবা পার্থ হয়ে যেতে হবে। ঐ দু’টো রুটের ফ্লাইট চালু থাকবে। অনেক ভেবেচিন্তে মেলবোর্ন এর অপশন টাই বেছে নিলাম। তার মানে, দু সপ্তাহে তিনটে স্টেট। শিডিউল খানিক আঁটসাঁট হয়ে যায় কিন্ত একটা বড় সুযোগ পাওয়া যায়। সেটা হল – মেলবোর্ন থেকে “গ্রেট ওশেন রোড” হয়ে এডেলেড এ যাওয়ার প্ল্যান করা।
“গ্রেট ওশেন রোড” অস্ট্রেলিয়ার মূল ভুখন্ডের সর্বদক্ষিণে দক্ষিণ মহাসাগরের তীর ঘেঁষা ২৪৩ কিলোমিটার বিস্তৃত সবচাইতে আকর্ষনীয় ড্রাইভিং রুট। শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ বিশ্বসেরা কয়েকটি ড্রাইভিং রুটের মধ্যে এটি একটি। নীল সমুদ্রের পাড় ধরে পাহাড় ঘেঁষে ছুটে চলা আঁকাবাঁকা সর্পিল এ রাস্তা যে শুধু সৌন্দর্যের আকর তাই না; এর রয়েছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাসও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত প্রায় তিন হাজার সৈনিক ১৯২২ সালে শুরু করে, প্রায় তের বছর শ্রম দিয়ে, যুদ্ধে হারানো তাদের সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে এ রাস্তাটি নির্মাণ করেন। আর তাই এটি আজ বিশ্বের দীর্ঘতম যুদ্ধের স্মারক (war memorial) হিসেবে স্বীকৃত। গ্রেট ওশেন রোড সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে পড়ুন এখানে - http://en.wikipedia.org/wiki/Great_Ocean_Road
শুধু সুযোগ পেলেই তো হবে না, চাই পরিকল্পনা। এ তো নিজে একা ঘুরাঘুরি করা না যে কোন না কোনভাবে ম্যনেজ হয়ে যাবে; পরিবার নিয়ে ভ্রমণ বলে কথা। পরিবার বলতে সাথে স্ত্রী আর দুই পুত্র; একজনের দশ বছর, আরেকজন চার। তাই পুরো রুট সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়া দরকার যাতে কোন বিপদে না পড়তে হয়। প্রথমেই কথা বললাম, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধুর সাথে এডেলেড এ যার বাসায় আমরা উঠব। প্ল্যান শুনেই ঝাড়া “না” বলে দিল বন্ধু। কারণ দুটো – অস্ট্রেলিয়ায় গাড়ি ডানপাশ চালিত আর মধ্যপ্রাচ্য থাকার কারণে আমার অভিজ্ঞতা বাঁ পাশে চালিয়ে। তার মানে হল, ট্রাফিক নিয়ম সম্পুর্ন উল্টো। বাংলাদেশে কখনো গাড়ি চালাইনি; তা হলেও না হয় ডান পাশে চালানোর কিছুটা অভিজ্ঞতা হত। দ্বিতীয় কারণ হল – মেলবোর্ন এডেলেড এর রাস্তায় গাড়ি, ট্রাম এবং সাইকেল চলে। অর্থাৎ ট্রাফিক নিয়ম, সিগনাল সব মিলিয়ে ব্যপারটা একজন আগন্তকের জন্য বেশ কঠিন। বন্ধুর কাছে ধাক্কা খেয়ে খানিক দমে গেলাম; কিন্ত আশা ছাড়ি কিভাবে। গেলাম ভ্রমণের জন্য আমার পছন্দের সাইট http://www.tripadvisor.com/ এ। ফোরামে একটা নতুন থ্রেডে প্ল্যান জানিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত চাইলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে দু তিন জন এক্সপার্ট যে শুধু উৎসাহই দিল তা না, সাথে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে আমাকে একটি পুরো তিন দিনের প্ল্যান দাঁড় করতে সহায়তা করল। ভ্রমণ ফোরাম সম্পর্কে ধারণা নিতে চাইলে পুরো আলোচনা দেখে নিতে পারেন এখানে - http://bit.do/TAadvice । গ্রেট ওশেন রোড হয়ে মেলবোর্ন থেকে এডেলেড এর আমার গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ৯৬৮ কিলোমিটার; গুগল ম্যপে যা এইরকম - http://bit.do/GORdrive । লিস্টে নিয়েছি বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। এ পুরো যাত্রা সম্পন্ন করার জন্য দু রাত তিন দিন প্রয়োজন হবে। দু রাত কাটানোর জন্য হোটেল ও যাত্রার মাসখানেক আগেই বুকিং দিয়ে দিলাম। অনলাইনে হোটেল বুকিং দেয়ার জন্য আমার প্রিয় সাইট www.booking.com অনেকদিন ধরেই এই সাইট আনন্দের সাথে ব্যবহার করে আসছি, কখনো কোন সমস্যা হয়নি। প্ল্যান তো হল তো এবার চলে যাই মূল ভ্রমণে। এই লিখাটি যেহেতু গ্রেট ওশেন রোডে যাত্রা নিয়ে তাই অস্ট্রেলিয়া পৌঁছানো, মেলবোর্নে বা অন্য স্টেটে ঘোরাঘুরি এখানে আনছি না। কখনো সময় পেলে তা নিয়ে লিখা যাবে।
২০ এপ্রিল ২০১৫ দুপুর ১ টা
অফিশিয়াল প্রসেস শেষ করে হার্টজ (গাড়ি ভাড়া দেয়ার প্রতিষ্ঠান) থেকে গাড়ী নিয়ে কতক্ষণ ঝিম বসে থাকি ড্রাইভিং সিটে। গত ক’দিনের মেলবোর্ন অভিজ্ঞতা বলে, এখানে গাড়ি চালানো আসলেই খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষত অনভিজ্ঞ চালকের জন্য। যদিও এ ক’দিনে সময় পেলেই ঘণ্টা দুয়েকের বেশ কিছু লার্নিং ভিডিও দেখে নিয়েছি কিন্ত পুরো আত্মবিশ্বাসটা পাচ্ছিলাম না। দুরু দুরু বুকে ইঞ্জিন স্টার্ট করে উঠে এলাম রাস্তায়। ভাবছিলাম মেলবোর্ন শহরটা ঝামেলাহীন পেরোতে পারলেই হয়। একবার হাইওয়েতে উঠে গেলে আর সমস্যা নেই। এর মধ্যে প্ল্যান থেকে ছিটকে গেছে তিন ঘণ্টা। প্ল্যান ছিল দশটায় বের হওয়ার। যাই হোক, হোটেল থেকে লাগেজ এবং স্ত্রী-পুত্রদের তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। মুঠোফোনে জিপিএস রাস্তার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতি “স্প্লিট পয়েন্ট লাইট হাউজ”। শুধু একবার রাস্তা মিস করা আর একটা গিভ ওয়ে রুলস ভুল; এ দুটো বাদে কোন বড় ঝামেলা ছাড়াই গাড়ি যখন শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠে পড়েছে তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। গাড়ি তখন জিলং বে এয়ারপোর্ট হাইওয়ে ধরে ছুটছে।
স্প্লিট পয়েন্ট লাইটহাউজঃ
১২৪ কিমি রাস্তা পাড়ি দিয়ে প্রায় দু’ঘন্টা পর যখন আমরা স্প্লিট পয়েন্ট লাইটহাউজ পৌঁছাই তখন তিনটে বেজে গেছে। ছোট্ট শহর এইরেস ইনলেট এ অবস্থিত এ লাইটহাউজ টি খুবই জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট। লাইটহাউজ হিসেবে এটি বেশ সুন্দর স্থাপনা; ধবধবে সাদা টাওয়ারের চুড়ায় লাল টুপির আচ্ছাদন। আবার এখান থেকে সমুদ্রের খুব ভালো ভিউ পাওয়া যায়। যখন পৌঁছেছি, পর্যটক নেই বললেই চলে। কারণটা তখন বুঝিনি কিন্ত এখন লিখার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি এ লাইটহাউজ প্রতিদিন গাইডেড ট্যুর চালায় অর্থাৎ এর চুড়ো পর্যন্ত উঠে চারদিকের দৃশ্য উপভোগের সুযোগ দেয়। কিন্ত এর শেষ ট্যুর শিডিউল দুপুর দুটোয়। সে জন্যই দুটোর পর সাধারণত পর্যটক আসে না। বড় ধরণের একটা মিস হয়ে গেল। ছোটবেলায় রাশিয়ার রাদুগা প্রকাশন এর বাংলায় অনুবাদ হওয়া কোন এক গল্পের বইতে একটা গল্প (নামটা এখন মনে নেই) পড়েছিলাম যেখানে এক কিশোর এক লাইটহাউজের গার্ডের সাথে সখ্য পাতিয়ে চুড়ায় উঠে দেখতে চাইত। লাইটহাউজ সে কিশোরের কাছে ছিল অপার রহস্যে ঘেরা দূর্গ। সে গল্প থেকে লাইটহাউজে ওঠে রাত কাটানোর একটা স্বপ্ন গেঁথে গিয়েছিল। অনন্য অসাধারণ সেই রাদুগার বইগুলো পড়ার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তারা জানেন কৈশোরকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পারে বইগুলো। লাইটহাউজ ঘিরে কিছু ছবি নিচে -
ছবি – স্প্লিট পয়েন্ট লাইটহাউজ
ছবি – লাইটহাউজ লুকআউট ভিউ
ছবি – লাইটহাউজ লুকআউট, মহাসমুদ্রের অপার সৌন্দর্যে বিস্মিত
ঘোরা আর ছবি তোলা পর্ব শেষ হলে পর গাড়িতে ফিরে এলাম। স্ত্রী হোটেলের রান্নাঘর থেকে কিছু খাবার রান্না করে এনেছিল। তা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেয়া হল। এ প্রসঙ্গে স্ত্রী পুত্রদের কথা কিছু বলি। আমার স্ত্রী ভ্রমণের জন্য দারুণ এক সহযাত্রী। ছেলেদের খাওয়া, বাথরুম করানো থেকে ব্যাগ গুছানো পর্যন্ত সেরে নিজেকে গুছিয়ে ঠিক সময়মত তৈরী হয়ে যায়। যে জন্য আঁটসাঁট শিডিউলেও আমার প্ল্যানমাফিক ট্যুর শুরু থেকে শেষ করে আনা সম্ভব হয়। আমার দুই ছেলেও ভ্রমণপ্রিয় এবং দারুণ কো-অপারেটিভ। ক্লান্তিতে বিরক্ত হয় না কিংবা ভ্রমণে আব্দার করে কখনো যাত্রা ব্যহত করে না। এরকম সহযাত্রী না পেলে তিন দিনের এ ধরণের একনাগাড়ে ভ্রমণ করা দুঃসাধ্য হত। যা হোক, দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য “টেডিস লুক আউট”।
টেডিস লুকআউটঃ
সাগর পাড় ধরে প্রায় বিশ মিনিট ড্রাইভ করার পর আমরা পৌঁছালাম ছোট্ট শহর লরনে’র দক্ষিণে টেডিস লুকআউটে। সি-লেভেল থেকে বেশ খানিকটা উপরে এটি একটি দৃষ্টিনন্দন লুকআউট যেখান থেকে সাগর, গ্রেট ওশেন রোড এর অংশবিশেষ দেখা যায়। এর অন্য পাশে পাহাড়। এখানে আসার আরেকটি কারণ এর গাছে নাকি অনেক কোয়ালা (অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম প্রাণী, ক্যঙ্গারুর পরেই এর অবস্থান) দেখা যায়। গাছে গাছে অনেক উঁকিঝুঁকি দিয়েও দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একটিরও দেখা পেলাম না। আলো কমে আসছিল। তাই আমরা খুব বেশী সময়ক্ষেপণ না করে গাড়িতে চড়ে বসলাম।
ছবি – টেডিস লুকআউট
আজকের শিডিউলে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী তৃতীয় গন্তব্য বিখ্যাত “টুয়েলভ এপোস্টেলস”। এ দেখার আদর্শ সময় নাকি সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়। তাই প্ল্যান ছিল ওখানে সূর্যাস্ত দেখে প্রথম রাতের হোটেলের পথ ধরব। কিন্ত যেখানে আছি সেখান থেকে “টুয়েলভ এপোস্টেলস” আরও একশত সাত কিলোমিটার দূরে। আর তা থেকে হোটেল আরও চূয়াত্তর কিলোমিটার। দেখা যাক কি হয় এ চিন্তা করে রাস্তায় নেমে পড়লাম। তখনো জানতাম না কি বিপত্তি অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
জঙ্গলের পথেঃ
সাগরের পথ ধরে ফুরফুরে মেজাজে এগিয়ে চলেছি আমরা। উপভোগ করছিলাম হেয়ারপিন বেন্ড (চুল বাঁধার পিনের মত বাঁক) ধরে ড্রাইভিং, একপাশে সবুজ আরেক পাশে নীল। কতক্ষণ ধরে চালাচ্ছি ভুলে গেছি। প্রায় হঠাৎ করেই রাস্তা সাগর ছেড়ে সবুজ অরন্যে মোড় নিল। আর প্রায় তখনই কোত্থেকে যেন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল। রাস্তার পাশে সাইনবোর্ডে দেখলাম আমরা বিশাল গ্রেট ওটওয়ে ন্যাশনাল পার্কের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। সাথে রয়েছে নির্দেশনা সাবধানে চালানোর; যে কোন সময় বন্যপ্রাণী প্রধাণত ক্যাংগারু রাস্তায় চলে আসতে পারে। যতদূর দেখা যায় নিকশ কালো। পুরো জঙ্গলে যেন আমরাই একমাত্র বহিরাগত। সামনে পেছনে যতদূর দেখা যায় কোন গাড়ি কিংবা জন-মানুষের দেখা পাচ্ছিনা। বুঝে গেলাম আজ আর টুয়েলভ এপোস্টেলস দেখা সম্ভব না বরং হোটেলের রাস্তা ধরি। এখন যেখানে আছি তা থেকে আরও অন্তত দেড়শ কিমি দূর। জিপিএস এ গন্তব্য বদলিয়ে হোটেল সেট করতে সেলফোন হাতে নিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক নেই। ফোনে দুটো সিম কার্ড ছিল। একটা রোমিং আরেকটা লোকাল। এতক্ষন পর্যন্ত পুরো যাত্রাপথে মাঝে মাঝে একটা বিচ্ছিন্ন পেলেও আরেকটা (টেলস্টার – যার কাভারেজ অস্ট্রেলিয়ায় সবথেকে বেশী) সব সময়ই পাচ্ছিলাম। কিন্ত এই জঙ্গলে দুটোই উধাও। নেটওয়ার্ক নেই মানে জিপিএস এ গন্তব্য বদলানো সম্ভব না। আপাতত সেট করা জায়গাতেই যেতে হবে। হঠাৎ চিন্তা হল এই অবস্থায় যদি কোন একটা বিপদ ঘটে তাহলে তো কাউকে ফোন করে জানাতেও পারব না। ক্রাইম রেট এই উন্নত দেশে অনেক কম হবে নিঃসন্দেহে কিন্ত একেবারে হয় না তা দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না। কিংবা খানাখন্দে পড়ে বা যে কোন কারণে গাড়ি বিগড়ে বসল; তাহলে কি হবে। এই জনমানবহীন স্থানে কে উদ্ধার করবে। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি নেমে গেল। এতক্ষণে মনে পড়ল আমার ট্রিপএডভাইজর এর আলোচনায় সবাই বারবার সতর্ক করেছিল সন্ধ্যার পর গাড়ি না চালানোর। খুব সম্ভবত সে কারণেই আর কোন গাড়ি দেখতে পাচ্ছিনা। যা হোক, ফেরার পথ তো আর নেই। এভাবেই যেতে হবে দেড়শ কিলো। গাড়ীর গতি লিমিটের চেয়েও খানিক বাড়িয়ে চললাম। এ জঙ্গল থেকে বেরোতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। এতক্ষণ পর্যন্ত যা উচ্ছ্বাস ছিল সবার তা থেমে গেল। সবাই নিশ্চুপ। স্ত্রী একদৃষ্টিতে সামনের দিকে উৎকণ্ঠিত চোখ রেখে যাচ্ছিল। আমিও মাঝে মাঝে হাই বিম দিয়ে রাস্তার বাঁক বুঝে বুঝে চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা বাঁক পার হয়ে দূরে আলো পড়তেই দেখি প্রায় দুশো ফুট দূরে একেবারে রাস্তা মাঝ বরাবর থমকে দাঁড়িয়ে দুটো পা। ভয়ে স্ত্রী অস্ফুটে ডাক দিল। চারদিকের নিকশ কালোর মাঝে এ কি মানুষ না প্রাণী বোঝা যাচ্ছে না। তাৎক্ষনিক ভাবে মাঝারী ব্রেক কশে গতি অর্ধেকে নামিয়ে আনলাম কিন্ত মাথায় চিন্তা চলছিল যদি মানুষ হয় তবে থামাটা কতটুকু যৌক্তিক। হাই বিমে আলো ছুঁড়লাম। চোখে আলো পড়া মাত্রই দেখি পা দুটো লাফিয়ে পাশের জঙ্গলে হারিয়ে গেল। পরিস্কার দেখা গেল না কি কিন্ত লাফানোর ভঙ্গীতে বুঝলাম ক্যাঙ্গারু। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান এ সব ঘটে গেল। স্বস্তির হাসি হাসলাম। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি নিশ্চিত ভূত প্রেত কিছু ভেবেছিলে। উত্তরে বলল, এই বনে ওটা ভাবা কি ভুল। যাই হোক, এভাবে প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পর বন শেষ হয়ে গিয়ে দুদিকে বিস্তৃত দুটো রাস্তা এল। জিপিএস এর উপর ভরসা না করে ভাবলাম কাউকে জিজ্ঞেস করি কোন পথে যাব। গাড়ি রাস্তার একপাশে সাইড করে দাঁড়ালাম। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ি কোন ধরণের ইশারা দেবার আগেই পেছনে এসে থামল। গাড়ি থেকে না নেমে অপেক্ষায় রইলাম দেখি আগে তাদের উদ্দেশ্য কি? মিনিটখানেক পর গাড়ির উপরে-পাশে নানান ধরণের বাতি জ্বলে উঠল। বুঝলাম পুলিস। এতক্ষণ ইচ্ছে করে লাইট অফ রেখেছিল। যাক একটু ভরসা পাওয়া গেল। একটু পরেই অফিসার নেমে এসে বলল – “গাড়ি সাইড কর”; এই বলেই আমার কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। ভাবলাম আমি তো সাইডেই আছি, সামান্য একটু বাইরে। সাথে সতর্কতাসুচক ইন্ডিকেটর জ্বালানো। এই রাতে কোন গাড়িও দেখছিনা যে এক্সিডেন্ট করবে। যাহোক আরও সাইড করে তার অপেক্ষায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর আবার এসে বলল, “এটা সাইড হয় নি, পুরোপুরি সাইড কর”। বলেই আবার উধাও। এবার মনে হল, এ তো নতুন যন্ত্রণা, কাগজপত্র চেক করবে নাকি? যা হোক গাড়ি রাস্তা থেকে পুরোপুরি নামিয়ে দিলাম। লাইসেন্স আর পাসপোর্ট হাতের কাছে নিয়ে তার অপেক্ষায় বসে রইলাম। আমার শুধু জানা দরকার ওয়ার্নাম্বুল কোন পথে, এতটুকুই ব্যস। মিনিট দুয়েক পর আর ফিরে না এসে সে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। যাব্বাবা, অদ্ভুত পুলিস তো! এই জনহীন জায়গায়, দুটো ছোট বাচ্চা নিয়ে একটা পরিবার ইন্ডিকেটর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অথচ একবার জিজ্ঞেসও করলনা, তোমাদের কি কোন সাহায্য দরকার! এর মধ্যে স্ত্রী বলল ছোট ছেলেকে বাথরুমে নেয়া দরকার। নিজের উদ্ধার নিজেকেই করতে হবে। গাড়ি একটু এগিয়ে এসে একটা বন্ধ রেস্টুরেন্ট পেলাম। নেমে গিয়ে উঁকি দিয়ে কাউকেই পেলাম না। হঠাৎ স্ত্রীর নজরে এল দূরে রেস্টরুমের সাইন। বললাম দ্রুত বাচ্চার বাথরুম সেরে আনতে। এ জায়গায় বেশীক্ষণ দাঁড়ানো নিরাপদ ভাবছিনা। ওরা বাথরুম থেকে ফিরতে ফিরতেই আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে পথ জেনে নিলাম। তারপর আবার যাত্রা। বাকী পথে আরও তেমন সমস্যা হয় নি। হোটেলের কাছাকাছি এসে নেটওয়ার্ক ও এসে গেল। জিপিএসে লোকেশন ঠিক করে হোটেলে যখন পৌঁছেছি তখন রাত নয়টা পার হয়ে গেছে। আবার সকাল দশটার মধ্যে পথে নামতে হবে। কাছাকাছি একটা ফাস্টফুড থেকে খাবার এনে খেয়ে এক রাশ ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
২১ এপ্রিল ২০১৫ সকাল ১০ টা
সময় ঠিক রেখে পড়িমরি করে বেরিয়ে পড়লাম। এ আরেক ঝক্কি। এক রাতের জন্য টেনেহিঁচড়ে সব লাগেজ নামাও, রুমে নাও, খোল, আবার পরদিন সব গুছিয়ে গাড়িতে তোল। যা হোক আগেরদিনের গন্তব্য টুয়েলভ এপস্টেলস মিস করায় পুরো চুয়াত্তর কিমি আবার ফিরে যেতে হচ্ছে। ওটা দেখে শেষ করে আবার একই পথে ফিরে আসতে হবে। অর্থাৎ দেড়শ কিমি বাড়তি চালাতে হবে মূল প্ল্যান থেকে। সকালের ঝিরঝির হাওয়ায় আগের দিনের ক্লান্তি কেটে গেছে সবার। গলা বাড়িয়ে উপভোগ করছি রাস্তার দুপাশের সবুজ। কিছুদুর পরপরই মাঠ ভর্তি গরুর পাল চরে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে গ্রেট ওশেন রোড ধরে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
টুয়েলভ এপোস্টেলসঃ
পোর্ট ক্যম্পবেল ন্যশনাল পার্ক এর সাগর পাড়ে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা চুনাপাথরের বারটি খাড়া ছোট পাহাড় সদৃশ অবয়ব হল এই টুয়েলভ এপোস্টেলস। দক্ষিণ মহাসাগরের প্রতিকূল আবহাওয়ায় লক্ষ বছরের ধীরে ধীরে সৃষ্টি এই অবয়বসমূহ। এরা এক সময় ৭০ মিটার লম্বা মূল ভূমির অংশ ছিল। প্রচণ্ড বাতাস আর স্রোতে ধীরে ধীরে দূর্বল জায়গাগুলো ক্ষয়ে যেতে যেতে প্রথমে গুহাসদৃশ আকার ধারণ করে। তারপর আরও ক্ষয় হয়ে এদের এখন সাগর ফুঁড়ে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব বলে ভ্রম হয়। চুনাপাথরের এই গঠনসমূহ এখনো প্রতি বছর দু সেন্টিমিটার করে ক্ষয়ে যাচ্ছে আর ফলশ্রুতিতে ভেঙ্গে পড়ছে। এখন পর্যন্ত টিকে আছে আটটি। দক্ষিণ মহাসাগরের পাড় ধরে এদের পরাবাস্তব সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছর লক্ষ পর্যটক ভিড় জমায়। পাড় ঘেঁষে অনেকটা অংশে হেঁটে হেঁটে উপভোগ করার জন্য রেলিং ঘেরা সরু রাস্তা করা আছে। এটাই গ্রেট ওশেন রোড এর সবচাইতে আকর্ষণীয় স্পট হিসেবে বিবেচিত। ঘুরেফিরে অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম গাড়িতে। পরবর্তী গন্তব্য ৯০ কিলোমিটার দূর।
ছবি – টুয়েলভ এপোস্টেলস এর দুটো এপোস্টেলস
ছবি – হেঁটে দেখার ব্যলকনি
ছবি – অন্য অবয়বগুলো
টাওয়ার হিল ওয়াইল্ডলাইফ রিজার্ভঃ
প্রিন্সেস হাইওয়ে ধরে ওয়ার্নাম্বুল হয়ে পোর্ট ফেয়ারীর পথে দক্ষিণ পশ্চিম ভিক্টোরিয়ায় এ দর্শনীয় স্থানটির অবস্থান। প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগের অগ্নুৎপাত থেকে “মার(maar)” জ্বালামুখ এর সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয় আর এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠে টাওয়ার হিল। জ্বালামুখ টি এখন মৃত বলেই যদিও জানা যায় তথাপি অনেক জায়গায় এমনকি উইকিতেও একে সুপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভূ নির্গত উত্তপ্ত লাভা বা ম্যগমা যখন সমতলের পানির স্পর্শে আসে তখন তা থেকে প্রকান্ড বিস্ফোরণে যে জ্বালামুখ তৈরি হয় তাকে বলে “মার”। ছাই আর লাভা ধীরে ধীরে জ্বালামুখ ঘিরে স্তরে স্তরে বসে গিয়ে রিং আকৃতি ধারণ করে। তার মাঝে পানি জমে হাজার বছরে এ এখন লেকের আকার ধারণ করেছে। তাই আগে থেকে না জানলে জ্বালামুখের ব্যপারটা বোঝার উপায় নেই, সাধারণ একটি লেক হিসেবেই ধরে নিতে পারেন যে কেউ। পর্যটকদের জন্য এখানে একটি সেন্টার আছে যারা গাইডেড ট্যুর অফার করে। নিজেদের মত করে ঘুরেফিরে দেখার জন্য বেশ কয়েকটি দাগাঙ্কিত পথ রয়েছে। এ পথ ধরে কেউ চাইলে জ্বালামুখ টি চক্কর দিয়ে আসতে পারেন। লক্ষ্যাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ ও গাছ লাগানো হয়েছে এ রিজার্ভে। রয়েছে কোয়ালা, এমু আর ওয়ালাবি র মত প্রাণীদের অবাধ বিচরণ। এখানেই আমরা প্রথম কোয়ালার দর্শন পাই। সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ায় আমরা নিকটতম পথে জ্বালামুখ দেখে ফিরে আসি।
ছবি – টাওয়ার লেক হিল এর জ্বালামুখ
প্রিন্সেস হাইওয়ে ধরে ১৭০ কিলোমিটার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মাউন্ট গ্যম্বিয়ার। সেখানেই রাত্রিযাপন। এছাড়াও সেখানে আশেপাশে দর্শন তালিকায় আছে ৩টি স্পট। মাউন্ট গ্যম্বিয়ারে যখন পৌঁছেছি তখনো দিনের আলো ফুরিয়ে যায় নি। হাতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে। তাই সরাসরি হোটেলে না গিয়ে চলে গেলাম প্রথম দর্শনীয় স্থানে।
উম্ফার্স্টন সিঙ্কহোলঃ
সিঙ্কহোল আমরা সবাই দেখি আমাদের রান্নাঘর কিংবা স্নানঘরের বেসিনে। মাঝের ছিদ্র দিয়ে পানি বেগে বেরিয়ে যায়। প্রকৃতিতে সিঙ্কহোল গুলো সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক ভাবে ভূমিস্তর এর ক্ষয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। এ হতে পারে বিবিধ কারণে। উম্ফার্স্টন সিঙ্কহোল এক সময় ছিল চুনাপাথরের গুহা যা কিনা চুনাপাথরের ভূমিতে সাগরের ঢেউ দ্বারা ক্রমাগত ঘর্ষণে অনেক বছর ধরে উদ্ভব হয়। এ গুহার উপরের স্তর এক সময় ধ্বসে পড়ে এ সিঙ্কহোলের সৃষ্টি। ১৮৮৬ সালে জেমস উম্ফার্স্টন এতে নানাবিধ ফুলের গাছ, ঝুলন্ত পাতাবাহার, ফার্ন লাগিয়ে একে বাগানের রূপ দেন। আর তাই এখন এটি ডুবন্ত বাগান নামেও পরিচিত। দর্শনার্থীদের জন্য এটি উন্মুক্ত। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পুরো সিঙ্কহোল টি ঘুরে উপভোগ করা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ছবি – উম্ফার্স্টন সিঙ্কহোল
ব্লু-লেকঃ
সিঙ্কহোল দেখে উঠে এসে দেখি আরো আধ ঘন্টা বা তার কিছু বেশী সময় হাতে রয়েছে অন্ধকার হয়ে আসতে। কাজেই সামান্য দূরত্বে ব্লু লেক দেখে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। ব্লু লেক আক্ষরিক অর্থেই ব্লু। সেরকমটাই জেনে এসেছি। এর কারণেই এ লেক মাউন্ট গ্যম্বিয়ারের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। গ্রীষ্মে (ডিসেম্বর থেকে মার্চ) এটি গাড় নীল বর্ণ থাকে। এপ্রিল শুরু হতে এটি খানিক ঠান্ডা ধাতব বর্ণ নিতে শুরু করে। আর যখন আমরা দারুণ ঠাণ্ডা সন্ধ্যের বাতাস কাটিয়ে লেকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তখন তা আলোর স্বল্পতায় কালচে বর্নে দেখা দিয়েছে। খানিক মন খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম সুযোগ পেলে পরদিন সকালে আরেকবার এসে দেখে যাব কিন্ত সময় স্বল্পতায় তা আর হয়ে ওঠেনি। যা হোক, এ নীল বর্নের ও ব্যখ্যা আছে। মাউন্ট গ্যাম্বিয়ার এ চারটি মৃত জ্বালামুখ হ্রদের ব্লু লেক একটি। চারটির মধ্যে দুটো শুকিয়ে গেছে। যে দুটো আছে তার মধ্যে এটি একটি মনোমিক্টিক লেক। ধরণীতে চার ধরণের লেক রয়েছে। তার মধ্যে হলোমিক্টিক লেক এর একটি উপশাখা হল মনোমিক্টিক লেক। উষ্ণ মনোমিক্টিক লেকে গ্রীষ্মে উপরের পানি নিচের অংশের সাথে মেশে না কিন্ত শীতে উপর এবং নিচের স্তরের পানির তাপমাত্রা খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। আর তাই শীতে সব স্তরে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। গ্রীষ্মে উপরের স্তরের জৈব-রাসায়নিক পরিবর্তন, সূর্যের অবস্থান আর উদ্ভিজ ক্রিয়াই এ লেকের নীল বর্নের রহস্য। এ লেক শহরের খাবার পানির উৎসও বটে। যাহোক গাড় নীলের দর্শন না পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে “ইকোনো লজ” – আমাদের আজকের রাত্রিযাপন স্থলে পৌছালাম। হাতে বেশ কিছু সময় ছিল সন্ধ্যের খাবারের। লাগেজ নামিয়ে, ফ্রেশ হয়ে তাই খুঁজে বের করলাম ভারতীয় রেস্তোরাঁ। ক’বেলা ভাত খাইনি তাতেই মনে হচ্ছিল কত বছর খাইনি। ভরপেট খেয়ে এসে ঘুম।
ছবি – ব্লু লেক
২২ এপ্রিল ২০১৫ সকাল ১০ টা
নাস্তা করে লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে আবার পথে নেমে পড়েছি। ক্লান্তির ছোঁয়া দেখছিনা কারো মধ্যেই। আমার আর স্ত্রীর একঘেয়ে চাকুরিজীবন আর বাচ্চারা স্কুলের পড়াশোনার মধ্যে বেশ অনেক বছর একসাথে ঘোরা হয় না। সবাই তাই বেশ উদ্যম ধরে রেখেছে। সাথে আছে প্রতিদিনের নতুন নতুন স্বাদের স্পট, সবুজ মোহময় রাস্তা, দিগন্ত জুড়ে বিশাল আকাশ, পাইন গাছের সারি, ছোট ছোট শহর পেরুনো, স্মৃতি হাতড়ে মাঝেমাঝে নিজেদের গল্পগুলো বের করে আনা।
টানটানুলা গুহাঃ
আজকের প্রথম স্পট “টানটানুলা” গুহা, শহর থেকে আধ ঘণ্টার দূরত্বে। টিকিট করে অপেক্ষায় রইলাম গাইডের। অস্ট্রেলিয়ার বেশীরভাগ দর্শনীয় স্থানে যেখানেই টিকিট কাটতে হয় সেখানেই দেখেছি যে, জনপ্রতি টিকিটের পাশাপাশি বেশ খানিকটা ছাড়ে ফ্যামিলি প্যাকেজ (১০ বছরের উর্ধে দু’জন আর নিচে দু’জন) থাকে। সন্তান নেয়াকে উৎসাহ দানেই সম্ভবত এটা রাষ্ট্রের এক ধরণের সমাজকল্যাণমূলক পলিসি। যাহোক, গাইড ভদ্রমহিলা পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন গুহামুখে। বেশ দীর্ঘসময় ধরে বর্ননা দিলেন এর আবিষ্কার আর উদ্ভবের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ। এক চেম্বারবিশিষ্ট মাঝারি গুহা এটি। গল্প আছে ১৯৩০ সালে এক বালকের পোষা ফেরেট (দু ফুট দীর্ঘ ভোঁদড় সদৃশ এবং একই গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী) একটি গর্তে ঢুকে পড়ে। সেটিকে খুঁজতে গিয়েই বালক আবিষ্কার করে এই গুহা। ধারণা করা হয় সমুদ্রের স্রোত আর প্রচণ্ড বাতাসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে এ গুহার সৃষ্টি। ধীরে ধীরে সমুদ্র হয় দূরে সরে যায় কিংবা ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনে ভূমির উচ্চতা বেড়ে এ স্থান এখন সমুদ্র থেকে বেশ দূরে। ডলোমাইট (এক ধরণের কার্বনেট খনিজ) বৃষ্টির পানির সংস্পর্শে উপর থেকে চুইয়ে পড়ে ধীরে ধীরে স্ট্যলেগটাইট আর স্ট্যলেগমাইট এর বিভিন্ন আকৃতির কলাম গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে এ গুহায়। বাদামী, ধূসর, সাদা রঙের বর্নিল গঠনে গুহাটিকে করে তুলেছে অপার্থিব সুন্দর। গাইডের বর্ননা শেষে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, প্রয়োজনমত ছবি তুলে নিলাম। শুধু গাইডের নির্দেশমত ছুঁয়ে দেখা থেকে বিরত থাকতে হল। এবার আবার গাড়িতে ফেরার পালা। যাত্রাপথে পরবর্তি এবং শেষ দর্শনীয় স্থান আরেকটি গুহা।
ছবি – টানটানুলা গুহা
নারাকোর্টে গুহাঃ
এক ঘণ্টা গাড়ী ভ্রমণের পর আমরা পৌঁছাই নারাকোর্টে গুহায়। জিপিএস ধরে গন্তব্য চিনতে সাময়িক সমস্যা হয় এখানে। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে জিপিএস আমাদের মূল রাস্তা থেকে পাথুরে রাস্তায় নিয়ে যায়। তা ধরে প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার চলার পর যখন লোকবসতি বা কোন স্থাপনার অস্তিত্ব পাই না তখন আবার মূল রাস্তায় ফিরে এসে রাস্তায় কর্মরত একজনকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা চিনে নেই। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত “নারাকোর্টে কেভ ন্যাশনাল পার্ক” প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়ানো মোট ২৬ টি গুহার সমষ্টি। এটি বিশ্বের অন্যতম ফসিল সাইট হিসেবেও গুরুত্ব পেয়েছে। দশ লক্ষ বছর পূর্বে এ গুহায় বাসা বেঁধেছিল শিকারি প্রাণী। গুহার ফাঁক গলে শিকার নিচে আটকে গেলে তার ভোজ লাগাত এরা। গুহায় আবিষ্কৃত স্তরে স্তরে চাপা পড়া হাড়গোড় এ গুহাগুলোকে করেছে সমৃদ্ধ। পেলেওন্টোলজিস্টরা (ফসিল বা জীবের বিবর্তন নিয়ে যারা গবেষণা করেন) বেশ কিছু হাড়গোড় জোড়া দিয়ে বের করে এনেছেন তার আকৃতি। ২৬ টি গুহার মধ্যে মাত্র চারটি সাধারণের জন্য উন্মুক্ত, বাকীগুলো শুধুমাত্র বিজ্ঞানী বা গবেষকদের কাজের জন্য। এ চারটি দেখতে হলে গাইডেড ট্যুরের প্যাকেজ কিনতে হয় আর সে ট্যুরও বেশ দীর্ঘ। আমাদের শেষ গন্তব্য অর্থাৎ এডেলেড এ পৌঁছাতে আরও বাকি সাড়ে তিনশো কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার ড্রাইভ। দু’দিন আগের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাস্তায় নেমে পড়াটাই সমীচীন ভেবে আমরা গাইডেড ট্যুর এর টিকিট নিলাম না, নিলাম নিজের মত ঘুরে বেড়ানোর টিকিট। খরচও কিছুটা কম। কিন্ত ঘুরতে গিয়ে দেখি এ টিকিটে শুধু একটা গুহায় ঢোকার সুযোগ আছে, বাকী তিনটিতে শুধুমাত্র গাইডেড ট্যুরেই ঢোকা যায়। কিছুটা বিরক্ত ও হতাশ হলাম। এ তথ্যটি কাউন্টারে বলেনি। চারটি গুহা প্রত্যেকটির আলাদা নাম রয়েছে। আমরা যেটিতে ঢুকতে পেরেছিলাম সেটির নাম এখন আর মনে নেই। গঠনের দিক থেকে এটি টানটানুলার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন।
ছবি – নারাকোর্টের প্রবেশমুখ
ছবি – পার্কে দুপুরের খাবার
গুহা ঘুরে এসে গাড়ি থেকে বের করে নিলাম দুপুরের খাবার। সামান্য রুটি, জ্যাম, কলা আর ছোট ছেলের জন্য ফ্রায়েড রাইস। গাছতলায় টেবিল চেয়ার পাতা আছে দর্শনার্থীদের জন্য। প্রকৃতির মাঝে উদরপূর্তি সেরে যাবার জন্য রওনা হলাম। পৌঁছাতে হবে আরেক স্টেট এ যেখানে আমাদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন বন্ধু পরিবার। পথযাত্রা শেষের সাথে আমাদের এ ক’দিনের যাযাবর জীবনের সমাপ্তি। বিদায় জানাতে হবে ছোট্ট লাল গাড়িটিকে যা আমাদের সঙ্গী হয়ে ছিল পুরোটা সময়।
মন্তব্য
দেশের চৌষট্টি জেলার ষাটটিই ঘোরা হয়েছে, তবে কখনো দেশের বাইরে যাওয়া হয় নি। ভিনদেশি ভ্রমণকাহিনী তাই বরাবরই ভাল লাগে। আপনার সম্ভবত ভ্রমনের অভিজ্ঞতা কম নয়। লেখা চালিয়ে যান, দারুণ হয়েছে!
রূপালি সিংহ
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আমার খুব বেশী তা বলব না তবে ইচ্ছেটা অনেক। সময় করে ওঠাই মুশকিল। আমার আফসোস দেশেই অনেক জায়গায় যাওয়া হয় নি, বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ। এখন ছুটিতে বাড়ি গেলে পরিবার, বন্ধু বা স্বজনদের সময় দিয়েই আর ঘোরা হয় না।
লিখা ভাল লেগেছে জেনে আনন্দিত ভাল থাকুন আর ঘোরাঘুরি চলুক।
মাকশুম
ভালো লেগেছে। আরো লিখুন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অনেক ধন্যবাদ নজরুল ভাই। লিখব আশা রাখি।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
লেখাটা ভাল লাগল। ছবি গুলো বড় সুন্দর।
------------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/2015/05/for-blogger-to-blogger.html
অনেক ধন্যবাদ। ছবিগুলো সব মুঠোফোনে তোলা। ক্যামেরাটা এ যাত্রায় ঝামেলা করছিল।
মাকশুম
কলেজের এক বন্ধু থাকে সিডনিতে।
রিসেন্টলি সচল 'রংতুলি' মুভ করেছেন অস্ট্রেলিয়া, জবর ছবিটবি দেখান।
এতো সুন্দর সব পাথুরে সি-বিচগুলোতে ঘুরছেন, আপনাদের হিংসা!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথীডোর, সচলে মাত্রই নিবন্ধন করলাম। আস্তে আস্তে পরিচয় করে নিব সবার সাথে। আমি অবশ্য এখনো পাড়ি জমাইনি অস্ট্রেলিয়ায়, তবে এক পা দেয়া আছে।
হিংসা দিয়েন না কইলাম বাঁচমু আর কয়দিন
ভালো থাকবেন।
মাকশুম
গুড জব মাকশুম! লেখা ভালো লেগেছে, ছবিও। নিয়মিত লিখুন ভ্রমণ নিয়ে বা অন্য কিছু নিয়ে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেক ধন্যবাদ ষষ্ঠ পাণ্ডব। লিখব আশা রাখি।
ভাল লেগেছে ভ্রমণ কাহিনী।
যারা ফোনের জিপিএস এর উপর ভরসা করেন তাদের জন্য আমার ছোট্ট পরামর্শ:
১। শুধু জিপিএস থাকলে সেটাও সাথে রাখা -এদের নেটওয়ার্ক সমস্য নেই
২। ফোনের জিপিএস অ্যাপ্লেকশনের জন্য অফলাইন ম্যাপ নামিয়ে রাখা। (যেমন, নোকিয়ার ফোনে HERE -এ অফলাইনে যেদিকে যাওয়া হবে সেদিকের পুরো ম্যাপ নামিয়ে রাখা।) তাহলে আর নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করতে হবে না।
শুভেচ্ছা
১। জিপিএস ভাড়া তিন দিনে বেশ কিছু ডলার চেয়েছিল হার্টজ। তাই নিই নি। সত্যি বলতে আমার ধারণা ছিল না অস্ট্রেলিয়ার মত জায়গায় কোথাও নেটওয়ার্কের সমস্যা হতে পারে। যেখানে আমাদের দেশেই এখন বঙ্গোপসাগরের মাঝখানেও নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
২। অফলাইন ম্যাপে কাজ করে এরকম এপস তার পরদিনই ডাউনলোড করে নিয়েছি যাতে এই বিপত্তিতে আর না পড়তে হয়
"অফলাইন ম্যাপে কাজ করে এরকম এপস" - কি এপস? আই ফোনে কাজ করবে সেটা?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এপস এর নাম নেভিগেটর। এটা এন্ড্রয়েড এবং উইন্ডোজ এ কাজ করে সম্ভবত। আই ফোনে করে না
লেখা, ছবি মিলিয়ে ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন