ধুর! তখন থেকে ওই বুড়োর দিকে নজর রেখেছে জলিল, বিরক্তি ধরে গেল প্রায়। কিন্তু বুড়োর চালচলনে কোনো পরিবর্তনের আভাস দেখতে পায় না ও। মাছটুকু কি বেচার ইচ্ছে নেই নাকি বুড়োর? মনে মনে বুড়োর উদ্দেশ্যে একটা গালি ছোড়ে জলিল। বাজারের এক পাশে এই টঙের উপর কি অল্প সময় বসে আছে ও? শুধু বসে থাকলেও হতো, বুড়োর মাছটুকুর দিকেও নজর রাখতে হচ্ছে না? অন্য সব মাছের যা দাম রে, ভাই! ওই সব মাছের দিকে তাকায় না জলিল, মিছিমিছি তাকিয়ে কীই বা হাতিঘোড়াটা হবে? বুড়োর ওই পাঁচমিশেলি ছোট ছোট মাছ, কেজিখানেকেরও কম আছে-তাও তিনশো হাঁকতে হাঁকতে শেষবার দু’শো চাইলো ওই প্যান্ট পরা দাঁড়িওলাটা লোকটার কাছে। ভাগ্যিস দাঁড়িওলা লোকটা মাছগুলো নিলো না। জলিল বসে আছে দামটা আরেকটু কমবে সেই আশায়। এখন প্রায় সন্ধ্যা, মাছের দাম কমবার সম্ভাবনা আছে আরও কিছু। কিন্তু তার আগেই যদি আর কেউ নিয়ে নেয়? চিন্তাটা এলেও তেমন পাত্তা দেয় না জলিল, কে নেবে আবার এই ‘সরা’ মাছ দু’শো টাকায়? আরেকটু পরে যাবে ও, দেড়শো টাকা বলবে, বুড়ো দিতে না চাইলে আরেকটু ঝুলোঝুলি, একশো ষাট-সত্তরে হয়ে যেতে পারে, আন্দাজ করে জলিল।
ট্যারা চোখে চারপাশটা দেখে জলিল, জরিপ করার মতো। এই সারিটা সব মাছওলাদের জন্য বরাদ্দ, মাংস বেচে পাশের সারিতে। শেষ বিকেল বলেই মাছ-মাংস তেমন কিছু একটা নেই দোকানিদের কাছে। বুড়োর পাশের দোকানির কাছে ইলিশের বাচ্চা আছে কয়েকটা, তার পাশেরজন নেই, ওপাশে কয়েকটা রুই কাতলা নিয়ে বসে আছে একজন। মানুষও তেমন নেই আজ বাজারে। ও পাশে সবজির দোকানগুলোতে তবু একটু আধটু বেচাকেনা চলছে। মাংসের দোকানগুলোর মধ্যে একটা মাত্র মাচানে গরুর দু’টুকরো ঠ্যাং ঝুলিয়ে ঝিমাচ্ছে দোকানদার, ঠ্যাং দুটো শুকিয়ে চিমসে হওয়ার দশা, তারই দাম নাকি সাড়ে তিনশো! জলিলের মাংস খাওয়ার সাধ নেই তাই, মাছটুকু নিয়ে গিয়ে বউকে আলু দিয়ে শুকনো মরিচ বেশি করে বেটে রাঁধতে বলবে। আম্মা যা ভালো রানত এই সালুন! ইস! আম্মাটা বিছানায় পড়ে আছে কতদিন হয়, রান্না দূরের কথা, বেশিক্ষণ বসেও থাকতে পারে না আজকাল। আম্মা খুশি হবে নিশ্চয়ই, কতদিন একটু ভালোমন্দ খাওয়াও হয় না আজকাল।
ভালোমন্দ একসময় রোজই খাওয়া হতো জলিলদের। এই বছরখানেক আগে ট্রাকের সাথে অ্যাক্সিডেন্টটা হলো, রিক্সাটা তো গেলই, নিজে কতদিন মেডিকেলে থেকে এলো জলিল। ইস! আর জীবনেও হাসপাতালে যাওয়ার ইচ্ছে নেই জলিলের। এখন আর ভারী কাজ করতে পারে না ও, পিঠের হাড়ে ব্যথা আছে, অনেকদিন নাকি থাকবে, বলেছে ডাক্তার। এ বাড়ি ও বাড়ি হালকা কাজ করে কত টাকাই বা আর রোজগার হয়? তবু তো মর্জিনা আজকাল কাঁথা সেলাইয়ের কাজটা করছে। ওই জন্যই না চলছে সংসারটা টেনেটুনে।
জলিলের চোখ বুড়োর দোকানে আরেকবার ঘুরে আসে। বিরক্ত মনে হয় এবার বুড়োটাকে, এই কয়টা মাছ বেচা হয়ে গেলেই চলে যায়, এদিকে কেউ আসছেও না আর কিনতে, পাশের দোকানিকে কী যেন একটা বলছে আস্তে করে। জলিল ভাবে, এটাই ভালো সময়, ধীরে সুস্থে চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে একটা হাই তোলে ও, ঘুম আসছে নাকি হে এই অসময়ে? এবার উঠতে যাবে আর তখনই ওর চোখে পড়ে বস্তুটা; হাত দুয়েক দূরেই, বিদ্যুতের লম্বা খুঁটিটার নিচে, একটা পাশ মাটিতে ঢেকে আছে, পুরোটাই হয়তো পাতা বা কাগজ বা আর কিছুতে ঢেকে ছিল এতক্ষণ, তাই দেখতে পায়নি ও। মাটি লেগে চকচকে ভাবটা নেই, একটা নোট, পুরো এক হাজারের নোট একটা! বিস্ফারিত চোখে দেখতে দেখতে জলিল একটা ঢোঁক গেলে। আশেপাশে তাকায়, না কেউ তাকিয়ে নেই ওদিকে, আসলে তেমন একটা কেউ নেইই তো এখানে। উঠে দাঁড়ায় ও, আবার চারপাশে তাকায়, দেখছে না কেউ। কাছে গিয়ে নিচু হয়ে টাকাটা তুলে নেয় ও, লুঙ্গিটা ঠিক করার ছলে গিঁটের ভিতর নোটটা ঢুকিয়ে ফেলে জলিল। বুড়োর কাছে মাছ নিতে যেতে গিয়েও যাওয়া হয় না আর। পা দুটো সরে না কিছুতেই। কিছুদিন আগে এই বাজারেই দেখা চোর পিটানোর দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে অকস্মাৎ। কী ভয়ঙ্কর! নোটটা কুড়ানোর আগে মনে পড়েনি কেন? ইস! অস্থির লাগতে থাকে জলিলের।
টাকাটা জলিল চুরি করেনি, ওকে কেউ কুড়িয়ে নিতেও দেখেনি কিন্তু তবু ওর বুকে কেমন শিরশিরানি ভয় জমে এবার। যদি টাকার মালিক ফিরে আসে আর ওকে দেখতে পেয়ে যদি সার্চ করতে চায়? যদি ওই বুড়ো বা আর কেউ দেয় বলে ও এখানে বসে ছিলো অনেকক্ষণ? জলিল এই সন্ধ্যাবেলার খোলা বাতাসেও কুলকুল করে ঘামতে থাকে। পিঠের ব্যথাটা হঠাৎ জানান দিয়ে যায় আরেকবার চিড়িক করে। নোটটা ফেলে দিতে গিয়েও পারে না ও, কেউ যদি দেখে তখন চোর সন্দেহ হবেই। আর তা হলে? না, আর কিছু ভাবতেও পারে না জলিল। শুধু জানে ও আর থাকবে না বাজারে। একটুও সময় নষ্ট করতে চায় না জলিল। বুড়োর মাছের দিকে একটিবারও না তাকিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় ও-মাছের দাম বুড়ো অনেক কম রাখবে এখন, ও জানে। কিন্তু থাক, কতদিন মাছ খাওয়া হয় না, আর একদিন না খেলে কীই বা এমন হবে? এই মুহূর্তে মাছটাছ সব বাদ হয়ে যায়, কেবল নিজের জীবনটাকে অমূল্য মনে হয় জলিলের।
দেবদ্যুতি
মন্তব্য
পদ্মা নদীর মাঝিতে না এমন একটা ঘটনা ছিল? কুবের রাতে ঘুমন্ত হোসেন মিয়ার পকেট মারার সময় কে যেন দেখে ফেলে? গোপী বোধহয়।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
গোপীই ছিল, মনে পড়ল ঘটনাটা। আপনার স্মৃতিশক্তি সাংঘাতিক, আগেই জানতাম, প্রমাণ পেলাম আবার
দেবদ্যুতি
আমার স্মৃতিশক্তি??? আস্তে কন, ঘুড়ায় হাসপে!!!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঘুড়ার সাথে আমার কী? স্মৃতিশক্তিই যদি না হবে তাইলে গোপীরে মনে আছে কী করে???? নাকি মতলব অন্য ছিলো তখন
দেবদ্যুতি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঘুড়া কেডা?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ইয়ে মানে লিখা এত ছুডু ক্যারে???
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ছুডুই তো ভালো! বড় লিখতে পেলুম না...
দেবদ্যুতি
হুট করে শেষ হয়ে গেলো মনে হল। মনে হচ্ছিল কোন টুইস্ট আসবে। কিন্তু এলো অন্যভাবে। খারাপ লাগে নি, আবার ঠিক আপনার মানের মনেও হয় নি। যাই হোক, গল্প লেখা চলতে থাকুক।
বানান পুলিশদের মন্তব্য বেশ কাজে লেগেছে দেখছি। বেশ বেশ। খুব ভালো।
____________________________
আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আপনি আমার লেখা কখনওই পড়েন না, প্রফেসর। আসলে কাল খুব করে একটা গল্প লিখতে মন চাচ্ছিলো আর মাছের দিকে নজর রাখার ব্যাপারটা গত পরশু বাজারে দেখেছিলাম চোখের সামনে। তো, অর্ধেক লিখে আর এগোতে পারছিলাম না সত্যি বললে, এইজন্য ব্যাপারটা এমন ছেঁদো হয়ে গেছে মনে হয়
দেবদ্যুতি
কেন পড়বো না! পড়ি সবার লেখাই, বিশেষ করে নতুনদের লেখা খুব আগ্রহ করে পড়ি। মাঝখানে অনেকদিন চরম ব্যস্ততার কারণে মন্তব্য করিনি কোন লেখাতেই। কিন্তু সচল পড়েছি নিয়মিত, ফাঁকে ফাঁকে। আর আমি নিতান্তই হেজিপেজি গোছের পাঠক। আপনি যে মনে রেখেছেন আমাকে, এতেই বুক ভরে গেলো খুশিতে।
ভালো লাগলো আপনি আপনার অবজারভেশনটাকে তুলে এনেছেন বলে। তবে না, ছেঁদো হয়নি মোটেও। ফিনিশিংটা পুরো তৃপ্তি দিতে না পারলেও ভালো হয়েছে।
____________________________
সুন্দর লেখা, সুন্দর বর্ণনা
সুন্দর লেখা, সুন্দর বর্ণনা
- উদ্দেশ্যহীন (আগের মন্তব্যে নাম দিতে ভুলে গেছিলাম )
বাহ্, এবার নামটা জানা গেল আপনার অনুবাদও অনেক সুন্দর।
দেবদ্যুতি
ছোট্ট ভাল।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
দেবদ্যুতি
অপেক্ষার প্রহর যেন খুব বেশি দীর্ঘ না হয়, প্রিয় লেখক, অনুরোধ থাকলো। অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
গৌতম হালদার
প্রিয় পাঠক, আপনার লেখা কই?
দেবদ্যুতি
নতুন মন্তব্য করুন