মানচিত্রের সন্ধানে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২০/০৭/২০১৫ - ৯:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তথ্যসংগ্রহের আর একটি দিক সম্পর্কে বলবো,যার আরম্ভ পলাশী যুদ্ধের মাত্র সাত বছরের মধ্যে।সেটি হচ্ছে মানচিত্র অঙ্কন।জাহাজ ভারতীয় উপকূলের বন্দরে পৌঁছানোর জন্য পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক থেকে য়ুরোপীয়রা অনেক মানচিত্র তৈরি করেছে ভারতীয় উপদ্বীপের,কিন্তু তাতে ভুলভ্রান্তি প্রচুর।জরিপের যন্ত্র উন্নত হতে অষ্টাদশ শতক থেকে মোটামুটি নির্ভুল মানচিত্র পেতে শুরু করি আমরা,জনক ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল এমন সব জাতি,যথা,পর্তুগিজ,ডাচ,ফরাসী—ইংরেজতো আছেই।উপকূলের ছবি ঠিক হলেও যে হেতু এদের দেশের অভ্যন্তরে জরিপের অনুমতি ছিল না,সেই ঘাটতি আন্দাজে পূরণ করতে হতো।

ভারতে চলে আসা চিরাচরিত পদ্ধতিতে ইংরেজ ভারত শাসন করতে চায়নি।পূর্বের পদ্ধতি ছিল সহজ,রাজ্যের সীমানা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলো,কৃষকদের খাজনা ও বণিকদের শুল্ক কী প্রকারে কতখানি বৃদ্ধি করা যায়,তার ফিকির দেখো,অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই।অপর দিকে,ইংরেজরা তাদের রাজত্বের শুরুতেই এই দেশটা সম্পর্কে জানা শুরু করে দিল।তা শুধু আয় বাড়ানোর উপায়ে সীমাবদ্ধ রইলো না,আগ্রহ প্রসারিত হলো আপাত-অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে,যথা,ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব,ধর্ম,গাছপালা,স্থলচর-জলচর প্রাণী থেকে কীটপতঙ্গ পর্যন্ত।এবং এইসব তথ্যসংগ্রহ হতে লাগলো সরকারি অর্থব্যয় করে।গেজেটিয়র তারই ফল।কী বিশাল কর্মযজ্ঞ,ভাবলে অবাক হতে হয়,সরকারি সর্বস্তরের কর্মচারীরা স্থানীয় তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছে,বিভিন্ন স্তরে সেই তথ্য ঝাড়াই-বাছাই হয়ে পৌঁছচ্ছে প্রধান সংকলকের কাছে—এবং পদ্ধতিটা ধারাবাহিক।ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশে স্থায়ী গেজেটিয়র অফিস আছে,এখনো এই পদ্ধতি জীবন্ত ও চলমান।
তবু এই কাজটি শুরু হতে হতে উনিশ শতক শুরু হয়ে গিয়েছিল,তথ্যসংগ্রহের আর একটি দিক সম্পর্কে বলবো,যার আরম্ভ পলাশী যুদ্ধের মাত্র সাত বছরের মধ্যে।সেটি হচ্ছে মানচিত্র অঙ্কন।জাহাজ ভারতীয় উপকূলের বন্দরে পৌঁছানোর জন্য পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক থেকে য়ুরোপীয়রা অনেক মানচিত্র তৈরি করেছে ভারতীয় উপদ্বীপের,কিন্তু তাতে ভুলভ্রান্তি প্রচুর।জরিপের যন্ত্র উন্নত হতে অষ্টাদশ শতক থেকে মোটামুটি নির্ভুল মানচিত্র পেতে শুরু করি আমরা,জনক ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল এমন সব জাতি,যথা,পর্তুগিজ,ডাচ,ফরাসী—ইংরেজতো আছেই।উপকূলের ছবি ঠিক হলেও যে হেতু এদের দেশের অভ্যন্তরে জরিপের অনুমতি ছিল না,সেই ঘাটতি আন্দাজে পূরণ করতে হতো।
প্রথম জীবনে জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০)ছিলেন ভাগ্যান্বেষী জাহাজী,সামুদ্রিক জরিপের কাজ ভালোই শিখেছিলেন,ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ১৭৬৪ সালে প্রথম বাংলায় আসেন।কোম্পানি ইতিমধ্যে তার দখলীকৃত অংশের জরিপ করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল,নবাগত রেনেল সে দায়িত্ব পান।প্রথম আদেশ ছিল,জলঙ্গীর মুখ থেকে গঙ্গা(পদ্মা)-মেঘনা সঙ্গম পর্যন্ত দক্ষিণ কূলের জরিপ ও এবং শুকনো ঋতুতে গঙ্গা থেকে কলকাতা পর্যন্ত সবথেকে সুবিধাজনক জলপথটি নির্ণয় করা।রেনেল কাজ শুরু করে দিলেন,বজরায় যাত্রা,সঙ্গে ছিল একজন সহকারী সার্ভেয়ার,তিন য়ুরোপীয়ান,এগার জন করে লস্কর,কুলি ও সিপাহি এবং একজন দোভাষি।জলঙ্গী-মেঘনা জরিপটি খুব বড় স্কেলে করা (৫০৭.৫ইয়ার্ড=১ইঞ্চি),পরবর্তীকালে সুবিধার জন্য স্কেল অনেক ছোট করে নেন।পরের বছর অক্টোবরে আদেশ হলো সমগ্র বঙ্গের মানচিত্র তৈরির।রেনেল প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর কর্মস্থল হবে কলকাতা নয়,ঢাকা,যদিও কলকাতায় একটি অফিস ছিল।সেই অনুযায়ী ঢাকায় একটি বাড়িও বানিয়ে নেন।জরিপ করতে করতে ভুটান সীমান্তের কাছে বাড় নামক একটি জায়গায় তাঁর প্রাণসংশয় হয়,সেটা ছিল ১৭৬৬ খ্রি.ফেব্রুয়ারি মাস।সেখানে সন্ন্যাসীরা নিকটবর্তী একটি শহরে লুঠপাট চালাচ্ছে খবর পেয়ে মরিসন নামে সেনাবাহিনীর এক অফিসার নব্বইজন সিপাহি নিয়ে তাদের দমন করতে যান,সন্ন্যাসীরা সংখ্যায় ছিল প্রায় আটশো।মরিসন ঘোর বিপদে খবর পেয়ে রেনেল তাঁর লোকজন নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিলেন।সন্ন্যাসীদের একটি দল রেনেলকে একা পেয়ে ঘিরে ফেলে,অতি কষ্টে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।শরীরে তলওয়ারের বহু আঘাত,তার মধ্যে গুরুতর বাঁ কনুইয়ের উপরে ও আ র একটি ডান কাঁধের শোল্ডার ব্লেড দ্বিখণ্ড করে কয়েকটি পাঁজর কেটেছে।ক্ষত প্রায় বারো ইঞ্চি গভীর।ধারেকাছে কোনো ডাক্তার নেই,সিদ্ধান্ত হলো নৌকায় ঢাকা আনার,তিনশো মাইলের পথ,লাগবে ছ’দিন।মাঝিমাল্লারা ক্ষতের ওষুধ দিতো শুধু পেঁয়াজের রস।ঢাকায় পৌঁছে ডাক্তারবন্ধু রাসেলের চিকিৎসায় সেরে উঠলেন কিন্তু চিরকালের মতো ডান হাত আংশিক আর বাঁ তর্জনী সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেল।প্রভূত রক্তক্ষরণ জনিত দুর্বলতা তো ছিলই।
(চলবে যদি পাঠকরা ইচ্ছা করেন)
বুড়া


মন্তব্য

শাফা সিদ্দিকী এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু

শাফা সিদ্দিকী এর ছবি

হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

মাঝের প্যারাটা প্রথমে এসে পড়ায় এবং বাক্যগুলির মধ্যে উপযুক্ত স্পেস না রাখায় লেখাটা পড়তে কষ্ট হয়েছে, তবে রেনেল এবং মানচিত্র সম্পর্কে জানা হল।

রেনেল প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর কর্মস্থল হবে কলকাতা নয়,ঢাকা

ঢাকাকে বেছে নিলেন কাজের সুবিধার্থে?

আগ্রহ প্রসারিত হলো আপাত-অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে,যথা,ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব,ধর্ম,গাছপালা,স্থলচর-জলচর প্রাণী থেকে কীটপতঙ্গ পর্যন্ত।এবং এইসব তথ্যসংগ্রহ হতে লাগলো সরকারি অর্থব্যয় করে।গেজেটিয়র তারই ফল।

বোঝাই যাচ্ছে, বিশাল এক তথ্যের ভান্ডার গড়ে উঠেছিল সে সময়। সেই ভান্ডার টিকে আছে এখনো? আমাদের দেশ বলতে এখন যা বোঝায়, সেই অঞ্চলগুলো নিয়েও তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল? হলে তথ্যগুলি কিভাবে পাওয়া যেতে পারে?
।।।।।।।।।
অনিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ বা পূর্ববঙ্গ যেতে হলে উজানে পদ্মা-ভাগীরথী বা পদ্মা-জলঙ্গী যেতে হবে। তাই ঢাকায়।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর তারেক অণুর আগের লেখাটি আলোচনাসহ পড়লে পাবেন।
বুড়া

হিমু এর ছবি

বুড়াদা, দুইখান অনুরোধ। পরবর্তী পর্ব আরো দীর্ঘাঙ্গ করুন, আর বিরামচিহ্নের পর একটা স্পেস দিন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

১। পাঠক হিসাবে ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

২। হিম্ভায়ের মন্তব্য-বন্ধনে সংহতি জানাইলাম। চাল্লু

৩। পরবর্তী পোস্টে ঐ সকল মানচিত্রের ছবি যোগ করার আবদার রাখিলাম। দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য। ম্যাপের অংশবিশেষ দেবো নমুনা হিসাবে।
বুড়া

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক আগ্রহদ্দীপক লেখা। আমার ভাল লেগেছে। সন্ন্যাসী দের লুটপাট এর বিষয় টি উঠে এসেছে, যদিও বিষয় টা হয়ত এই লেখার বিষয়বস্তুর সাথে খুব বেশি জড়িত না, কিন্তু এই বিষয়ে কি খানিকটা বিস্তারিত বলা যায়? ধন্যবাদ।

অনন্যা

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক । ভালো বিষয়ে ভালো লেখা। রেফারেন্স দেয়া যায় লেখার সাথে?

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

দেবো,লেখার শেষে।
বুড়া

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

দাদা,
অবশ্যই আগ্রহ জাগানিয়া পোষ্ট। আপনার হয়ত মনে আছে, রেনেল এবং তার ম্যাপ নিয়ে সচলে আমারও একটা সংক্ষিপ্ত পোষ্ট ছিল, আশা করি আপনার এই পোষ্টটা আরও বিস্তারিতভাবে বিষয়টিকে তুলে আনবে।
লেখাটি কত পর্ব বিশিষ্ট হতে যাচ্ছে? হিমু ভাইয়ের মত আমারও নিবেদন পরবর্তী পর্বগুলো যেন দীর্ঘতর হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই, আপনার লেখাটি রেনেল বিষয়ে অনেক বেশি তথ্যপূর্ণ এবং যারা এই সিরিজ পড়ছেন,সকলকে অনুরোধ করব আপনার লেখাটি অবশ্যই পড়ার জন্য। আমার ফোকাসটা অন্যত্র। কিছুদিন আগে গেজেটিয়র নিয়ে করা মন্তব্যের জের বলতে পারেন। ইংরেজরা ভারত সম্পর্কীয় জ্ঞানান্বেষণের যে সব চেষ্টা করেছিল, বলা উচিত সূচনা করে দিয়েছিল, তার সঙ্গে রাজকোষের লোকসান ছাড়া লাভের আশা ছিল না। ইংরেজ-পূর্বযুগেও জরিপ হতো। তার উদ্দেশ্য মালিকানা-নির্ধারণ ও খাজনার পুনর্বিন্যাস। শতলক্ষ টাকা খরচ করে হিমালয়ের শৃঙ্গদের উচ্চতা নির্ণয় কি আর্থিক লাভ ঘটিয়েছে?
যুগান্তর যখন ঘটে,তার এমন কিছু লক্ষণ দেখা যায়,যা কারো চোখ এড়াতে পারে না।ইংরেজ শাসনে আমরা মধ্যযুগের ক্ষয়িষ্ণু রেশটুকু ঝেড়ে ফেলে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছি। পুরনো কালের বিচারে অনেক কিছুকেই অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। জ্ঞানই যে ক্ষমতা,আধুনিক যুগের শীর্ষবাক্য,সে উপলব্ধির কাহিনী বলতে চেয়েছি।
বুড়া

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ব্রিটিশপূর্ব যুগের জরীপ নিয়ে লিখুন বস্‌!

ব্রিটিশরা দূরদর্শী ছিল তাই তারা গবেষণায় রিসোর্স খাটিয়েছে। সব গবেষণা যে তাৎক্ষণিক ফল দিয়েছে তা নয়। আর কিছু গবেষণা যে কোন কালে ফল দেবে না সেটাও তো আমরা জানি। দক্ষিণ আমেরিকাতে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের অভিযাত্রার ফলে আবিষ্কৃত সিনোকোনা থেকে তৈরি ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক কুইনাইন সিপাহী বিদ্রোহের সময় অধিকতর ব্রিটিশ সৈন্য ভারতে পাঠাতে সাহায্য করেছে। আবার পলিনেশিয়া থেকে ভারতে আনা রুটিফলের চাষের চেষ্টা মাঠে মারা গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।