সেদিন আকাশ ছিল ঘন নীল, বাতাস ছিল উতলা | আনজামের মনে লেগেছিল বসন্তের রং, মহুয়ার মাতাল নেশা | আনজাম ডুবু ডুবু চোখে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল "তোমাকে আজ পরীর মত লাগছে"|
আনজামটা যে কী!
ভাবতে ভাবতে অহনার চোখ ছল ছল হয়ে আসে | কতকাল পর সে তাকে পরী বলে ডাকলো | মায়াভরা চোখ মেলে আনজামের দিকে তাকায় অহনা | তাকায় আর ভাবে, এই কি সেই তরুণ যে কিনা ঝড় বাদল উপেক্ষা করে ট্রাফিক জ্যাম ডিঙিয়ে নুন্ঝাল মাখানো আমড়া আর কামরাঙ্গা কিনে আনতো ! গোলগাল নাদুস নুদুস চেহারাটি দেখে কে বলবে একদিন এই পাগল ছেলেটাই স্রেফ পায়ে কাদা লেগে যাবে বলে অহনাকে কোলে করে.....| ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলেনি ! পনের বছর পর আজ আনজামের গলায় যেন সেদিনের সেই আহবান, তার ডুবুডুবু দৃষ্টিতে ওই শেষ বিকেলের মাদকতা |
"কই কিছু বলছনা যে?"
"কী বলব?"
"আচ্ছা কিছু বলতে হবেনা | বাচ্চারা কোথায়?"
"ঘুমিয়ে পড়েছে, তুমি ঘুমোবেনা?"
"আর ঘুম! চোখে কী দিয়েছ, কাজল?"
"কাজল না ছাই! ক্লান্তিতে চোখের নীচে কালি পড়েছে|"
"ক্লান্তির কালি কি এত সুন্দর হয়? কাছে আস তো, একটু ভালো করে দেখি |"
"তোমার কথাবার্তা কিন্তু সুবিধার ঠেকছেনা | কেমন কেমন যেন লাগছে |"
ওদের শোবার ঘরের দেয়ালটা নীল রঙের, অহনার পছন্দের রং | নীল রং আনজামের এমনিতে অসহ্য লাগলেও আজ মনে হচ্ছে এর চেয়ে সুন্দর রং বুঝি আর হয়না | নীল ঘরে লাল চেয়ার, লাল চেয়ারএ আলো আঁধারীতে বসে আছে নীল বসনা | নীল বসনার চোখে কালো কাজল, আনজামের মন সেই কখন থেকে দ্রবীভূত হয়ে আছে! কত যন্ত্রনাই না হয়েছে একটা সময় এই নীল রং নিয়ে, আনজাম ভাবে | বিয়েতে মেয়েরা লাল শাড়ি পড়ে, এটাই রীতি | অহনা পড়েছিল নীল ঘাগরা, অহনার পিড়াপিড়িতে আনজাম কে পড়তে হয়েছিল নীল শেরওয়ানি | বিয়ের ফটো দেখার পর সিমিলি খিল করে হেসে বলেছিল "ওমা সব দেখি নীল ছবি দুলাভাই "| ঘর ভর্তি মানুষের সামনে আনজামের ফর্সা মুখটা দেখতে দেখতে লাল হয়ে গিয়েছিল | তার নামই হয়ে গিয়েছিল নীল দুলাভাই |
"নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে নীল যমুনায়...."| গুনগুন করে উঠে আনজাম |
"বাপরে! ছেলের বাবার গলায় একী শুনছি আজ, গান?" অহনার গলা তরল হয়ে এসেছে | চেয়ার থেকে উঠে বিছানার দিকে এগোয় সে | বাইরে তখন ঝিরি ঝিরি দখিনা হাওয়া, জানালার কোনে এক ফালি পঞ্চমীর চাঁদ |
"দরজাটা লাগিয়ে দাও"| গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলে আনজাম |
অল্পক্ষণ নাকি অনেকক্ষণ? কে জানে ? কী দরকার জানার! উত্তাল সমুদ্রের মাঝে ছোটো একটি জাহাজে করে ভেসে যাচ্ছে দুজন যাত্রী | জগত সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব.........
"মা"
যেন ডুবো চরে হঠাত ধাক্কা লেগে থমকে গেল জাহাজ | অহনা মুহুর্তেই বরফ শীতল, নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে | আনজাম প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় লাফিয়ে উঠে সরে যেতে চাইল | কিন্তু অবস্থানগত কারণে সেটি অসম্ভব | দরজার বাইরে দাড়িয়ে তার ছয় বছরের ছেলেটি | ঘুম ভেঙ্গে উঠে এসেছে | আনজামের মনে পড়ে গেল এই দেশে দরজায় ছিটকিনি থাকেনা, ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এর বিধান | কুল কুল করে ঘামছে সে, বরফ শীতল ঘাম | শীত লাগছে |
অহনা ঘোর ভেঙ্গে ডাঙায় ফিরে এসেছে|
"তাড়াতাড়ি নাম, দয়া করে কোথাও লুকাও প্লিজ | তুতুন এক্ষুনি এসে পড়বে |"
তড়িতস্প্রিষ্টের মত লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল আনজাম, কানে ভেসে এলো অহনার ফিসফিস,
"জামা কাপড় নিয়ে যাও..."|
আর জামা কাপড় ! আনজাম এখন লুকোনোর জায়গা খুঁজছে | ওরা এই এপার্টমেনটে এসেছে মাত্র একমাস হতে চলল | একটা বিছানা আর সেই লাল রঙের চেয়ারটা ছাড়া আর কোনো আসবাব কেনা হয়নি এখনো | কোথায় লুকোবে সে ! চোখ পড়ে গেল খাটের নিচে | ঢুকতে গিয়েই মাথায় বাড়ি লেগে পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো তার | কতবার অহনাকে বলছিল উঁচু খাট কেনার জন্য | নাহ, তিনি শোনেন নি | উঁচু খাট নাকি বড়ই সেকেলে | খাট হবে খাটের মতন, নিচু | এটাই একালের ফ্যাশন | হাত দিয়ে মুখ চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আনজাম, ঠিক যেভাবে ঢুকেছিল | খাট টা এতই নিচু যে একটু উল্টে নিয়ে চিত হবার কোনো উপায় নেই | মাথাটা কি ফেটেই গেল? পিঠের মাঝখান টায় জ্জলে যাচ্ছে, নুনছাল উঠে গিয়েছে নিশ্চিত |
"মা আমার ভয় লাগছে"
"কোনো ভয় নেই তুতুন সোনা, ঘুমিয়ে পড়"
"যাও বাবা যাও, দয়া করে ঘুমিয়ে পড়| ঘুমিয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড় |" প্রার্থনার সুরে বিড়বিড় করছে আনজাম | মাথায় ব্যথা, পিঠে জ্জ্লুনি আর সব কিছু ছাড়িয়ে অসহনীয় একটা ঠান্ডা | খাটের নীচে হিটারের উত্তাপ পৌছায় না | এই বরফের দেশে মাঝ ফেব্রুয়ারীতে কাঠের মেঝে আর সিমেন্টের মেঝেতে কোনো তফাত নেই | আড় চোখে একবার নিজের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে সে | আহা, গায়ের লোম গুলো যদি একটু বড় আর ঘন হতো!
দরজা খুলে ঘরে চলে এসেছে তুতুন, বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে তার একরত্তি বালিশটাকে | আলুথালু বড় বড় চুল ছেলেটার, চাঁদের আলোয় কী যে সুন্দর লাগছে ! দেখেই অহনার মন জুড়িয়ে গেল |
"কী হয়েছে তুতুন সোনা, ভয় পেলি কেন?"
"একটা রাক্ষস এসেছিল মনে হয়, কেমন যেন ঘসঘস ঘসঘস একটা শব্দ শুনেছি মা"
নতুন ম্যাট্রেসের উপরে পাতলা একটা প্লাস্টিকের কভার রয়েছে | আনজাম বলেছিল সরিয়ে ফেলতে | অহনা সরায়নি, ওটা নাকি ম্যাট্রেস প্রটেক্টর | "ভালই প্রটেক্ট করেছে.......|" মনে মনে একটা গালি না দিয়ে পারলনা আনজাম |
"ভুল শুনেছ বাবা, কেউ আসেনি| "
"এসেছিল মা, তুমি জাননা | রাক্ষসটা ফিস ফিস করে কথাও বলছিল | জানতে চাও কী বলছিল ?"
খাটের নিচে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা আনজামের কান গরম হয়ে গিয়েছে | "জানতে চাইনা, জানতে চাইনা | তুমি কিছুই শোননি তুতুন, কিচ্ছুনা "
অহনাটা কি বোকা ? সে জানতে চাইছে কেন? আমাদের পাতালপুরীর বাসিন্দা নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে তুতুন কি বলে তার জন্য |
"রাক্ষস টা একবার বলছিল ইয়েস আরেকবার বলছিল নো | মা আমি ভাইয়া কে অনেক ডেকেছি কিন্তু ও উঠেনি | ভয় লাগছে মা "|
"ধুর বোকা তুই স্বপ্ন দেখেছিস, চল তোকে তোর ঘরে দিয়ে আসি"
"আমি যেতে চাইনা মা, যদি রাক্ষস টা ফিরে আসে?"
"আসবেনা তুতুন সোনা, রাক্ষস টা এতক্ষণে ঠান্ডায় জমে গিয়েছে"
হাসতে হাসতে ছেলের চুলে বিলি কেটে দেয় অহনা | রাগে চিড়বিড় করে উঠে আনজাম | ওরা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, খাটের নিচ থেকে টের পায় সে | আর কিছুক্ষণ মাত্র | একটু হাত-পা সরিয়ে টানটান হতে গিয়েই চমকে উঠে আনজাম | কী ওটা! নরম নরম কী একটা যেন ঠেকলো হাতে? চোখ পড়তেই শিরদাড়া বেয়ে তীব্র একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল আনজামের শরীরে | একটা মাকড়সা, হাতের থাবার মত বড় একটা হিলহিলে রোমশ মাকড়সা | চট করে সরতে গিয়েই বাড়ি খেল মাথায় | আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিত্কার দিয়ে উঠলো | কতখানি তার যন্ত্রনায় আর কতখানি আতঙ্কে, সেই জানে |
"মা------------------"
অহনা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তুতুনকে | চিত্কারে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে বড় ছেলেরও |
"কী হয়েছে মা, কী হয়েছে তুতুন?"
"ভাইয়া বাসায় একটা রাক্ষস এসেছে, ইয়েস নো রাক্ষস"
রবিন ঘুম ঘুম চোখে হা করে তাকিয়ে আছে | বুঝতে পারছেনা কিছুই |অহনা দুই হাতে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে একবার তাকালো খাটের তলায় | আনজামের হাত দেখা যাচ্ছে, বুড়ো আঙ্গুলটা উঁচু করে ধরে রাখা |
"ও কিছুনা বাবা, বাইরে একটা কায়ওটি বেরিয়েছে | এখন তোমরা ঘুমিয়ে পড়তো"
"এই ঘরেই ঘুমোতে চাই মা |"
.............................................................................
সকাল হয়েছে | ঘেসটে ঘেসটে খাটের নিচ থেকে কোনমতে বেরিয়ে এসেছে আনজাম | ঘুমিয়ে পড়েছিল সেও | ঠান্ডায় সমস্ত শরীর নীল হয়ে গিয়েছে তার, ঠিক যেন নীল দুলাভাই | মাটিতে শুয়েই ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে চাইল বিছানার দিকে | নীল চাদরের উপর সাদা কম্বল | তারই তলায় তিনটে ফুল ফুটে আছে, ঘুমুচ্ছে | একটা স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে পড়ল আনজামের মুখ জুড়ে | হাত বাড়িয়ে জামাটা নিতে নিতেই দেখতে পেল কাল রাতের মাকড়সাটা কে | মেঝেতে পড়ে আছে, তুতুনের খেলনা মাকড়সা | কী ভয়ই না পেয়েছিল সে ! মাকড়সা টা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে আনজাম | একটু গুগল করা দরকার | ছিটকিনি ছাড়া আর চলছেনা |
মন্তব্য
লেখাটি জমা দিয়েই মনে হলো নিজের নাম লিখতে ভুলে গিয়েছি - মোখলেস হোসেন
বিশেষ দ্রষ্টব্য:এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক, নিজের জীবনের সাথে কেউ মিল খুঁজে পেলে তাতে লেখকের কোনো দায় নেই | লেখক তার জন্য মোটেও দু:খিতও নন | নিজেকে ভুক্তভোগী মনে করলে কমেন্ট সেকসনে নাম ঠিকানা লিখে দিন, আপনার ঠিকানায় একটি সিমপ্যাথি কার্ড চলে যাবে |
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
দেবদ্যুতি
সব কিছু কালপনিক। তবে তা মানুষের কলপনা। তাই মিলে যাবেই-------ভাল লেগেছে।
এ্যানি মাসুদ
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মজার, কিন্তু বাবা গায়েব হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করল না?
নাহ, কেননা এটা গল্প| গল্পের গরু গাচে উঠ্লেই বা কী? বরং তার এই আভিযান নিয়েই লিখে ফেলা যায় আরেকটা গল্প | যেমন ধরুন্ঃ
ঘৃতকুমারি ভাবেনি পথ টা এমন জটিল হবে| খোড়ল গুলো থাকায় এ যাত্রা বেচে গিয়েছে| তিনটি খুর তিন খোড়লে আট্কে অন্ধের মত চার নম্বর এর আশায় লট্কে ঘৃতকুমারি | তার মাথার উপরে পুরনিমার চাদ, চাদে কার প্রতিবিম্ব দেখে সে?।,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
- উদ্দেশ্যহীন
বশির মাহমুদ
Jaraahzabin
"আহা, গায়ের লোমগুলো যদি একটু বড় আর ঘন হতো!"
বেতাল লেগেছে, একেবারে বেতাল! একদম জটিলের মতো বেতাল!
শুনে প্রীত হলাম
খুব ভাল লাগলো গল্পটা। থামবেন না...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
নতুন মন্তব্য করুন