হারপার লি’র টু কিল এ মকিংবার্ড পড়েছিলাম এইচএসসি পরীক্ষার পরপর। কালো মলাটের ছোটখাট পেপারব্যাকটা ফ্যান্টাসি বইপোকা এই আমার কাছে শুরুতে বেশ ধীরলয়ের লাগছিলো, কিন্তু একটু পর দেখলাম গল্পের ভেতরে ঢুকে গেছি, ১৯৩০ এর আমেরিকান সাউথের ছোট শহর মেকোম্ব শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছি।
টু কিল এ মকিং বার্ডের ন্যারেটার ছয় বছর বয়সী জিন লুইস ফিঞ্চ, যাকে সবাই ডাকে স্কাউট বলে। ছোট একটা বাচ্চার চোখে তার আসেপাশের পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষের কান্ডকারখানা অদ্ভুত এক আলোতে ধরা দেয়। তার ছোট শহর যখন বর্ণবাদে, বৈষম্যে নুয়ে আসছে, কয়েক বছরের বড় ভাই জেম তাকে সমাজের শ্রেণীবিন্যাস বোঝাতে চেষ্টা করে। মাথা নাড়িয়ে স্কাউট খুব স্বাভাবিকভাবে বলে ওঠে “Naw, Jem, I think there's just one kind of folks. Folks" এই চিন্তার মুক্তি আর সারল্য স্কাউট পেয়েছে তার বাবা এটিকাস ফিঞ্চের কাছ থেকে – পুরো শহরের বিপক্ষে যেয়ে যিনি তখন একজন আফ্রিকান এমেরিকানকে একটা মিথ্যা মামলায় সাজা পাওয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
খুব সহজে এই বইটা টিনেজার আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলো, সাম্য, মনুষ্যত্ববোধ, অন্যের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবতে শেখা, সমাজের অন্যায় নিয়মের কাছে মাথা না নোয়ানো, সত্য আর সঠিককে প্রথার উপরে স্থান দেয়া... আরো লক্ষ লক্ষ মুগ্ধ পাঠকের জন্যেও তাই। লেখিকা হারপার লি এই বই প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে পঞ্চাশ বছর যাবত সবার প্রশ্নের জবাবে বারবার বলে এসেছেন, জীবন নিয়ে যা বলার তা তিনি এই বইতেই বলে দিয়েছেন, নতুন করে বলার কিছু নেই। একজন লেখকের জন্য এটা বলতে পারার চেয়ে বড় অর্জন আর কি হতে পারে?
হঠাৎ গত বছরের শেষে শুনি টু কিল এ মকিংবার্ডের সিকুয়াল বের হচ্ছে। অদ্ভুত লেগেছিলো তখনি, লেখিকার বয়স নব্বই এর মতন, এখন নতুন বই? কিভাবে? পাঠকের মাঝে নানা জল্পনা কল্পনা, বইটা আসলেও তার কিনা তা নিয়ে স্পেকুলেশান, স্কাউট, জেম আর এটিকাসের সাথে আবার দেখা হবে এই আনন্দ, আর একইসাথে খুব প্রিয় একটা বই এর চিরন্তন আবেদন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করতে থাকে। আমার ক্ষেত্রে ভয়-ই বেশি ছিলো হয়তোবা।
জুলাই এর মাঝামাঝি বই প্রকাশ হওয়া মাত্র ইলেক্ট্রনিক কপি জোগাড় করি।পাবলিশারদের তরফ থেকে বলা হয় এটা টু কিল এ মকিংবার্ডেরই প্রথম ড্রাফট, তখন প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়নি, পরবর্তীতে এখান থেকেই প্রধান চরিত্রদের নিয়ে, বিশ বছর আগের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে হারপার লি কালজয়ী উপন্যাসটি লেখেন। ম্যানুস্ক্রিপ্ট নাকি এত বছর পর পাওয়া গেছে।
কৌতূহল জয়ী হয়, আতঙ্ক একপাশে রেখে পড়তে বসি। স্কাউটের বয়স এখন পঁচিশ, নিউইয়র্কে থাকে সে, ফিরছে তার পুরনো শহরে। প্রথম কয়েক পাতার মধ্যেই একবার মন ভেঙ্গে যায়, খুব প্রিয় একটা চরিত্র আর নেই (স্পয়লার দেবোনা)। গল্পের পরিসরে আরো নেই ‘ডিল’ – স্কাউট আর জেমের ছোটবেলার প্রিয় খেলার সাথী। হ্যাঙ্ক নামে একজন নতুন চরিত্রের সাথে দেখা হয় আমাদের, জেমের প্রিয় বন্ধু সে, আর এখন স্কাউটের পাণিপ্রার্থী। কাহিনীর শুরু থেকেই হারপার লি’র সাবলীল পরিচিত ভাষা পড়াকে গতিশীল করে, হঠাৎ হঠাৎ টু কিল এ মকিং বার্ডের কিছু লাইন হুবহুও পাওয়া যায়।
এই গল্পের আসলে তেমন কোন ‘গল্প’ নেই, কোন ক্লাইম্যাক্সের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়না। বিশ বছর পরের জিন লুইসের মাঝে পুরনো স্কাউটের ঝিলিক দেখা যায় মাঝেমধ্যেই – কিন্তু সে পুরনো চেনা মানুষগুলিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকে, যা অবশ্যই বেশিরভাগ সময় সুখকর হয়না । যেই আদর্শের উপর ভিত্তি করে তার ব্যক্তিত্ব, চিন্তাধারা গড়ে ওঠে তা নাড়া খায় অনেকাংশে, সাথে আমার মতন পাঠকেরাও অবশ্যম্ভাবী ধাক্কা খাবেন এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
আমার বিশ্বাস লেখিকা এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সক্ষম অবস্থায় থাকলে এই বই প্রকাশিত হতে দিতেন না। হারপার লি’র বৈষয়িক বিষয় দেখতেন তার বোন এলিস লি, ২০১৪ সালে মারা যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন লেখিকা খুব নাজুক অবস্থায়, তার সামনে কোন কাগজ সই এর জন্য আনলে যেটা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়ার অবস্থায় নেই তিনি। ওয়াচম্যান লেখার পরবর্তী সময়ে, লেখনী আর জীবনদর্শন আরেকটু পরিণত হওয়ার পর তিনি নিজেই বুঝেছিলেন এই গল্পের সবচেয়ে সুন্দর প্রকাশ হতে পারে স্কাউটের ছোটবেলায়। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য, অস্তিত্বের টানাপোড়েন সম্পর্কে তিনি গো সেট এ ওয়াচম্যানে যা আধাআধি তুলে আনতে পেরেছিলেন, মকিংবার্ডেই পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গরূপে, অসাধারণভাবে বলেছেন। একজন লেখকের পূর্ণ সামর্থ্যে আসার প্রক্রিয়া বুঝতে চাইলে গো সেট এ ওয়াচম্যান পড়া যেতে পারে, কিন্তু টু কিল এ মকিংবার্ডের সিকুয়াল এটি নয়।যে চরিত্রদের আমরা মকিংবার্ডে চিনেছি, ২০ বছর পরের এই গল্প তাদের হতে পারেনা কোনভাবেই।
বই শেষ করে খালিখালি লাগতে থাকে আমার। ভালো, খারাপের সংজ্ঞায় পড়ে না এই অনুভূতি, খালি মনে হয় আমার কি যেন একটা হারিয়ে গেলো...
- অনন্যা
মন্তব্য
টু কিল এ মকিংবার্ড পড়িনি তো :(
দিশাপ্পু কই? ফাঁকি মারে ক্যান? X(
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনুবাদের জন্য অপেক্ষা না করে আসল্টাই পড়ে ফেলেন । এইটা অবশ্যপাঠ্য :D
(Y)
দেবদ্যুতি
অল্প কথায় অতি চমৎকারভাবে কালজয়ী একটি বইকে তুলে এনেছেন। অসাধারণ রিভিউ! আজই খোঁজে নেমে পড়ব মনে হয়।
এই রিভিউ-এর একটি লক্ষনীয় বিষয় হল, বইয়ের স্রষ্টাও সমানভাবেই উঠে এসেছেন। কৃতজ্ঞতা! বই লেখিকা এবং রিভিউ লেখিকা- দুজনকেই!
।।।।।
অনিত্র
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে :)
দিলেন তো দ্বিধায় ফেলে! এখন তো চিন্তায় পড়ে গেলাম - গো সেট পড়ব, নাকি পড়ব না! মকিংবাডকে ফিকে করে দিলে তো ---
____________________________
গো সেটকে প্যারালাল ইউনিভার্সের কাহিনী ভেবে পড়ে ফেলতে পারেন :p
এখন তো দুটোই পড়তে হবে।
নতুন মন্তব্য করুন