পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের পৈতৃক নিবাস অম্বিকাপুরে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৩/০৮/২০১৫ - ৫:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার কবিতায় আমি বড় বড় রাজা বাদশার কাহিনী বলতে পারি নি। বড় বড় বীরের কাহিনী অবলম্বন করে কবিতা রচনা করতে পারি নি যা আপনাদের নবজীবনের পথে নব নব উন্মাদনা এনে দিতে পারবে। গাজী সালাউদ্দিনের বড় বড় যুদ্ধের চাইতে পল্লী গ্রামের রুপা মিয়ার গ্রাম্য কাইজ্যা আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। রাতদুপুরে যখন মেঘে মেঘে শব্দ করে ঝড় আসে তখন রাত্রির অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে বছিরদ্দিও মাছ ধরতে যায়, তার সেই সাহসিকতা আমাকে পাগল করে, শহরের এলায়িতকুন্তলা সুবাসিনী সুন্দরীদের পাশে আমার রচিত সাজু, দুলী, আনোয়ারা এরা যে স্থান পাবে না তা আমি জানি। এত শিক্ষা সুনিপুনা শহরের বিদুষী মহিলাদের পাশে আমার সাজুর কাঁথা সেলাইয়ের সূক্ষ্ম কারুকার্যের মূল্য কতটুকুন। কিন্তু তাজমহলের চাইতে ও আমাকে পাগল করেছে এইসব নকশী কাঁথার সুন্দর ইন্দ্রপুরী।
আমার দেশের কথা, ১৯৪৯

এই কথাগুলোর লেখক কবি জসীম উদ্দিন। আমাদের কাছে তিনি পল্লী কবি হিসাবেই আদৃত। তার কবিতায় জীবনানন্দ দাশের কবিতার মত নিসর্গের বর্ণনা নেই; কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মত বিদ্রোহের দামামা নেই; সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মত সংগ্রামী স্ফুলিঙ্গ নেই; ফররুখ আহমেদের কবিতার মত নবজাগরণের আহ্বান হয়ত নেই; কিন্তু আছে আবহমান বাংলার পল্লী গ্রামের সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ ও বেদনার সাতকাহন। তাই তিনি আমাদের অতি আপনজন।

তিনিই সারা পৃথিবীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নকশী কাঁথার মাঠের হাসু কিংবা রসুলপুরের আসমানি’র সাথে। দাদীর কবর দেখিয়ে নাতনীর সাথে সাথে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়েছেন। শিশু কিশোরদের মামা বাড়ির আনন্দের স্বাদ আস্বাদন করা শিখিয়েছেন। আনমনে খেলা করে যাওয়া রাখাল বালকের কথোপকথন শুনিয়েছেন। তিনি নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমাদেরকে তাঁর বাড়ি থেকে ঘুরে আসবার।

তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।

কবির নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম ছোটবেলায়। সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করবার সুযোগ পেলাম অনেক বড় হয়ে ফরিদপুর গিয়ে। অফিসের কাজে এসেছিলাম। আমার ক্ষেত্রে যা হয়, একইসাথে রথ দেখা আর কলা বেচা দুই’ই সারি। হাতে বেশ খানিকটা সময় থাকায় ভাবলাম কবির নিমন্ত্রণ এইবার রক্ষা করতেই হবে। চলার পথে সঙ্গী হলেন ফরিদপুরের রিজিওনাল ম্যানেজার জিয়া ভাই।

পল্লীকবি জসীম উদ্দিন ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে তিনি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয়ে যোগদান করে এবং ১৯৬২ সালে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় কবি মৃত্যুবরণ করেন।

ফরিদপুর শহর থেকে কবির বাড়ি মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে। বাইকে করে গেলে ১৫ মিনিটের বেশি লাগে না।

২০০৩ সালে কবিপত্নী মমতাজ জসীম উদ্দিন বাড়িটিকে জাদুঘরে রুপান্তর করেছেন। বাড়ির কয়েকটি কক্ষে কবির আত্মীয়স্বজন থাকলেও বেশিরভাগ অংশই জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত। কবির স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

কবির বাড়ির উঠানে দাঁড়ালেই যেই ঘরটি চোখে পড়ে সেটির দেয়ালে কবির অমর সৃষ্টি কবর কবিতাটি টানানো আছে। এই ঘরে বসেই কবি ‘রাখালী’ ও ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

১৯২৭ সালে যখন ‘কবর’ কবিতাটি লিখেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৪। কবিতাটি ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় যখন কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায় তখন কবি বি.এ. ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের হৃদয়স্পর্শী কবিতাগুলোর যদি তালিকা করা হয় তাহলে আমি নিশ্চিত এই কবিতাটি প্রথম অবস্থানেই থাকবে। কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়েই কবিতাটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়। আজও এই কবিতার আবেদন এতটুকুও কমে যায় নি।

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।

হাতের ডানপাশে চোখে পড়ল ছোট্ট একটা কাচারি ঘর। ১৯৩০ এর দশকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দুইবার এই ঘরে এসে থেকেছিলেন।

শুধু থেকেছিলেন বললে ভুল হবে, কাজী নজরুল ইসলাম কবির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীতে নৌবিহার এবং গোসল করে এতটাই আনন্দ পেয়েছিলেন যে আনন্দের আতিশয্যে দুই লাইনের একটা কবিতাও লিখেছিলেন,

আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ
নদীর তীরে ডিঙ্গি তরী পথিক ধরা ফাঁদ।

কাছারি ঘরের ভিতরটাতে কবিকে নিয়ে প্রখ্যাত ব্যক্তিদের লেখাগুলো টানিয়ে রাখা হয়েছে। সেই সাথে আছে কবির জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, কবির জীবন মোটেই সাদামাটা ছিল না, বরং বৈচিত্র্য ছিল তাঁর জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ।

কবি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’কে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন জানতাম না। এই ঘরে ঢুঁকে সেটা চোখে পড়ল। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তারিখে লেখা দুই ছত্রের এই কবিতাটি বঙ্গবন্ধু’র প্রতি কবির গভীর অনুরাগকেই প্রকাশ করে।

মুজিবর রহমান।
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।
বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,
জ্বালায় জ্বলিছে মহা কালানন ঝঞ্ঝা-অশনি বেয়ে
বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার।
হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার;
দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজুম বুকে,
দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে;
তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি
ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।

এই ঘরে এসে নতুন একটা তথ্য জানলাম। সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কবি জসীম উদ্দিনকে জাতীয় কবি ঘোষণা করার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ সম্ভব হয় নি। কবি তাঁর জীবনকালে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এইজন্য যে, তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় নি। তাঁর ছাত্রদের অনেককেই জাতীয় অধ্যাপক করা হলেও কবিকে করা হয় নি। অথচ বঙ্গবন্ধু’কে হত্যার পর জসীম উদ্দিন একমাত্র এই হত্যার প্রতিবাদ করে খুনিদের অনুষ্ঠানে যান নি। এমনই হয়। মোসাহেবরা চিরকালই প্রদীপের আলোয় আসে, আর সত্যিকারের দেশপ্রেমিকরা পাদপ্রদীপের নিচেই থেকে যান।

কাচারী ঘর থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল চমৎকার একটা গাছ বাড়ি। আহ, এইরকম একটা বাড়িতে থাকার খুব শখ। বাড়ির দরজায় লেখা আছে ‘প্রতিদান’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন,

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা
আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।

গাছ বাড়ি পেরিয়ে একটু সামনে এগুতেই কবির পিতা আনসার উদ্দিনের কক্ষ। বাইরে বড় করে লেখা ‘ছবি তোলা নিষেধ’। কে শোনে এই সাবধান বাণী।

ঘরের ভিতর ঢুঁকেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অনেকগুলো কাঠের আলমারি আর শোকেজে থরে থরে সাজানো আছে দুর্লভ সব কালেকশন। যে কোন জাদুঘরই ধন্য হয়ে যাবে এইসব কালেকশন হাতে পেলে।

উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে হরেক রকম মুখোশ, নকশী কাঁথা, মাটির বিভিন্ন ধরণের পুতুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অটোগ্রাফ সম্বলিত বই, কবির নিজের হাতে ছাপানো বই, পীর দুদু মিয়ার আমলের তরবারি এবং গ্রামাফোনের দুর্লভ সব রেকর্ড।

কিংবদন্তীতুল্য সুরকার শচীন দেব বর্মন যে জসীম উদ্দিনের লেখা দুটি গানে সুর দিয়েছিলেন সেটা একদমই জানতাম না। গান দুটো হচ্ছে ‘নিশিতে যাইও ফুলবনেরে ভোমরা’ এবং ‘আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলা রে’। কলকাতার হিন্দুস্তান রেকর্ডিং থেকে ১৯৩২ সালে গান দুটো রেকর্ড করা হয়েছিল। সংগ্শারহলায় গান দুটির অরিজিনাল গ্রামাফোন রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও আছে মরমি শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া পল্লিগীতি, নেতাজি সুভাস চন্দ্রের ভাষণ এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের গ্রামাফোন রেকর্ডের দুর্লভ সংগ্রহ। দুঃখের বিষয় হচ্ছে মহামূল্যবান এই নিদর্শনগুলো যেভাবে সংরক্ষণ করা দরকার সেভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে না। নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। চুরি যদি নাও হয়, কেবল সংরক্ষণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণেই আগামী ৫ বছরের মধ্যেই নিদর্শনগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। এর দায় তাহলে কে নিবে?

কবির পিতার কক্ষ থেকে বের হয়ে ঢুঁকলাম কবির সেজ ভাইয়ের ঘরে। ঘরটি একইসাথে 'হাসু মিয়ার পাঠশালা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' এবং 'নকশী কাঁথা কেন্দ্র' হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘরের ভিতর আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। কেবল আছে কবির তরুণ এবং যুবক বয়সের কিছু ছবি। ঘরের বাইরে আছে কবির বিখ্যাত চরিত্র আসমানিকে নিয়ে লেখা কবিতা এবং আসমানির ছবি।

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

‘আসমানী’ কবিতাটি ১৯৪৯ সালে কবির ‘এক পয়সার বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এই কবিতা মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্য বইতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসমানি যে সত্যিই ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ না থাকলেও কে ছিলেন সেই আসমানি সেটি অনেকেই জানত না। মূলত কবি জসীমউদ্দীনের ভাই সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদ এর শ্বশুর বাড়ি ছিল আজকের ফরিদপুর সদরের ইষান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে। সেখানে একবার বেড়াতে গিয়ে এই আসমানীর দেখা পান জসীমউদ্দীন। অনেককাল পরে আসমানির খোঁজ বের করেন সাংবাদিকেরা। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে আসমানি নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করেন।

সেজ ভাইয়ের ঘর থেকে বের হয়েই কবির বড় ভাইয়ের ঘর। এই ঘরে অবশ্য লোকজন বাস করে বুঝতে পেরে আর ভিতরে ঢুকি নি। শুধু ভাইদের ঘরই নয়, কবির বাড়ির প্রত্যেকটি কক্ষের বাইরেই কবির বিভিন্ন রচনার অংশবিশেষ কিংবা পুরোটাই উল্লেখ আছে। সেই সাথে আছে কবির বিভিন্ন ছবি আর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ। এইরকম এক বিবরণ পড়েই জানতে পারলাম পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পল্লী সংগীতকার, সংগ্রাহক, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ রক্ষার নেতা এলেন লোমাক্স পল্লীকবির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পোলিশ শহরে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীতের সন্মেলন হয়। সেখানেই দুজনের পরিচয় এবং বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। কবি’র ভ্রমন কাহিনী ‘চলে মুসাফির’ গ্রন্থে এই বিষয়টি উল্লেখ আছে এইভাবে,

এই এলেনের সহিত কি করিয়া যে আমার বন্ধুত্ব এত ঘনিষ্ঠ তাহা ভাবিতে আজ বিস্ময় লাগে। এত যে তাহার খ্যাতি। এত যে তাহাকে লইয়া বহুলোকের টানাটানি, তবুও এলেন যেখানে যাইবে আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইবে।

এবার গন্তব্য কবির বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের ঘরের উদ্দেশ্যে। ডানদিকে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলাম। এই কক্ষে লোকজন থাকে। অতএব বামপাশের ঘরে ঢুকলাম।

এই ঘরে কেবল ছবি আর ছবি। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে কবির তোলা ছবি, কবির যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণের ছবি, বাঁধাই করা কবির লেখা চিঠি ও কবিতা এবং কবির ব্যবহার্য কিছু আসবাবপত্র।

প্রিয় পাঠক এইবার আপনাদেরকে নিয়ে যাব সেই ঘরটিতে, যেটিতে কবি থাকতেন। এই ঘরে বসেই কবি রচনা করেছিলেন কবর, রাখালী, নকশী কাঁথার মাঠ এবং সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যগ্রন্থ। ঘরের ভিতরটা দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তালা দেওয়া ছিল বিধায় সেই ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব হয় নি।

সেই ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে ঢেঁকি দেখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারও কবির বাড়িতে এসে ঢেঁকির দেখা পাওয়া গেল। এই ঢেঁকিতে চাল কুটেই কবির মা কবির ভাই-বোনদেরকে পিঠা তৈরি করে খাওয়াতেন।

আমাদের এবারের গন্তব্য কবির স্ত্রী’র ঘর। ঘরটির নাম খুব চমৎকার, মনিমালার মনিহার

মনে মনে যা খুঁজছিলাম এই ঘরে এসেই সেটির দেখা পেলাম। একসাথে কবির সমস্ত বই এর সংগ্রহ। সেই সাথে কবির হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিও চোখে পড়ল। খুব ইচ্ছে করছিল পাণ্ডুলিপিগুলো একটু ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু কাঁচের আচ্ছাদন আমার সেই ইচ্ছেতে বাঁধ সেধেছিল।

কবির অনেক পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তাঁর স্ত্রী করে দিতেন। একটা মজার তথ্য জানলাম, কবির সাথে যখন তাঁর স্ত্রী’র ঝগড়া হত তখন কবিপত্নী পাণ্ডুলিপিগুলো ছিঁড়ে ফেলতেন। পড়ে অবশ্য আবার নিজেই কষ্ট করে সেগুলোর অনুলিপি করে দিতেন।

আমরা কবির বাড়ির পেছন দিকে চলে আসলাম। পেছনটায় চমৎকার বাগান করা হয়েছে। জায়গাটা এখন প্রেমিক যুগলদের প্রেম করবার চমৎকার এক তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। কবির নিজ হাতে লাগানো অনেক বড় একটা গাছ আছে (কি গাছ ভুলে গেছি)। বাগানের একদম পিছনে পল্লীকবি জসীম উদ্দিন সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে। এখনও উদ্বোধন হয় নি। কবির সমস্ত সংগ্রহ এই ভবনেই স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কবির এক ছেলে সংগ্রহগুলো ছাড়তে চাইছে না। কারণ ১০ টাকা টিকেটের ব্যবসাটা যে তাহলে মার খেয়ে যাবে। দুঃখ লাগলো, ব্যক্তি উদ্যোগে এই নিদর্শনগুলো রক্ষা করা কোনমতেই সম্ভব হবে না। সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উনাকে বোঝানোর। দেখা যাক কি ঘটে সামনে।

এবার ফিরবার পালা। কবির কবর জিয়ারত করতে গেলাম। চমৎকার কবর স্থানটিতে কবি তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে শুয়ে আছেন। কবিকে কবর দেওয়া হয়েছে ডালিম গাছের তলেই। চারপাশটা ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে।

কবর দেখলেই কেমন জানি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে। এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে তো হবেই। পেরেছি কি পৃথিবীকে কিছু দিয়ে যেতে? এই মানব জীবন কি শুধু ব্যর্থতার দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়েই নিঃশেষ হবে? পৃথিবীতে কেয়ামত কবে শুরু হবে জানি না, কিন্তু প্রত্যেকের জন্য কেয়ামত তো তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই শুরু হয়ে যাবে। কবির ভাষাতেই বলতে ইচ্ছে করে,

এই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে
অমনি করিয়া লুটিয়া পড়িতে বড় সাধ জাগে,
মসজিদ হইতে আজান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর
মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গুড জব! কবি সম্পর্কে, তাঁর কর্ম সম্পর্কে এবং সংগ্রহশালা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার জন্য ধন্যবাদ। আরও ধন্যবাদ ছবিগুলোর জন্য। একবার ফরিদপুর গিয়েও সময়াভাবে কবিতীর্থ দেখতে পারিনি সে আফসোস্‌ রয়ে গেছে।

একটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি নিজের নাম 'জসীম উদ্‌দীন' এই বানানে লিখতেন, 'জসীম উদ্দিন' নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- । নামের বানানটা দেখেছিলাম কিন্তু কবি নিজে যে এইভাবে লিখতেন সেটা জানতাম না। এডিট করবার উপায় থাকলে করে দিতাম। পরেরবার ফরিদপুর গেলে ঘুরে আসবেন। হাতে ঘণ্টাখানেক সময় থাকলেই পুরোটা ঘুরে দেখে আসতে পারবেন।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আবারও পপকর্ন ? রেগে টং ম্যাঁও

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।