একদিকে খরস্রোতা রায়মাটাং নদী। অন্যদিকে ভুটান পাহাড়ের হাতছানি। ছবির মত সাজানো একটা পাহাড়ী গ্রাম। নদীর নামেই গ্রামের নাম। রায়মাটাং। পূর্বতন জলপাইগুড়ি (এখন নবগঠিত আলিপুর জেলার অন্তর্গত) জেলার কালচিনি ব্লকের এই প্রান্তিক গ্রামে আপনাকে স্বাগত।
আমার বাড়ী থেকে সব মিলিয়ে ঘণ্টা চারেকের পথ। অতএব উঠল বাই তো রায়মাটাং যাই। প্রথমে বাসে কালচিনি। সেখান থেকে গাড়ী ভাড়া করে রায়মাটাং। চা বাগানের বুক চিরে সরু রাস্তা। শ্রমিক বস্তি। এস এস বি ক্যাম্প। একটু এগোলেই রায়মাটাং নদী। সেটা পেরোলে তবে রায়মাটাং গ্রাম। মাঝ নদীতে হঠাৎ বিপত্তি। নদীর স্রোতে আটকে গেছে গাড়ীর চাকা। প্রথম গীয়ার প্রবল গর্জনে জানিয়ে দিল লাভ নেই বাবা, আমাকে রেহাই দাও। আশে পাশে কেউ নেই। কোন সকালে চারটে খেয়ে বেরিয়েছি। পেটেও আগুন। সবাই নেমে ঠেলা শুরু করলাম। লাভ হল না। দূর থকে ইঞ্জিনের শব্দ পেলাম। ট্রাক। পাথর তুলতে আসছে নদী থেকে। সেই ট্রাকে দড়ি বেধে আমাদের গাড়ির পেছনে দড়ি বেঁধে উদ্ধার হল।
এবারে ড্রাইভার গোঁ ধরল সে আর যাবে না। জল বাড়ছে নদীতে। ফিরতি পথে কী হবে? আমরা ভাবলাম হক কথা। অতএব মালপত্র পিঠে বেধে সোজা হাটা লাগালাম। পথে পেয়ে গেলাম সেই গ্রামের এক সওয়ারী কে। তার পিছু পিছু চলা শুরু করলাম।
এক বন্ধু ফোনে বলে দিয়েছিল কাজী সাহেব কে। উনি হোম স্টে চালান রায়মাটাং এ। মানে নিজের বাড়ির দোতলায় দুটো ঘরে পর্যটকদের থাকার ব্যাবস্থা। যা বলবেন, রেঁধে খাওয়াবে। একটা বাড়ী বাড়ী ব্যাপার। হোটেলের মত সেলাম ঠুকবে না কিন্তু নিজের রান্নাঘর থেকে নিজের হাতে বানানো গাওয়া ঘী টা, আচারটা আপনার পাতে চুলে দেবে।
এই হল রায়মাটাং। ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম। ভীষন চুপচাপ। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের লাগোয়া। একটু দূরেই ভূটান। সারি সারি কাঠের বাড়ি গোটা গ্রাম জুড়ে। বেশ সাজানো গোছানো। গ্রামের লোকেরা চাষবাস করেন আর কেউ কেউ হোম ষ্টে চালান। টুকটাক পশুপালন তো আছেই। গরুটা, মুরগীটা। দুধ টা, ডিমটা। তাও হাতির হামলায় ফসল নষ্ট হয় প্রায়শই। অনেকে শষ্যবীমা করান। ক্ষতিপূরণও জুটে যায়।
তো রায়মাটাং পৌঁছে সোজা কাজি সাবেবের কাঠের দোতলার একখানা ঘরের বিছানায় নিজেকে সমর্পন করলাম। একটু জিরিয়ে স্নান টান সেরে খাওয়ার ডাক পরল। ডিমের ঝোল ভাত যেন অমৃত।
বেলা থাকতে থাকতে ভাবলাম একটু ঘুরে দেখি আশপাশটা। জঙ্গল ঘন হচ্ছে। আসলে বনের একটা হাতছানি হাতছানি ব্যাপার আছে। শুধু মনে হয়, ঐ বড় গাছটা অব্ধি যাব, ব্যাস। তারপর মনে হয়, এইত্তো আর একটু। এভাবেই ভেতরে ঢুকে গেছি অনেকটা। বুনো আওয়াজ, বাঁদরের লাফঝাপে ভয় পেলাম। বেশ জলদি পা চালিয়ে ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখি একজন আমাদের খুজতে বেড়িয়েছে। ভেবেছে কোর এরিয়ার ঢুকে গেছি।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দেখি দূর থেকে লোকজনের চিৎকার আর পটকার আওয়াজ। ভয় পেয়ে গেলাম। কাজি সাহেব জিগেস করলেন, হাতি দেখবেন? তাহলে চুপটি করে দাঁড়ান বারান্দায়। এ তো রোজকারের ব্যাপার। ভূট্টার লোভে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে হস্তিকূল হানা দেবে লোকালয়ে। ব্যাস ফাটাও পটকা। আর ভাগাও হাতি। আগের দিন পূর্নিমা গেছে। চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। হাতির চিৎকার শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। একটু পরে দেখি সব চুপচাপ। মানুষের সাথে পারা একটু চাপের।
সকাল সকাল সকাল হল। অন্যদিন খুব তাড়া না থাকলে একটু দেরী করেই হয়। আজ তো তাড়া ছিল না। তাহলে? চা বিস্কুট খেয়ে একটু টহলদারি করলাম। এবাড়ী ও বাড়ী। বাচ্চারা পড়ছে। সকাল আটটায় দিনের একমাত্র যান টি ছাড়ে রায়মাকটাং থেকে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া দু চারজন, ব্যাবসায়ী, অনেকদিন পর বাড়ির বাড়ী যাওয়া বধূ – সবাই খুব ব্যাস্ত। আমরাই শুধু গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
কাজি সাহেব বললেন, যাবেন নাকি জঙ্গলে? আমরা একটু ভয় পেলাম। গতকালের স্মৃতি সুখকর নয়। কাজী সাহেব একটু হেসে বললেন, আরে ভয় নেই। আমার বাবা সাথে যাবেন খুকড়ী নিয়ে। গাইড যখন পেয়ে গেলাম, তখন আর কি?
গতকাল যে দিকে গেছিলাম, সে দিকে নয়। আজ আন্য দিকে। প্রথমে বেশ ফাঁকা ফাঁকা। যত এগোচ্ছি, তত ঘন হচ্ছে জঙ্গল। নাম না জানা পোকারা ডেকেই চলেছে অবিরত। দূর থেকে জলের শব্দ পাচ্ছি। ছোট নদী। জল প্রায় নেই। নদী পেরোলেই বক্সা।
কাজি সাহেব একটা গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন। কালচিনি ড্রপ করে দিয়ে আসবে। লুচি আলুর দম সাঁটিয়ে বাক্স প্যাটরা বেঁধে কাজি সাহেবে টা টা করে চড়ে বসলাম গাড়ীতে। রায়মাটাঙ্গের বুকে থামলাম একটু। দু একটা ক্লিকবাজি আর মনে মনে রায়মাটাং কে টা টা বলা।
**********************************
# দীপালোক
#
**********************************
মন্তব্য
চমৎকার ছবি ব্লগ। ঘুরবার ইচ্ছা থাকল। এরকম পোস্ট আপনার কাছ থেকে আরও বেশি বেশি চাই।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
- দীপালোক
ফ্লিকার থেকে যখন ছবির কোড সচলায়তনে পেস্ট করবেন, তখন যে ছবিটা নীড়পাতায় দেখাতে চান, সেটার কোডে একটু কষ্ট করে width = "100%" height = "100%" করে দেবেন। তাহলে ছবিটা আর ফ্রেমের বাইরে চলে গিয়ে নীড়পাতা ভচকে যাবে না।
জায়গাটা ভারি সুন্দর।
নীড়পাতায় বেখাপ্পা ভাবে সেঁটে থাকা ছবি দেখে নিজের চোখেই কেমন ঠেকত।
শিখলাম পদ্ধতি টা।
ধন্যবাদ।
- দীপালোক
কাচ্চা বাচ্চার ছবিগুলা সেইরকম ভাবের, পড়ার ছবিটায় কি মনোযোগ!
চুরি করে তুলেছি পিচ্চিদের ছবিগুলো।
- দীপালোক
আগের ছবিব্লগ গুলোতে আলাদাভাবে ছবির ক্রমিক সংখ্যা ও শিরোনাম দিতাম। এটায় নিটোল ভ্রমণ কাহিনীর ধরন আনতে চেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে শিরোনাম না থাক, অন্তত ছবির ক্রমিক সংখ্যা থাকাটা দরকার।
ধন্যবাদ শাব্দিক, আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য।
- দীপালোক
লেখা ও ছবি সব মিলিয়ে অসাধারণ। ছবিগুলিতে নম্বর দিয়ে দিলে আলোচনা করতে সুবিধা হয়।
বাচ্চাদের ছবিগুলি সবচেয়ে ভাল লাগল। আর ক্যাক্ট্যাসের পরের ছবিটা আমার চোখে লেগেছে দারুণ!
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
এই ছোট্ট লেখাটায় নাকি ছবি তোলার ধরণে কী এক যাদু ছিল, এক নিমেষে রায়মাটাং এর প্রেমে পড়ে গেলাম। তিনটে শিশুকে এমন জীবন্ত লাগলো! বাংলাদেশ থেকে তো জায়গাটা কাছেই। একবার ঘুরে আসতে চাই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আপনি বাংলাদেশের কোথায় থাকেন জানি না।তবে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে রায়মাটং।
চলে আসুন রায়মাটাং এর সন্ধানে।
- দীপালোক
আহারে, এমন মানব জনম আর কি পাবে/ মন যা চায় ত্বরায় কর এ ভবে...!
এত সুন্দর জায়গাটা, কেমন নিরব আর মায়া মায়া। মাঝে মাঝে শিউড়ে উঠলো গা। কত দিন যেন এমন কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে নি...
একটা লাইন খুউব ভালো লাগলো
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
বাহ, লোভে পড়ে গেলাম
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
দারুণ!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ছবি গুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। লেখাটা পড়ার পর মনে হল ইস আর একটু বড় হলে মণ্ড হোত না।
-------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/
নতুন মন্তব্য করুন