ভোরের আলোয় প্রথম যা নজরে পড়লো তা একটি রুপালি মল। এ নামটি বলাই হয়তো সংগত। মলটি আসলেই রুপার কিনা সে কথাও ভাবনায় এসেছে আনসার সাহেবের। গোড়ালি ছাড়িয়ে মলটি লুটিয়ে ছিল যে পায়ে তার আঙ্গুলগুলো সুন্দর। লাল নেইল পালিশ সরু ফর্সা আঙ্গুলগুলোকে আরো মোহনীয় করেছে। মাঝখানের দুটো আঙ্গুলে রুপালি আংটি। রমনা পার্কের লেক ঘেঁষা সিমেন্টের বেঞ্চে মেয়েটি ঘুমিয়ে ছিল। সাদা ফুঁটি মেশানো লাল কামিজ ও সাদা পাজামা মেয়েটির দেহ ঢেকে রেখেছে। হলুদ দোপাট্টার একটি অংশ দিয়ে বাম হাতটি ঢাকা। বাকি অংশ মাথা আবৃত করে মুখের উপর পড়েছে। তা চেহারাকে আড়াল দিয়েছে। ভাঁজ করা ডান হাতটি বালিশ করে কি আয়েশে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি। লেক ঘেঁষা ফুটপাত দিয়ে প্রাতঃভ্রমণরত আনসার সাহেব এসব নজর করছিলেন। বেঞ্চটির একেবারে কাছে এলে আনসার সাহেব অবাক হলেন এই দেখে যে একজন নয়, দুজন ঘুমিয়ে আছে বেঞ্চে। সরু বিছানায় সিক্সটিনাইন হয়ে দুজনের ঘুমানোর এ কায়দাটির কথা তিনি আগে শুনেছেন। কাছে থেকে না দেখলে মনে হবে একজন। দ্বিতীয়জনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই ঢাকা। তারপরও এটা অনুমান করতে বেগ পেতে হলো না যে এটিও একটি মেয়ে। নারী দেহকাঠামো সুন্দর। পুরুষ থেকে আলাদা করে তাকে চিনতে জহুরী লাগে না।
ঘুমন্ত প্রথম মেয়েটির মাথার নিচে ভাঁজ করা ডান হাতের মধ্যমা ও অনামিকায় আংটি আছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় তার উপরও নজর পড়লো আনসার সাহেবের। আরও একটি কারণ হয়তো এই যে ভোরের আলোয় রুপালি মল ও আংটিগুলো চিকচিক করছিল। শুধু কি সে জন্যেই এমন গভীর পর্যবেক্ষণ? ভোরে এই পার্কের বেঞ্চে আরও কত মানুষ ঘুমিয়ে আছে। কই তাদের নিয়ে তো এত ঔৎসুক্য হয়নি আনসার সাহেবের। এসব ভাবনা যখন মাথায় ভিড় করছে, তখন আবারো সুন্দর পায়ে অবহেলায় বিছিয়ে থাকা মলের ছবিটি মনের আয়নায় দেখলেন আনসার সাহেব।
এখন বোশেখ মাস। গত রাতের প্রথম প্রহরে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে যে আদ্রতা ও ভ্যাপসা গরম ছিল, তা আর নেই। বৃক্ষের পত্রাবলি ধোঁয়ামোছা, ঝকঝকে। কিউটিন নামের ভেষজ মোম পাতার বহিরাবরণে একটি চকচকে ভাব দিয়েছে। তার উপর বৃষ্টির ফোঁটা ভোরের আলোয় মুক্তোর দানার মত স্থির হয়ে আছে। তাও পুরো ঠিক নয়। হাওয়ার দোলায় টুপটাপ গড়িয়েও পড়ছে নিচে। বেঞ্চের উপর প্রসারিত বৃক্ষশাখা থেকে পানির ফোঁটা ঘুমন্ত মেয়ে দুটোর উপরও পড়েছে নিশ্চয়ই। ভাবেন আনসার সাহেব। তারপরও কি আয়েশে তারা ঘুমিয়ে আছে? মল পরা মেয়েটি কি স্বপ্ন দেখছে?
এর পরের ভাবনাগুলো আনসার সাহেবের জন্য স্বস্তিকর হয়নি। ভোর হয়ে গেলে প্রকৃতির প্রানবাহি সবাইতো জেগে ওঠে। সেটাই তো নিয়ম। এরা দুজন কি অবলীলায় সে নিয়ম ভঙ্গ করে ঘুমিয়ে আছে। নিয়ম তো ভঙ্গ হয়েছে আগেই। ঘুমুতে যাবার নিয়ম। রাতের শেষ প্রহর অবধি হয়তো এই পার্কে নির্ঘুম থাকতে হয়েছে তাদের। তার কারণটি খুঁজতে গিয়ে বেদনা অনুভব করলেন আনসার সাহেব। কতই বা বয়স হবে মেয়ে দুজনের? খোলা পায়ের পাতা আর হাতের আঙ্গুল দেখে তো মনে হয় কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে আছে মেয়েটি। ঘর যে নেই তা তো স্পষ্ট। খায় কোথায় ওরা? নিছক ক্ষুধার কষ্ট মেটাতেও তো উপার্জন লাগে? তার জন্যই এই পার্কে রাত জাগা?
মল পরা মেয়েটির একটি নাম দেয়া যাক। মা-বাবা-দাদি-নানির দেয়া নাম মুছে ফেলে ফুল, নদী, পাখির নাম ধারণ করতে হয় পার্কের মেয়েদের। চম্পা নামটি ঠিক করা গেল। সাথের মেয়েটির নাম হতে পারে কলি। এবারে চম্পার কথা।
শীতের কুয়াশাঢাকা ভোর। হিরনপুর গ্রাম মাত্র জাগতে শুরু করেছে।
‘চম্পা মায়া উড। হাঁসের খুপ খুলতা না?
মায়ের ডাকে চম্পার ঘুম ভাঙলেও কাঁথার উম ছেড়ে তার উঠতে ইচ্ছে হয় না। তারপরই চম্পার মনে পড়ে দিনকয় আগে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেছে। ধানের ডুলায় উমে বসা মুরগির ডিমের সাথে দশটি হাঁসের ডিম চম্পাই দিয়েছিল। কতদিনের অপেক্ষার পর ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো বেরুলো। মুরগির বাচ্চার সাথে হাঁসের বাচ্চা!
‘এরা আবার কারা?’
মা মুরগির চোখে অবাক বিস্ময়। চম্পার নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে তা বাদ পড়েনি। আরও কি আশ্চর্য! বাচ্চাগুলোকে আলাদা করে চম্পা যখন হাঁসের কাছে নিয়ে গেল, তখন কি আয়েশেই না বাচ্চাগুলোকে চিনে নিয়েছিল মা। প্রথম সুযোগেই বাচ্চাগুলোকে সাথে নিয়ে বাড়ির পুকুরে নিয়ে গিয়েছিল মা হাঁস। এত ছোট ছোট বাচ্চা, এরা পানিতে ডুবে যাবে না? পুকুর পাড়ে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে চম্পা বসে ছিল। মায়ের পিছু পিছু ওরা জলে ভেসেছে, জলকেলিতে মত্ত হয়েছে। চম্পা মনে করার চেষ্টা করলো হাঁসের ওই বাচ্চাদের পায়ের রঙের কথা। একরকম রং ছিলনা সবার পায়ের। কারো লাল, কারো হলুদ। কারো বা কালো।
‘বাজান, বাজার থেইক্ক্যা ছোড ঘুঙুর আইন্ন্যো।’
‘ছোড ঘুঙুর দিয়া কি করবি?’
‘লাল পা ওলা হাঁসের বাচ্চার পায়ে বান্দুম।’
বাবা হাসেন। সুতোয় বাঁধা ঘুঙুর বাবা ঠিকই এনেছিলেন। সাথে এনেছিলেন চম্পার পায়ের মল। চম্পা ঘুঙুর পরানো লাল পায়ের হাঁসের বাচ্চার নাম দিয়েছিল লালবিবি।
‘আমার পুতলা লালবিবিরে, দেখ তর পায়ে দিছি ঘুঙুর, আমি পিন্দছি মল। ক দেহি লালবিবি, কোনডা বেশি সোন্দর?’
রমনা পার্কের বেঞ্চে ঘুমন্ত চম্পার ঠোটে মৃদু হাস্যের রেখা কি চকিতে খেলে গিয়েছিল?
হাঁসের বাচ্চারা বড় হলো। তাদের বাচ্চাকাচ্চা হলো। চম্পাও এখন কিশোরী। বেণি দুলিয়ে স্কুলে যায়। তার চোখে নানা রঙের তারাবাতি জ্বলতে শুরু করেছে। চোখের সামনে বড় হওয়া হাঁসা-হাঁসির সোহাগ ভালবাসা তাকেও আন্দোলিত করে। নিজের সুন্দর পায়ের পাতা দেখে চম্পা নিজেই মুগ্ধ। পায়ের মলটি অবশ্য তার আর পরা হয়না। ছোট বেলায় বাবার দেয়া মলটি বেড়ে ওঠা তার পায়ে বেমানান ঠেকে। তবে আরেকটি মল কিনে দিতে বাবার কাছে চম্পার বায়না ধরা হয়না। কেমন এক লজ্জা চম্পাকে আঁকড়ে ধরে।
‘মায়া চম্পা, আমার মাথার কাছে বস।’
কি এক অসুখে ধরেছে চম্পার মায়ের। কিছু খেতে পারেনা। অল্প দিনেই হাড্ডিসার হয়ে গেল চম্পার রূপবতী মা। পরীর মত চম্পাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে। সে বার্তা মা পেয়ে গেছে।
‘হুন চম্পা, আজরাইল ফিরিশতা আইবো আমার জান কবজ করতে। বেশি দিন নাই। তর বাপে আরেকটা বিয়া করবো। মায়াগো তর হতালো মা যেন বালা অয়। তরে যেন সোহাগ করে।’
মায়ের কথা ফলতে দেরী হয়নি। তার কবরে যাবার পর তিন মাস ঘুরেনি। বাবা আবার বিয়ে করেছে। তবে মায়ের বাসনাটি পূরণ হয়নি। সৎ মায়ের বয়স বেশি নয়। চম্পার মায়ের মত রূপ না থাকলেও বাবাকে আচ্ছন্ন করার মত চমক তার আছে। সে মায়ের ঘরে সন্তান এসেছে। পুত্র সন্তান। বাবার কাছে চম্পা আদরের ছিল। তবে একটি ছেলের জন্য বাবার কাতরতার কথা চম্পা জানতো। সৎ মায়ের আদর চম্পা পায়নি। ছেলে পাবার পর বাবার আদরেও কি টান পড়ছে? চম্পা ভেবে আকুল হয়। দিন যায়। বড় হয় চম্পা। সে সাথে বাড়ে তার রূপ।
‘বাজান, এক কৌটা তিব্বত স্নো আইন্নো।’
চম্পা খেয়াল করেছে বাবা সৎ মায়ের জন্য তেল, স্নো, পাউডার এনে দেয়। ছোট ভাই রতনের সব বায়না পূরণ করে। অনেক দ্বিধার পর চম্পা তিব্বত স্নোর বায়না ধরেছিল। কিন্তু বাবার চোখে আগের মত সস্নেহ আশ্বাস চম্পা দেখেনি। বরং সেখানে কেমন এক অসহায়তা। সৎ মা জাদু করেছে বাবাকে। বাবা তিব্বত স্নো আনেনি অথবা আনতে ভুলে গিয়েছে।
চম্পার উপর নিগ্রহ বেড়েছে। কারণে অকারণে সৎ মায়ের খোটাই শুধু নয়, স্কুলে যাওয়া তার বন্ধ হয়েছে। ঘরের কাজ চম্পা আগেও করেছে, এখন রান্না শুধু নয়, তাকে লাগানো হয়েছে ধানবানাসহ গতর খাটার নানা কাজে। এসবই চম্পা মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বাবার অনাদর তার অসহ্যবোধ হলো।
শহরে কাজ করে হরকত। কি কাজ, তা কেউ তেমন জানেনা। মাঝে মধ্যে গ্রামে আসে। চম্পার উপর নজর তার অনেক দিনের। চম্পাও তা জানে। পাত্তা দেয়নি কখনো। হরকত হাল ছাড়েনি।
‘চম্পা, তর কি চেহারা আছিল, কি অইছে। সৎ মায়ের জ্বালায় আর কত জ্বলবি? ল আমরা জাইগা ঢাকা শহরে। ভালা কাম জোগাড় করছি গার্মেন্টসে। ঘরও ভাড়া করছি। তরে বিয়া করুম, সুহে রাখমু।’
চম্পা ভাবে। হরকতকে কি বিশ্বাস করা যায়? সেসব ভাবনার ইতি হয় এক রাতে। হরকতের হাত ধরে চম্পা আসে শহরে। বাস থেকে নেমে রিকশায় চড়ে বস্তির পথে যেতে রাতের ঢাকার দোকানপাটের আলোর ঝলকানি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল চম্পা। তবে দ্রুতই তা অন্তর্হিত হলো কটু দুর্গন্ধে। বস্তির গলিপথে রিকশা থেমেছে। খোলা নর্দমার পাশ ঘেঁষে টিনের চালা আর বাসের বেড়ায় আচ্ছাদিত সারি সারি ঘর। তেমনি এক ঘরে হরকত ঢুকল চম্পাকে নিয়ে।
পার্কের বেঞ্চে চম্পার নাক কি এ সময় একটু কুঁচকে গিয়েছিল?
‘কইছিলাম না ঘর ভাড়া করছি।’
হরকতের এই কথায় হিরনপুরের গ্রামের বাড়ির উঠান, পুকুরে সঞ্চরণরত ঘুঙুর পায়ে লালবিবি, স্কুলে যাবার মেঠোপথ - এসব থেকে রুঢ় বাস্তবে ফিরে আসে চম্পা। হরকতের আশ্বাসে খুব একটা ভরসা পায় না।
‘এই চৌকিত আরাম কইরা বয়। দোকান থেইক্কা খাওন লইয়া আইতাছি।’
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা বন্ধ করতে বলে হরকত বের হয়ে যায়।
এ কোথায় এসেছে? চম্পা ভাবে। কাগজের ঠোঙায় পরোটা এবং পলিথিন ব্যাগে মুরগির ঝোল মাংস নিয়ে হরকত ঘরে ঢুকলে চম্পার কলজায় পানি আসে।
‘আমরার বিয়া হয় নাই অহনো।’
চম্পার কাকুতি মিনতিতে কান দেয়নি হরকত। প্রথম রাতেই চম্পা ধর্ষিত হয়।
কয়েক দিন চলে যায়। বিয়ের কাজি আসে না।
‘ধইরা ল আমরার বিয়া হয়া গেছে।’
হরকতের এমন কথায় চম্পার শুধু কান্নাই পায়।
‘তুমিতো কামে যাও না। গার্মেন্টসে কামের কথা কইছিলা না।’
চম্পার এ কথায় রহস্যের হাসি খেলে যায় হরকতের মুখে।
‘চম্পা, কাম তো করবি তুই। কত টেহা কামাইবি।’
এ নিয়ে চম্পার ভাববার সুযোগ বেশি হয়নি। কারণ সে রাতেই চম্পা ধর্ষিত হয় চারবার। ঢাকায় আসবার পঞ্চম দিন দিবাগত রাতে যে দুজন তাকে ধর্ষণ করে, তারা এ পাড়ার মাস্তান। তাদের কথা চম্পা জেনেছে পরে। এক মাসও যায়নি। চম্পাকে রাতের পার্কে কাজে নামিয়েছে হরকত। অবস্থা ফিরেছে। ভাল ঘর নিয়েছে হরকত। বছর ঘুরেছে। দিনে দিনে চম্পার চোখ খুলেছে। নিজের ক্ষমতার জোরটি ভাল করেই বুঝেছে। হরকতের হাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজে চম্পা।
শাহবাগে প্রাণের জোয়ার লেগেছে। পার্কে চম্পারা যেমন জেগে থাকে, তেমনি জেগে থাকে শাহবাগ। এত মানুষ একসাথে কখনো দেখেনি চম্পা। দিনরাত মাইকে ছেলে-মেয়েদের শ্লোগান কেমন এক ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে দূর পার্কের মেয়েদের কানে ভেসে আসে। তা শুনে চম্পার মনেও দোলা লাগে। কি এক নেশার টানে রমনা-সহরোওয়ার্দি মাঠের গাছ-গাছালির আলো-আঁধারির ফাঁকে ফাঁকে সে অগ্রসর হয়। ঘোর লাগানো শ্লোগান শোনে। শ্লোগান কন্যাদের নাম তার মুখস্থ্ হয়ে গেছে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনলেই চম্পার হিরনপুর গ্রামের কথা, মায়ের কথা মনে পড়ে। জলে ভাসা ঘুঙুর পায়ের লালবিবির কথা মনে পড়ে।
‘ল আমরাও যামু শাহবাগ।’
চম্পার এমন প্রস্তাবে অবাক হয় রমনা পার্কের রাতের বন্ধু কলি।
তারা সেখানে যাবে? কলির কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়।
‘চম্পা, আমরা হইলাম নষ্ট মাইয়া। আমরা যামু শাহবাগ? যাওনডা কি ঠিক হইবো? যাইতে দিব আমাগো?’
কলির এসব কথায় চম্পা দমে যায় না।
‘হুন কলি, কাইল সন্ধ্যায় আমরা শাহবাগ যামু। গোছল দিয়া, পয়-পরিষ্কার হইয়া ভালা শাড়ি পইরা যাইতে হইবো। সারা রাইত শাহবাগে থাহুম। পার্কের কাম কাইল বন্ধ।’
সাবান, শ্যাম্পু মেখে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেছে চম্পা। সেই ছোট বেলায় বাবার দেয়া মলটির কথা কেন মনে হয়েছিল তার? রুপালি মল, হাতের ও পায়ের আংটি কিনেছে আজকের দিনটির জন্য। লাল সবুজের ফিতা কিনেছে মাথায় বাঁধবে বলে। এমনই তো বাঁধে শাহবাগের ছেলে-মেয়েরা। সাজা-পাড়া শেষ হলে আয়নায় নিজেকে দেখে চম্পা অবাক। ভিড় ঠেলে সন্ধ্যায় ঠিকই চম্পা ও কলি হাজির হয়েছিল শাহবাগে। খুব কাছে চলে গিয়েছিল শ্লোগান কন্যাদের। গলা ফাটিয়ে শ্লোগানও ধরেছিল। কেমন এক শিহরণ সারা শরীরে। মুক্তির শিহরণ।
‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই।’
এ শ্লোগান এক নতুন বার্তা দেয় চম্পা-কলির মনে।
কঠিন সিদ্ধান্তটি সে রাতেই তারা নিয়েছিল। প্রথমে নেশায় বুঁদ করা। তারপর এক ধাক্কায় রমনা পার্কের লেকের পানিতে ফেলে চেপে ধরে রাখতে হবে কতক্ষণ। তার প্রস্তুতি চলেছে পরপর কয়েক রাত। গত শেষরাতে শত্রুনিধন যজ্ঞটি সুচারু ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তারপর সিমেন্টের বেঞ্চে গভীর পরিতৃপ্তির ঘুম।
এই ভোরে কোলাহলটির কারণ খুঁজতে গিয়ে আনসার সাহেব যা দেখলেন, তা রমনা পার্কের লেকের পানিতে ভাসমান একটি লাশ। সে দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে কিছু মানুষের দৃষ্টি। তারাই কোলাহল করছে।
সে কোলাহলে চম্পা ও কলির নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। তবে কোলাহলের উৎসের দিকে নজর ফেরাতে তেমন আগ্রহ বোধ করেনা তারা। আরেকটি প্রভাত যে ইশারা দিয়েছে তা মুক্তির। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চম্পা ও কলি চেয়ে থাকে পরস্পরের মুখের দিকে। বিস্মিত হয় তারা। নিজেদের মুখ নয়, তারা দেখতে পায় শ্লোগান কন্যাদের মুখ।
- মো. আনোয়ার হোসেন
মন্তব্য
মনে হলো খামোখাই গল্পে শাহবাগ ঠেসে দিয়েছেন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
গল্পটি পড়বার জন্য ধন্যবাদ জানাই। শাহবাগে নতুন প্রজন্মের জাগরণে সমাজের সবাই যোগ দিয়েছিল। শ্লোগান কন্যারা মুক্তির নানা বার্তা দিয়েছিল সে উত্তাল সময়ে। তা আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাতে আলোড়িত হয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষ। শিখণ্ডী থেকে শুরু করে কে না যোগ দিয়েছে শাহবাগে। রমনা পার্ক তো শাহবাগ থেকে খুব দূরে নয়। খুব কাছে থেকে দেখেছি কি ভাবে লাঞ্ছিত-নিপীড়িতরা মুক্তির পথ খুঁজেছে শাহবাগে নানা শ্লোগানে। গল্পে সেই সময় - তার অনুষঙ্গ-অভিঘাত যুক্ত করা সহজ কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করছি। কবিতায়, গানে শাহবাগ যেভাবে উঠে আসছে, গল্পে তেমনটা হয়নি। শক্তিমান গল্পকাররা যখন সেই দূরহ কাজটি সম্পাদন করবেন, তখন 'খামোখাই গল্পে শাহবাগ ঠেসে দেয়া' মনে হবে না। আপনার মন্তব্যের জন্য পুনশ্চ ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
নতুন মন্তব্য করুন