সাফারি পার্ক শব্দযুগল শুনলেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি কিংবা লম্বা ঘাসের জঙ্গল। সেই জঙ্গলে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলেদুলে শিকারের দিকে এগিয়ে চলছে বাঘ কিংবা সিংহ মামা। কোথাও জলহস্তীগুলো পানি থেকে বের হয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কোথাও বা জিরাফগুলো ঘাসের আড়াল থেকে লম্বা গলা বের করে বিস্ময়ের সাথে হাতির বাচ্চাদের জলকেলি দেখছে। আর আমি হুডখোলা জীপের ভিতরে বসে এইসব প্রাণীকুলের ভিতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
আপাতত যেহেতু কেনিয়া কিংবা তানজানিয়া যাওয়ার মুরোদ নেই, সেহেতু ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের কল্যাণে এইসব দিবাস্বপ্ন দেখতে খারাপ লাগে না। কল্পনার তো আর সীমা-পরিসীমা নেই। আমার কাছে সাফারি পার্ক মানেই তাই এক চঞ্চল পরিব্রাজকের হুডখোলা চৌ-চক্রযানে চেপে জনমানবশূন্য পশুকুলের রাজত্বে হারিয়ে যাওয়া।
সেই আমি যখন শুনলাম বাংলাদেশেও সাফারি পার্ক আছে তখন যতটা অবাক তারথেকেও বেশি খুশি হয়েছিলাম। কক্সবাজারের পেকুয়া থানার শুঁটকি বাজারে ঘুরতে ঘুরতে যখন শুনলাম সাফারি পার্কটার অবস্থান ঢিল মারা দূরত্বে তখন মনে আনন্দের বান ডেকে গিয়েছিল। যাক, স্বপ্নটা মনে হচ্ছে অবশেষে পূরণ হয়েই যাবে।
বলছি দুলাহাজরা সাফারি পার্কের কথা। ২২২৪ একর আয়তনের এই সাফারি পার্ক কক্সবাজারের চকোরিয়া থানায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম থেকে এর দূরত্ব ১০৭ কিমি। বছর চারেক আগে যখন সেখানে যাই তখন সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সাফারি পার্ক। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে গাজীপুরে এশিয়ার বৃহত্তম সাফারি পার্ক উদ্বোধন করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই দুই সাফারি পার্কের নামই রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামে। যে কোন একটা সাফারি পার্কের নাম বদল করে অন্য কারও নামে রাখলে মনে হয় যুক্তিযুক্ত হত।
২০১১ সালের কথা। চাকরীতে জয়েন করেছি অল্প কিছুদিন হল। মিটিং করতে গেলাম চট্টগ্রাম। মিটিং এর পরেরদিন ছিল ফিল্ড ভিসিট। ঠিক করলাম কক্সবাজারের চকোরিয়া আর পেকুয়া থানায় যাব। খুব ভোরে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে প্রথমে গেলাম পেকুয়া’তে। সেখান থেকে চকোরিয়া। আগেই ধান্দা করেছিলাম এই চান্সে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসব। স্যারকে উল্টা-সিধা বুঝিয়ে রাজী করালাম যে রাতে কক্সবাজার থাকব। হাতে অনেক সময়। ঠিক করলাম এই সুযোগেই সাফারি পার্ক ঘুরে দেখতে হবে। আমাদের চকোরিয়ার প্রতিনিধি’কে বললাম যে সাফারি পার্কে ঘুরতে চাই। অতএব একটা আনকোরা বাইক তৈরি হয়ে গেল আমাকে দুলাহাজরা নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
আমাদের লোকাল প্রতিনিধির নাম ছিল সৈকত। কঠিন চালু মাল। আর্মিতে ছিল এককালে। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিল যাতে মেয়ের বিয়ে ঠেকানো যায়। এই কাজে সে সফল। সেই সাথে আরো সফলতা আছে। আর্মির আইডি কার্ড তার কাছে এখনো আছে যেটার ব্যবহার সে প্রায়ই করে। কিভাবে? যখন ট্রাফিক পুলিশ লাইসেন্স দেখতে চায় তখন সে আইডি দেখিয়ে বলে সে আর্মিতে চাকরি করছে। এখন দুই মাসের ছুটিতে আছে। একবছর এইভাবেই চলছিল। এখনকার খবর জানি না।
বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর রাস্তা হচ্ছে সাতকানিয়া টু কক্সবাজার রাস্তা। দুইপাশে জঙ্গল আর প্রচুর গাছপালা।
কক্সবাজার থেকে দুলাহাজরার দূরত্ব ৪০ কিমি। আর চকোরিয়া থেকে ১৫-২০ কিমি। চকোরিয়া থেকে চারপাশের দৃশ্য বাইকে করে দেখতে দেখতে যেতে দারুন লাগছিল। রাস্তায় মাঝে মাঝেই কিছু মাচা চোখে পড়ছিল। এইরকম মাচাসদৃশ ঘরে রাত কাটাতে পারলে ভালই হত।
এই রাস্তায় বাইক চালানোর একটাই সমস্যা। হুশহাশ করে চারপাশ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে গাড়ি চলে যায়। বাইক চালানোর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। আর সৈকত বাইক চালাচ্ছিল সেইরকম জোশ নিয়ে। নাক-মুখ-চোখ বন্ধ করে দাঁতকপাটি মেরেছিলাম অনেকক্ষণ। (চাকরি জীবনের শুরুর দিকের কথা তো। এখন অবশ্য বাইকের পিছনে চড়তে চড়তে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে ১০০ কিমি গতিতে চললেও বাদাম ছিলে খেতে পারব।) অবশেষে পার্কের প্রবেশপথে চলে এলাম। দেয়ালের উপর বিভিন্ন পশু-পাখি আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি। বাস্তব না, প্রতিকৃতি।
শেষ বিকেলে দিকে দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু সৈকত কঠিন চালু। সে এক পরিচিত লোক বের করে ফেলল। সেই লোককে বাইকের পেছনে তুলে আমরা পার্কের ভিতরে ঢুঁকে পড়লাম। দক্ষিনা হিসাবে ৫০ টাকার একটা নোট খরচ করতে হল এই যা। কিছুদূর যাবার পর চোখে পড়ল চমৎকার একটা লেক।
লেকের অপর পাশে দেয়াল ঘেরা জায়গাটায় দুইটা কুমিরকে ঘুমাতে দেখলাম। গাইডের ভাষ্য অনুযায়ী "স্যার, এইগুলান ভড়ং ধইরসে। খালি দেওয়াল টপকাইয়া নামেন। কপ কইরা কামড়াইয়া ধইরা আপনেরে নিয়া পানিতে নাইমা যাইব।" ভয় পাওয়ার মতই ব্যাপার। এত শান্ত চেহারা দেখে বোঝাই যায় না কুমিরগুলা এত মিচকা শয়তান। আপনাদের কি মনে হয়?
কুমির দর্শন শেষে আমরা জঙ্গলের রাস্তা ধরে বাইক নিয়ে ছুটলাম। সরু রাস্তা। দুইপাশে বন অনেক ঘন হওয়া শুরু করল।
কিছুক্ষণ পর এসে পৌঁছলাম একটা মিনি চিড়িয়াখানায়। চলেন আমরা কিছু চিড়িয়া দেখি। প্রথমেই শকুন। আরও আছে মেছো বাঘ এবং ময়ূর।
আবারও বাইক যাত্রা। এইবার থামলাম একটা ওয়াচ টাওয়ারের নিচে।
টাওয়ারের উপর উঠে নিচে তাকালে মাথা পুরাই ঘুরায়।
পূর্বদিকে অরণ্যের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের অবয়ব চোখে পড়ল। ওইগুলো বান্দরবনের পাহাড়। অরণ্য যেখানে শেষ সেখান থেকে বান্দরবন শুরু।
পশ্চিমদিকে তাকিয়ে আমি মুগ্ধ। সূর্যাস্তের শেষ আলোয় গহীন অরণ্যকে কেমন যেন রহস্যময় রহস্যময় লাগছিল। ঠিক যেন চাঁদের পাহাড়ের রহস্যময় প্রাণী বুনিপের আবাসস্থল।
নিচে নেমে বাইক আবারও ছুটে চলল। এবার আমরা দ্রুততার এমন একটা জায়গা পার করলাম যেখানটায় বুনো হাতি চলাচল করে। ভয় যেমন করছিল তেমনি রোমাঞ্চও হচ্ছিল। বুনোহাতি দেখার সাহস ছিল না তাই বলে কি হাতি দেখব না? অতএব তুলে ফেললাম একখান ফটো পোষ মানা হাতিকে পাশে নিয়ে।
এইবার আমরা আবারও চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করলাম। প্রথমে হরিণ।
তারপর সিংহ মামা।
এবং বাঘ মামা। এই বাঘ মামা আবার স্পেশাল। কিছুদিন আগেই তিনি একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে দিয়ে তার লাঞ্চ সেরেছেন। সাফারি পার্কের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার প্রাণীরা লোহার গরাদের পাশাপাশি মুক্ত জায়গাও পায় বিচরনের জন্য। এমন বিচরণের সময় জনৈক বেরসিক ব্যক্তি বাঘের বিচরণস্থানে ঢুঁকে পড়েছিলেন। তারপর ভাগ্য মন্দ থাকলে যা হয় আর কি।
আরো দেখলাম পানিতে ডুবে থাকা জলহস্তী এবং ভালুক।
অনেক ঘুরে ক্লান্ত? বিশ্রাম করার জন্য স্পেশাল ঘরের ব্যবস্থা আছে।
আমাদের সাফারি পার্ক ভ্রমণ আপাতত শেষ। এই বনে আছে ১৬৫ প্রজাতির ৪০০০ এর বেশি প্রানী। কিছু প্রাণী সংগ্রহ করা হয়েছে বাইরের দেশ থেকে আর বাকিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া বিপন্ন প্রাণীগুলোর নিরাপদ আবাস এই সাফারি পার্ক। যারা এখনো যান নি, তারা সুযোগ করে ঘুরে আসুন। আফ্রিকার সাফারি পার্কের ফ্লেভার হয়ত পাবেন না, কিন্তু অরণ্যের ভিতরে ঘুরতে আপনার ভাল লাগবেই সেই গ্যারান্টি আমি দিয়ে গেলাম।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
মন্তব্য
ইমেজশ্যাক সাইটটা স্লো। ইমগুর বা ফ্লিকারে ছবি আপলোড করে শেয়ার দিলে দ্রুত লোড হয় সবকিছু।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ছবিগুলো অনেক আগে আপলোড করেছিলাম। তখন ইমেজ আপলোড হোস্টিং সাইট হিসাবে ইমেজশ্যাক কেই চিনতাম। এখন অবশ্য টাইনিপিকে ইমেজ আপলোড দেই অথবা ফেসবুকে আপলোড করে সেখান থেকে ব্লগে পোস্ট করি। ফ্লিকারে ছবি আপলোড করা হয়ে উঠে নি এখনও।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আপনার লেখার হাত ভালো। পুরো লেখার মধ্যে কেবল বাঘের হাতে মানুষ মারা যাওয়ার দুর্ঘটনা নিয়ে রসিকতাটুকু ভালো লাগল না। পরে একাউন্ট পেয়ে গেলে জায়গাটা এডিট করে নেবার কথা চিন্তা করে দেখতে পারেন।
..................................................................
#Banshibir.
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। এডিট করবার বিষয়টা মনে থাকবে।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আপনার হাতের লেখা ঝরঝরে! আরো লিখুন। পার্কে জনসমাগম কেমন হয়? প্রবেশমূল্য কত?
ইমেজশ্যাক এ ছবি দেবার বিপদ আছে। বছর চারেক আগে আমার লেখা একটা ৮ পর্বের সিরিজের সব ছবি তারা হাপিস করে দিয়েছে। এর চেয়ে মনে হয় ফ্লিকার ভালো।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
পার্কটা কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম উভয় শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় খুব বেশি জনসমাগম হয় না। যারা আসে ছুটির দিনগুলোতেই আসেন। প্রবেশমূল্য কত সেটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে ৫০ টাকার বেশি মনে হয় না।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
যুক্তিগুলি জানতে ইচ্ছে করছে। তেমন কিছু না, জাস্ট জানার ইচ্ছা বলতে পারেন। একটু কষ্ট করে বলবেন কি?
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
তেমন সিরিয়াস কিছু হিসাব করে বলি নি। যেহেতু দুইটাই সাফারি পার্ক, তাই একটা নাম বঙ্গবন্ধুর নামে রেখে অন্যটা আর কারও নামে রাখা যেত। আপনি যদি বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক লিখে সার্চ দেন তাহলে গাজীপুরের টা চলে আসে, কক্সবাজারের টা আসে না। কক্সবাজারের জন্য দুলাহাজরা সাফারি পার্ক নামে সার্চ দিতে হয়। অপরিচিত কেউ হঠাত করে কনফিউজড হতে পারেন। এই কারণেই পার্ক দুইটার নাম ভিন্ন হলে ভাল হত বলে আমার মনে হয়। ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন