লোকাল ট্রেনের একঘেয়ে দুলুনিতে ছেঁড়া মানিব্যাগটা বের করে টেকো মধ্যবিত্ত ভাবে – “না, এভাবে আর চলছে না”। রান্নায় এম.এ করা শ্রেয়া বউদি ক্ষীরের পায়েসটা চামচ দিয়ে আলতো করে ঠোঁটে লাগিয়ে বলে-“না, আজকেরটা জমল না”। একদিনও তানপুরা না ধরেই সঙ্গীত বিশারদ কেষ্টবাবু আনকোরা গাইয়ের খেয়াল শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ওঠেন-“না, কিসসু হচ্ছে না”। পাড়ার বাচ্চাদের দুরন্ত ক্রিকেট বল গোপালের মুকুটে লাগলেই পিসিমা চিৎকার করে ওঠেন-“না, এই অধমের মাঝে ধম্ম-টম্ম হবে না”।
না, আপনার সাথেও আর হেঁয়ালি করব না। আসলে হলটা কি, পরপর তিনবার ইন্টারভিউ থেকে “না” শুনে এই “না” শব্দটার ওপরেই খুব রাগ হল। একবার ভাবলাম শব্দটাকে ডিকশনারী থেকে তুলে সোজা চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে দেই। কিন্তু উপায় নেই। আমিও তো আসলে না-বচনেরই শিকার। সেই কাকভোরে মা কাঁচা ঘুমটার বারোটা বাজালেই বলে উঠি –“না মা, আর একটু”। তারপর ব্রেকফাস্টে দুধের গ্লাসে তাকিয়েই বলি-“না, অসম্ভব”। আমার মোবাইলটা নিয়ে পাশের বাড়ির বিট্টু গেম খেলতে চাইলেই চেঁচিয়ে উঠি –“না, এখন হবে না, ভাগ”। শুধু তাই নয়, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই এই “না” শব্দটা ঠোঁটকে জাপটে ধরে রাখে।
এই “না” হয়ত কখনো কখনো আমাদের এক্সিসটেন্সকে বাঁচিয়ে দেয়। বোঝায় যে “আমি” বলেও কেউ একজন এই পৃথিবীর মাঝেই আছি আর আমার সত্তা কখনও কখনও নিয়মের দিকে আঙুল তুলে “না” বলার সাহস রাখে। ঠিক যেমন সেই পাথরযুগ থেকেই প্রকৃতির গুঁতো খেতে খেতেই একদিন বুঝেছিলাম “না, আর নয় , এবার হাতে হাত ধরতে হবে”। ঠিক যেমন সেদিন নেলসন ম্যান্ডেলা হোয়াইট ডমিনেশনের বিরুদ্ধে গলা উঁচিয়ে বলেছিলেন “না, অনেক হয়েছে এবার আমাদের কথা শোনো”। ঠিক যেমন কয়েক হাজার তাজা রক্ত ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারী একসাথে বলে উঠেছিল-‘ “না”, আমরা বাংলা ভাষা ছাড়তে পারব না’।
কিন্তু সেইসব অনেক আগের কথা। এখন “না” –এর মানেটা যেঁ বদলে গেছে মেসোমশাই।এই “না”টি যদি আপনি একটু অন্যসুরে বলেছেন কি মরেছেন। এই ধরুন, দুরুদুরু বুকে হাতে আনকোরা প্রেমপত্র লিখে আপনি সেই বকুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন, আর উনি সমস্তটা পড়ে (কিংবা না পড়ে) একটা ছোট্টো “না” বলে চলে গেলেন। তখন সেই আপনিই ঘরে বসে নিকোটিনের ধোঁয়ায় জয় গোস্বামী আওড়াবেন। আর ভাবুনতো, দরকারি অ্যাসাইনমেন্টটা বসকে জমা দিতে যাচ্ছেন, আর ট্যাক্সির পাত্তা নেই। যেটাই হাত নেড়ে দাঁর করাচ্ছেন, সেটাই বলছে- “না, ওদিকটায় যাব না”। আবার, কোনো একদিন বিলুর দোকানে চা খেতে গেছেন, না চাইতেই কোনো পলিটিক্যাল ডিবেটে আটকে পড়ে লম্বা-চওড়া একটা লেকচার ঝেড়ে বাহবা নিতে গেছেন, আর ওমনি চক্রবতী মশাই হাত নেড়ে বলে বসলেন-“নাহ, ধুর তোমরা আজকালকার ছোকড়া সেসবদিন কি বুঝবে!”। রেগে যাবেন? না, রাগলে হবে না দাদা। কারণ আপনি যখন ডিবেট সেরে বাজারের অর্ধেক লিস্টি ভুল মারবেন, তখন গিন্নিকে সেই আপনিই বলবেন- “না, না, ভুলব কেন? যা আগুন দাম...আজ এই নিয়েই চালিয়ে দাও”। এইতো সেদিন আদিত্য যখন লেট করে ক্লাসে ঢোকার জন্যে বাঁধন বাবুর ঝার খেতে যাবে, তখনি পেছন থেকে বললাম –“আরে ঘাবড়াস না, একটা ‘না’ মেরে দে”। পাটা পিচে লোপা বল পেয়ে কেউ ছাড়ে নাকি? সাথে সাথে বলল- “না স্যার, আসলে জগা খুড়ো কাল ইতি টেনেছেন, আর শেষকাজের কেউ নেই, তাই কাল সারারাত জেগে...”। এইসব সেন্টিমেন্টাল ইস্যুতে হাত না লাগানোই ভালো ভেবে স্যার চুপ মেরে গেলেন।
নাহ, এবার একটু সিরিয়াস হই। আসলে হয়ত “না” বলাটা আমাদের ইনহেরিটেন্স। আমাদের ডিএনএ হয়ত নিউক্লিক অ্যাসিড আর “না” দিয়েই তৈরি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, যদি এই “না”টাই আমরা ঠিক জায়গায়, ঠিক সময় বলতে পারতাম, তবে কেমন হত। এই যেমন ফেইলিওরের পরে হাতে ব্লেড নিয়ে শিরার ওপর আঁকিবুঁকি করার আগে যদি আমরা বলতে পারতাম – “না, এভাবে নয়, অন্য ভাবে, অন্য কোনোদিন, আজ নয়”। রেলবস্তির ওই মেয়েটা যদি মদ খেয়ে আসা লোকটার উদ্ধত হাতটা থামিয়ে দিয়ে একটাবার বলতে পারত “না, আর না”। শাসকেরা আমাদের কণ্ঠরোধ করতে এলে আমরা সবাই মিলে যদি একবার “না” বলতে পারতাম? এবার “না” বলার সময় এসেছে। “না” শব্দটাকে আমরা অনাহূত মনে করি, ভাবি এটা একটা লম্বা বাক্যের তলায় পিষে থাকা সিলেবল। কিন্তু দেখ, আমি “না” বলছি, তুমিও আমার সাথে বল, দেখবে এটাই কলরব হয়ে গেছে।
নিক-শেয়াল পণ্ডিত
মন্তব্য
বেশ লিখেছেন হে
হুমমম
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
না, এই পোস্ট নিয়ে এখন কিছু বলব না; অন্য কোন পোস্টে বলব। এখন বরং জিজ্ঞেস করি, ভ্রমণকাহিনী আর নাই?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
না, ভ্রমন পরেই হবে খন, মনে রাখার জন্যে থ্যানকু।।।
না, না, না, কে বলেছে এই লেখাটা ভালো না? আমি এটাকে মোটেই খারাপ বলবো না! না, এখন থেকে আমি আর না বলতে না করবো না। না, না, না, কিছুতেই না!
****************************************
একটা অনুচ্ছেদ শেষ হলে একবার করে এন্টার চাপুন। লেখা ভালো লেগেছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
না, কিছু বলার নেই। পড়েছি কিনা সেটাও বলব না
মাঝি ভাই, আপনি তো এখন থেকেই কলরব শুরু করলেন দেখছি।
না বোধক গল্পটি ভালো লেগেছে। যদি প্যারা ভাগ করে দিতেন পড়ে আরেকটু আরাম পাওয়া যেতো। আপনাকে একটি হ্যাঁ দিলাম শেয়াল পণ্ডিত
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
“হ্যাঁ” পেয়ে হলাম
না, এরকম লেখা ঘন ঘন না পেলে কিন্তু জমছে না। (যান, একটার বদলে দুটো না মেরে দিলুম)।
এবার একটা হ্যাঁ -
হ্যাঁ, লেখাটা বেশ জম্পেশ হয়েছে তো!
____________________________
না, লেখাটা দেখে প্রথমে ভাবিইনি যে এতটা সুখপাঠ্য হতে যাচ্ছে! না, না-কে নিয়ে এত কিছু ভেবে দেখিনি তো আগে!
অসাধারণ পর্যবেক্ষন! অসাধারণ অনুধাবন!
ভাল লেগেছে। অসম্ভব ভাল। লিখে চলুন, শেয়ালদা!
।।।।।।।।।।
অনিত্র
অনিত্র,
হিজিবিzবিz মশাই, আপনি খেয়ালি করেননি , আপনি তিনটে “না” বলেছেন। বুঝুন তবে!!!
শেয়াল পন্ডিত মনে করিয়ে দিলেন ২০০৭ এ লেখা ( কি আশ্চর্য এর ভেতর ৮ বছর পার) একটি পোস্ট: না এর নানাত্ব নিয়ে নানার্থক নাড়া।
লিংক এখানে
http://www.sachalayatan.com/shohailmc/7286
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
স্যাম,
বেড়ে লেখা। রম্যরচনা বিভাগেও থাকতে পারত কি।
ভাল থাকবেন। শুভেচ্ছা।
---------------------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/
নতুন মন্তব্য করুন