ঈসা খাঁ’র স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়িতে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৭/১০/২০১৫ - ১১:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঈসা খান/খাঁ মানসিংহের যুদ্ধের গল্প শুনেছেন? ছোটবেলায় শুনেছিলাম। মানসিংহ ছিলেন মুঘল বাদশাহ আকবরের সেনাপতি। আর ঈসা খান বাংলার বার ভূঁইয়াদের অন্যতম একজন, অনেকের মতে শ্রেষ্ঠতম। যুদ্ধ শুরুর আগে ঈসা খান মানসিংহকে এক চমৎকার প্রস্তাব দেন। কি হবে যুদ্ধ করে সাধারণ সৈনিকদের জীবননাশ করে। এরথেকে ভাল দুই সেনাপতি যুদ্ধ করুক। যদি ঈসা খান হেরে যান, তাহলে তিনি মুঘলবশ্যতা স্বীকার করে নিবেন। আর মানসিংহ পরাজিত হলে তাঁর বাহিনী দিল্লী ফেরত যাবে।

দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হল। এক পর্যায়ে ঈসা খানের তরবারির আঘাতে মানসিংহের তরবারি ভেঙে যায়। তখন ঈসা খান মানসিংহকে নিজের তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করবার সুযোগ প্রদান করেন। কারণ, তাঁর দৃষ্টিতে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষকে আঘাত করা কাপুরুষতারই নামান্তর। ঈসা খানের এই মহানুভবতায় মানসিংহ মুগ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে দিল্লী ফেরত যান। এমনকি সাথে করে ঈসা খানকেও সম্রাট আকবরের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যান। মোটামোটি এই হচ্ছে ঈসা খান আর মানসিংহের গল্প।

এই গল্পের সত্যতা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। অনেক খুঁজেও এই ঘটনার কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাই নি। তার উপর ১৫৯৭ সালের ঈসা খানের সাথে যুদ্ধে মানসিংহের পুত্র দুর্জন সিং যে নিহত হয়েছিলেন সেটির প্রমাণ ইতিহাসে আছে। নিজের পুত্রের হত্যাকারীকে নিশ্চই মানসিংহ কোলে করে দিল্লী নিয়ে যাবেন না। এছাড়াও বার ভুঁইয়ারা সবাই ছিলেন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন দেশপ্রেমিক এবং তাঁরা লড়াই করেছিলেন আগ্রাসী মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে। কেউ আমার দেশ দখল করতে আসবে আর আমি গদগদ হয়ে তার সাথে দেখা করতে তার রাজধানীতে চলে যাব সেটা কখনোই যৌক্তিক নয়। বার ভূঁইয়াদের ব্যাপারে বাংলাপিডিয়াতে বিস্তারিত লেখা আছে। চাইলে দেখে নিতে পারেন।

ঈসা খানের জন্ম ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে। তাঁর পিতামহ বাইশ রাজপুত সম্প্রদায়ভুক্ত ভগীরথ প্রথমে অযোধ্যা থেকে বাংলায় আসেন এবং বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ-এর অধীনে দীউয়ান (মুঘল যুগে দীউয়ান শব্দটি দ্বারা রাজস্ব বিভাগের প্রধান ব্যক্তিকে বোঝাতো এবং কার্যালয়টিকে দীউয়ানি বলা হতো) হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র কালিদাস গজদানী পিতার দীউয়ান পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে কালিদাস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান নাম ধারণ করেন। সোলায়মান সুলতানের কন্যা সৈয়দা মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন এবং সরাইলের জমিদারি লাভ করেন। এখানেই সোলায়মানের পুত্র ঈসা খানের জন্ম হয়।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর জামাতা সোলায়মান খান নিজেকে বৈধ উত্তরাধিকারী দাবি করে নব প্রতিষ্ঠিত আফগান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রাহ ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি প্রায় স্বাধীনভাবেই ভাটি অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন এবং তাঁর রাজ্য শাসনের কেন্দ্র বিন্দু ছিল সরাইল।

১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করে বাংলাকে একটি একক প্রশাসনিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু সোলায়মান খান ইসলাম শাহের ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইসলাম শাহ তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দু’জন সেনাপতিকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। সোলায়মান খান তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও নিহত হন এবং তাঁর দুই পুত্র ঈসা ও ইসমাইলকে বন্দি করে ইরানী বণিকদের নিকট দাসরূপে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাজ খান কররানী বাংলা ও বিহারের শাসন ক্ষমতা গ্রহন করলে, ঈসা খানের চাচা কুতুব খান তার অনুগ্রভাজন হন এবং দরবারি কাজে নিযুক্তি লাভ করেন। এ সময়ে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বয়ের (ঈসা ও ইসমাইল) খোঁজ পেয়ে অর্থের বিনিময়ে ইরানী বণিকের কাছ থেকে মুক্ত করে আনেন।

ঈসা খান দেশে ফিরে চাচা কুতুব খানের প্রচেষ্টায় তাঁর পিতার সরাইলস্থ জমিদারি লাভ করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর ঈসা খান আফগান শাসকদের মুঘল আক্রমণ মোকাবেলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ত্রিপুরার রাজা উদয়মানিক্যের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অভিযানে দাউদ খানকে সাহায্য করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সোনারগাঁও-এর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মুঘলনৌবহরকে বিতাড়িত করতেও দাউদখানের সেনাপতিকে সাহায্য করেন।

১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানী পরাজিত ও নিহত হলে কার্যত বাংলায় আফগান শাসনের অবসান ঘটলেও ঈসা খান এ সময়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই তাঁর রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু তিনি যথার্থভাবেই অনুধাবন করেন যে, নিজের সীমিত শক্তি দিয়ে একা মুঘলদের মোকাবেলা করতে পারবেন না। তাই তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদার ও আফগান দলপতিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের সঙ্গে মুঘল বিরোধী রাজনৈতিক ও সামরিক মৈত্রী গঠন করেন। তিনি প্রতিবেশী ত্রিপুরা ও কামরূপ এর রাজা অমরমাণিক্য ও রঘুদেবের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ ছাড়াও ঈসা খান তার সামরিক শক্তির প্রধান অবলম্বন রণতরীগুলির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করেন।

১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সুবাদার খান জাহান ঈসা খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে ভাওয়ালে সৈন্য শিবির স্থাপন করলে ঈসা খান সরাইল সন্নিকটবর্তী কাস্তলে (কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত) মুঘলবাহিনী মুকাবিলা করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে ঈসা খান পরাজিত হয়ে ত্রিপুরা রাজ অমরমাণিক্যের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ত্রিপুরার সাহায্য আসলে মুঘলবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। রাজমালার বর্ণনা অনুসারে আনুমানিক ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা অমরমাণিক্যের ‘অমর সাগর দিঘি’ খননের জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হলে তাঁর অনুরোধে সারা দিয়ে বাংলার অন্যান্য জমিদারের সঙ্গে সরাইলের জমিদার ঈসা খান এক হাজার শ্রমিক পাঠিয়ে ত্রিপুরার রাজাকে সাহায্য করেছিলেন। তা ছাড়াও, ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অমর মানিক্যের নৌ-বাহিনীর অধ্যক্ষরূপে তরফের জমিদার ফতেহ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে মুঘলসেনাপতিদের বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খান পূর্ব বাংলায় তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। তিনি ১৫৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি হিসেবে ঘোষণা দেন এবং নিজেই ‘মসনদ-ঈ-আলা উপাধি’ গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র সরাইল থেকে সোনারগাঁও-এ স্থানান্তর করেন এবং সোনারগাঁও এর নিকটবর্তী কাত্রাবো, কলাগাছিয়া ও খিজিরপুরে দুর্গ নির্মাণ করেন।

ইতোমধ্যে সম্রাট আকবরের দুই বিদ্রোহী সেনাপতি মাসুম খান কাবুলী ও কতলু খান ঈসা খানের সাথে যোগ দেন। সম্রাট আকবর ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি আজমকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে মুঘল সেনাপতিদ্বয়ের আশ্রয়দাতা ঈসা খান মসনদ-ই-আলার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দেন। এ সময় মুঘল সেনাপতি শাহবাজ খানের সাথে টোকে এবং তারসুন খানের সাথে বাজিতপুরে ঈসা খানের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুঘল বাহিনী পরাজিত হয়। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি শাহবাজ খান পুনরায় ঈসা খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় যুদ্ধ ক্ষেত্র ঢাকা, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, কাত্রাবো প্রভৃতি এলাকায় বিস্তৃত ছিল। মুগলদের সাথে সংঘর্ষের এ পর্বেও ঈসা খান সাফল্য লাভ করেন। এ সময়ে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ভাটি এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করে লক্ষ্যানদীর তীরে কাত্রাবোয় তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন।

১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সাথে ঈসা খানের যুদ্ধ হয়। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ সুবাদার নিযুক্ত হয়ে বাংলায় আসেন এবং ঈসা খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে সচেষ্ট হন। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মানসিংহ রাজমহল থেকে ঈসা খানের বিরুদ্ধে যাত্রা করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয়নি। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মানসিংহ ঈসা খানের বিরুদ্ধে স্থল ও জলপথে দু’টি বাহিনী প্রেরণ করেন। মানসিংহের পুত্র দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে মুঘলবাহিনী প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেন। এমন কি তারা ঈসা খানের রাজধানী কাত্রাবোও আক্রমণ করে। ঈসা তার মিত্র বাহিনীসহ অনেক নৌকা নিয়ে বিক্রমপুর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে উপস্থিত হন এবং মুঘল নৌ-বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয় (সেপ্টেম্বর, ১৫৯৭)। যুদ্ধে দুর্জন সিংহ সহ মুঘল বাহিনীর অনেকে নিহত হয় এবং অনেক মুঘল সৈন্য ঈসা খানের হাতে বন্দি হয়। এরপরে মুঘল বাহিনীর সাথে ঈসা খানের আর কোনো যুদ্ধ হয়নি।

ঈসা খানের জীবদ্দশায় মুঘল সম্রাট আকবর পূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। এ সময়ে ঈসা খান ভাটির বিশাল অংশে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সে অঞ্চলকে একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন। এ রাজ্য বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক এবং প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বিস্তৃত ছিল।

ঈসা খানের মৃত্যু হয় ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বর্তমান গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুরে। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র মুসা খান মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। মুসা খান এক শক্তিশালী নৌ-বাহিনীর অধিকারী ছিলেন। রাজধানী সোনারগাঁও ছাড়াও খিজিরপুর, কাত্রাবো, কদম রসুল, যাত্রাপুর, ডাকচর, শ্রীপুর ও বিক্রমপুর তার দুর্ভেদ্য সামরিক ঘাঁটি ছিল। অপরাপর ভূইয়াদের সহায়তায় পূর্ব বঙ্গের স্বীয় আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তিনি ১০ বছর কাল মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু বারবার পরাজয় এবং সোনারগাঁওসহ তার ঘাঁটিগুলো পতনের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুঘলদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন।

ঈসা খানের বৈচিত্র্যময় জীবন কাহিনীতে জঙ্গলবাড়ির অবস্থান কোথায়? সেটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। সেই বছর ঈসা খান কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীর সামন্তরাজা লহ্মণ হাজরাকে পরাজিত করে দুর্গটি দখলে নেন। দুর্গটি সংস্কার করে তিনি এর তিন দিকে পরিখা খনন করে নরসুন্দা নদীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে জঙ্গলবাড়িকে একটি গোলাকার দ্বীপের মত করে গড়ে তোলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ঈসা খান ছিলেন ৬ টি দুর্গের অধিপতি এবং ২২টি পরগনার শাসক। অনেকে বলেন জঙ্গলবাড়ি ছিল ঈসা খানের দ্বিতীয় রাজধানী। তথ্যটি সঠিক নয়। ঈসা খানের ৬ টি দুর্গের অন্যতম ছিল জঙ্গলবাড়ি এবং এখানে তিনি ১৫৮১ থেকে ১৫৯৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত কিংবা অনিয়মিতভাবে অবস্থান করতেন। তাঁর বংশধরেরাও বর্তমানে এখানেই থাকেন।

আমাদের আজকের গন্তব্য ঈসা খানের স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি। প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত এই দুর্গটির অবস্থান কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার অধীনে জঙ্গলবাড়ি গ্রামে। জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরের এই স্থানে অটোরিকশা করে খুব সহজেই যাওয়া যায়। পথ চিনতে কোন সমস্যাই হবে না। কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশেই দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে।

১ কিলোমিটার এগুলে একটা সেতু পেরিয়ে দেওয়ানগঞ্জ বাজার। সেখান থেকে ডানদিকে ৫০০ গজ এগুলেই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হবে নতুন রঙ করা চমৎকার ছোট্ট একটা মসজিদ। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মসজিদের নির্মাতা ছিলেন ঈসা খান। প্রায় ১০ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন মসজিদের ছিল জীর্ণ দশা। বাংলাদেশ সরকারের জঙ্গলবাড়ি সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় এই মসজিদসহ পার্শ্ববর্তী নিদর্শনগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।

মসজিদের সাথেই অনেকগুলো নামহীন কবর। এই কবরগুলো কার স্থানীয়রাও সঠিক বলতে পারছিলেন না। কবরগুলোর আকৃতি দেখলে অবাক হতে হয়। যারা এখানে শুয়ে আছেন তাঁরা যে দীর্ঘদেহী ছিলেন বোঝাই যায়।

এইবার আমরা দুর্গের দিকে এগুলাম। ধারণা করা হয় লক্ষণ হাজরা কিংবা ঈসা খান কেউই দুর্গটির মূল নির্মাতা নন। দুর্গ এলাকার বাইরে বিশেষ করে দুর্গের দক্ষিন, পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম অংশে অসংখ্য ইটের টকরা ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া যায়। প্রাপ্ত নির্দেশনাবলি প্রাক-মুসলিম আমলের যা নির্দেশ করে স্থানটি ছিল একটি সমৃদ্ধশালী জনবসতির কেন্দ্র। তবে দুর্গের অভ্যন্তরে বেশ কিছু স্থাপনা ঈসা খানের। মূল দুর্গের আগে একটি পান্থশালা আছে।

পান্থশালায় ১০-১২ টি কক্ষের ধ্বংসাবশেষ কোনোক্রমে টিকে আছে। ১০ বছর আগে যখন প্রথম এখানে আসি তখন পান্থশালার ২ টি কক্ষকে জাদুঘরে রুপান্তর করা হয়েছিল যেখানে ঈসা খানের বিভিন্ন নিদর্শন ছিল। এইবারে পুরাই হতাশ হলাম। কিছুই নাই। সব নিদর্শন নাকি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে চুরি হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। ঈসা খানের ব্যবহৃত বেশ কিছু নিদর্শন কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে। এইখানে এখন কেবল একটা বইয়ের আলমারি আছে। ঈসা খানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই একটি আলমারিই সেটার নিদর্শন।

পান্থশালার বাকি কক্ষগুলো জরাজীর্ণ। যে কোন সময় ভেঙে পড়বে বলে মনে হয়। সংস্কারের টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে কে জানে? দেয়ালের চমৎকার অলঙ্করণগুলোই প্রমাণ দেয় তাঁরা কতখানি রুচিবান ছিলেন।

বৈঠকখানার পাশেই মূল দুর্গ। প্রিয় পাঠক, আপনাদের যাদের মনে দুর্গের কথা ভাবলেই ইউরোপের রাজসিক দুর্গগুলোর কথা মনে হয় তাঁরা নিশ্চিতভাবেই এই দুর্গের ছবি দেখলে মানসিকভাবে ধাক্কা খাবেন। এটিকে দুর্গ না বলে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ বলাই মনে হয় ভাল হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ধ্বংসাবশেষেও কিন্তু লোকজন থাকেন। এবং তাঁরা হচ্ছেন ঈসা খানেরই বংশধর। দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেই প্রতাপ আর জৌলুষ কোনটাই তাঁদের আজ অবশিষ্ট নেই।

মনটাই খারাপ হয়ে গেল। Ralph Hodgson এর সেই বিখ্যাত কবিতা Time, You Old Gipsy Man এর কথা মনে পড়ে গেল। আসলেই অর্থ, সম্পদ, প্রাচুর্য কিংবা সভ্যতা কোনটাই সারাজীবন স্থায়ী হয় না। মন খারাপ ভাব দূর করবার জন্য জঙ্গলবাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে হাওড়ের প্রবেশদ্বার চামড়া নদীবন্দরে চলে গেলাম। সেদিন ছিল ব্লাডমুনের রাত। ডিঙ্গি নৌকার গলুইতে বসে হাওরের নিস্তরঙ্গ পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখে মনটা কেমন জানি উদাস হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমিও থাকব না। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতেই হবে। এবং বাস্তবতা এই যে, আমাকে কেউই মনে রাখবে না। কেউ না।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক


মন্তব্য

নিহন আহসান  এর ছবি

খুব ভালো লাগলো রূপক ভাই ...এরকম লেখা আরো চাই উত্তম জাঝা!

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আশা করছি সামনে আরও লেখা পাবেন। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

লেখা ভালোই হয়েছে, তবে একটু দীর্ঘ হয়ে গেছে মনে হয়, মূল ভাব বজায় রেখে আরও ছোট করা যেত এবং সেটাই বোধ হয় যথার্থ হত।

মুঘল যুগে দীউয়ান শব্দটি দ্বারা রাজস্ব বিভাগের প্রধান ব্যক্তিকে বোঝাতো এবং কার্যালয়টিকে দীউয়ানি বলা হতো

"দীউয়ান" শব্দটি এখনও বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে "দেওয়ান" রুপে। বর্তমান কালের "দেওয়ানি মামলা", "দেওয়ানি আদালত", "দেওয়ানিগিরি(মাতুব্বরি অর্থে)", এসব সেই দীউয়ান বা দীউয়ানি থেকেই এসেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা দীর্ঘ হয়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম কিন্তু ইচ্ছে করেই সংক্ষিপ্ত করি নি। কারণ, সঠিক ইতিহাস সবার জানা দরকার। ঈসা খাঁ'কে নিয়ে অন্তর্জালে যেসব লেখা পাওয়া যায় সেগুলোতে অনেক ভুল আছে। অনেক লেখাতেই জঙ্গলবাড়িকে ঈসা খানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে উল্লেখ করেছেন যেটা সত্যি নয়। সোনারগাঁ তে মুঘল আক্রমন বেড়ে গিয়েছিল বলেই তিনি জঙ্গলবাড়িসহ আরও ৪ টি জায়গায় দুর্গ স্থাপন কিংবা অধিকার করেন। যখন যেখানে সুবিধা সেখান থেকে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। যদিও কাত্রাবো ছাড়া অন্য কোন স্থানটিকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে উল্লেখ করা হয় নি।

আবার অনেক লেখাতেই ঈসা খানের দিল্লী যাত্রা, দিল্লীতে মানসিংহের বিশ্বাসঘাতকতায় বন্দী হওয়া, মানসিংহের স্ত্রীর বদান্যতায় মুক্তি পাওয়া ইত্যাদি কাহিনী প্রচলিত আছে। সম্ভবত এইগুলো সবই স্থানীয় উপকথা। একারণেই একটু বিস্তারিত লিখলাম যেন ঈসা খানের ব্যাপারে কিছুটা হলেও ভুল ধারণার অবসান আমাদের ঘটে। রেফারেন্স হিসাবে আমি বাংলাপিডিয়া অবলম্বন করেছি। কারণ যদ্দুর জানি, এটিই এখন পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস বিষয়ক সবথেকে নির্ভরযোগ্য দলিল।

দীউয়ান শব্দটি যে দেওয়ান শব্দের আদিরূপ সেটি ধারণা করেছিলাম কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না। আপনার মন্তব্যে নিশ্চিত হলাম। ধন্যবাদ।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

তাঁর বংশধরেরাও বর্তমানে এখানেই থাকেন।

তাদের কারো সাথে দেখা হয়েছে আপনার? দেখা হয়ে থাকলে সেই বর্ণনা লেখাটিকে আরও সমৃদ্ধ করত নিশ্চিত।
ভ্রমনগল্প চলুক।
।।।।।।।।।
অনিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

কারও সাথে দেখা হয় নি বলাটা ভুল হবে। বাড়ির আঙিনায় স্কুলপড়ুয়া প্রায় ৮-১০ জন বাচ্চা খেলছিল। সবাই কোরবানি ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এদের মাঝে কেউ হয়ত ছিল ঈসা খানের বর্তমান বংশধর। তবে কথা হয় নি। আসলে প্রাচীন দুর্গের এমন দীনহীন অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারও সাথে গল্প করবার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

খালি হজুবাবুর কোবতেখানাই কমন পড়ল, লেখা চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

মেশিন (এই মেশিন ভ্রমণ মেশিন, সাইদি মেশিন নহে চোখ টিপি ) চলছে, চলবে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।