পাহাড়ের যে রহস্য- সেটা অন্য সব রহস্যের থেকে আলাদা।
খমনুদের পাড়া থেকে প্রায় দশ-পনেরো মাইল উত্তরের যে গাঢ় সবুজ পাহাড়শ্রেণী সৌন্দর্যের সমুদ্রটাকে মৌন, নিস্তরংগ বানিয়ে রেখেছে- সেটার রহস্যটা যেনো আরো বেশি। যেদিন রাতে খমনুর মা কাজলী- তাকে আর তার দিদিকে লুসাই, ত্রিপুরা কিংবা পাংখোয়াদের রুপকথা শোনায়, তাতে সে রহস্য আরো গাঢ় হয়। ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর খমনুর কাছে সেদিনের পাহাড়ি অরণ্যটাকে আগের দিনের থেকেও বেশি রহস্যময় আর অব্যক্ত বলে মনে হতে থাকে।
সূর্য চাঙ্গা হতে না হতেই অবশ্য সে রহস্য শিশিরের মতই মিলিয়ে যায়। কংলুই পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রচন্ড প্রাণশক্তি নিয়ে নিজেদের আনন্দ রাজ্যে প্রবেশ করে। খমনুও তার ব্যাতিক্রম নয়। বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা আর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরিতেই খমনুর সকালটা মোটামুটি পার হয়ে যায়। খুব বেশি দূরে যায় না বাচ্চারা, পাড়ার মোটামুটি মাইলখানেকের মধ্যেই থাকে। বেশিরভাগ শিশুই দুপুরে খাবার আগে আর ঘরে ফেরে না। পাহাড়ের চিরপরিচিত ঝলমলে উজ্বল একটা সকালের মতই আনন্দ-ঝলমল সময় কাটে তাদের।
খমনু অবশ্য ভোরে নাস্তা খেয়ে বাসা থেকে এক ছুট বেরিয়ে গেলেও ঘন্টাখানেক বাইরে কাটিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসে; তার একটা কারণও আছে! খমনুর দিদি চৈতালি- প্রায়ই এ সময়টাতে ঝর্ণার পানি আনতে যায়। খমনু সে যাত্রায় তার দিদির সঙ্গী হয়। সারাটা রাস্তা দিদিকে কত কথা জিজ্ঞেস করতে করতে যাওয়া যায়- প্রজাপতির গায়ে রঙ লাগালো কে, নদীর উত্তরে যে বড় পাথরগুলোর কথা শোনা যায়- সেগুলো কোথা থেকে এলো, বর্ষা এলেই পূর্ব দিকের পাহাড়গুলোর পেছন থেকে মাঝে মাঝেই যে গুম গুম শব্দ হয়- সেটা কিসের শব্দ... চৈতালি নিজেও তার পাচ বছর বয়েসী ছোটভাইয়ের সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না, কারণ তার নিজের বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা কোনটাই খুব একটা বেশি নয়। এই বর্ষাতে সে কেবল এগারোতে পড়েছে। তারপরও সে গুটগুট করে যতটা সম্ভব ছোটভাইয়ের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করে। খমনুর অবাক লাগে সবকিছু শুনে। এতো আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটে তাদের এই দেশে, এতো অদ্ভুত তাদের এই পাহাড়ি গ্রাম!
আজো সঞ্জীব, উলাপ্রু, সিগরাং, কল্পনা- ওদের সাথে খানিকটা সময় খেলাধুলা করে খমনু বাড়ি ফিরে এলো। তাদের বাড়িটা মোটামুটি পাড়ার এক প্রান্তে। খমনু আর তার দিদির ঘরের জানালা খুললে তো সামনের খাদ, দূরে পাহাড় আর জনমানবহীন অরণ্য ছাড়া কিছু চোখেই পড়ে না। মা অবশ্য তাদেরকে জানালা খুলতে দিতে চায় না সহজে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে নিয়ে ভোর হবার আগ পর্যন্ত। আর মা যেটা মানা করবে, দিদির সেটাই করা লাগবে। যথারীতি এ নিয়ে দিদি মা'র কাছে বকাও খায় প্রতিদিন।
বাড়ি ফিরে খমনু কাউকে খুজে পেলো না। মা এসময় দোকানে বসে, সুতরাং মা ঘরে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। বাবাও নিশ্চই সেখানেই আছে। কিন্তু কেউ না থাকলেও দিদির তো থাকার কথা! তবে কি দিদি তাকে ফেলে রেখেই পানি আনতে রওনা হয়েছে? এমন তো না যে সে দেরি করে ঘরে ফিরেছে যে কারণে তাকে রেখেই এভাবে চলে যেতে হবে। খমনুর হঠাতই খুব মন খারাপ হয়ে গেলো।
মন খারাপ ভাব কাটাতে সে তাদের শুকরটার কাছে গিয়ে বসলো। এই একটাই শুকর তাদের। সিগরাংদের শুকর সব মিলে আটটা; এর মধ্যে একটা তো আছে রীতিমত বিরাট। বিরাট হলেও অবশ্য শান্ত খুব। সিগরাংকে প্রায়ই দেখা যায় সাঙ্গপাঙ্গ কয়েকটাকে নিয়ে সেটার পিঠে উঠে বসে আছে। খমনু নিজেও একদিন উঠেছিলো। সে হিসেবে তাদের শুকরটা প্রায় ইদুর সাইজ।
শুকরটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছিলো, খমনু হাটু ভেঙ্গে ব্যাং এর মত সেটার কাছাকাছি গিয়ে বসলো। তারপর শুকরের পিঠে হাত রেখে নীচু গলায় সেটার সাথে কথা বলা শুরু করলো-
'কিরে, কি করিস!'
শুকরটা তেমন কিছু করছিলো না, তাই তাকে উত্তর দেবার ব্যাপারেও খুব একটা উতসাহী বলে মনে হোল না। শুধু একবার 'ঘ্রোত' করেই চুপ করে গেলো।
'ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাবি?'
খাওয়া দাওয়ার মত এমন স্থুল একটা জাগতিক বিষয় নিয়ে ভাবার ব্যাপারে শুকরটাকে মনে হোল না খুব একটা আগ্রহী। তবে ভদ্রতার খাতিরেই সে খুব সম্ভবত আবার 'ঘ্রোত' জাতীয় একটা শব্দ করলো।
খমনু এবার ফিসিফিস করে বললো- 'আজ দিদি খুব খারাপ একটা কাজ করেছে- আমাকে রেখে একা একা পানি আনতে চলে গিয়েছে। কাজটা কি ঠিক হোল তুই ই বল? আমি তো খেলা থেকে ঠিক সময়ের আগেই চলে এসেছি, তাহলে..' খমনু কথা শেষ করতে পারলো না, তার গলা ধরে এলো।
এই প্রথম শুকরটাকে একটু বিচলিত হতে দেখা গেলো। সে চোখ দু'টো আরেকটু খুলে একবারের জায়গায় কয়েকবার 'ঘ্রোত ঘ্রোত' করে শব্দ করলো।
খমনুর যখনই মন-টন কোন কারণে খারাপ থাকে (সেটা ঘটে অবশ্য খুব কমই), তখন সে এসে তাদের শুকরটার সাথে এভাবেই কথাবার্তা চালিয়ে নিয়ে যায়; ধীরে ধীরে তার মন খারাপ ভাবটা কমে আসে। কিন্তু আজ কিছুতেই কিছু হোল না। সে শুকরের কানের পাশের ঘাড়ের দিকটা একটু চুলকে দিয়ে দোকানের দিকে রওনা হোল।
খমনুর বাবা মালিরাম লোকটি অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। সবসময়েই তার মুখে হাসি লেগে থাকে। কংলুই পাড়ায় তার ছোটখাট একটা মুদি দোকান আছে। মালিরামের জীবনের সব সঞ্চয় এই এক দোকানের পেছনেই বের হয়ে গিয়েছে। অবশ্য গতবছর দোকানটা চালু করার পর থেকে বিক্রি-বাট্টাও যে খুব একটা খারাপ হচ্ছে- এমন না। মোটের উপর মালিরাম বেশ সন্তুষ্ট। কাজের চাপও খুব একটা নেই। সপ্তাহে দু'দিন শুধু দীঘিনালা গিয়ে তাকে দীঘিনালা বাজার থেকে কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসতে হয়, বাকিটা খমনুর মা'ই দেখে। ফলাফল হিসেবে কংলুই পাড়ার সদানন্দ, হাসিখুশি মালিরামকে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে বসে নিশ্চিন্তমনে হুক্কা টানছে।
আজও খমনু যখন মন খারাপ করে তাদের দোকানে উপস্থিত হোল, মালিরাম যথারীতি দোকানের বেঞ্চিতে আয়েশ করে বসে হুক্কা টানছিলো। খমনু তার বয়েসী অন্য পাহাড়ি বাচ্চাদের তুলনায় একেবারেই শান্ত বলা চলে। মালিরাম কিংবা কাজলী- কাউকেই আজ পর্যন্ত খমনুকে কখনো, কোন কিছু নিয়েই গলার স্বর উচু করে কথা বলতে হয় নি। এতোটাই লক্ষ্মী হয়েছে তাদের এই ছেলে!
কাজলী ছেলের মুখ দেখেই বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে ছেলে এমন মুখ গোমড়া করে থাকবে কেন! বাবার মতন এতোটা হাসিখুশি না হলেও খমনু সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রাখবার মতন ছেলেটিও নয়। তবে সমস্যা হচ্ছে- সে যেমন শান্ত, তেমনই চাপা- মন খারাপ হলেও খমনু মুখ ফুটে কখনো, কাউকে সেটা বলে না। নানা কায়দা করে কাজলীকে সেটা জেনে নিতে হয়; আজো তিনি সে পথেই এগুলেন-
'কি রে বাবা! আয় আমার কাছে এসে বস! বিস্কুট খাবি?'
খমনু উপর নীচে মাথা নাড়লো। কোন কারণে দোকানে এলেই মা তাকে বিস্কুট খেতে দেয়।
'আজকে চৈতালিকে বলছিলাম, পানি নিয়ে ফিরে আসবার পথে সঞ্চনাদের মা'র যেনো একটু খবর নিয়ে আসে। শুনতে পেলাম- বেচারি নাকি হঠাত খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে'
খমনু কিছু না বলে ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো শুধু। কাজলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেকে লক্ষ্য করতে করতে বললেন-
'চৈতালী তোকে রেখে যেতে চাচ্ছিলো না, আমিই জোর করে একটু আগে আগে পাঠিয়েছি। তা না হলে পানি নিয়ে আবার রোগী দেখে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।'
অভিমানে খমনুর ঢোক গিলতে কষ্ট হতে লাগলো। কাজলী এবার কিছুটা হলেও বুঝতে পারলেন কেনো ছেলের মন খারাপ! তিনি ছেলেকে খুশি করবার জন্য অন্যমনস্ক গলায় বললেন-
'আজ রাতে গল্পের আসর বসানো যায়। আমার কাজের চাপ আজ একটু কম আছে....'
আনন্দে খমনুর গলায় বিস্কুট প্রায় আটকে যাবার উপক্রম হোল। তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে খেলো সে! ছেলের তড়িত এই মনোভাবের পরিবর্তন কাজলীর চোখ এড়ালো না। তার এই ছেলেটি গল্প শুনতে বড় পছন্দ করে; কখনো মুখ ফুটে আবদার করবে না, কিন্তু গল্প শুনতে পারলে কি খুশি যে হবে! কাজলী নিজে সারাদিন পরিশ্রমের পর প্রচন্ড ক্লান্ত থাকেন, চাইলেও প্রতিদিন রাতে সন্তানদের এ বিলাসী চাহিদাটুকু মিটিয়ে উঠতে পারেন না। এরই মাঝে কখনো কখনো সময় সুযোগ পেলে ছেলেমেয়েদেরকে বিভিন্ন গোত্রের প্রাচীন রূপকথাগুলো শোনান। ভাইবোন দু'চোখ ভরা কৌতুহল আর গভীর আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
খমনু বিষণ্ণ হৃদয়ে দোকানে ঢুকেছিলে, বেরিয়ে এলো উজ্জ্বল পাহাড়ি সকালের মতন ঝলমলে এক আনন্দ-মন নিয়ে। দোকান থেকে বেরিয়ে সে সোজা সামনের দিকে ছুটতে থাকে- যেনো অসীম আকাশকে ছুয়ে দেবে। অনন্ত সে আকাশ নিজেও যেনো কি এক গভীর আগ্রহ আর চাপা আনন্দ নিয়ে জাগতিক সে সুখ-স্পর্শ পাবার জন্য সৌম্য ধৈর্য্যে অপেক্ষা করে থাকে।
দু'হাত দু'পাশে ছড়িয়ে মুক্ত পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকা খমনুকে কাজলীর বাতাসে ভেসে যাওয়া সোনালি রোদের মতন মনে হয়!
*
পুরো কংলুই পাড়ায় ইলেকট্রিসিটি আছে কেবল পাড়া-কারবারী সাধুচং এর বাড়িতে; তাও খুব বেশি কিছু না- শুধু তিনটা ইলেকট্রিক লাইট। আধুনিক প্রযুক্তি প্রকৃতির উপর পুরো নির্ভরতার পক্ষে না। তাই আগে যেখানে সূর্য ডোবার পর চাদ-তারা আর কুপির আগুনের আলোই ছিলো ভরসা, সেখানে এখন সগর্বে সোলার পাওয়ারড সিএফএল বাতি তার নীলাভ-রূপালি আলো বিলায়।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে ঘন্টাখানেকের উপর হোল। অন্যদিন এই সময়ে খমনু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, কিন্তু আজ জেগে আছে। কাজলী যে রাতগুলোতে তার সন্তানদেরকে রূপকথার গল্প শোনান, সেদিন এভাবেই রাতের সব নিয়ম ওলট পালট হয়ে যায়। খমনু আর চৈতালি তাদের শোবার জায়গা ঠিকঠাক করে অপেক্ষা করছে কাজলীর জন্য। অপেক্ষা বলতে একটু পর পর পাশে মা-বাবার কামরায় চলে যাওয়া আর মা এখনো কেন আসছে না- সে প্রশ্নের কৈফিয়ত দাবী। এক সময় প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হোল- কাজলী হাতের সব কাজ শেষ করে ছেলেমেয়ের ঘরে ঢুকে তাদের বিছানায় গিয়ে বসলেন।
মাটির বিছানার মাথার দিকটাতে একটা কুপি জ্বলছে, আলো বলতে শুধু ঐটুকুই। বাইরে ঝিঝি পোকার অবিশ্রান্ত ডাকাডাকি। মাঝে মাঝে দূরের বনপ্রান্ত থেকে অস্পষ্ট-অচেনা কোন শব্দ ভেসে আসছে। পাহাড়িরা এসব কিছু শুনে শুনে অভ্যস্ত, তারা মায়াবিনী পর্বত-অরণ্যের রহস্যকে স্বীকার করে নিয়েছে বলেই অপরিচিত, অজানা কোন শব্দে বিস্মিত হয় না; সেটাকে সম্মান করে।
কাজলী- কুপির ছড়িয়ে যাওয়া নরম আলোর মতন স্বরে তার গল্প শুরু করলেন-
অনেক অনেক কাল আগে এখানে এক লুসাই রাজার রাজ্য ছিলো। রাজ্যে প্রজারা সবাই খুব সুখে শান্তিতে বাস করতো, কারণ রাজা, রাণী দু'জনই ছিলেন খুব ভালোমানুষ। প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট তারা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না।
রাজা-রাণীর সন্তান বলতে তাদের একটা মাত্র মেয়ে- কঙ্কণ। রাজকন্যা কঙ্কণ দেখতে ছিলো খু-উ-ব সুন্দর; পাথুরে নদীর জলের মতন স্বচ্ছ চোখ, আনারের রঙের মতন গায়ের রঙ আর গহীন পাহাড়ি বনে নেমে আসা অন্ধকারের মতন ঘন কালো চুল- সব মিলে মনে হোত যেন স্বর্গশিশু।
সেই কঙ্কণের যখন ছয়/সাত বছর বয়স, তখন একদিন সে রাজ্যের অন্য শিশুদের সাথে খেলতে খেলতে নদীর ওদিকটায় চলে যায়। খেলার মাঝে হঠাতই নাকি বাচ্চাগুলো শোনে, নদীর ওপারের বন থেকে কেমন অদ্ভূত এক ধরণের শব্দ আসছে। মনে হোল- সুর করে যেনো কেউ বিলাপ করছে। বড় মন খারাপ করিয়ে দেয় সে অদ্ভূত, অপার্থিব সুর।
বিচিত্র সে শব্দ শুনে বেশিরভাগ বাচ্চাই ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু রাজকুমারী কংকণ গো ধরে বসলো- শব্দটা কিসের সেটা সে নদীর ওপারের বনাঞ্চল ঘুরে দেখে আসতে চায়। বাচ্চারা তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু রাজার মেয়ে বলে কথা! যেমন তার সাহস, তেমন একগুয়েমি। শেষ পর্যন্ত আর কেউ রাজী না হওয়ায় রাজকুমারি একাই নদী পার হয়ে ওপারে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
সেটা ছিলো শীতের শুরুর দিককার কথা। নদীতে পানি খুব একটা ছিলো না। রাজকুমারী অনায়াসেই নদী পার হয়ে ওপারে উঠে আসে। তারপর শব্দের উতস লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে শুরু করে। কংকণের কাছে মনে হচ্ছে- যেখান থেকেই শব্দটা আসুক না কেন, সেটা বনের খুব বেশি ভেতরের দিকে নয়; কাছাকাছিই কোথাও। কিন্তু তারপরেও সে পর্যন্ত পৌছুতে তাকে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম আর কষ্ট করতে হবে। কারণ একে তো এদিকটার বন অনেক নিবিড়, আবার কোন জনমানুষের চলাচলও নেই যে বনের মধ্য দিয়ে হেটে যাবার মত ন্যুনতম রাস্তাটুকু থাকবে। সমস্যার উপর আরেক সমস্যা- কংকণের সাথে দা জাতীয় কিছুও নেই যে সে বন পরিষ্কার করে করে এগুবে। সব মিলে সে একরকম অন্ধের মতই রহস্যময় সে সুর অনুসরণ করে আস্তে আস্তে কোনরকমে এগুতে থাকে। যতই শব্দের কাছাকাছি পৌছুতে থাকে, রাজকুমারীর মনে কৌতূহল ততই গাঢ় হয়। এমন শব্দের কথাও তো কখনো সে কারো কাছ থেকে শোনে নি!
অবশেষে সত্যি সত্যি রাজকন্যা সে রহস্যময় শব্দসুরের উতসটাকে খুজে পায়। আকৃতিতে মোটামুটি মাঝারি এক অপূর্ব পাখি বনের একটা জায়গায় আটকা পড়ে অমন শব্দ করছে! কি অদ্ভূত সে পাখি! অনেকটা ময়ূরের মত দেখতে, কিন্তু লেজের দিকটা পালকে পালকে আরো সমৃদ্ধ, আরো রঙ্গীন; সে রঙ এতোটাই জীবন্ত যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয়- তার তীব্র ঔজ্জ্বল্যে যে কোন সময় চোখ ধাধিয়ে যাবে!
কংকন পাখিটার কাছাকছি গিয়ে হাটু মুড়ে বসলো। বনের এ জায়গায় গাছপালা, বনঝোপ একটু পাতলা হয়ে এসেছে; আশপাশে নানা আকারের কিছু পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এমনই একটা পাথরের নীচেই পাখিটার লেজের একটা অংশ আটকা পড়েছে। এই অদ্ভূত পাখি এখানে কোথা থেকেই বা এলো, আর কিভাবেই বা এমন বেকায়দা আটকা পড়লো- কে জানে। ঘটনা যাই ই হোক না কেন, এখন এই পাখিটাকে মুক্ত করে দেওয়া দরকার; বেচারা কতক্ষণ এভাবে আটকে আছে কে জানে!
যেমন ভাবা তেমন কাজ- কংকন পাথরটার নীচের দিকে হাত রাখবার মতন সুবিধামত খাজ খুজে বের করলো। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি একত্র করে কোনমতে পাথরটাকে সামান্য একটু উচু করে তুলে ধরলো। তাতেই এক ঝটকায় পাখিটা তার আটকে পড়ে লেজের অংশটুকু মুহূর্তে বের করে সরিয়ে নেয়। কংকনও দেরি না করে পাথরটা ছেড়ে দিয়ে পাশে মাটিতে বসে বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে।
গল্পটার বিচিত্র অংশ শুরু হয় এর পর থেকে। পাখিটা কংকনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত সুরেলা গলায় কথা বলে ওঠে-
"মেয়ে! তুমি আমার অনেক বড় উপকার করেছো। বিনিময়ে আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই। আজ রাতে তুমি তৈরি থেকো, তখনই আবার দেখা হবে।"- বলেই আশ্চর্য সে পাখি বনের গভীরে উড়ে যেতে থাকে। বিস্মিত রাজকুমারী কংকন উচু গলায় জিজ্ঞেস করে- "কিন্তু, তুমি কে?"
বনের গাঢ় সবুজে নিজেকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলবার ঠিক আগ মুহূর্তে উজ্জ্বল কমলা আর ঝলমলে নীল শরীরের সে পাখি উত্তর করে- "আমি স্বর্গের পাখি- রিরৈ!"
সেরাতে আবার ছিলো পূর্ণিমা। রাজবাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলেও রাজকুমারী সেদিন ঘুমালো না। খাটে শুয়ে শুয়ে রিরৈ এর প্রতীক্ষা করতে লাগলো। মিনিট যায়, ঘন্টা যায়! বাইরে পোকামাকড়ের ডাকাডাকি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে রাজকুমারী একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একসময় ডানার ঝটপটানির শব্দে আবার তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাত তখন গভীর; পূর্ণিমার চাদ মধ্য আকাশ থেকে কিছুটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রাজকুমারী কংকন রাজবাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
চাদের নীল আলোয় আশপাশটা অল্প অল্প চোখে পড়ে। দূরের পাহাড়গুলোকে কেন যেনো জীবন্ত মনে হয়। অরণ্যকে মনে হয় যেনো গোপন, যেনো চাইলেই তাকে ছোয়া যাবে না।
রাজকুমারী অবাক হয়ে দেখে, তাদের বাড়ির একটু তফাতেই যে বিশাল পাথরের চাইটা- সেটার ওপর সগৌরবে রিরৈ দাঁড়িয়ে আছে। অবাক ব্যাপারটা হোল, সকালের রিরৈ এর সাথে সাথে এখনকার স্বর্গ-পাখি রিরৈ এর পার্থক্য অনেক। সকালে যে রক্ত মাংসের শরীর ধারণ করে ছিলো, এখন সেইই আবার আগাগোড়া এক আলোর পাখি! উথাল পাথাল জোছনার আলোর মতনই অপার্থিব এক কোমল নীল আলো দিয়ে গড়া তার পুরো শরীর, যেনো তরল জোছনা জমাট বেধে ময়ূরের আকৃতি নিয়েছে!
তারপর সারারাত স্বর্গপাখি রিরৈ আর রাজকুমারী মিলে কত না গল্প করে! সেদিনই তারা একজন আরেকজনের প্রাণের বন্ধু হয়ে যায়। শেষরাতে পাখিটা রাজকুমারীকে পিঠে করে আকাশ ঘুরিয়ে আনলো। তারপর সূর্য উঠে যাওয়ার আগেই রাজকুমারীর হাতে ছোট এক বাক্স উপহার ধরিয়ে দিয়ে একসময় বিদায় নেয়....
খমনু গাঢ় মনযোগ দিয়ে মা'র গল্প শুনছিলো আর কল্পনায় যেনো রাজকুমারী, স্বর্গপাখি, পাহাড়, অরণ্য... সবাইকেই স্পষ্ট-অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলো। তার কাছে মনে হচ্ছিলো মাথাভর্তি ঘন, কিছুটা কোকড়ানো চুলের রাজকুমারী কংকন যেনো দেখতে অনেকটা তার দিদির মতই.. টুকরো টুকরো ছবি হয়ে কখনো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো বনের গাঢ় সবুজ; কখনোবা গাছ-লতা-ঝোপের মাঝ দিয়ে স্বর্গপাখি রিরৈ এর উজ্জ্বল কমলা-নীল রং.. বাইরে ঝিঝির ডাক, পেচার ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ আর খমনুদের ঘরের কুপির আলোর বাস্তবতাকে ছাপিয়ে খমনুর অবাক কল্পনায় সাময়িক ধরা দিয়েছিলো শান্ত জোছনায় ভেসে যাওয়া বহু প্রাচীন এক আশ্চর্য জনপদ!
একসময় চৈতালী জিব দিয়ে ঠোট দু'টো ভিজিয়ে চাপা গলায় তার মা'কে জিজ্ঞেস করলো- "ঐ বাক্সে কি ছিলো?"
"বাক্সে ছিলো স্বর্গের মহামূল্যবান ধনসম্পদ! সে সম্পদের প্রাচুর্যেই পরবর্তীতে ঐ রাজ্যের সবাই খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। তাদের আর না রইলো কোন অভাব, না রইলো কোন দুঃখ। সবাই রাজকুমারী কংকনেরও অনেক প্রশংসা করলো.."
এবার খমনু তার অতৃপ্ত কৌতূহল মেটাতে মা'কে জিজ্ঞেস করলো- "এরপর কি আর রিরৈ পাখির সাথে রাজকুমারীর কোনদিন দেখা হয় নি মা?"
এরপর কি হয়েছিলো সেটা কজলীর নিজেরো জানা নেই, কারণ গল্প এখানেই শেষ। তাই ছেলের প্রশ্নের উত্তরে- "হয়েছিলো নিশ্চই! বন্ধুর সাথে বন্ধুর দেখা না হলে কেমন করে হবে?..." শুধু এটুকু বলে বাচ্চাদেরকে ঘুমের জন্য তাগাদা দিলো- "ঠিক আছে। আজ অনেক গল্প হয়েছে। এখন দু'জন ঘুমিয়ে পড়। তা না হলে সকালে উঠতে পারবে না।"
খমনু আর চৈতালী দু'জনেরই খুব ঘুম পেয়েছিলো, গল্পের নেশায় নেশায় কেউই এতোক্ষণ সেটা বুঝতে পারে নি। মা'র তাগাদা শুনে তাদের হুশ হোল। হঠাতই ঘুম যেনো পাহাড়ি বানের মতন আচমকা দু'ভাইবোনের চোখের পাতা ভারি করে তুললো। আর দেরি না করে, কুপি নিভিয়ে সেদিনকার মতন দু'জন বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ে।
ঘুমিয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে আবছা আবছাভাবে খমনুর কাছে মনে হোল- স্বর্গপাখি রিরৈ বুঝি কংলুই পাড়ায় তাদের বাসার চালে এসে বসেছে।
*
খমনু অনেকক্ষণ ধরেই তার দিদির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। দিদিকে একটা তথ্য জানানো খুব দরকার, কিন্তু কিভাবে কথাটা বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কাল রাতে মা'র কাছে রাজকুমারী কঙ্কনের গল্প শুনে আজ সে সেটা তার বন্ধুদের সবাইকে বলার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু খমনু অবাক হয়ে খেয়াল করলো- তার সে গল্প বন্ধুরা আগে থেকেই জানে। কল্পনা তো এমন কথাও বললো যে- সেই স্বর্গের পাখিকে রাজকুমারীর পরও নাকি অনেকে দেখেছে। সকালে নাকি যারা নদীর ওপারের বনে রিরৈ এর ডাক শুনতে পায়, তারা রাতের বেলা সেই আলোর পাখিকে দেখে। তাদের নাকি একটা ইচ্ছাও স্বর্গের সে পাখি পূরণ করে! আর এই অতি অমূল্য তথ্য দিদিকে দেবার আগ পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না বলেই ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু ফিরে এসে খমনু উলটো নিজে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলো।
খমনু ঘরে ফেরার পর থেকেই দেখছে দিদির মেজাজ খুব একটা ভালো নেই। বাড়ির সামনে অল্প খানিকটা জায়গায় দিদি শখ করে বাগানের মত করেছিলো। চৈতালি নিজেই খুজে খুজে নানা রকমের ফুলগাছের বীজ জোগাড় করে করে নিয়ে আসতো; প্রায় বছর দুই ধরেই অনেক যত্ন করে আসছিলো সে নিজের বাগানের। মাস দুই আগে রডোডেনড্রন গাছে ফুলও ধরে, থোকা থোকা লাল ফুল! বেশ লাগতো দেখতে। মনে হোত, অতিথিকে যেনো তাদের ছিমছাম বাড়িটি লাল-রঙ্গা ফুল উপহার হিসেবে নিবেদন করছে।
সমস্যাটা হয়েছে চৈতালির সে বাগান নিয়েই! কে যেনো চৈতালির সাধের সে বাগানের কয়েকটি চারা গাছ দলামোচা করে গেছে। সন্দেহের প্রাথমিক তীর তাদের শুকরটির দিকে। চৈতালির বদ্ধমূল ধারণা- শুকরটা কোন না কোন ভাবে তার বাগানের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলো। আর এতেই সর্বনাশ যা হবার সেটা হয়ে গেছে।
খমনু দেখলো দিদি তার বাগানের সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে রাগের চোটে বিড়বিড় করছে। এমন অবস্থায় রিরৈ পাখির প্রসংগ তুললে নিশ্চিতভাবেই সে দিদির কাছ থেকে একটা রাম ধমক খাবে। অনেক ভেবে চিনতে সে তখনকার মত তার দিদিকে না ঘাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটা খবর থেকে তার দিদি আপাততঃ বঞ্চিত হোল। কি আর করা!
খমনু বিমর্ষ অবস্থায় বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।
*
প্রায় মাস-ছয় পরের কথা। খমনুর জীবন আগের মতনই আছে। সারাদিন সে বন্ধুদের সাথে এখানে-ওখানে ঘুরে সময় কাটায়, দিদির সাথে পানি আনতে যায় আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন আবার ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়া; নির্ভাবনা আর নিশ্চিন্ততার এক অপূর্ব সময়! মজার ব্যাপারটা হোল- শিক্ষা কিন্তু চলতে থাকে! যে প্রকৃতি মানুষের সব থেকে বড় শিক্ষক, তার কাছ থেকেই উপকরণ নিয়ে নিয়ে শিশুরা তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। অল্পকাল পরেই যে জীবনযুদ্ধে তাদেরকেও নেমে যেতে হবে- তার প্রস্তুতিও চলতে থাকে অচেতন ভাবেই।
যে রাতে ভাগ্য খুব ভালো থাকে, সে রাতগুলোতে মা রূপকথার গল্প শোনায়। তবে সত্যি বলতে কি- আজ পর্যন্ত যতগুলো গল্প খমনু শুনেছে, সে রাজকুমারী কংকন আর আলোর পাখির গল্পটার মতন দাগ কাটতে পারে নি আর কোনটি। খমনু আশা করে থাকে- আবার কবে মা ঐ গল্পের মতন অসাধারণ আরেকটা রূপকথা শোনাবে! প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যায় খমনুকে আশাহত হতে হয়, আদিবাসী রূপকথার আর কোন কাহিনীই সে রাজকুমারীর গল্পের মতন করে তাকে আর মুগ্ধ করতে পারে না। গল্পের মাঝখানে খমনু হাই তোলে, কাজলী অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে-
"কি রে, গল্প শুনতে ভালো লাগছে না? ঘুমিয়ে পড়বি?"
খমনু ঘুম ঘুম গলায় বলে-"বাকিটা পরে শুনবো-" পরক্ষণেই আবার কিছুটা চাপা গলায় চোখ বড় বড় করে মা'কে বলে- "আচ্ছা মা, ঐ রিরৈ পাখির গল্পটা আরেকবার..."
পাশ থেকে চৈতালী, খমনুর পিঠে খোচা দেয়- "এক গল্প কয় হাজার বার শুনবি?"
কাজলী হালকা হেসে বলেন- "কই কত-বার শুনতে চাইলো! আগে তো এমন কখনো বলে নি.."
চৈতালী শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে উত্তেজিত গলায় বলে- "তুমি জানো না মা, কি এক ভূত ওর মাথায় ঢুকেছে। তোমাকে বোধহয় আজই প্রথম বললো, কিন্তু আমাকে সুযোগ পেলেই- তারপর মুখ ভেংচে খমনুর নকল করে বললো- 'দিদি, ঐ রাজকুমারী কংকন আর রিরৈ পাখির গল্পটা একটু শোনাও না!'... এর মধ্যে কম করে হলেও একই গল্প ওর পাচ-ছয়বারের বেশি শোনা হয়ে গেছে।"
খমনু একটু লজ্জা পেয়ে যায়; দিদিটা এমন পাগল টাইপের কেনো?
কল্পনা একথা শুনে হাসতে হাসতে মেয়েকে বলেন- "খমনুর বোধহয় রাজার মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়েছে বুঝলি চৈতালী! এ জন্যেই বার বার ও একই গল্প শুনতে চায়..."
এবারে দিদির উপর খমনুর সত্যি সত্যিই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কাজলী অবশ্য সাথে সাথেই কৌশলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলেন। জিনিসটা আর বেশিদূর গড়ানোর সুযোগ পায় না।
সারাদিন খমনু বেশ ছোটাছুটির ওপর থাকে বলেই তার নিজেরো স্বর্গ-পাখির কথা খুব একটা মনে থাকে না। শুধু মাঝে মাঝে যখন খেলতে খেলতে বনের ভেতর ঢুকে পড়ে, তখন নিজের অজান্তেই তার চোখ-কান সজাগ হয়ে ওঠে। চারপাশের বনঝোপের মধ্য দিয়ে যতখানি দৃষ্টি যায়- সে সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখে; বন্ধুদেরকেও বলে দৃষ্টি রাখতে। যদি কারো নজরে পড়ে যায় নীল-কমলা রঙ্গা কোন অদ্ভূত, অপূর্ব পাখি! কিংবা কেউ যদি বনের ভেতর থেকে কখনো শুনতে পায় মন ভোলানো কোন অপার্থিব সুর!
পশ্চিমের বিস্তৃত পাহাড়-সমুদ্রে শেষ বেলার সূর্য যখন আবির-গুড়ো ছড়াতে শুরু করে, তখন খমনু আর তার বন্ধুরা খেলা শেষে যার যার বাড়ির পথে রওনা হয়। অন্য পাড়ার অনেক ছেলেমেয়রাও খমনুদের সাথে খেলে। রেয়াক্রি পাড়ার উলাপ্রু, ন্যউপ্রু; কাছালং পাড়া থেকে উতপল দ্রং, সঞ্জীব কিংবা সুস্মিতা.. এ পাড়াগুলো পার হয়ে সবার শেষে খমনুদের কংলুই পাড়াটি পড়ে। তাই কংলুই পাড়ায় পৌছুতে পৌছুতে ছেলেমেয়েদের দলটাও বেশ ছোট হয়ে আসে, সূর্যটাও দিগন্তের পাহাড়চূড়ায় আলতো করে চুমু খায়। আকা-বাকা বন্ধুর পাহাড়ি পথে অনেক সময় কাছের জিনিসও ঠিক জায়গায় না দাড়ালে চোখে পড়ে না, তেমনিভাবে খমনুরাও কংলুই পাড়ার খুব কাছাকাছি, বিশেষ এক বাক পেরুনোর আগ পর্যন্ত- নিকটে পৌছে যাওয়া সত্বেও- নিজেদের গ্রামটাকে দেখতে পায় না। সে বাক ঘুরলে হঠাতই চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়- খমনুদের গ্রাম- কংলুই পাড়া! খমনুর বাড়িটাও সেখান থেকেই চোখে পড়ে। সাঝবেলায় নামতে থাকা কোমল অন্ধকারে খমনুর কাছে মনে হয়- ইশ, কোনদিন যদি তাদের বাড়ির টিনের চালটিতে সে আলোর পাখিটা উড়ে এসে বসতো!
অন্ধকার পুরোপুরি নেমে আসবার আগেই খমনু দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
*
মালিরাম এই সপ্তাহে আজ তৃতীয়বারের মত দীঘিনালা বাজারে এসেছে। এমনিতে সপ্তাহে সে দুইবার আসে; চাইলে একবারের জন্য এসেও পুরো সপ্তাহের জন্য বাজার-সদাই নিয়ে ফিরে যাওয়া যায়, কিন্তু সেটা সে করে না। বাজারে এলে অন্য পাড়ার অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়, খোজ-খবর জানা যায়। তাছাড়া ব্যবসা সূত্রে অনেক নতুন মানুষের সাথেও মালিরামের ইদানীং পরিচয় হয়েছে। তাদের মধ্যে এমনকি কয়েকজন বাঙ্গালিও আছে।
অবশ্য এই সপ্তাহে তৃতীয়বারের মতন বাজারে আসার পেছনে তার অন্য আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে। আগে পাহাড়ের এদিকটা টুরিস্টদের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় কোন জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলো না, কিন্তু ইদানীং সে চিত্র পালটে যাওয়া শুরু করেছে। গত বছরখানেক ধরে এ অঞ্চলটাতে ধীরে ধীরে টুরিস্টদের আগমন বাড়ছে। যদিও এখনো মানুষজন অতটা দুর্গমে ঢোকে না, তারপরও মালিরামদের কংলুই পাড়া পর্যন্ত হলেও অনেকে যায়। এ বছরের শরতে তো এমনকি একটা দল দেবখুম ঝর্ণা পর্যন্তও গিয়েছিলো। সেখানে যেতে হলে কংলুই পাড়ার ভেতর দিয়েই যেতে হয়, ফিরেও আসে মানুষজন একই পথ ধরে। সুতরাং দেবখুম ঝর্ণার সন্ধান যখন পর্যটকেরা পাওয়া শুরু করেছে, মালিরাম মোটামুটি নিশ্চিত- আগামী বছরগুলোতে পর্যটকের যাওয়া-আসা আরো বাড়বে। সে সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই মালিরাম চিন্তা করছে- তার দোকানটার পণ্য-বৈচিত্র কিছু বাড়ানো যায় কি না। বিশেষ করে টুরিস্টদের জন্য কিছু চিপস, জুস এমনকি চা! সাথে পাহাড়ের সিজনাল কিছু ফলমূলও থাকলো..
আজ দীঘিনালা বাজার এলাকায় ঢোকার পর থেকেই মালিরামের কাছে পরিবেশটাকে কেমন একটু অন্যরকম লাগছে। অনেকের দৃষ্টি যেন কেমন অদ্ভূত! মালিরামের স্পষ্ট মনে হোল- কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে, মানুষজনও খুব একটা নেই। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটি বোধহয়- বেশ কয়েকটা দোকানকে মনে হচ্ছে বন্ধ! অথচ এ সময়টাতে মানুষের ভীড়ে পুরো এলাকা গিজিগিজ করে। রাস্তার দুপাশে সার বাধা দোকানগুলো দোকানদার-খদ্দের, চেনা-অচেনা, পরিচিত-অপরিচিত নানান মানুষের কথপোকথনে মুখরিত হয়ে থাকে। মালিরাম আজ পর্যন্ত কখনো চায়ের দোকানের বেঞ্চগুলো অন্ততঃ ফাকা পড়ে থাকতে দেখে নি, অথচ আজ সেগুলোও পুরোপুরি জনশূণ্য। মালিরাম নিশ্চিত হোল, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। সে দ্রুত পা চালিয়ে ইসমাইল মিয়ার দোকানে এসে হাজির হয়।
মালিরাম বাজারের যে দোকান থেকে তার নিজের দোকানের জন্য সওদা কিনে নিয়ে যায়, সেটা এক বাঙ্গালির দোকান- নাম ইসমাইল মিয়া। সে কার কাছ থেকে যেনো শুনেছিলো বাঙ্গালিরা কিছুটা লোভী প্রকৃতির হয়, সে ক্ষেত্রে ইসমাইল মিয়া লোকটি ব্যতিক্রম। মালিরাম বাজারের অন্য দোকানগুলোতে নানা সময় খোজখবর নিয়ে দেখেছে; ইসমাইল মিয়া তার কাছ থেকে দাম একেবারেই কম রাখে। মানুষটার সমস্যা শুধু একটাই- অতিরিক্ত কথা বলে।
ইসমাইল মিয়া মালিরামকে দেখে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো- "আজকে হাটে আইলেন যে! খবর কিছু শোনেন নাই?"
'না তো! কি হয়েছে?'
'আরে ভাই কেয়ামত হইছে, কেয়ামত। গতকালকে দুপুরের দিকে আক্কাস আর জামাল নামে দুইজন হুন্ডা নিয়া বাইর হইছিলো, এরপর থিকা আর তাগোরে খুইজা পাওয়া যাইতেছে না। এ নিয়া রীতিমত তুলকালাম শুরু হইছে। রমজান আলী, শুক্কুর আলীরা মিল্যা দল পাকাইতেছে পাহাড়িদের গ্রামে আগুন দিবো; তারা নাকি নিশ্চিত ঐ দুইজনরে সুধীর খীসার দলবল অপহরণ কইরা নিয়া গেছে। এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। চারপাশে মোটামুটি খবর ছড়ায়া গেছে। আজকে বাজারে পাহাড়ি কোন খদ্দের দেখি নাই সকাল থিকা, আপনেরেই প্রথম দেখলাম। শুধু যাদের দুকান ছিলো, তারা একসাথে মিল্যা সবাই আসছিলো একবার ভোরের দিকে, ঘন্টাখানেক থাইকাই আবার যার যার দোকান বন্ধ কইরা বাড়ি ফির্যা গেছে।'
বাজারে ঢোকবার পর থেকে মালিরামের কেন সবকিছু এত অস্বাভাবিক লাগছিলো- এতোক্ষণে তিনি সেটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু, কথা হচ্ছে- ইসমাইল মিয়া যেরকমটা বললো, অবস্থা কি আসলেই এতোটা ভয়াবহ?
'ইসমাইল ভাই, যারা সত্যি সত্যি অপহরণ করেছে, তাদের দোষ থাকতে পারে। কিন্তু সেটার জন্য গ্রামে আগুন দেওয়ার কথা উঠছে কেন? এইটা কেমন কাজ বলেন তো?'
'আরে ধুর মিয়া! অপহরণ যে সত্যি সত্যি করছে এইটারও তো কোন প্রমাণ নাই। হয়তো দুইজন মটরসাইকেল নিয়া বাইর হইছিলো, ঠিকমত চালাইতে না পাইরা খাদে-টাদে পইড়া গেছে। আর আপনে যে কি কন- এইরকম ঘটনাগুলাতে সব থিকা বেশি ক্ষতি তো হয় আমার আপনার মত সাধারণ মানুষগুলারই, যারা এইসবের সাতেও নাই, পাচেও নাই। যাই হোক, শোনেন আপনেরে ভালো কথা কই- আজকে আর হাটে থাইকেন না, বাড়ি চইলা যান। পরে খোজ খবর নিয়া পরিস্থিতি শান্ত হইলে আবার আইসেন।' তারপর নিজের মনে ইসমাইল মিয়া বিড়বিড় করলো- 'আপনে যে এখনো সহি সলামতে আছেন- আল্লার কাছে হাজার শুকুর।'
মালিরাম দোকান থেকে বেরিয়ে আসবার সময় ইসমাইল মিয়া মালিরামকে থামালো, তারপর গলা নামিয়ে বললো- 'ভাই, আমার এই গামছাটা দিয়া মুখটা ঢাইকা নেন। আর চলেন, আপনেরে যতটুক সম্ভব আগায়া দিয়া আসি। আমি যতক্ষণ আপনের সাথে থাকমু আপনের চিন্তার কিছু নাই, আমারে এই এলাকার বাঙ্গালিরা খুব ভালো পায়। তারপরেও কিছু কওয়া যায় না অবশ্য, দিনকাল একটু বেশি রকমেরই খারাপ। যাই হোক, আপনে 'ট্যানশন' নিয়েন না, আমি এই ব্যাগে কইরা পেপার পেচায়া একটা দাও নিতাছি। আপনের গায়ে আচড় লাগতে দিমু না ইনশাল্লা।'
এরপর তারা দু'জন মিলে ইসমাইল মিয়ার দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। মালিরাম ইসমাইল মিয়াকে বললো- 'আপনার দোকান একদম খালি রেখে যাবেন?"
'আরে ধুর মিয়া, মানুষ আগে নাকি দুকান আগে?'- ইসমাইল মিয়া মহাবিরক্ত হোল!
দ্রুত পায়ে হেটে দু'জন বাজারের সীমানার দিকে যেতে থাকে। পরিস্থিতি আরো থমথমে হয়েছে। প্রচন্ড ঝড় আসবার আগে দিয়ে যেমন একটা অস্বাভাবিক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়, এখনো ঠিক একই অবস্থা। উজ্জ্বল সুন্দর শরতের এক দুপুর- বিধ্বংসী এক মানব ঝড়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। যে কেউ সে ঝড়ের আগাম অস্তিত্ব টের পাবে, মালিরাম নিজেও পেলো।
কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই ইসমাইল মিয়া মালিরামকে নিয়ে বাজার-লোকালয় পার হয়ে চলে এলো। কংলুই পাড়া যেতে সামনে আরো ঘন্টাখানেকের হাটা পথ। মালিরাম ইসমাইল মিয়াকে বললো- 'ভাই আপনি অনেকদূর এসেছেন, আর সামনে আগানোর প্রয়োজন নেই। আশা করি- এখন আর কোন সমস্যা ছাড়াই পাড়ায় পৌছে যেতে পারবো। ওখানে গিয়ে সবার সাথে কথা বলে দেখি- আসলে ব্যাপারটা কি?'
ইসমাইল মিয়া কিছু বললো না, কি যেন ভাবতে লাগলো। শুধু মালিরাম বিদায় নিয়ে সামনে হাটা ধরবার আগে তার সবুজ হাতব্যাগটা মালিরামের কাছে দিয়ে বললো- "ব্যাগটা রাইখা দেন, ভিত্রে একটা দাও আছে। আল্লা না করুক পথে কোন বিপদ-আপদ হইলে যেন...'- কথা শেষ না করেই ইসমাইল মিয়া থেমে গেলেন।
মালিরাম কিছুদূর সামনে এসে বাক ঘোরার আগে একবার পেছন ফিরে তাকালেন। তখনো নীল শার্ট আর সাদা লুঙ্গি গায়ের ছোটখাট কালো মানুষটি চোখের আড়াল হয়ে যায় নি।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাতই সদানন্দ, সদাহাস্যোজ্বল মালিরামের দু'চোখ ভর্তি হয়ে যায় পানিতে।
দূরত্ব নয়, চোখের পানিই শেষমেষ ইসমাইল মিয়াকে মালিরামের চোখে অস্পষ্ট বানিয়ে দিলো!
*
মালিরাম যেমনটা ভেবেছিলো, সত্যিকার অবস্থা মনে হোল তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। পাড়ায় পৌছে ইসমাইল মিয়ার সবুজ ব্যাগটা দোকানে কাজলীর কাছে রেখেই সে ছুটলো কারবারী সাধুচং এর বাড়ি। সেখানে নাকি ইতিমধ্যেই গ্রামের অনেকেই জড়ো হয়েছে। সাধুচং এর বাড়ি পৌছে মালিরাম অবাক হয়ে খেয়াল করলো- কাছাকাছি দু'টো পাড়ার কারবারীরাও সবাই সেখানে। কিছু যুবককে শোনা গেলো উত্তেজিত গলায় কথা বলছে।
মালিরাম সেখানে খবর যা শুনলো- সেটা বেশ ভয়ের। বাঙ্গালিরা নাকি ছা্ংউ পাড়া দিনে-দুপুরে জ্বালিয়ে দিয়েছে; পাশের নগেন্দ্র পাড়াও আক্রমণ করতে গিয়েছিলো- কিন্তু সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি। নগেন্দ্র পাড়া গ্রাম হিসেবে বেশ বড়; আর সে কারণেই বাঙ্গালিরা সেখানে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বাঙ্গালিদের একজন নাকি মারাও গিয়েছে সেখানে। আর তাতেই আরো খেপে গেছে তারা। নিজেদের দল আর অস্ত্রশস্ত্র ভারি করে দীঘিনালার চারপাশে যত পাহাড়ি গ্রাম আছে- সবগুলোতেই নাকি আজ গভীর রাতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাঙ্গালিরা।
ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন ক্ষুব্ধ গলায় বললো- 'আমরা কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো নাকি? আক্রমণ করতে আসলে আমরাও উপযুক্ত জবাব দেবো।'
কেউ বললো- 'আশপাশের সব পাহাড়ি এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে আমরাই তো গিয়ে বাঙ্গালিদের গ্রাম আক্রমণ করতে পারি..'
'রমজান আলী আর শুক্কুর আলীকে প্রথমে শেষ করা দরকার, শয়তানের মূল এ দুইটাই। এরা গতবছরেও ঝামেলা পাকাতে চেয়েছিলো।'
এ জাতীয় কথাবার্তায় উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন সাধুচং কারবারীকে কথা বলতে শোনা গেলো। লোকটার গলার স্বর শান্ত। তিনি কথা বলা শুরু করা মাত্র বাকি সবাই কথা থামিয়ে দিলো। পিনপতন নিস্তব্ধতায় সাধুচং মোটামুটি দশ মিনিটের একটা ভাষণের মত দিলেন। তিনি যেটা বললেন, সহজ বাংলায় তার সারমর্ম হচ্ছে-
এবারের ঝামেলাটা আসলে অনেক বেশি জটিল। বাঙ্গালিরা আট-ঘাট বেধেই নেমেছে। নগেন্দ্র পাড়া থেকে পিছু হটে আসার পর রমজান আলী বাইরে থেকে আরো লোক আনার চেষ্টা করছেন। খুব সম্ভবত তারা এবার রাতের আধারে অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করতে পারে। অংলাই আর সেপ্রু পাড়ার আদিবাসীরা ইতিমধ্যেই বাড়িঘর ছেড়ে বর্ডারের দিকে যাওয়া শুরু করেছে; ছাংউ পাড়ার অবস্থা সামনাসামনি দেখে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছে। আমি নিজেও আমার পাড়ার মহিলা এবং শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বর্ডারের দিকে চলে যাওয়ার পক্ষপাতি। সমস্যা মেটার আগ পর্যন্ত আমরা সীমানার আশেপাশেই থাকবো। সমস্যা মিটে গেলে আবার ফেরত আসবো। জনাব ক্যসাপ্রু এবং জনাব জ্ঞানলালও আমার চিন্তার সাথে একমত। তারাও নিজ নিজ পাড়ার লোকজনকে বর্ডারের দিকে সরে যাওয়ার ব্যাপারেই উপদেশ দেবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।
প্রত্যেকেই আর দেরি না করে ইন্ডিয়ার দিকে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করে দাও। বর্ডার পর্যন্ত পৌছুতে আমাদের কম-বেশি ৮ ঘন্টার মত সময় লাগবে- এটা মাথায় রেখেই যা যা নেয়া দরকার, এবং নেয়া সম্ভব- তার সবই সাথে করে নিও। বর্ডার পর্যন্ত যাবার জন্য লুসাইরা যে রাস্তাটা ব্যবহার করে- আমার মনে হয় সেটা ব্যবহার করাটাই ভালো হবে। রাস্তাটা প্রচলিত এবং নিরাপদ।
আমরা সন্ধ্যার পর পর রওনা হয়ে যাবো। কেউ দলছুট না হয়ে সবাই এক সাথে থাকার চেষ্টা করবা। যারা জুমে ছিলো- আমি তাদেরকে নিয়ে আসতে লোক পাঠিয়েছিলাম- এতোক্ষণে নিশ্চই সবাই এসেও পড়েছে। এখন যাও, সবাই যার যার বাড়ি গিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি শুরু কর...
সাধুচং কারবারীর কথা শেষ হবার পরও সবাই কিছুক্ষণ তার বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে রইলো। কেন দাঁড়িয়ে রইলো- সেটা ঠিক পরিষ্কার না। হয়তো কারো কারো মনে এমন বিশ্বাস ছিলো যে, এখনই আবার সাধুচং তার আগের বক্তব্য ফিরিয়ে নেবেন; বলবেনঃ 'কোথাও কোন সমস্যা নেই, সব ঠিক আছে। কাউকে আর পাড়া ছেড়ে বর্ডারের দিকে যেতে হবে না!' কিন্তু তাদের সে ব্যাকুল আশাকে মিথ্যা প্রমাণ করে প্রবীন সাধুচং আর কিছু বললেন না, ক্লান্তভাবে তার ছোট চৌকিটার ওপর বসে রইলেন, বসেই রইলেন।
হৃদয় আর যুক্তির দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা মানুষগুলো একে একে কারবারীর উঠোন ছাড়া শুরু করে। অল্পক্ষণেই সাধুচং কারবারীর বাড়ির উঠান পুরোপুরি মানুষ-শূণ্য হয়ে আসে।
*
উত্তেজনায় খমনুর হাত পা কাপছে, সে ঠিকমত কোনকিছু চিন্তা করতে পারছে না। কান দু'টো দিয়ে মনে হচ্ছে গরম বাতাস বেরুচ্ছে, মাথাটা যেন অল্প অল্প ঘুরছে। আর সব বাচ্চা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের চোখে গভীর কৌতূহল আর সম্ভ্রম মাখানো বিস্ময়।
কাপা কাপা গলায় খমনু যেটা বললো- তার সারমর্ম হচ্ছে- খেলার এক পর্যায়ে সে, উলাপ্রু আর সঞ্জীব বনের ভেতর ঢুকে গিয়েছিলো। সঞ্জীব আর উলাপ্রু একসাথেই ছিলো- খমনু তাদের থেকে ছোটাছুটির কারণেই কিছুটা আলাদা হয়ে পড়ে। তারা তখনো বনের খুব একটা গভীরে প্রবেশ করে নি- এমন সময় হঠাতই অরণ্যের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে অদ্ভূত সুরেলা এক ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। থেমে থেমে কয়েকবার ডেকে হঠাতই পুরো বন আবার আগের মতন শব্দহীন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার সেই অদ্ভূত সুর।
খমনু সে অচেনা শব্দ অনুসরণ করে বনের আরো গভীরে ঢুকে গিয়েছিলো। এক সময় দূরে বড় বড় গাছের ছায়ায়, বনঝোপের ফাক-ফোকড় দিয়ে তার নজরে আসে উজ্জ্বল কমলা আর গাঢ় নীলের কিছু একটা ছুটতে ছুটতে আরো গভীর সবুজে হারিয়ে যাচ্ছে! ইতিমধ্যে বন এতোটা ঘন হয়ে এসেছিলো যে খমনু অনেক চেষ্টা করেও আর ভেতরে যেতে পারে নি। সেখান থেকেই সে ছুটতে ছুটতে দ্রুত বন্ধুদের কাছে ফেরত এসেছে।
সঞ্জীব আর উলাপ্রু দু'জনই খমনুর কথার সত্যতা নিশ্চিত করলো। তারাও আজ জীবনে এই প্রথম এমন এক শব্দ শুনেছে, যেটা এর আগে কখনো শোনেনি।
সব কথা শুনে টুনে কল্পনা তার মতামত জানালো এই বলে যে- খমনু নিশ্চিতভাবেই স্বর্গপাখি রিরৈ এর দেখা পেয়েছে। আজ রাতেই আবার পৃথিবীর বুকে নেমে এসে খমনুর একটা ইচ্ছা পূরণ করবে রিরৈ। রাত গভীর হলে যখন আলোর শরীর নিয়ে রিরৈ মাটিতে নেমে আসবে, তখন খমনু যেনো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সে স্বর্গের পাখির কাছে কিছু একটা চায়- এটাই নিয়ম। কল্পনা নিজে খমনুর সৌভাগ্যে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
সেদিন সন্ধ্যা হবার আগেই খেলায় ইস্তফা দিয়ে বাচ্চাগুলো যে যার বাড়িতে ফিরে এলো।
খমনু তখনও ঠিক ধাতস্থ হতে পারে নি, এর মধ্যেই বাড়ি পৌছে হতভম্ভ হয়ে দেখলো মা-বাবা নিজেদের ঘরে খাটের উপর বসে কাদছে। প্রথমতঃ এই সময় মা-বাবা দু'জনই দোকানে থাকে, বাড়িতে তাদের থাকার কোন কারণই নেই। দ্বিতীয়তঃ বাবাকে সে আজ পর্যন্ত কখনো কাদতে দেখে নি। খমনু অধিক শোকে পাথর হয়ে নিঃশব্দে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। দিদি উঠানেই ছিলো, খমনু দেখলো সেও চুপ করে এক কোণায় দাঁড়িয়ে তার বাগানের গাছগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খমনুকে দেখতে পেয়ে চৈতালি বললো-
'এসেছিস! আয়, তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বাবা শুকরটাকে তখনই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, আমি দেই নি। বলেছি খমনু আসুক, ছেড়ে দেয়ার আগে একবার অন্ততঃ সে যেনো তার প্রিয় শুকরটাকে আদর করার সুযোগ পায়।'
খমনু কিছুই বুঝতে পারছে না। শুকরটাকে ছেড়ে দেয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?
দিদিকে একথা জিজ্ঞেস করতেই দিদি নীচু গলায় বললো- 'আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আবার কখনো আসতে পারবো কি না, আসলেও কবে আসবো- তার কোন ঠিক নেই। শুকরটাকে তো আর সাথে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাই...'
খমনু অত্যন্ত অবাক হয়ে বললো- 'চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় চলে যাচ্ছি? কেন চলে যাব?'
'আমরা ইন্ডিয়ার বর্ডারের দিকে চলে যাবো। শুধু আমরা না- আমরা, সঞ্চনারা, উলাপ্রু, সঞ্জীব, সুস্মিতা, কল্পনা- সবাই যাবে। এখানে থাকলে নাকি অনেক বিপদ হতে পারে। ওদিকের কয়েকটা পাড়ায় নাকি খারাপ মানুষ আগুন দিয়ে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। কয়েকজন নাকি মারাও গেছে। আমাদের গ্রামেও নাকি তারা আগুন দিতে পারে। তাই সবাই আস্তে আস্তে এ জায়গা ছেড়ে বর্ডারের দিকে চলে যাচ্ছে।'
খমনু পুরো ব্যাপারটা খুব একটা ভালো বুঝতে পারলো না। শুধু বুঝলো- কিছু দুষ্ট লোকের কারণে তাদেরকে কংলুই গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে! কি আশ্চর্য! দিদি তাহলে এতোদিন ধরে এতো যত্ন করে যে ফুলের বাগানটা তৈরি করলো সেটার কি হবে? আচ্ছা, তাদের বাড়িটাও কি দুষ্টু লোকগুলো পুড়িয়ে দেবে? দোকান?! দোকানটাও যদি পুড়িয়ে দেয়, তাহলে খমনু ফিরে এসে বিস্কুট খাবে কোথা থেকে?
প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে খমনু তার শুকরটার পাশে গিয়ে বসে। তার পিঠে আদর করতে করতে নিচু গলায় বলে-
"ভালো থাকিস রে। তোকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারলাম না...."- খমনুর কন্ঠস্বর হঠাতই রুদ্ধ হয়ে এলো। সে নিঃশব্দে কাদতে কাদতে শুকরটার গলার বাধন খুলে দেয়। শুকরটা বিভ্রান্ত-পায়ে কিছুটা দূরে গিয়ে আবার খমনুর কাছে ফিরে আসে, বোধহয় বিশ্বাস করতে পারে না- সে মুক্ত! তারপর আবার পেছন ঘুরে দৌড়ে পশ্চিম দিকের ঢাল বেয়ে নেমে যেতে থাকে।
খমনু অশ্বত্থ গাছটা পর্যন্ত শুকরটার পিছু পিছু গেলো, তারপর গাছের গুড়িতে পা রেখে যতদূর দৃষ্টি যায়- নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে।
সূর্য পাহাড়ের ওপারে চলে গিয়েছে। গোধূলির আলোর-সমুদ্রে রঙের ঢেউয়ে সময়ের সাথে সাথে দিগন্ত বদলে যাচ্ছেঃ গাঢ় সোনালী-হলুদ, এরপর কমলা-লাল, এরপর গোলাপী-বেগুনী-মেরুন... আকাশের সে অদ্ভূত রঙ-খেলার আভা কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকেও। দিগন্তের ধ্যানমগ্ন পাহাড়-চূড়ায় সে আলো-আধারির খেলা দেখে ক্ষণিকের জন্য গম্ভীর পাহাড়গুলোকে কেমন অচেনা অচেনা লাগতে থাকে; মনে হয়- কঠিন সাধনাকে ক্ষণিকের জন্য দূরে ঠেলে দিয়ে তারা বুঝি তারুণ্যের রঙ্গীন চঞ্চলতা আর স্বপ্নময় উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছে।
ধীরে ধীরে পাহাড়ি কংলুই পাড়ায় শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা নেমে আসে।
*****
রাতে সত্যি সত্যিই কংলুই পাড়ায় আগুন দেয়া হয়। সর্বগ্রাসী সে আগুনের গাঢ় কমলা-হলুদ শিখায় পুড়ে ছাই হতে থাকে মানুষের ভালোবাসা, স্বপ্ন আর সাধ। বোধশক্তিহীন কোন উন্মাদ যেনো ধ্বংসের প্রলয়োল্লাসে উদভ্রান্তের অট্টহাসি হাসে, আগুনের শিখা আশেপাশের পাহাড়ের গায়ে বিচিত্র সব ছায়া তৈরি করে। কম্পমান, বিভ্রান্ত সে নকশার ছায়াছবি হয়তো মানুষকে গূঢ় কোন ইঙ্গিত দিতে চায়। কিন্তু দুর্বোধ্য সে ইঙ্গিত বোঝা ধুলোকাদার এই পৃথিবীর মানুষের সাধ্যের বাইরে!
ঠিক সে সময় কংলুই পাড়া থেকে অনেক অনেক দূরে- বাবার কোলে ঘুমন্ত খমনু, কার যেনো চাপা কান্নার শব্দে হতচকিত হয়ে জেগে ওঠে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতেই কি না- তার বুঝতে অনেক সময় লাগে আসলে কাদছেটা কে? যখন বুঝতে পারে কাদছে আসলে তার মা, তখন খমনুর নিজেরো বুক ঠেলে কান্না উঠে এলো। শিশুটির ছোট্ট হৃদয় এতোক্ষণ অভিমানের যে উথাল পাথাল সমুদ্রটাকে জোর করে শান্ত বানিয়ে রেখেছিলো, হঠাতই সে সাগরে বিশাল এক ঝড় ওঠে! কোন শক্তিই যেনো আর সে ঝড়কে দাবিয়ে রাখতে পারে না।
খমনুর কান্না শুনে মা ছুটে এসে পরম মমতায় ছেলের পিঠে হাত রাখেন। নরম গলায় বলেন- "কি হয়েছে আমার বাবুটার! কাদছিস কেনরে বাবা? কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিস? আয় আমার কোলে আয়"
ছোট্ট খমনু কাদতে কাদতেই বলে-
"মা, তোমরা চিন্তা করো না। আমি রিরৈ এর কাছে প্রার্থনা করেছি যেনো আমরা আবার আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে পারি। দিদিকে ওর বাগান নিয়ে মন খারাপ করতে মানা কর, আর তোমরাও তোমাদের দোকান নিয়ে ভেবো না। দেখো, নিশ্চই আমরা ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত সব ঠিক আগের মতনই থাকবে। আজ সকালেই আমি বনে স্বর্গ-পাখিকে দেখেছিলাম। সত্যি মা! আর যারা তাকে দেখতে পায়, রিরৈ তো তাদের ইচ্ছাপূরণ করে! মা! স্বর্গ-পাখি রিরৈ এর কাছে আমার ইচ্ছা একটাই- যেনো আমরা আবার আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে পারি। যেনো কেউ আমাদের কংলুই পাড়ার কোন ক্ষতি না করতে পারে।"
কাজলী ছেলের কথা শুনে চোখ মোছেন। তার নিজেরও বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা হয়- সত্যি সত্যিই বুঝি কেউ তাদের প্রিয় কংলুই পাড়ার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। স্বর্গপাখি রিরৈ যাকে দেখা দেন, তার মনের ইচ্ছা কি তিনি পূরণ না করে পারেন !
রাত গভীর হয়। ধীরে ধীরে কংলুই পাড়ার আগুন স্তিমিত হয়ে আসে। আগুনের ক্রুর গর্জন আর প্রতিহিংসার হিসহিস থেমে গিয়ে পুরো এলাকা আবার পাহাড়ি অরণ্যের ধ্রুপদী নৈঃশব্দে ডুবে যায়।
শেষ রাতের সে চিরায়ত নিস্তব্ধতা- জোছনা-রঙ্গা এক অপূর্ব স্বর্গপাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ শোনবার জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করে থাকে।
-পুলহ
মন্তব্য
স্বাগতম, পুলহ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
স্বাগতম, পুলহ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সচলে আজকাল গল্প আসে না খুব একটা। তাই 'ইনি মিনি মাইনি মো' বলে আগে পড়িনি এমন একটা পুরনো গল্প খুলে বসলাম। কিছুটা পড়েই নিজের উপর রাগ হলো খুব। কী করে চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো এই গল্পটি! ফিরে আসুন পুলহ।
-----মোখলেস হোসেন।
নতুন মন্তব্য করুন