অ-কথন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৭/১০/২০১৫ - ১:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
পুকুরটা ছিল বিশাল বড়, পাড়ার পেছনদিকে শেষ মাথায় আমাদের বারোয়াড়ি পুকুর। বিশাল মানে সে আমাদের সেই বয়সে পৃথিবী দেখার হিসেবে। সেই পুকুরকে আমরা বলতাম ‘দীঘি’, আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট হয়ে শব্দটা হয়ে যেত ‘ডিগি’। সেই পুকুর ছিল পাড়ার ছেলেপেলের সারাদিনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। গণগণে গরমের লালচে আগুনঝরা দিন থেকে শুরু করে কনকনে শীতের হলদেরঙা দুপুর, পাড়ার সকল দস্যি ছেলেমেয়েরা দুদণ্ড হাঁফ ছাড়বার প্রয়াসে ঝাঁপ দিত পুকুরটায়। অবশ্য দস্যিদের বাবা-মা’রাও যে দিত না এমনটা নয় কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেই পুকুরটায় দিনমান লাফ-ঝাঁপ শেষে, ডুবসাঁতারে ছোঁয়াছুঁয়ি ‘হাঁড়ি/হাঁউড়ি’ খেলা শেষে লাল টকটকে চোখ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর মার ভয়ানক চোখরাঙানির পর দুচারটে কানমলা আর ওঠবসের উপর দিয়ে যদি পার পাওয়া যেত তাহলে তা ছিল সাতপুরুষের ভাগ্য, নইলে যে নিদারুণ শাস্তি অপেক্ষা করত একেক জনের জন্য, সে কহতব্য নয়।

পুকুরের উপরেই ছিল রামদের বিশাল বড় চমৎকার বাঁকানো কূলের গাছটা। বারোয়াড়ি পুকুরপাড়ের গাছ রামদের একলার ভাগে পড়ার কারণটা আর কিছুই নয়, পাড়ের নিচের জমিটাই ছিল ওদের। মালিকানা যারই হোক আর গাছে কূল থাক বা নাই থাক, সেই গাছের সবকটা ডালে উঠে পুকুরের জলে খাড়া লাফিয়ে পড়ার অধিকার ছিল সকলের। কূলের দিন লাফ দেয়ার আগে দু’চারটা কূল মুখে পুরে ফেলাও খুব একটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল না তখন। সে গাছের একেবারে উঁচু মগডালটা ছিল আমার একলার সম্পত্তি, সে ডাল যার অধিকারে, দলের আর সবার কাছে সে সাক্ষাৎ বীরত্বের প্রতিমূর্তি আর মার কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। সেই বয়সে অবশ্য মার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার চাইতে অন্যদের কাছে বীর হওয়ার লোভটা বড় কম ছিল না আর সেইসাথে নিজেকেও অনেকখানি অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল না যে, তেমনটাও নয়।

আমরা পিচ্চিরা রোজ সকাল দুপুর বিকেলে সময়ের তোয়াক্কা না করে ছুটতাম পুকুরপাড়ে। বেশ উঁচু পাড়গুলো তখন আমাদের কাছে নেহাত মাটির ঢাল, ওখান থেকে লাফানোতে না আছে মজা, না আছে অ্যাডভেঞ্চার আর না আছে অন্যকে নিজের কীর্তি দেখানোর মাহাত্ম্য। আমরা সোজা উঠে যেতাম সেই কূলগাছে, গাছটা এঁকেবেঁকে উঠে গিয়েছিল সোজা পুকুরের মাঝ বরাবর। পুকুরের বুকে ঝুঁকে পড়া একেকটা ডাল বেছে নিয়ে আমরা দিতাম মনের সুখে লাফ, ঝুপ করে শব্দ হতো জলে আর ভুস করে ডুবে যেতাম আমরা, এক ডুবে সাঁতরে মাথা তুলতাম আরেক জায়গায়। মাঝেমাঝে বেকায়দায় পড়লে জলের কঠিন আঘাতে মনে হতো মরেই যাচ্ছি বুঝি। সেই জলে ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার, বুক সাঁতার চলত একের পর এক, একের পর এক, একের পর এক।


উঠানটা ছিল অনেক বড়, পাড়ার একেবারে পুবদিকে আমাদের বাড়ি লাগোয়া বারোয়াড়ি উঠানটা। আমাদের খেলবার, দৌঁড়াবার, আড্ডা দেবার প্রিয়তম স্থান। দাঁড়িয়াবান্ধার কোট কাটা থাকত বারো মাস, মাঝেমধ্যে কোদালে কুপিয়ে সেই পুরনো কোটটাকে আরেকটু স্পষ্ট করে নেয়া হতো মাত্র। মাঝ বরাবর ছোট্ট করে ঠিকই থাকত গোল্লাছুটের ঘরটা। পুব-পশ্চিম দুদিকে দুটো বউচি’র ঘর; বড়টা দলের সক্কলের, পিচ্চিটা একলা বউয়ের জন্য। হু হু করা বাতাসের দিনে বা গণগণে রোদ্দুরের ঘামঝরানো বিকেলে এই উঠানেই দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বউচি ছাড়াও জমে উঠত ওপেন্টি বায়োস্কোপ, ইচিং বিচিং, এক্কাদোক্কা, আমচু-বাগাচু, আইসক্রিম-ক্লাস থ্রি খেলা। উঠানের পুব ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা খড়ের গাদা ক’টা আর মোটা মোটা আম, কাঁঠাল, তেঁতুল গাছগুলোর ফাঁক ফোঁকড় ছিল লুকোচুরির আদর্শ জায়গা। রোজ বিকেলে, রোজ দুপুরে আমার চেয়ারম্যান দাদুর মিলিটারি মেজাজ বাঁচিয়ে আমরা খেলতাম, দৌঁড়াতাম, চেঁচাতাম মনের সুখে। কাঁঠালগাছ কাঁঠালগাঁছ, বুড়িমা বুড়িমা, নুচিপুরি ভাজিয়া খেলার ফাঁকে সময় যেন দৌঁড়ে চলত। কত দুপুরে ‘তাড়িয়া নাল’-এর কোটে দাঁড়িয়ে চোর হয়ে নিতান্তই দুশ্টিন্তায় থাকতে হয়েছে এই বুঝি আবার কারও হাত তেড়ে এলো ঠাস করে!

উঠানের মাঝ বরাবর এখনকার মতোই রাজার ভঙিতে দাঁড়িয়ে ছিল একলা তালগাছটা একপায়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে। আকাশের দিকে উঁকি মারা সেই গাছে জোড়া সাপের মিথ আমাদের ছোটবেলার জ্যান্ত রূপকথার গল্প, মাঝেমাঝে গাছের গোড়ার পাওয়া সাপের ‘কুরুছ’ সেই গল্পকে প্রায় সত্যি বানিয়ে দিত, সে এক রূপকথার সত্যি হয়ে ওঠার রোমহর্ষক গল্প! শেষ ফাল্গুনের ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটার সাথে ঝুরঝুর করে পড়া হলদে রঙের সোনা সোনা তালফুল কুড়ানোর গল্প শুনে শুনে কতজনের কান ঝালাপালা হয়ে গেল। সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, ধুলো ওড়া বাতাসের সাথে সাথে তালগাছের ডালগুলো দুলত শনশন শব্দ করে আর তার সাথে নিচে নেমে আসত হাজারে হাজারে সোনালি তালফুল। আমাদের হাতের ছোটছোট মুঠোগুলো ভরে যেত, মুঠোর পর ভরত কোঁচড়, তারপর মাটি। সে যেন খনি খুঁড়ে কে কত সোনা পেল, এমন ব্যাপার! তালফুল পড়া শেষ হতে না হতেই তালগাছটা আরও বিচিত্র সবুজে ভরে যেত। ঠোঁটে করে আনা খড়কুটো দিয়ে চমৎকার বাসা বাঁধত বাবুই। বর্ষার দিনে ঠাণ্ডা বাতাসে বৃষ্টির জলের সাথে তিরতির করে কাঁপত বাবুইয়ের বাসা, তারও চাইতে বেশি তিরতির করে কাঁপত বাবুই দম্পতি। সেই তালগাছ! সেই লম্বায়, চওড়ায় ছড়ানো বারোয়াড়ি উঠান!


বছরের অর্ধেক দিন জল থাকে না পুকুরটায়। মেশিন লাগিয়ে জল দিয়ে তাতে মাছ চাষ করে আমার তখনকার পিচ্চিপাচ্চা ভাইয়ের দল। রামদের কূলগাছ কাটা হয়ে গেছে সেই কবে। কাঠ করার জন্য নয়, জ্বালানির জন্যও না, পাশের পাড়ার পিচ্চিগুলোর অত্যাচারে একটাও কূল ঘরে তুলতে না পারলে মিছিমিছি বুড়ো গাছটা রেখে লাভটাই বা কী? কোনো এক বিষণ্ন দুপুরে সে গাছ তাই চালান হয়ে গেছে কারও চকচকে কুঠারের নিচে। গাছের ডাল নেই, পুকুরের ভাঙাচোরা নিচু পাড় থেকেও লাফ দেবার কেউ নেই। পুকুরটা বড্ড নিশ্চুপ, কেবল মাছেদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলে বড্ড নিঃসাড়ে।

উঠানটায় দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট আর বউচির কোট ঢেকে গেছে কয়েক পরত মাটির নিচে। তাড়িয়া নালের ছোট কোটটায় দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করা কোনো উদ্বিগ্ন মুখ চোখে পড়ে না, হাসি চেপে রেখে খড়ের গাদার পেছনে লুকানো পিচ্চিটার মাথায় এসে ঝপ করে হাত বসিয়ে দেয় না লুকোচুরি খেলার চোর। বুড়ো হয়ে যাওয়া একলা দাঁড়ানো তালগাছটার সোনালি ফুল দুহাতে ধরবে বলে মুঠো বাড়ায় না কেউ আর।

সেই পুকুর, সেই উঠান, সেই সাঁতার, সেই খেলা কোথায় চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমার পরে যে বোন ছিল, আমার পরে যে ভাই আছে, গোল্লাছুটের কোটে দাঁড়িয়ে তারা বনবন করে লাটিমের মতো ঘুরতে শেখেনি, চিৎসাঁতারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে আস্ত পুকুরটা নিজের করে নিতে শেখেনি কোনোদিন। নাকি শিখেছে? কে জানে!

দেবদ্যুতি


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

লেখাটা শুরু করেই মনে হচ্ছিল আপনার লেখা, দিনে দিনে এক লহমা হয়ে যাচ্ছি দেখি! চাল্লু
Btw, পুকুর আবার কি জিনিস? বাচ্চাকাচ্চাদের এইসব কল্পিত জিনিসের গপ্প দেয়া ভাল না!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার লেখা তো অতি সহজেই বোঝা যাবার কথা কারণ আমি ছাড়া কেই বা এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে আবজাব লেখে বলুন তো, সাক্ষী দা’? আপনার এক লহমা বা ফেলুদা হওয়া পুরাই বানচাল হয়ে গেল বলুন!

আর ইয়ে, ভাবছি একটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখব, তার জন্য এই ‘পুকুর’ জিনিসটা আবিষ্কার করে ফেললাম!!!

দেবদ্যুতি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুমন্ত এর ছবি

ভারী চমৎকার লাগলো আপনার লেখা। অনেক ধন্যবাদ। এক টানে পড়ে ফেললাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানবেন, সুমন্ত হাসি

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ লিখেছেন। আপনার ভাষা বড় আধুনিক। আর সব লেখার শেষে যেন আপনাকে বোঝাতেই হবে আপনি আসলে একজন পাক্কা কবি। খুব ভালো লাগল।
------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমেই অনেকগুলো আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- তবে সত্যি কথা কী জানেন তো, আমি জীবনেও কবি হতে পারব না, কবিতার ব্যাপ্তি বোঝার ক্ষমতা আমার মতো সাধারণস্য সাধারণের নেই। শুভকামনা জানবেন হাসি

দেবদ্যুতি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

এখন আর সাঁতার কাটতে পারি না। পা টেনে ধরে পানি। আমি নিজেকে ছাড়াতে পারি না। পানি এখন ভয় লাগে। স্মৃতিচারণ খুব ভাল কর তুমি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি বলি কী, একদিন পানির পা টেনে ধরার ভয় ছুঁড়ে ফেলে আবার নেমেই দ্যাখো না সাঁতার কাটবে বলে, তবে শাড়ি পরে নেমো না যেন। শুভকামনা হাসি

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

পুকুরটা, কুলগাছটা, উঁচু পাড়টা, উঠোনটা, গোল্লাছুটের ঘরটা, তালগাছটা - সত্যানন্দদার ভাষাতেই বলতে হয় এসব কল্পকাহিনি এখনকার বাচ্চাদের না শোনালেই ভাল, এখনকার বাচ্চাদের বরং শোনাতে কংক্রিটের রাজপুরির কথা, বিশ্বমানের রডের কথা, সিমেন্টের কথা, পাইপের কথা।
।।।।।।।।
অনিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

তবে তাই হোক-আপনিই না হয় কংক্রিট, সিমেন্ট, রড, পাইপের গল্পটা শোনালেন এবার হাসি আর হ্যাঁ, বড্ড উপকার করলেন কিন্তু, যদিও ঠিক করবার উপায় নেই তবু কুলগাছ বানানটা যে আগাগোড়াই ভুল লিখেছি এ লেখায়, চোখে পড়ল আপনার মন্তব্যের জেরে। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- শুভকামনা

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষ করবার আগেই অতিথির পরিচয় জেনে ফেলেছি বললে ক্লিশে শোনাতে পারে বলে বললাম না।

শিশুদের ধান-কাঠের খাটে ঘুম পাড়ানোর দায়টা অভিভাবকদেরই বোধ হয়। লেখা বরাবরের মতোই ভালো লাগলো।

শুভেচ্ছা জানবেন।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আর শুভকামনা জানবেন নিরন্তর, স্বয়ম হাসি

দেবদ্যুতি

তিথীডোর এর ছবি

বাহ, ভাল্লাগলো পড়তে। চলুক

সাঁতার কাটতে পারি না, গ্রামে গিয়ে বাড়ির পুকুরেও নামিনি কখনো। লেখায় সে স্বাদটা খানিকটা কল্পনা করে নেয়া গেলো।
লিখুন আরো।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, তিথীডোর। সাঁতার এখনও শিখে নিতে পারেন কিন্তু হাসি

দেবদ্যুতি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।