কাল রাতে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখেছি।
...............................................................
দেখলাম আমরা নতুন বাড়ি কিনেছি, আমরা মানে আমি আর আমার স্ত্রী। বাড়িটা দারুণ, অনেকগুলো ঘর একতলা দোতলা মিলিয়ে। তিনপাশ জুড়ে সবুজ ঘাসের ঘন লন, লনের প্রান্ত ঘেঁষে বেশ কয়েকটি ফলের গাছ, বাড়ির সামনের দিকে পরিপাটি ফুলের বাগান। ভূতপূর্ব গৃহস্বামীর রুচিতে আমি মুগ্ধ। নতুন বাড়িতে আমি একাই এসেছি। নিচতলার যে ঘরটায় থাকবো বলে ঠিক করেছি তার দুই দিকে বড় বড় দু’টি জানালা, জানালায় সাদা রঙের টানা ব্লাইন্ড। ব্লাইন্ড সরাতেই চোখে পড়ল মূর্তি দুটো। দুটো শ্বেত পাথরের পরী, দেখতে হুবুহু একই রকম মনে হলেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই তফাৎ টা চোখে পড়ে। পশ্চিমের পরীটা লক্ষ্মীট্যারা।
খুব ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট খাই, তাড়াহুড়ায় প্যাকেটটা পুরনো বাসায় ফেলে এসেছি। একদিক থেকে ভালোই হোলো, সিগারেট কিনতে গিয়ে পাড়াটা ঘুরে দেখা যাবে। এই শহরে আগে কখনো আসি নি আমি, তবে জানি এলাকাটি ভালো, তিনটি স্কুলের তিনটিই দেশের সেরাদের তালিকায়। আরও রয়েছে একটি হাসপাতাল, দু’টি শপিং মল, চারটি পার্ক এবং এক সারি পাহাড়। এক সময় ইহুদিরা থাকতো এখানে, বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপ থেকে পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পালিয়ে এসেছিলো এরা, অন্য কোথাও ঠাই না পেয়ে পাহাড়ের নিচে এভারগ্রীনের জঙ্গল সাফ করে গড়ে তুলেছিল বসতি। সে বসতি ভেঙ্গেছে অনেকবার, আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে প্রজন্মের হাত ধরে। পুরনো বাড়িগুলো খুব একটা চোখে পড়েনা আজকাল। যে কটা টিকে আছে, দেখলেই বোঝা যায় সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বানানো হয়েছিলো। বাড়িগুলো এ দেশের আবহাওয়ার সাথে দারুণ বেমানান। অবশ্য এটিই স্বাভাবিক, ইহুদিদের মুল গন্তব্য ছিল মধ্য প্রাচ্য, প্রমিস ল্যান্ড। উত্তর আমেরিকার এই ছোট্ট উপত্যকা সে গন্তব্যের পথে একটি বিরতি মাত্র। শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ পরিবারেরই আর যাওয়া হয়নি। হতদরিদ্রদের আবসস্থল কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে প্রাচুর্যময় পরিপূর্ণ শহর, নেইহামের। পত্তনের চার প্রজন্ম পর নেইহামের ইহুদিরা চলে যাচ্ছে। এ মহা প্রস্থান শুরু হয়েছিল প্রায় বছর পনেরো আগে। ইহুদি বলতে এখন কেবল বিশ ত্রিশটি পরিবার আর জীর্ণপ্রায় একটি সেনাগগ। শূন্যস্থান তো আর পড়ে থাকেনা। মানুষ আসছে স্রোতের মতো, উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম এমনকি দক্ষিণের সমুদ্র পেরিয়ে দলে দলে আসছে বিভিন্ন জাতির মানুষ। পত্রিকায়, রেডিওতে, টিভিতে রীতিমতো বিশেষ আয়োজন করে জানানো হয় কতো দামে বিক্রি হল সর্বশেষ বাড়িটি। নেইহামে বাড়ি কিনতে পারার সংগতি আমার নেই। আর থাকলেও কেই বা এমন অচেনা জায়গায় একবারও না দেখে দুম করে আস্ত একটা বাড়ি কিনে বসে! স্বপ্ন বলেই হয়তো এটি আমাকে ভাবাচ্ছে না। যেমন ভাবাচ্ছেনা স্ত্রী-পুত্র রেখে একা চলে আসার বিষয়টি।
হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে, চারিদিকে রঙের ছড়াছড়ি, অক্টোবরের এই সময়টাতে গাছে গাছে যেন দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। পাল্লা দিয়ে আগুন ঝরায় ওক-মেপল-হিকরি-এলডার-উইলো, এমনকি ব্যাকইয়ার্ডে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ব্লুবেরি ঝোপের সবুজ পাতাও। আমার পছন্দ মেপল। নেইহামে মেপল তেমন একটা নেই বলেই মনে হচ্ছে। কেন নেই ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো নেইহামের ইহুদিরা এসেছিল ইউরোপ থেকে। ইউরোপে যে মেপল নেই তা নয় তবে ব্যাভারিয়ান আল্পসের যে জনপদগুলোতে ইহুদিদের বসতি ছিল সেখানে দেখা যায়না খুব একটা। ব্যাভারিয়াতে হেমন্তের রং হলদে সোনালি। উত্তর আমেরিকার মতো ওক-মেপলের আগুন রাঙা কমলাটে লাল নয় বরং বার্চ, অ্যাকেশিয়া, ওয়ালনাট, এবং পপলারের হরিদ্রাভ কোমলতায় আচ্ছন্ন হেমন্তের ব্যাভারিয়া। নেইহামের ইহুদিদের ওই সোনালি হলুদ ব্যাভারিয়া যুদ্ধের আগুনে ঝলসে গিয়েছে সেই কবে! নেইহামে লাল নেই, কমলা নেই, ওক নেই, মেপল নেই। নেইহামে আছে একখণ্ড ব্যাভারিয়া, রয়েছে প্রপিতামহের দীর্ঘশ্বাস হয়ে দাড়িয়ে থাকা সারি সারি পপলার, বার্চের বন, ওয়ালনাটের বাগান। কোনও এক হেমন্তে - শত সহস্র মাইল দুরে - একদিন এমনই কিছু গাছের ছায়ায় লুট হয়ে গিয়েছিল কিছু মানুষের স্বপ্ন। আমার স্বপ্নে আমি হেঁটে চলেছি সেইসব স্বপ্ন হারানো মানুষদের শহরে, ভর দুপুরের নির্জনতায় একটা মানুষ চোখে পড়ছেনা । কোথায় গেলো সবাই!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে বামে না গিয়ে ডানে হাঁটলে দশ মিনিটেই কনভিনিয়েন্ট স্টোরটা পেয়ে যেতাম। শ্যামল মাহমুদ বললেই পারতেন আমার নতুন বাড়ি একটা ক্রিসেন্টে। যে বাড়ি তিনি কোনদিন চোখে দেখেননি, যে ক্রিসেন্টের হয়তো কোনো অস্তিত্ব নেই, সেই পাড়ায় কিছুটা পথ বাড়তি হেঁটেছি বলে দারুণ রাগ হোলো ভদ্রলোকের উপর। এমনিতেই তাঁর উপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত ছিলাম পশ্চিমের জানালা নিয়ে, এজেন্ট হিসেবে তাঁর উচিৎ ছিল পরীটার কথা আমাকে জানানো। রাগ ঝাড়ার জন্য তাঁকে এখন পাবো কোথায়?
কনভিনিয়েন্ট স্টোরের দরজায় বড় বড় করে লেখা ‘হেইস্টি মার্ট’, অর্থাৎ দারুণ দরকারে ঝটপট কেনাকাটা সেরে ফেলার দোকান। আমিও দারুণ প্রয়োজনেই এসেছি, প্রাণটা সেই কখন থেকে আইঢাই করছে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কাউন্টারের দিকে এগুতে থাকি, আমার পছন্দের ব্র্যান্ড বেলমন্ট। আছে কিনা বোঝার কোনও উপায় নেই, তামাক জাতীয় দ্রব্য দোকানে প্রদর্শন করা বেআইনি। সিগারেট কিনতে গেলে আশেপাশের মানুষ জন এমন ভাবে তাকায় যেন চোরাই মাল কিনছি। আরও তিনজন অপেক্ষা করছে, আমি একটু পিছিয়ে দাঁড়ালাম, সবার সামনে বলতে চাইনা কী খুঁজছি।
হেইস্টি মার্টের দৃশ্য ওখানেই শেষ। কন্টিনিউটি স্বপ্নে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে থেমে থেমে, ভেঙ্গে ভেঙ্গে, কখনো হয়তো অবচেতনে টের পায় এটি স্বপ্ন, তবে এই অভিজ্ঞতা দুর্লভ। স্বপ্ন যে একটা দেখছিলাম সে আমরা বুঝি স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবার পর। কন্টিনিউটি তখন অর্থহীন, মূল্যহীন, পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলির লাবণ্য বিলাস।
স্বপ্নের এই অংশে দেখতে পাচ্ছি আমি একটা চেয়ারে বসা, আমার নতুন বাড়ির নিচতলার ঘরে, পাশেই খোলা জানালা, ব্লাইন্ডের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে শ্বেত পাথরের পরী। পুবের পরী? নাকি পশ্চিমের? অচেনা শহরে এসে আমি পূর্ব-পশ্চিম গুলিয়ে ফেলেছি। খুব যে বড় একটা সমস্যা তা নয়, পরীর চোখের দিকে চাইলেই জানা যাবে জানালটি পুবের না পশ্চিমের। তাকাবো ভাবতেই কেমন যে লাগলো! দারুণ অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি, ঠিক ভয় বলবো না, অনেকক্ষণ ধরে বাজতে থাকা সিডি প্লেয়ার হঠাৎ বন্ধ গেলে যেমন লাগে অনেক টা সেরকম - দমবন্ধ লাগছে। দরজা খুলে দিলাম। দেখি লিভিং রুমের পুরু কার্পেটে বসে খেলা করছে দুটি শিশু, আমাকে দেখে হাসল ওরা, আমিও হাসছি, জীবন বড় মধুময়।
ফুটফুটে দুটি শিশু আমার বাড়িতে, পরনে পাতলা সোয়েটার, সোয়েটারের সাথে রঙ মিলিয়ে গ্যাভারডিনের ঢিলেঢালা প্যান্ট। একজনের পায়ে উলের মোজা অন্য জন গলিয়েছে ফোলা ফোলা নরম নরম এক জোড়া স্লিপার।
“তুমি কি আমাদের ডলস হাউস টা দেখেছ? অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছিনা।”
“কোথায় রেখেছিলে বলতো?”
“ফায়ার প্লেসের পাশেই, তুমি নিশ্চয়ই সরিয়ে রাখো নি?”
আমি ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলাম, কোনও ডলস হাউস দেখেছি বলে তো মনে পড়েনা!
“আমরা এদিকটাতে খুঁজি, তুমি বরং ওই সেলফ গুলোর পেছনে একটু দেখ। অত উঁচুতে আমরা নাগাল পাইনা।”
সেলফগুলোতে ধুলোর স্তর জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে অনেকদিন কারো হাত পড়েনি এখানে। যতখানি সম্ভব নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে হাতড়ে চলেছি আমি, বাড়ির ভেতর খুঁজছি হারিয়ে যাওয়া বাড়ি।
“গুড ইভিনিং, আশা করি ঘুম ভালো হয়েছে। এদিকটায় নতুন মানুষ খুব একটা আসেনা, ড্রাইভওয়েতে গাড়িটা দেখেই বুঝতে পারলাম আপনি এসে গিয়েছেন। দারুণ গাড়ি আপনার! আগে কখনো এমন গাড়ি দেখেছি বলে তো মনে হয়না।”
সেলফগুলোর আড়ালে যে একটা টেবিল রয়েছে তা আমার চোখেই পড়েনি, লালচে কালো মাঝারি আকারের এক্সিকিউটিভ টেবিল, মনে হয় চেরি কাঠের, উপরটা পুরু কাঁচে ঢাকা। টেবিলের পায়া চারটি বাইরের দিকে খানিকটা বাঁকানো, জায়গায় জায়গায় চলটে উঠে গিয়েছে, অনেক পুরনো নিশ্চয়ই। টেবিলের পেছনে হাতল আলা রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে লোকটা, দারুণ বৃদ্ধ, চলটে উঠে যাওয়া টেবিলটির চেয়েও প্রাচীন।
“আমার নাতনি দুটো আপনাকে জ্বালিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি। চলুন, ডিনারের সময় হয়ে এলো। ইভা, সিঁড়ির বাতিগুলো জ্বালিয়ে দাও, আঁধার হয়ে আসছে।”
মেয়ে দুটি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে সিঁড়ি বেয়ে, বৃদ্ধের কোনও একটা কথায় খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ার জোগাড় তাদের। আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে লিভিং রুম থেকে বেরুতে বেরুতেই নিঃশব্দ চারিদিক। হাতের ডানেই দেখতে পাচ্ছি সিঁড়িটা, সরু এবং দারুণ খাড়া, উপর দিকে উঠতে উঠতে হঠাৎ নেই হয়ে গিয়েছে। একবার মনে হল সিঁড়ি টিড়ি কিছু নেই, সামনের ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারটা আসলে কালো রঙের নিরেট একটা দেয়াল, ধাপগুলো ওই দেয়ালে গিয়েই মিশেছে। কিন্তু তাই বা কেমন করে হয়! স্পষ্ট শুনলাম বাচ্চা দুটো ধুপধাপ করে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, এই দরজা দিয়েই না বেরুলো ওরা? কী যে হোলো আমার, যাবো কি যাবনা করতে করতে শেষমেশ বাড়িয়েই দিলাম একটা পা।
রেলিং এ হাত রেখে অন্ধের মতো চলছি, একটা সময় মনে হোলো সিঁড়িটা যেন বাম দিকে ঘুরে যাচ্ছে, প্যাঁচানো সিঁড়ি! নাকি ল্যান্ডিং? বোঝার জন্য একটু থমকে দাড়াতেই দেখি হাত দশেক দুরে সে দাড়িয়ে। নিচ থেকে উঠছি বলেই তার মুখটা চোখে পড়েনি, শুধু দেখলাম একটা মোমবাতি আর সাদা একটা গাউন, যেন বাতাসে ভেসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
মানুষের জীবনে এক দু'টা মুহূর্ত আসে যখন নিজেকে একটা বিন্দুর মতো, ঘাসের ডগায় আটকে থাকা ধুলোর একটা কণার মতো মনে হয়। আমি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একটা পা এখনো পেছনের ধাপে, কানে ভেসে আসছে ঘুলঘুলি দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ, দুটি বালিকার খিলখিল, একটি শিশুর কান্না। কান্নাটা ক্রমশ তীক্ষ্ণ হয়ে আমার খুব কাছে এসে হঠাৎ থেমে গেলো। কিছু একটা আমার পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে , তার গায়ের বোঁটকা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারছে। স্বপ্নে জ্ঞান হারাবার কোনও সুযোগ নেই। কেবল মনে হল আমি যেন আমাকে ছেড়ে, আমাকে রেখে, খানিকটা সরে গিয়ে আমাকে দেখছি। মোমের নিভু নিভু আলোয় চিক চিক করছে আমার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম, বুকটা হাপরের মতো উঠছে আর নামছে, আমার মুখটা একটু খোলা, একটা চিৎকার, একটা আর্তনাদ, আমার বুক বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এসেও, থমকে গিয়েছে। একটা খস খস আওয়াজ, মোমবাতি এগিয়ে আসছে, ক্ষীণ আলোয় চোখে পড়লো একটা হাত, মোম ধরে রাখা সে হাত দারুণ প্রাচীন, ভীষণ ফ্যাকাসে। তারপর, হঠাৎ আলো। সিঁড়ির দেয়ালে ব্রোঞ্জের মোমদানিতে মোম গুলো জ্বলে উঠেছে। মোমের নরম আলোয় দেখলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক মাতামহী- দীর্ঘকায়, ক্ষীণতনু। মুখের চামড়ায় অজস্র বলিরেখা, অনন্তের সাক্ষ্য। পায়ের সাথে লেপটে থাকা বেড়াল টাকে আলতো করে কোলে তুলে আমার দিকে সুন্দর করে হাসলেন।
“ক্ষমা করবেন, আলো জালাতে একটু দেরি হয়ে গেলো। ব্রোঞ্জের মোম দানি গুলো অন্ধকারে এমন মিশে থাকে! দয়া করে আসুন আমার সাথে, খাবার টেবিলে ওরা সব অপেক্ষা করছে।”
কোন ফাঁকে যে আমি আবার আমাতে ফিরে এসেছি টের পাইনি। স্মিত হেসে বললাম,
“গুড ইভিনিং, অনুমান করছি আপনিই ইভা। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।"
আমরা খেতে বসেছি, টেবিলে সুন্দর করে সাজানো চিরায়ত জুইশ খাবার - তিল মাখানো সাবাত খাল্লাহ, শাকশুকা, আর একটি বিফ ব্রিস্কেট। সেই সাথে একবাটি হামান্তাশ্যেন। শাকশুকার নাম অনেক শুনেছি, টিভিতে একটা ডকুমেন্টরিও দেখেছিলাম, তবে খাবার সুযোগ হয়নি। রান্নাটা সহজ, কাজ বলতে কয়েকটি ডিম পোঁচ ঝাঁজালো টমেটো সসে মসলা মিশিয়ে পার্সলির ফোঁড়নে আধঘণ্টা কষানো। গোলানের আদিবাসিন্দারা এটি সকালের নাস্তায় খেলেও ইউরোপে চল রাতেই। শাকশুকা স্রেফ একটি খাবার নয়, আরও অনেক কিছু। এটি কষানো হয় ঢালাই লোহার কড়াইয়ে, যে কড়াই মাতামহী হয়ে মা, মা থেকে কন্যা, কন্যা থেকে তস্য কন্যার হাত ঘুরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান। টেবিলের কালচে ধূসর ওই কড়াইটিতে মিশে রয়েছে কোনও এক মাতামহীর স্নেহ, হাজার বছর ধরে মরু-নদি-সমুদ্র-পাহাড়ে স্বপ্ন তাড়া করে ফেরা কিছু মানুষের দীর্ঘশ্বাস। শাকশুকা একটি অভিজ্ঞতা।
সাবাত খাল্লাহ আহামরি কিছু নয়, এক ধরনের রুটি যা আজকাল দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়। হামান্তাশ্যেন বরং বেশ অভিনব, দেখতে সিঙ্গাড়ার মতো তবে পুরটা নরম জেলির। আর বিফ ব্রিস্কেট, আহা! ধিকি ধিকি আঁচে দীর্ঘ সময় ধরে ভাপিয়ে রাঁধা হাড়ে জড়ানো মাংস, গরুর সামনের পা এবং কাঁধের মাঝামাঝি জায়গা থেকে কেটে নেয়া। এমনিতে রাবারের মতো শক্ত, তবে রাঁধতে জানলে খোলা পাহাড়ে বেড়ে উঠা কচি ভেড়ার রানের মতোই তুলতুলে।
খেতে খেতেই মাথায় চিন্তাটা এলো, এতক্ষণ কেন আসেনি সেটাই বিস্ময়! এরা কারা? আর আমার বাড়িতেই বা কেন? শ্যামল মাহমুদ চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাড়িটি খালি পড়ে আছে, বাক্সপেঁটরা নিয়ে উঠে পড়লেই হবে। তবে কি ভুল বাড়িতে উঠে এলাম? ঠিকানায় তো ভুল নেই, সাতাত্তর ব্যথারস্ট, নেইমার। চাবিও কাজ করেছে ঠিক ঠিক। ব্রিস্কেট পড়ে রইলো ব্রিস্কেটের জায়গায়, আমার চোখ চামচে, সেখানে আমার প্রতিবিম্ব - আমাকে উল্টো দেখাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি উঠে এসে বসলেন আমার পাশে, আমার অস্বস্তি তাঁর দৃষ্টি এড়ায় নি।
“আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। আমারই দোষ, আসলে চিঠিটা সময় মতো পাঠাতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
কোন চিঠির কথা বলছে বুড়ো!
“হয়েছে কি, বাড়িটা বেচে দেবার পরদিনই ঈশতার এসে জানালো ভিয়েনা থেকে জাহাজটা ছেড়েছে।”
“দয়া করে ক্ষমা করবেন, জাহাজ!”
“আর বলবেন না, ষোলটি মাস অপেক্ষা করে আছি ওই জাহাজের জন্য। নাতনি দুটোকে নিয়ে আমি আর ইভা ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে আটকে গিয়েছিল আমার ছেলে এলি আর ওর বউ ইওনা। বুঝতেই পারছেন, যা দিনকাল পড়েছে তাতে ভিয়েনা থেকে বের হওয়া তো আর মুখের কথা নয়।”
ধন্ধে পড়ে গেলাম আমি। জানি পৃথিবীতে একটা বিপর্যয় ঘটে চলেছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, লেবানন, তিউনিসিয়া থেকে লাখো লাখো উদ্বাস্তু ভিড় জমিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরের আশপাশের অঞ্চলে। জনস্রোত কি তবে অস্ট্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেলো! হবে হয়তো, সেক্ষেত্রে ভিয়েনায় প্রবেশ করা কঠিন হলেও হতে পারে। কিন্তু বেরিয়ে আসা নিয়ে এতো ভাবনা কিসের?
“আপনার ছেলে কি কোনও জাহাজে চাকরি করেন?”
“জাহাজে চাকরি করার কথা আসছে কেন! এলি তো মাস্টার , পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক। ভিয়েনায় আমরা ভালোই ছিলাম, ছেলের চাকরি আর আমার পেনশনে খুব বিলাসী না হলেও মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। আর পাড়াটাও দারুণ, খ্রিস্টান,ইহুদি, থিতু হয়ে যাওয়া কয়েক ঘর জিপসি, সবমিলিয়ে পাঁচমিশালি একটা পাড়া। সময়ে সব বদলায়, কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম প্রতিবেশীদের একজন দুজন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আগে যার সাথে দেখা হলে গল্প জমে উঠত সে দেখি সম্ভাষণের জবাবে কেবল মাথা ঝুঁকিয়েই খালাস! খবরের কাগজ গুলোও কেমন কেমন যেন খবর ছাপে। এলির কি এসব নিয়ে ভাবার মতো মাথা আছে, নাকি ছিল কখনও? আমি একবার ওকে বলতেই আমাকে মুখের উপর বলে দিলো, বুড়ো মানুষের সাথে কথা বলার সময় কার আছে? আর খবরের কাগজ নাকি টিকেই থাকে আলতু ফালতু সব গপ্প ছড়িয়ে। এক রোববারের কথা, একটা চেয়ার নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে কেবল বসেছি, ইভা আর ইওনা বাগানের গাছে পানি দিচ্ছে, নাতনি দুটো ঘাসের উপর বসে কী খেলছে ওরাই জানে। হঠাৎ দেখি ফেন্সের বাইরে মুলার দাঁড়িয়ে। মুলার আমার ছেলের ছোটবেলার বন্ধু, দুটো বাড়ি পরেই ও থাকে। ওর বাবা আর আমি এক ক্লাবেই ফুটবল খেলতাম, ফুটবল মানে এখানে যেটাকে সকার বলে আরকি। নাতনি দুটো মুলারকে দেখে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো, আঙ্কল মুলার এসেছে! মুলার ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকেই জিগ্যেস করলো এলি কোথায়। বললাম এলি তো ওর ল্যাবে, আর তুমি বাইরে কেন, ভেতরে এসো। আমি চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে যেতেই দেখি মুলারের খানিকটা পিছনে দাঁড়িয়ে অল্প বয়েসি একদল ছেলে, সবার মাথা পরিষ্কার ভাবে কামানো, পরনে কালো জামা। মুলার ওর তর্জনীটা আমার দিকে একবার তুলে, একবার তুলেই চলে গেলো। চলেই গেলো হন হন করে। ছেলেগুলো ব্যাক ইয়ার্ডে ঢুকতে না ঢুকতেই আমি গুলি খাওয়া হরিণের মতো ছিটকে পড়ে গেলাম ঘাসের উপর। ওদের একজন আমাকে চড় কষিয়েছে । আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছি নাতনি দুটোকে হিড় হিড় করে কয়েকজন, অন্যেরা এগুচ্ছে ইভা আর ইওনার দিকে। একটা ট্রাকে নিয়ে তুলল আমাদের, সেখানে আরও অনেক মানুষ, আমার বন্ধু, ছেলের বন্ধু, ইভার বন্ধু, ইওনার বন্ধু, কে নেই সেখানে! সবার চোখে কেমন যেন একটা শূন্য দৃষ্টি, দারুণ অবিশ্বাস। বড়রা এক দিকে আর বাচ্চারা আরেক দিকে, গাদা গাদি করে ঠাসা ট্রাক। কতক্ষণ চলল সে ট্রাক কে জানে! সূর্য তখন ডোবে ডোবে, গিয়ে পড়লাম আরেকটা শহরে। বিশ্বাস করবেননা, মানুষ নয়, একপাল ভেড়ার মতো তাড়িয়ে নিয়ে আমাদের উঠালো একটা জিমনেশিয়ামে। কোথায় দাঁড়াবো? এক ইঞ্চি জায়গাও কি আছে সেখানে? খালি মানুষ আর মানুষ, কোনমতে ঠেলে ঠুলে একটু জায়গা করে নিয়ে দাঁড়ালাম। নাতনি দুটো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, ইভা আর ইওনা অভিব্যাক্তি হীন ।
রাতে একজন এসে নাম ডেকে ডেকে আরেকটা ঘরে নিয়ে গেলো আমাদের চারজনকে। এলিকে দেখলাম, একটা চেয়ারে বসা, ওর বাঁ চোখটা আধবোজা, ঠোঁটের কোনায় শুকিয়ে কালচে হয়ে আসা জমাট রক্ত। নাতনি দুটো ঝাঁপিয়ে পড়লো এলির কোলে, এখন আর ফুঁপিয়ে নয়, হাউমাউ করে কাঁদছে ওরা। ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালো আমার ছেলে, আমি কিছু বলার আগেই বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ইহুদি এঞ্জিনিয়ার, কেমিস্ট আর পদার্থবিদদের পরিবার সুদ্ধ ধরে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। কী একটা বোমা নাকি বানাতে হবে, এমন একটা বোমা যাতে সব কিছু জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। একটি বোমাতেই কেল্লা ফতে।”
আমি হা করে শুনছিলাম বৃদ্ধের কথা। বৃদ্ধ পানি খাওয়ার জন্য গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতেই আমি বললাম,
“সে রকম বোমার তো আজকাল অভাব নেই! এই আমেরিকার কাছেই তো রয়েছে কয়েক হাজার।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না, হাজার হাজার নয় কয়েকটি মাত্র বোমাই ওদের দরকার। একটি বোমা একটি শহর। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, মস্কো, প্রতিটি শহরের জন্য একটি করে বোমা।”
...........................................................................
আমি আবার সেই নিচতলার ঘরে, স্বপ্নের কন্টিনিউটি ভেঙ্গে গিয়ে এখন পশ্চিমের জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের পেছনের রাস্তা দেখা যায়। বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় অনেক মানুষ, সবার পরনে কালো পোশাক, খুব ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে তারা। ভিড়ের মাঝখানটায় একটু ফাঁকা মতো জায়গা, একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি, গাড়ির উপর চারটি কফিন, দুটো ছোটো। কফিন দুটোর মাঝখানে বসে আপাদ মস্তক কালো পোশাকে আবৃত একজন তরুণী, কেবল মুখ দেখা যায় -অপূর্ব রূপবতী। দুটো হাত দুই কফিনের উপর রেখে নিঃশব্দে কাঁদছে সে। খুব চেনা লাগছে মুখটা, কোথায় যেন দেখেছি।
...................................................................
অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে।
(মোখলেস হোসেন)
মন্তব্য
ধুর, পোস্ট করার সময়, কি তে চাপ লেগে শেষ বাক্যটির কিছু অংশ মুছে গিয়েছে। অতিথি লেখকদের সম্পাদনার সুযোগ নেই। তাই এখানেই তুলে দিলাম।
..........................................
আমি মোখলেস হোসেন। মাঝবয়সী, সপ্নহীন অনুলেখ্য একজন মানুষ, কিন্তু কেমন করে যেন, অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখে ফেলেছি কাল রাতে।
-মোখলেস হোসেন।
আপনার কাল রাতের অদ্ভুত স্বপ্ন নিয়ে আমিও কিছুটা চিন্তিত বিশেষ করে শ্বেত পাথরের পরী মূর্তির লক্ষ্মীট্যারা চোখ দেখাটা আসলেই অদ্ভুত
ফাহিমা দিলশাদ
স্বপ্ন বলে কথা ভাই! একবার ভাবুন তো, যদি দেখতাম চোখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে!
-মোখলেস হোসেন
ভালো লাগছে গল্পটা। গল্পের সময়কালটা ধরতে পারছি না বোধ হয় ঠিকমতো। কোথায় কোথায় জানি কিছু প্রশ্ন ঘুরতেছে। পরে কখনো সময় করে বলবো নিশ্চয়।
স্বয়ম
গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ স্বয়ম। আমারি দোষ, খুব তাড়াহুড়া করে লিখেছি। আসলে লেখার জন্য যে সময় দেওয়া উচিৎ সেটা না দেওয়াটা এক ধরনের অসততা। এই গল্পে, আমি বর্তমানের মানুষটা আমার স্বপ্নে গিয়ে পড়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কিছু মানুষের মাঝে। ইচ্ছে ছিল উপন্যাসের দিকে এগুনোর, পারিনি এটা আমার ব্যর্থতা। লেখাটিকে ওয়ার্কিং পেপার হিসেবে ধরে নিন।
মোখলেস হোসেন।
না না, সেক্ষেত্রে আমিতো ঠিকই ধরেছি। কিন্তু ওই ইউরোপমুখী অভিবাসনপ্রার্থীর বর্তমান স্রোত কিছুটা বিভ্রান্ত করেছে। বিশেষত এই লাইনটার কারণে-
লেখার আর কিছু নিয়েই কোনো ধন্দ নেই। শুভেচ্ছা জানবেন।
স্বয়ম
আমার সময়ে এই তো ঘটে চলেছে। নয় কি? তবে তিউনিসিয়া না লিখে ইয়েমেন লিখলেই ভালো হতো।
মোখলেস হোসেন।
আপনি পারেনও বাবা! আমি এত জটিল আর ভালো মানের গল্প লিখতে পারি না। ভালো হয়েছে লেখাটা। শুভেচ্ছা জানবেন।
দেবদ্যুতি
অনেক ধন্যবাদ দেবদ্যুতি। আপনার লেখাগুলো এখনও পড়ে উঠতে পারিনি বলে ক্ষমা চাইছি। সেমেস্টারের মাঝামাঝি, দম ফেলতে পারছিনা।
মোখলেস হোসেন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দিলাম শাখশুখা আর বিফ ব্রিস্কেট, আপনি কিনা খাচ্ছেন পপকর্ণ!
মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন