যারা বলছে বিভেদ তৈরির দায়ভার প্রগতিশীলদের উপরে তারা মূলত বামাতী। এই বামাতীরা প্রতিটা হত্যাকাণ্ডের পরে প্রথম যে প্রশ্নটি প্রচার করে "মুসলিম জঙ্গিরা যে খুন করেছে তা আপনি কিভাবে বুঝলেন? আগে ধরা পড়ুক, বিচার হোক তারপর না হয় সিদ্ধান্তে আসা যাবে..." এই কথাটা সুমধুর মনে হলেও পুরোপুরি মিথ্যা কারণ প্রতিবার জঙ্গিরা খুনের দায়ভার স্বীকার করে ফেলে তখন এরা নিজেদের কথা ফিরিয়ে নেয়না, ভুল কথার বলার জন্য ক্ষমা চায় না। কিভাবে ফিরিয়ে নিবে বলেন, নিজের উগড়ানো বমি কি আবার গিলে ফেলা যায়?
হাল আমলে তারা এই প্রচারণায় তেমন সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ বারবার জঙ্গিরা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে যাচ্ছে, খুনগুলো তারা করছে। তাই বামাতীরা এবার নতুন প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে, 'বাংলায় হিন্দু-মুসলিমরা আসলে মিলে-মিশেই ছিল। সমস্যা বাধিয়েছে নিধার্মিকেরা। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিকে জাগিয়ে তুলেছে নিধার্মিকেরা, উগ্র কথাবার্তা বলে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে মুক্তমনারা...' এগুলো স্রেফ মিথ্যাচার। কেনও এই কথাগুলো মিথ্যাচার তার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে বাংলা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার কাদের হাত ধরে হয়েছিল সেটা খেয়াল করতে হবে। এবং উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব বিশ্লেষণ করতে হবে।
ইসলাম আরব-ইউরোপের যেসব অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছিল সেগুলো বেশিরভাগই তলোয়ারের উপরেই হয়েছিল। এতে দোষের কিছু নেই, সে আমলে সব ধর্মই এভাবে প্রসারিত হত। খ্রিস্টানদের রক্তাক্ত ইতিহাসও আমরা জানি। রাজার ধর্মই তখন প্রজার ধর্ম হত। কিন্তু বাংলায় ইসলাম প্রচার হয়েছিল সুফিদের হাত ধরে, পীর-দরবেশদের হাত ধরে। নাদির শাহ-ইখতিয়ার খিলজী-বাবর প্রমুখের রক্তাক্ত যুদ্ধে এখানে ইসলাম ক্ষমতাশালী হয়েছে ঠিকই কিন্তু মূল কৃতিত্ব শান্তিপ্রিয় সুফি-দরবেশদের। এবং এই কারণেই শুরুর দিকে ইসলামের শান্তিপ্রিয় চেহারাটাই আমরা দেখতে পাই। দলে দলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তখন ইসলাম গ্রহণ করেছিল সে কারণেই। কিন্তু তখনকার মুসলিমরা যে ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মীয় আচার ইত্যাদি পুরোপুরি মানত তা কিন্তু না। পীর-দরবেশদের মাজারে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের কথা আমরা সবাই জানি। বর্তমানে বায়োজিদ বোস্তামী কিংবা শাহজালালের মাজারে অনেক হিন্দুকে যেতে দেখি আমরা। এমন কাজ তখন মধ্যযুগের মুসলিমরাও করত। মুসলমান হবার পরেও কালীর উপাসনা করার নজির কিন্তু আছে! ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগে না? যতীন সরকার ব্যাপারটাকে চিহ্নিত করেছেন নিম্নবৃত্তের সেকুলারজিম হিসেবে। যাই হোক, সবাই তো আর উপাসনা করত না, কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতির ভালো অনেক কিছুই তারা তখন পালন করতেন। সব ধর্মকে মেলাতে সম্রাট আকবরের প্রচেষ্টা এরই প্রমাণ।
কিন্তু দিনে দিনে বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরা যত 'টেক্সট' নির্ভর হয়ে উঠতে লাগলেন, আরবদের স্টাইলে ইসলাম পালনের চেষ্টা করতে লাগলেন সংঘর্ষ তত বাড়তে লাগল। কট্টরতার উৎপত্তি হয় তখনই যখন ধর্মগন্থ অক্ষরে অক্ষরে মানার চেষ্টা করবেন আপনি। হিন্দুয়ানী উপাদান ঝেড়ে ফেলে আরব হতে হবে, 'ধন্যবাদ' না বলে বলতে হবে 'জাজাকাল্লা'। ধর্মগ্রন্থে যা বলা আছে তার সব অক্ষরে-অক্ষরে ঠিক, বিজ্ঞান আর যুক্তি কি বলল না বলল তাতে কিছু যায় আসে না, এই চিন্তাই মৌলবাদী চিন্তা। এই চিন্তা যখনই আপনার মধ্যে গেড়ে বসবে তখনই আপনি মৌলবাদী, হয়ত আপনি অনেক ভালো লোক তবুও আপনি মৌলবাদী। এর প্রমাণ আমরা দেখি, গোঁড়া মোল্লাদের পরামর্শে আকবরের নাতির ঘরের ছেলে আউরংগজেবের হাত ধরে সারমাদ কাশানি সহ অনেক সুফি-দরবেশকে হত্যার মধ্য দিয়ে। আকবার থেকে আউরংগজেব এই একশত বছর সময়কালেই দেখুন কি নিদারুণ পরিবর্তন।
এরপর মুসলিম জাতীয়তাবাদী চিন্তার শুরু সেই খেলাফত আন্দোলনের সময়কাল থেকে, তার আগে বাংলায় হিন্দু-মুসলিমরা আনন্দেই ছিল মূলত। খিলাফত আন্দোলন ভেস্তে যাবার পর গ্রামে গ্রামে ধর্ম সঠিকভাবে মানার যে প্রচারণা শুরু হয় তা থেকে সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি। এই থেকে হল হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, এরপর শুরু হল দাঙ্গা, দেশভাগ পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক সাম্প্রায়িক রাষ্ট্রের জন্ম, এগুলো আমার কথা না, ইতিহাসবিদদেরই কথা। এই বিভাজনে হিন্দু মৌলবাদীদেরও দায়ভার কম না।
সুফি-দরবেশ প্রথা আজ বিলুপ্তির পথে, দিনে দিনে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আজ এই অঞ্চলকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে মৌলবাদীরা কিভাবে প্রতিটা সরকারের সময়ই ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়িয়েছে সে ইতিহাস সবারই জানা। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিব, সংবিধানে লিখে দিয়েছিলেন উদারনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু তাকেও মেরে ফেলা হল। এই অঞ্চলে ভালোরা মরে যায়, বেঁচে থাকারা পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছুটায়, বিষবাষ্প ছড়ায়। এরপর জিয়া গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনলেন, রাজাকারকে প্রধাননমন্ত্রী করলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ছুড়ে ফেলে খৎনা করে মুসলমান বানালেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। এরশাদ এসে সাম্প্রদায়িকতার চারা গাছে পানি ঢাললেন, খালেদা জিয়া এসে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব উপহার দিলেন,রাজাকারদের মন্ত্রী বানালেন। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে, আজকের হত্যা মৌলবাদীদের গত ৪০ বছরের শক্তি সঞ্চয়ের ফলাফল। তাই আজকের বাংলাদেশে নিধার্মিক-বিধার্মিক-ভিন্নমনা মুসলিম কেউই নিরাপদ না আর।
মোট কথা, মৌলবাদীদের উত্থান, শক্তি সঞ্চয়ের ইতিহাস, সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ইতিহাস প্রায় কয়েকশ বছরের ইতিহাস। বামাতীরা এসব ইতিহাস জানার কথা, কিন্তু তারা না জেনেও এই ইতিহাস লুকানোর চেষ্টা করেন। বামাতীরা প্রতিটা ঘটনায় দোষ দেখে প্রগতিশীলদের এবং সরকারের কিন্তু তাদের মতে জঙ্গিদের কোনও দোষ নেই। তাদের মতে জঙ্গিরা নান্না-বাচ্চা-দুধের শিশু। আমার অনেক দিনের দাবী, বামাতীদের একাউন্ট-ব্যাংক ব্যালেন্স চেক করা হোক। ফরহাদ মাজহার, পিনাকী ভট্টাচার্যরা ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা খাবার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
আমার মতে, বামাতীরা জামাতীদের চাইতেও খারাপ। জামাতের তো তাও একটা আদর্শ আছে। হয়ত আমাদের সাথে মেলে না, তাই এত সংঘর্ষ। কিন্তু বামাতীরা হচ্ছে স্রেফ ভন্ড, এদের কোনও আদর্শ নেই। বাম সেজে, প্রগতিশীল সেজে এরা জঙ্গিদের পক্ষে সাফাই গায়। মুনাফেক শব্দের ধ্রুপদী উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে বামাতীদেরকেই।
বিনীত - আহমদ রনি
মন্তব্য
কদিন পর জানা যাবে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গেছিল নিধার্মিকের চিন্তায়, রামুতে বুদ্ধমূর্তি পুড়ে গেছিল নিধার্মিকের ইচ্ছায়, এবার বিভিন্ন জেলায় দূর্গামন্ডপও ভেঙ্গেছে নিধার্মিকের লেখালেখিতে।
উজানের পানি ঘোলা করতে, কেবল ইচ্ছাই যথেষ্ট।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সাম্প্রদায়িকতার শুরু আরও আগে- তিতুমীর এবং হাজী শরিয়তুল্লাহ ও তার ছেলে পীর মহসিন উদ্দিনের ওহাবী পন্থী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। তার সাথে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভি পরিচালিত ইসলামী ভারত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলা থেকে মুজাহিদ রিক্রুটমেন্ট, এ সবই মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বীজ বপন করে তা চারাগাছে পরিণত করে। পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তা মহীরুহে পরিণত হয়।
নতুন মন্তব্য করুন