আমাদের জানামতে, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। অন্তত মানুষ তাই ভাবে। অন্যকোনো প্রানীর মধ্যে এ ভাবনা আছে কিনা তা জানা নেই, আর থাকলেও তার সাথে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া হয়ত এখনও সম্ভব হয় নাই। মানুষ অবশ্যই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার তার চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা এবং তা বাস্তবে রূপান্তরের সামর্থ্যের কারনে। অন্ততঃ পৃথিবী নামক এই ক্ষুদ্র গন্ডীর মধ্যে সমগ্র জীবের উপর সে তার আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছে। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে চায় তার আপন স্বার্থের কারনে, যদিও মহাজগতের কাছে তা মূল্যহীন। তার কাছে মানুষ শ্রেষ্ঠ হল না গরু শ্রেষ্ঠ হল, তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা। কে এলো আর কে গেলো তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, সে তার আপন নিয়মে চলে- সৃষ্টির পর ধ্বংশ, অতঃপর আবার সৃষ্টি। কিন্তু কে শ্রেষ্ঠ হল তাতে আমাদের অর্থাৎ এই মানুষের আসে যায়। মহাকালের যে বিলিওন বছর বয়স বা মহাজগতের যে আলোকবর্ষ দুরত্ব তার কাছে আমাদের এই মানবকুলের জীবনকাল নস্যি মাত্র । তাইতো আমাদের এত ব্যস্ততা, এত ত্রস্ততা। যদি বলেন কি লাভ এত দৌড়িয়ে? হয়ত কোন লাভ নেই, আবার আছেও। ঐ যে আমরা মানুষ, যারা কিনা শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার; সেই দাবীটা টিকিয়ে রাখায় আমাদের স্বার্থ বা লাভ। যদিও তাতে মহাকালের কিচ্ছু যায় আসেনা!
জাগতিকভাবেই মানুষ স্বার্থপর তার নিজের স্বার্থে, বেঁচে থাকার স্বার্থে, ভোগের স্বার্থে এবং নিজের নামটা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। সেই স্বার্থের পরিধিটা বিভিন্ন মাত্রিক। কখনোবা শুধুই নিজের জন্যে, কখনো পরিবারের জন্যে, কখনো ধর্মের জন্যে, কখনো দেশের জন্যে। আবার কখনো সমগ্র মানবকুলের জন্যে বা এই সমগ্র মহাজগতের জন্যে। এই পরিধিটা যত বেশী ব্যপৃত, সেটা ততোধিক মহত্ত্বের পরিচায়ক। তাইতো আমরা ক্ষুদ্র গন্ডীকে স্বার্থপর বলি, আর বৃহত্তর গন্ডীকে মহৎ বলে থাকি। পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই এই ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতে আবদ্ধ। যুগে যুগে মাত্র গুটিকয় মানুষ বৃহত্তর গন্ডীর পরিধিতে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের জন্যেই আমাদের এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিটা অক্ষুন্ন থাকে এবং শ্রেষ্ঠতর হয়। তাদেরকে আমরা কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার বা যুদ্ধক্ষেত্রের কমান্ডার এর সাথে তুলনা করতে পারি। আমরা বাকী সবাই (৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯.......%) আজ্ঞাবহ বা সিপাহী শ্রেণীর। এদের নিজস্ব কোন চিন্তা নেই, চিন্তা করার সময় নেই বা গন্ডীর বাইরে বেরোবার কোন সামর্থ্য নেই। এরা মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের উপাধিটির ধারক বা বাহক, আবিস্কারক নয়। এরা অনুগত বা আজ্ঞাবহ খেঁটে খাওয়া মানুষ- যারা খুবই ক্ষুদ্রগন্ডীর মধ্যে নিজের স্বার্থটুকু অটুট রাখতে ব্যস্ত। তার গন্ডীর বাইরের কেউ সেটাকে কেমন করে দেখছে, সে চিন্তার অবসরটুকুও তার নেই। ক্ষুদ্র অর্থে এদেরকেই আমরা স্বার্থপর বলে থাকি। নিজের নাম টিকিয়ে রাখার সবচাইতে যে সহজ উপায় অর্থাৎ বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে এরা তা করতে প্রানপণ চেষ্টা করে, যা কিনা মাত্র কয়েক জেনারেশন স্থায়ী হয়। পেশাগতভাবে এরা দক্ষ হওয়ায় তাদের স্বার্থপরতার বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে জাগতিক উন্নয়নে এদের অবদান অনস্বীকার্য।
সময়ের সাথে সাথে মানব জাতির তথা তাদের কর্মস্থল এই পৃথিবীর যে অগ্রগতি হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে কতিপয় আপাতঃদৃষ্টিতে দেখা পাগল বা গোয়ার প্রকৃতির মানুষের জন্যেই। তাদেরকে আমরা অবিশ্বাসীও বলতে পারি, কারন তারা সমসাময়িক নিয়মনীতি বা বিশ্বাসে বিশ্বাসী নয়। এরা বৃহত্তর স্বার্থে গন্ডির বাইরের নিজস্ব চিন্তার উদ্ভাবন এবং প্রমানে পারদর্শী। এরা কখনও ধর্মীয় পথ প্রদর্শক, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারক, রাজনীতিবিদ, কবি সাহিত্যিক, শিল্পী ইত্যাদি। আমরা তাদের অনুসারী বা আজ্ঞাবাহী। মহাপুরুষেরাও আবার নিজস্ব বৃহৎ স্বার্থের গন্ডিতে আবদ্ব। সেটাওতো ঐ শ্রেষ্ঠত্বের দাবীর বৃহৎ স্বার্থ। তাইতো আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন মতপার্থক্যের বৃহত্তর পরিধির বলয়সমুহ।
মহাকালের কাছে সব সৃষ্টিই সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ। সব সৃষ্টিতেই সময়ের বা কালের চিহ্নযুক্ত একটি বারকোড থাকে, যা সেই সময় বা কালের জন্যে প্রযোজ্য। শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে শিল্পীর বা স্রষ্ঠার কাজের নিপুনতায়। তাইতো কিছু কিছু মতবাদ বা শিল্প হয় কালজয়ী। কালজয়ী শিল্প বা মতবাদের বৈশিষ্ঠ্য হল, তা হতে হবে সরল এবং দুর্বোধ্য। অনেকটা গ্রাম্য প্রবাদ “ঢোলের মধ্যে বাজে, যে যা বোঝে” প্রকৃতির। স্থান কাল পাত্র ভেদে এর ব্যখ্যা হবে মানানসই এবং ভাবসম্প্রসারণযোগ্য। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব গন্ডির মধ্যে সেটার অর্থ আবিষ্কারের চেষ্টা করবে এবং তার চিন্তার সাথে মিল পেয়ে আত্মতুষ্টি অনুভব করবে। তবে বেশীরভাগ সৃষ্টি বা মতবাদ এর খ্যতি বা ব্যপ্তির জন্যে মূল আবিস্কারক বা স্রষ্ঠার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র গন্ডির সমচিন্তার কিছু মানুষের অবদান অতুলনীয়। যুগে যুগে এরাই কোন সৃষ্টি বা মতবাদকে বহন এবং ব্যাখ্যা করে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। এরা হল- বিভিন্ন জগৎবিখ্যাত শিল্প, ধর্মীয় মতবাদ বা বৈজ্ঞানিক মতবাদের ব্যাখ্যাকারী বোদ্ধা ব্যক্তিগন। এদের কারনেই সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের মূল এবং তুচ্ছ সব সৃষ্টিই খ্যতির শীর্ষে পৌঁছে যায়। কিন্তু যে সব মতবাদ বা শিল্প সময়ের পরিক্রুমায় জাগতিক নিয়মের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে সেটা টিকে থাকে, আর বাকীগুলো কালের গহবরে বিলীন হয়ে যায়।
বৈজ্ঞানিক মতবাদ বা সূত্রগুলো আসলে মহাজাগতিক নিয়মগুলোকেই বিভিন্ন গন্ডীতে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষনের চেষ্টা করে। একটি নির্দ্দিষ্ট গন্ডীতে বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো দারুন কাজ করে, কিন্তু তার বাইরে যেখানে সেগুলো কাজ করেনা সেটার জন্যে বৈজ্ঞানিকেরা উত্তরোত্তর চেষ্টা চালিয়ে যায়। যেমন অতি বৃহৎ (মহাবিশ্ব)এবং অতি ক্ষুদ্র (যেমন পরমাণুর ভিতরের কোয়ার্ক জাতীয় কণা) বিষয়গুলোতে এখনও অনেক সূত্র ঠিকমত কাজ করেনা। বৈজ্ঞানিক মতবাদগুলো অনেকটা ডকুমেন্টারি ফিল্মের মত, যেখানে রূড় বাস্তবতা ছাড়া আবেগের কোনো স্থান নেই। সবকিছুর ব্যাখ্যাই কাঠখোট্টা সত্যি দিয়ে, যাতে নেই কোনো আবেগ আপ্লুত মনগড়া পরিসমাপ্তি। কিন্তু ধর্মীয় মতবাদগুলোতে শুরু বা সমাপ্তির একটি সুস্পষ্ঠ বক্তব্য থাকে এবং সেগুলোকে জাগতিক নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন বলে ধরে নেয়া হয়। ধর্মীয় মতবাদগুলো পুরোটাই হাইপোথিটিক্যাল এবং বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর সুত্রগুলো প্রমানযোগ্য নয়, এমনকি বস্তুগত স্কেলে পরিমাপযোগ্যও নয়। যদিও পরিমাপের জন্য বস্তুগত উপমা ব্যবহার করা হয়।
বৃহৎ অর্থে মানসিক বা বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়গুলোর উৎপত্তি বস্তুগত বাস্তবতার মধ্যেই। বাস্তবে যা নেই, কল্পনায় তা থাকতে পারেনা। বস্তুগত জগতে যা নেই, সেটা কল্পনা করাও অসম্ভব। বাস্তবকে নানা রূপে রঙে কল্পনা করা যায়, কিন্তু অবাস্তবকে নয়। বছর পঞ্চাশেক পিছে ফিরে তাকান, তখনও কিন্তু হার্ডওয়্যার ছিল, কিন্তু সফটওয়্যার ছিলনা। তেমনি কয়েক মিলিয়ন বছর পিছে তাকালে দেখা যাবে এই ধরাধামে মানুষ ছিল, কিন্তু কল্পনা করার মত মন হয়ত তাদের ছিলনা। জাগতিক কাঠখোট্টা জিনিসের (হার্ডওয়্যার) উন্নত গুনাবলী আবিস্কার করে ঐসব অবিশ্বাসী পাগলগুলো, তখন অবধারিত হয়ে পড়ে মানানসই সফটওয়্যার এর বা নতুন নিয়ম বা মতবাদের। ঠিক তখনি আবার আরেক দল পাগল ঝাপিয়ে পড়ে নতুন সফটওয়্যার বা চিন্তা বা মতবাদ তৈরীতে। এভাবেই চলতে থাকে হার্ডওয়্যারের নতুন গুনাগুন আবিস্কার এবং তার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে নতুন নতুন সফটওয়্যার আবিস্কার। হার্ডওয়্যারের এই নতুন গুনাগুন আবিস্কারের কৃতিত্ব কিন্তু এককভাবে বৈজ্ঞানিক নামক পাগলগুলোর। তাদের স্বার্থ বা জাগতিক লাভ এটুকুই যে তাদের অজান্তে ঐ পাগলামি বা আবিস্কারের সাথে তাদের নামটা খোদাই হয়ে যাওয়া। কিন্তু স্বার্থের ভিত্তিতে সফটওয়্যার বা নতুন নিয়ম বা মতবাদের আবিস্কারক পাগলগুলো দুধরনের, একদল সত্যিকারের বৃহৎ স্বার্থবাদী বা নিঃস্বার্থ (নিজের নামটি নিজেরা খোদাই করেনা, পরবর্তীতে অন্যেরা খোদাই করে) আর অন্যদল বৃহৎ স্বার্থের মোড়কে ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী (অনেকটা জাতে মাতাল, তালে ঠিক প্রকৃতির; তবে এরাও ট্যালেন্ট)।
এই মহাজগতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল, কোনকিছুই স্থির নয়। তাই ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই। আমরা যা কিছু সত্য মিথ্যা বা ঠিক বেঠিক বলে জানি তা শুধু একটি নির্দ্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই গন্ডীর বাইরে আর সেগুলো প্রযোজ্য নয়। গন্ডীটা হতে পারে স্থান, কাল বা পাত্রের। আপাতঃদৃষ্টিতে আমরা বিদ্যুৎবাহী তারকে স্থির দেখি, কিন্তু তার মধ্যে পারমানবিকস্তরে অস্থির ভাঙাগড়া চলে, ইলেক্ট্রনগুলোর ছোটাছুটির আবহ আলোর গতিতে একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে চলে যায়। এইযে সত্য মিথ্যা বা ঠিক বেঠিক বিচারের যে মাপকাঠি, সেটি হল জ্ঞান। আর সেই জ্ঞানইতো প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। উন্নত থেকে উন্নততর স্থরে প্রবহমান। তাইতো সেই জ্ঞানের আধুনিকীকরনের সামর্থের উপরই নির্ভর করে একজন মানুষের সত্য মিথ্যা বা ঠিক বেঠিক বিচারের ক্ষমতা। এটাকে আমরা বর্তমান জগতের কম্পিউটারের সাথে তুলনা করতে পারি। যেমন নব্বই দশকের একটি কম্পিউটারের যে হার্ডওয়্যার ছিল, সেটাকে তো এখন উইন্ডোজ-৭ সফটওয়্যার দিয়ে চালানো যাবেনা। আবার ২০১০ সালের হার্ডওয়্যারের একটি কম্পুটারে যদি নব্বইয়ের দশকের সেই ৩৮৬ বা ৪৮৬ সফটওয়্যার লোড করা হয়, তবে সেটাও চলবেনা। এটাই বাস্তব বা যুক্তির কথা। এই বাস্তব বা physical world এ আমরা এটাই করি বা করতে বাধ্য হই। অর্থাৎ বাস্তব জগতে বাস করতে হলে আমাদের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার বা জ্ঞানের আধুনিকীকরনও একটি বাস্তব সত্য। আমরা সব ক্ষেত্রেই সেটা মানি বা করি, কিন্তু একটি ক্ষেত্রে মানিনা। সেটা হল, আমাদের ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্মীয় নিয়ম কানুনের আধুনিকীকরন। আধুনিকীকরন মানেই কিছু বাদ দেওয়া এবং কিছু নতুন সংযোজন বা বেশী পুরোনো হলে সবকিছু বাদ দিয়ে একেবারেই নতুন সংযোজন। আধুনিকীকরন একটি চলমান প্রক্রিয়া সুতরাং যে জিনিসটাকে আধুনিকায়ন করা হবে তাতে সেই flexibility থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া যে কোন মতবাদ বা সফটওয়্যার স্থান, কাল বা পাত্রের গন্ডীতে সীমাবদ্ধ। আবার তাকে ধারন করার যে হার্ডওয়্যার বা physical entity সেটাও হতে হবে যুগোপযোগী। ধর্মীয় মতবাদ বা সফটওয়্যার এ আধুনিকায়নের সেই flexibility নেই এবং বর্তমান স্থান, কাল বা পাত্রের গন্ডীতে তার উপযোগীতাও প্রায় শুন্যের কোঠায়। তাছাড়া সেটা ধারন করার যে হার্ডওয়্যার সেই প্রাচীনকালের মানুষ আর বর্তমানের মানুষও এক নয়। সুতরাং বর্তমানের এই হার্ডওয়্যারে সেই প্রাচীনকালের সফটওয়্যার লোড করলে সংঘাত (conflict) অবশ্যম্ভাবী। তাইতো বর্তমানের ধর্মভীরু বা ধর্মপ্রেমী মানুষের মাঝে দ্বৈতসত্বা প্রকট।
সময়ের পরিক্রমায় নানান ঘাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক আবিস্কার বা তত্ত্বগুলো আজ এমন স্তরে পৌছেছে যে তাকে আজ পরিহার করা একেবারেই অসম্ভব। তাদের ব্যবহার ছাড়া বর্তমান মানবসভ্যতা অচল। তার মানে ব্যবহারিক জীবনে বিজ্ঞান তার স্বমহিমায় ভাস্বর। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের কারনে মানুষের মনোজগতে বিজ্ঞানের কৃতিত্ত্ব ছিনিয়ে বসে আছে এক অদৃশ্য শক্তি, যা তার জীনএ বাহিত হয়ে এসেছে হাজার বছর ধরে এবং একটু একটু করে প্রোথিত হয়েছে শৈশবকাল থেকেই। যার ফলে যুগের পরিক্রুমায় আস্তে আস্তে একটি অকৃতজ্ঞ মানবগোষ্ঠীতে পরিনত হয়েছি আমরা। আমরা যার উপকার নিয়ে চলি তার সাথে ঝগড়া করি, আর অন্যকে তার কৃতিত্ত্ব দিই বা গুনগান করি। কী সীমাহীন দ্বন্দাত্বক আমাদের অস্তিত্ব!
বাস্তবে যাপিত জীবনই আসল জীবন, কল্পিত জীবন-জীবন নয়। অর্থাৎ বাস্তবে (physical world) একজন মানুষ ২৪ ঘন্টায় যে ক্রিয়া কর্ম করে সেটাই তার জীবনের একটা দিন এবং এই পুঞ্জীভুত দিনের সমষ্টিই তার সারাজীবন। ধরুন, একজন লোক মনে প্রাণে বাঙালী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী, কিন্তু সে বাস করে আমেরিকায় এবং প্রতিদিনের প্রতিটা কাজ করে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, তাহলে তাকে কি আমরা বাঙালী সংস্কৃতির ধারক বলে মেনে নেবো? আবার ধরুন, মনে প্রানে ধর্মবিশ্বাসী কোনো ব্যক্তির ২৪ ঘন্টার কাজে কর্মে যদি তার ধর্মবিশ্বাসের প্রতিফলন না ঘটে বা বাস্তবতার কারনে তার পক্ষে তা করা সম্ভব না হয়, তবে তার জীবনকে কি আমরা ধার্মিকের জীবন বলবো? বাস্তব জীবনে সব মানুষই বিজ্ঞানের পথে চলে, তার কল্পিত বিশ্বাসের পথে নয়। স্বার্থপরতার কারনেই সে শুধু তার মধ্যে এই দ্বৈতসত্ত্বা বয়ে নিয়ে বেড়ায় যুগে যুগে অনন্তকাল বেঁচে থাকার প্রত্যাশায়। আজীবন (জন্ম ও মৃত্যুর পর) বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে সে মনের মাধুরী দিয়ে কল্পনার রাজ্য বানায়, গল্প বাধে আর নিজের মধ্যে একটি বিশ্বাস গড়ে তোলে এবং তা বংশ পরস্পরায় বয়ে নিয়ে যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মহাজাগতিক বাস্তবতার সাথে তার মিল থাকেনা অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার বিচার করা যায় না। কল্পনার জিনিসের মধ্যে নীরস কাঠখোট্টা জাগতিক বাস্তবতা থাকলে তাতে তো কোন জোস্ থাকেনা। আর সেই কল্পনার গল্প, মতবাদ বা বিশ্বাস তো এই জ্ঞানবিমুখ ৯৯.৯৯৯৯৯…….% সিপাহী বা শ্রমিক শ্রেণীর মানসিকতার মানুষের জন্যই সৃষ্টি, যারা সংসারের ঘুর্নাবর্তে প্রতিনিয়ত বাস্তবতার রূঢ়পথে ক্লান্তিহীন ছুটে চলেছে। তাদের দরকার কল্পনার জগতের একদন্ড শান্তি বা শান্তির আশা। বিজ্ঞানের পথে চলা এই দৈনন্দিন বাস্তবভিত্তিক জীবনকে জীবনধর্মী প্রামান্য চলচিত্রের সাথে এবং ধর্মীয় মতবাদের জীবনকে ক্লাইমেক্স ভরা চলচিত্রের সাথে তুলনা করতে পারেন। কে পয়সা দিয়ে জীবনধর্মী রূঢ় সিনেমা দেখতে চায়, কল্পনার রং দিয়ে তৈরী ক্লাইমেক্স-এ ভরা চলচিত্র চিরদিনই হিট্ হয়। আমরা সেটাকে উপভোগ করি, চেতনে না হলেও অবচেতন মনে তা বিশ্বাস করি এবং যুগে যুগে তা বয়ে নিয়ে যায়। গোষ্ঠীস্বার্থের কারনে গল্পগুলো আবার নানানভাবে পরিবর্তিত হয়। পরিবার বা গোষ্ঠীর সুনামের কথা ভেবে আমরা যেমন আমাদের পিতামাতা বা আত্মীয়দের দোষগুলোকে ঢেকে গুনগুলোকে হাইলাইট করি বা বাড়িয়ে বলি এবং আমাদের সন্তানের কাছে আমাদের পিতামাতা মহৎ থেকে মহত্তর হয়। এমনকি বাস্তবে বা মূল গল্পে যে জিনিসটা ছিলোনা, কয়েক জেনারেশন পরে হয়ত সেটাও মূল গল্পের অবিচ্ছেদ্দ অংশ হয়ে যায়। আবার অপরদিকে আমার বাবার শত্রুদের পরিবারে গল্পটা উল্টে যায় এবং কয়েক জেনারেশন পরে তাদের কাছে আমার পিতা পুরো ভিলেন বনে যায়। মহাজগতের কাছে যে কোন ঘটনার ভার্ষন মাত্র একটিই, কিন্তু মানুষের গোষ্ঠীস্বার্থের কারনে তা নানান ভার্ষনে পরিনত হয়। বাস্তবধর্মী জাগতিক নিয়মে কোন ঘটনার ব্যখ্যা বেশীরভাগ মানুষেরই পছন্দ নয় বা তেমন ব্যখ্যায় বিশ্বাসী নয়। তাইতো আমরা কোন ঘটনাকে জ্ঞানের আলোকে না দেখে অন্ধভাবে দেখি বা দেখতে চাই। যার ফলে আমার নিজেকে আমি যেভাবে দেখি, অন্যকে সেভাবে দেখিনা। আমার পরিবার, গোষ্ঠী বা ধর্মের লোককে যেভাবে দেখি, অন্যদেরকে সেভাবে দেখিনা। তাইতো সময়ের সাথে সাথে জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম ও সীমানার বলয়গুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। আপাতঃদৃষ্টিতে আমরা উল্লসিত হই আমাদের বলয়ের উন্নতি দেখে। আমরা ভুলে যাই জাগতিক নিয়মের কথা, তুচ্ছ করি পাথরের গায়ে এঁকে থাকা মহাজাগতিক সময়ের স্তরচিহ্নগুলো। মানবজীবনকাল কতই না তুচ্ছ ঐ পাথরে আঁকা রেখাগুলোর বয়সকালের চেয়ে!
লেখকঃ নীল আকাশ
মন্তব্য
যদিও লেখাটা পড়তে বেশ জটিল লাগলো, তবু একটা নতুন ধারণা দিয়েছে। ধর্মের সাথে সফটওয়ারের তুলনাটা ইন্টারেস্টিং। পৃথিবীতে বিদ্যমান ধর্মগুলোকে যদি সফটওয়ারের সাথে তুলনা করি, বেশ মজার একটা চিত্র পাই। সফটওয়ার ঠিক না, অপারেটিং সিস্টেম বলাই ভালো। উইণ্ডোজ, ম্যাক, অ্যাণ্ডরয়েড এরকম নানান প্ল্যাটফর্মে সারা দুনিয়ার মানুষ কাজ করে। এখানে যে যেই সিস্টেমে অভ্যস্ত, তাকেই শ্রেষ্ঠ বলে। যদিও সবগুলো সিস্টেম দিয়েই কাজ চলে, তবু ভিন্ন ভিন্ন সিস্টেমের ব্যবহারকারী নিজের সিস্টেমের প্রতি বিশ্বাসী। যদি এই বিশ্বাস অন্য সিস্টেম ব্যবহারকারীদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তখন ধর্মযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। অতীত পৃথিবীতে যতগুলো ধর্মযুদ্ধ হয়েছে সবগুলো এই সিস্টেমের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণেই। বর্তমান পৃথিবীতেও তার জের চলছে। সিস্টেমের সমালোচনা করলে বোমা খাও, গুলি খাও, কোপ খাও।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এই দাবিটা মানুষই করে খালি। আমার জানামতে অন্য কোন প্রাণী এখনো এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নাই। ঠিক একইভাবে প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসী দাবি করে তার ধর্মই সেরা ধর্ম।
এখানেও কি গণতন্ত্রটা সবার আগে ঠিক রাখা যায়?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন