এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে, কেউ বিশ্বাস করেনি। এমনকি যিনি মামলা দায়ের করেছিলেন, তিনিও আদালতে দাঁড়িয়ে অকপটে বলেছিলেন যে, ঐশী বাবা-মাকে খুন করতে পারে, তা তার বিশ্বাস হয় না। উল্লেখ্য, মামলা দায়েরকারী ব্যাক্তিটি ঐশীর-ই আপন চাচা। নিজের ভাইয়ের হত্যাকারীর জন্য তার মনে হঠাৎ অপত্য স্নেহ জেগে উঠেছিল কিনা আমরা জানি না, কিন্তু অন্য সবার মত তারও হয়ত মনে হয়েছিল, একজন সুস্থ/স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে নিজ বাবা-মা'কে হত্যা করা সম্ভব নয়।
তবে অবিশ্বাস্য হলেও এও তো সত্য যে, এধরনের ঘটনা পৃথিবীতেই ঘটেছে এবং ঘটছে। । এইতো মাত্র বছর খানেক আগেই মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় বাবা-মা'কে কুপিয়ে হত্যা করেছিল সাইদুর নামের এক যুবক। তবে এই ঘটনাটা নিয়ে আদালতপাড়া উত্তপ্ত হয়নি, কারণ ঘটনাস্থলেই এলাকাবাসী সাইদুরকে পাকড়াও করে ফেলে এবং আদালতের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে গনপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে তাকে। অবশ্য এলাকাবাসী অনুসন্ধানি সাংবাদিকদের অপকপটে এও জানায় যে, সাইদুর মাদকসেবী ও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। আসলেই সাইদুর মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল কিনা আমরা নিশ্চিত করে জানি না, কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে, তাদের সাধারন বিচারে, তাদের সাধারণ বুদ্ধিতে, নিজের বাবা-মা'কে হত্যাকারী একজন সন্তানকে প্রায় অবধারিতভাবেই হতে হয় মানসিক ভারসাম্যহীন।
সাধারণ মানুষ এমন করেই ভাবে, তারা ঐশীকেও তাই মানসিক রোগাক্রান্ত ধরে নিয়েছিল, ঐশীর চাচার মাথাতেও হয়ত এমন সাধারণ চিন্তা খেলা করেছিল। কিন্তু সবাই যে এমন স্বাভাবিক সাদামাটা চিন্তা করবে, তাও কিন্তু অস্বাভাবিক, আর সে অস্বাভাবিকত্বকে চ্যালেঞ্জ করেই এল ঐশীর চুড়ান্ত রায়, যা থেকে আমরা জানতে পারি, “ঐশী পরিকল্পিতভাবে, সময় নিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সে খুনের সময় সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। আসামিপক্ষ তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বললেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। সে মাদকাসক্ত হলেও বাবা-মাকে সে হত্যা করেছিল সুস্থ মস্তিষ্কে।”
বিজ্ঞ আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে! তাছাড়া, প্রচলিত আইন-কানুন, এবং সাক্ষ্য-প্রমানের ভিত্তিতে দীর্ঘ ২৭ মাস পরে চাঞ্চল্যকর একটি হত্যাকান্ডের যে রায় প্রদান করা হয়েছে তা যথাযথ হয়েছ কিনা, অথবা ঐশী ভাল কি মন্দ , তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার মত অবস্থানে নেই আমরা। আমরা শুধু ঐশীকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহন করে সাধারণ মানুষের মত করে সাধারণ চোখে কয়েকটি সাধারণ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে পারি। যেমন, কেউ নিজ বাবা-মা'কে হত্যা করলে, তাকে কি সুস্থ মানুষের কাতারে ফেলা যায়? হত্যাকান্ড অমানুষিক কর্মকান্ড, সে হিসেবে যেকোন হত্যাকান্ডকেই অসুস্থ মানুষিকতার লক্ষন বলা যেতে পারে; কিন্তু তবু মানুষই সবচেয়ে বেশী হত্যাকান্ড করে থাকে প্রানীকূলে, এবং স্রেফ বৈষয়িক মোটিভ থেকে দুনিয়া জুড়ে এত এত হত্যাকান্ড করে থাকে যে, সেখানে সুস্থতা-অসুস্থতার সীমারেখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়। কুৎসিত হত্যাকান্ড করে অনেক মানুষ সুস্থ মানুষদের চেয়েও সুস্থতার সাথে দুনিয়াব্যাপি দাঁপিয়ে বেড়ান, বৈভব ও ক্ষমতার সুরা পেয়ালভরে পান করেন।
কিন্তু নিজ বাবা-মা'কে হত্যার ঘটনায় যেন হত্যাকারীদের চিরাচরিত ট্যাবু ভেঙ্গে পড়ে, সাধারন চোখে কেবলই মনে হয়, কোন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এমনটি করতে পারে না; অথচ অন্য কোন হত্যার ঘটনায় সুস্থতার প্রশ্ন মানুষ কমই তোলে, সেখানে ভালত্ব-মন্দত্বের বিচারই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় সাধারণ মানসে। এই কারণেই আমরা ঐশীকে নিয়ে সুস্থতা-অসুস্থতার যত বিতর্ক দেখি, তা দেখি না রাজন হত্যাকারী কামরুলকে নিয়ে। সাধারণ মানুষের চোখে ঐশী আসলেই অসুস্থ এক মানুষ, যা এমনকি প্রমানেরও অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে আদালত কখনো দেখবে না, এটাই স্বাভাবিক। আদালতের চাই প্রমান। আদালতের সাক্ষ্য-প্রমানে যদি বেরিয়ে আসে যে, ঐশী খুনের সময় স্বাভাবিক মানুষের মতই আচরণ করেছিল, তাহলে তাকে আর অস্বাভাবিক-অসুস্থ মানুষের কাতারে ফেলে শাস্তি এড়ানোর সুযোগ দেয়া হবে না। আদালতের এই বিচারিক পদ্ধতি এত সুনির্দিষ্ট যে, আমরা ধরে নিতে পারি, উপরে কথিত সাইদুর যদি গনপিটুনিতে মারা না যেত, তাহলে সে হয়ত কঠিনতম শাস্তি এড়াতে পারত, নিরাময়ের উদ্দেশ্যে এমনকি প্রেরিত হত হাসপাতালে; কারণ বাবা-মা'কে হত্যাকারী সাইদুলকে খুন করার সময় মানসিক ভারসাম্যহীন আচরন করতে দেখেছেন এলাকাবাসী, ঐশীর ক্ষেত্রে এমন অনেক সাক্ষী হয়ত ছিল না, যে গুটিকয়েক ছিল তারাও দেখেছে যে, সে স্বাভাবিক মানুষটির মতই তো চলছিল, ফিরছিল, বলছিল!
স্পষ্টতই আদালতের কাছে প্রমানই মূখ্য, এবং হত্যাকালীন মানসিক অসুস্থতার বাহ্যিক সংকেত খুব গুরুত্বপূর্ণ হত্যাকারীকে ভারসাম্যহীনতার সার্টিফিকেট প্রদান করে মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে প্রেরণের জন্য। হয়ত ঐশীর মা সত্যি সত্যি বলত, 'তুই আমার মেয়ে না', হয়ত ঐশী সত্যি পরিবার থেকে এত বিচ্ছিন্ন ছিল, বাবা-মা'য়ের কাছ থেকে তারাদের চেয়েও বেশী দূরে সরে গিয়েছিল, হয়ত ঐশী ভুগছিল তীব্র কোন হতাশায়, ভুগছিল ভীষন জটিল কোন মানসিক রোগে, হয়ত ইয়াবার মাঝে খুঁজে পেয়েছিল বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়, কিন্তু তবু তার তো বাহ্যিক লক্ষন সে রেখে যেতে পারেনি, অথবা মানসিক কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কোন প্রেসক্রিপশান তুলে ধরতে পারেনি আদালতের সামনে, যাতে কোন সাইকিয়াট্রেটের চিহ্নিত করা কোন রোগের নাম এবং তার মেয়াদ বা কার্যসীমা লিখিত থাকবে। আর তাই ঐশীর চড়ান্ত রায় দিতে খুব বেশী বেগ পেতে হয় না বিজ্ঞ আদালতকে।
তবে আদালতের চোখে চিত্রায়িত সুস্থ-স্বাভাবিক ঐশী-কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্রীক পুরানের যুবরাজ অরেস্টিসের কথা, যে রাজা ইজিসথাসের সাথে তার জন্মদাত্রী ক্লাইটেমনেস্ট্রাকেও হত্যা করে। জ্যঁ পল সার্ত্রের বিশ্বখ্যত নাটক 'মাছি' অরেস্টিসকে দেখিয়েছিল ব্যাক্তিত্ববাদ দর্শনের এক প্রবক্তারূপে, যে মাতৃ-হত্যার পর উচ্ছ্বসিত ও নির্ভার কন্ঠে বলছিলঃ "আমি মুক্ত, স্বাধীন/ আমি আমার কাজ করেছি- আর সে কাজটা ছিল অনিবার্যরূপে সঙ্গত"। সার্ত্রের নাটকে যে অরেস্টিসকে আমরা পাই, সে কিন্তু তার পিতা আগামেনন হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার নেয়ার উদ্দেশ্যে ইজিসথাস ও জন্মদাত্রী ক্লাইমনেস্ট্রাকে হত্যা করেনি, বরং তার কাছে কাজটা ছিল সঙ্গত, সে ছিল স্বাধীন, মুক্ত, স্বাভাবিক এবং সুস্থ।
আমরা ঐশীকে আমাদের সাধারণ চোখে এক মানসিক রোগাক্রান্ত মেয়ে হিসেবে দেখছি, অন্যদিকে বিজ্ঞ আদালতের চোখে ঐশী দিব্যি সুস্থ একজন মানুষ, যে হয়ত নায়ক অরেস্টিসের মতই এক স্বাধীন সত্তা। কিন্তু ঐশী আসলেই স্বাধীন ছিল, নাকি পরাধীনতার নিগড়ে সম্পূর্ণ বন্দী ছিল, সে ঐশী-কথা হয়ত সত্যি করে আমাদের কখনই জানা হবে না।
.........
অনিত্র
মন্তব্য
খুবই দুঃখজনক এবং হতাশাজনক ঘটনা।
কিন্তু ব্লগ এবং প্রথম আলোর রিপোর্ট পড়ে কতগুলো প্রশ্ন আসল।
সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের আইনগত ডেফিনিশন কী? কেউ যদি ডাক্তারি পরীক্ষায় সাইকোপ্যাথ প্রমানিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তার কি ধরনের সাজা হবে? বাংলাদেশে কি এমন হাই- সিকিউরিটি সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ড আছে? নাকি এক্ষেত্রেও আসামির ফাঁসি হবে?
ডাক্তারি পরীক্ষা করে কি কারো বয়স ১৭ নাকি ১৯ কিভাবে বোঝা সম্ভব ?
পূর্নাংগ রায়টা পাওয়া গেলে হয়ত বোঝা যাবে বিচারক কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঐশীকে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে করছেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রাপ্ত বয়সের প্রমান কেন বয়সের দালিলিক প্রমানের চেয়ে অধিকতর গ্রহনযোগ্য মনে হল বিচারকের কাছে তার একটা ধারণাও হয়ত পাওয়া যাবে।
যদিও যেকোন বিচার হওয়া উচিত প্রমানের ভিত্তিতে সম্পূর্নরূপে নিঃসন্দেহ হয়ে তবে মাঝে মাঝেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার বিচারে বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি, ধারনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতে এই মামলার ক্ষেত্রে যেমনটা রেখেছে।
আমি তোমাদের কেউ নই-> আতোকেন
কিছু ভুল সংশোধনঃ
বোল্ড করা উদ্ধৃতাংশে 'অস্তিত্ববাদ' হবে।
বোল্ড করা উদ্ধৃতাংশে 'সাইকিয়াট্রেস্ট' হবে।
এই ভুলগুলো এবং আরও যদি ভুল থেকে তার জন্যও সব সচল পাঠক-পাঠিকার কাছে দুঃখিত।
।।।।।।।।
অনিত্র
ঘটনা এবং বিচার দুটোই কেমন কষ্ট দিল
—---------------
সামিরা
১৭ বছরের মেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক বলে ফাঁসির রায় দেয়াটা কেন জানি অদ্ভুৎ মনে হচ্ছে
বাংলাদেশের অনেক অনেক মানুষের মূল জন্ম তারিখ আর সার্টিফিকেটের জন্ম তারিখ আলাদা।
যতবার বোন টেস্ট করা হয়েছে প্রত্যেকবারই ১৮+ এসেছে ফলাফল।
এখন আরো দীর্ঘ পথ আছে। কত আপীল, কত রিভিউ।
লেখাটা ভাল লাগল। ঐশির এই 'ঘটনা' কে যতভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এর নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াটাও যেন অনেক বিশ্লেষণের দাবী করে।
নতুন মন্তব্য করুন