এই লেখাটা মূলত এক বন্ধুর অনুরোধে গেলা ঢেঁকি। সরকারী অফিসে ইদানিং বুক রিভিউর মতো একটা বিষয় শুরু হইছে। তো এর পাল্লায় পড়ে আমার বন্ধুর মাথা খারাপ। সে আইসা ধরলো, আমি লেইখা দিতে হবে, আর সে ওইটা প্রেজেন্ট করবো। নানান মুলামুলির পর রাজি হইলাম। তার জন্য হাজারখানেক শব্দে লিখতে গিয়ে মনে হইলো একটু আরাম কইরা লেখি। তারে তারটা বুঝাইয়া দিয়া, আমি আমারটা নিয়া আগাইলাম। আমি কোনো সাহিত্য সমালোচক না। সাহিত্য ঠিকঠাক বুঝিও না হয়তো। যাক তবু সচলদের একটু বিরক্ত করা আর কি। লেখাটা বড় হওয়ায় কয়েকবারে দিতে হবে। আজ প্রথম কিস্তি।
(১)
উপন্যাস শুধু আখ্যান নয়, নয় কেবল জমাটবদ্ধ অগণিত ঘটনার পুঞ্জিভুত ঘনঘটা। একটিমাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনোবিশ্লেষণী পন্থায় রচিত হতে পারে উপন্যাস। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এমনই একটি নিদর্শন। এ তো জানা কথা যে, বাস্তবতা যখন ধ্বংসোন্মুখ অন্ধকার গুহার মধ্যে খুঁজে নেয় নিজস্ব নিবাস সাহিত্য তখন জাগানিয়া গান রচনা করে। এই বাস্তবতা ব্যক্তিক থেকে সামষ্টিক সকল পর্যায়ে বিস্রস্ত। সাহিত্য বাস্তবকে অস্বীকার করে নয় বরং তার ভেতর পূর্ণরুপে প্রবিষ্ট হয়েই পথ খুঁজে নেয় আলোর। ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ উপন্যাসে যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর ঘটেছিল মানব চৈতন্যের উদ্বোধন।
প্রাণের প্রধান দাবি অস্তিত্বের লড়াই, কিন্তু সেই অস্তিত্ব সামষ্টিক। আমরা যখন এককভাবে বাঁচার চেষ্টা করি তখন পরিণামে আমরা টিকতে পারি না। বর্তমান ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে প্রতিনিয়ত সকল অর্থেই ছিন্নমূল হতে হতে এই সত্য আজ চরমভাবে পরিদৃশ্যমান। আমরা ব্যক্তি অস্তিত্বকে নিঃশঙ্ক করতে গিয়ে ঘনিয়ে আনছি নিঃসীম অন্ধকার। সেই অন্ধকারে নিজেরাই শেষতক নিমজ্জিত হচ্ছি। বিরাজমান অন্ধকারকে ‘অপর’ জ্ঞান করে, নানা কাল্পনিক ওষধি খুঁজে বেছে নিচ্ছি পলায়নপর পথ। ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ গ্রন্থের মূল চরিত্র যুবক শিক্ষক আরেফ আলীও এই পথই খুঁজছিল সর্বান্তকরণে। কিন্তু তার সাফল্য অর্জিত হয়নি। শেষব্দি সে নিজেকে সমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল সামষ্টিকতার সংজ্ঞায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এই পলায়নপরতা থেকে যুবক শিক্ষকের লড়াইর ময়দানে ফিরে আসা পর্যন্ত সময়ের মাঝে সমাজকে হাজির করেছেন বিস্তৃত অনুসঙ্গে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর তিনটি উপন্যাসেই বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় ধর্মীয় গোঁড়ামির যে দূর-বিস্তারি শিকড় তার অনুসন্ধানে রত থেকেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ এগিয়েছে আপাত জটিল কিন্তু গতিময় ঘটনা পরম্পরার মধ্যদিয়ে যেখানে ‘মজিদ’ চরিত্রটির স্থিতি প্রাপ্তির সাথে সাথে উন্মোচিত হয়েছে দেশে বিরাজমান অভাব, অশিক্ষা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির পারস্পরিক সমন্ধ। তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তে এই বিষয়টি হাজির হয়েছে প্লটের সারল্যের মাঝেও লুকিয়ে থাকা বৌদ্ধিক উপমার কারুকার্যে। আর এ তিনটিতেই নারীকে হাজির হতে দেখা যায় একইসাথে ধর্মের প্রথম ও প্রধান শিকার এবং তার বিপরীতে ঋজুভাবে দাঁড়ানো প্রতিবাদী স্বর হিসেবে উস্থিত থাকতে। লালসালুতে জমিলা তার প্রতিবাদ বা কটাক্ষ সোচ্চারেই উচ্চারণ করে যার দ্বারা পাঠক নির্দ্বিধায় এগিয়ে যেতে পারে মজিদের চরিত্র উন্মোচন, ধর্মের খোলসের নিচের দগদগে ঘা অবলোকন, আর এ ধর্মকেন্দ্রিক অনাচারের স্বরূপকে চিনে নিতে। এর বিপরীতে এ সবগুলোই একসাথে উঠে এসেছে ‘চাঁদের অমাবশ্যাতে’ও। তবে কোনো বক্তব্য ছাড়াই। জমিলার মতো এখানে নারীর কণ্ঠে কোনো বয়ান হাজির না করেই গোটা সমাজের বিপরীতে, ধর্মের বিপরীতে তীব্র কটাক্ষ নিয়ে হাজির হয় নারী। খেয়াল রাখার বিষয় হচ্ছে তাঁর প্রথম ও তৃতীয় উপন্যাস উভয়টিতেই ঘটনার মধ্যদিয়ে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ঠিক এখানটাতেই তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ ভীষণভাবে ব্যতিক্রম। চাঁদনি রাতে বাঁশঝাড়ে একটি অর্ধ-উলঙ্গ মৃত নারীদেহ থেকে যে উপন্যাসের চিত্ররুপের শুরু তা অবশ্যম্ভাবিরুপে দাবি করা বিস্তৃত ঘটনা পরম্পরার পথে না হেঁটে এগিয়েছে মনোসমীক্ষণের পথ ধরে। যে সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরবার জন্য একজন ঔপন্যাসিক সাধারণত হাঁটেন নানা ঘটনা ও চরিত্রের ঠাসবুনটের চেনা পথ ধরে, সেই সমাজ বাস্তবতাকে তুলে আনতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ হেঁটেছেন তাঁর মূল চরিত্র যুবক শিক্ষকের মনের অলিগলি ধরে। প্রায় প্রতিটি কোনে আলো ফেলে তিনি ব্যক্তির ভেতরে সমাজের যে শ্রেণি ধারণা, ক্ষমতা ও বিত্তের সমীকরণ, ভীরুতা, স্বার্থপরতার পরম্পরা বা সংস্কার অজান্তেই বিরাজ করে তা থেকেই তুলে এনেছেন পুরো সমাজ ব্যবস্থাটির প্রকৃত চরিত্র। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ উপন্যাসে কোনো সরব নারী চরিত্র নেই। এমনকি তাদের উপস্থিতিও ঠিক টের পাওয়া যায় না। যতটা পাওয়া যায় তা ওই যুবক শিক্ষকের ছাত্র- ছাত্রীদের মাধ্যমে একটি অনুমিত হাজিরা হিসেবে। এটা অনেকটা এমন যে, ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে যেহেতু আছে, সেহেতু তাদের একজন মা অবশ্যই আছেন। আরেকটি ক্ষেত্রে এ অস্তিত্ব একটু জানান দিয়ে যায়, আর তা হলো যুবতী নারীর মৃতদেহ পাওয়ার পর, তার শাশুড়ী ও ননদের বিলাপ। এর বাইরে নারীর আর কোনো সরব উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। অথচ এখানে নারীই থাকে সবচেয়ে বড় উদ্দিষ্ট। পুরো উপন্যাসেই নারী থাকে প্রাণহীন একটা সত্ত্বা হিসেবে বিরাজ করে। এখানে লেখক দারুণ এক বৌদ্ধিক পন্থায় তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন সমাজকে। পুরুষতান্ত্রিক বা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে নারী জন্মদানে, মৃত্যুতে বা হাহাকারেই কেবল তার অস্তিত্ব জানান দিতে পারে। এ বাস্তবতা ওয়ালীউল্লাহর সময়কালে যেমন বাস্তব ও সত্য ছিল, এখনো তেমনি আছে। এক পাও আমরা আগাতে পারিনি সম্ভবত।
একটি হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া উপন্যাসটির প্রথম পরিচ্ছেদেই একটি শক্তিশালী গল্প কাঠামোর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় যা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দারুন কুশলতায় বিবর্ধিত হয়েছে। শুরুতেই একটি হত্যার ঘটনা পাঠককে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনাপুঞ্জির প্রতি আগ্রহী করে তুললেও ঔপন্যাসিক সে পথে হাঁটেননি। এমনকি পুরো উপন্যাসে বাঁশঝাড়ে মৃতদেহ দেখা, কাদের ও যুবক শিক্ষকের মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, স্টিমারের সারেং কর্তৃক সেই বিকৃত মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়া ও মাঝি-বৌ হিসেবে তার নিশ্চিতকরণ এবং শেষতক যুবক শিক্ষকের পুলিশের কাছে গিয়ে হত্যাকারী বিষয়ক সত্য প্রকাশ করা, এই চারটি মূল ঘটনার বাইরে আর কোনো উল্লেখযোগ্য বাস্তব ঘটনার বিবরণ নেই। অথচ এর মধ্যদিয়েই সেই গ্রাম যা কিনা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সমস্ত গ্রামের প্রতিভূ, তার সমাজ, সমাজের মানুষ, শ্রেণি, ধর্ম ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ঠুনকো বিচার ও প্রশাসন ব্যবস্থার এক কুশলী আখ্যান আমাদের সামনে উঠে এসেছে।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র দাদাসাহেব চাকুরি শেষে গ্রামে ফিরে এলে বাড়িতে থাকা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সমন্ধে বলেন- ‘এখনো তাদের মন সার-দেয়া জমির মত। তাতে যে বীজ রোপণ করা যাবে সে বীজই ফলবতী হবে।’ এই উক্তির সত্যতা সমন্ধে আমরা সকলেই প্রায় নিশ্চিত। ব্যক্তি মানস গঠনে সমাজ ও পরিবারের ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। এই কথা খুবই সাধারণ এবং দাদাসাহেবের চরিত্রের সাথেও এই উক্তি সাদৃশ্যপূর্ণ। কিন্তু মনোবিশ্লেষণধর্মী একটি কাঠামোর কারণেই মনে হয় এই উক্তিটি বহুল ব্যবহৃত কোনো কিছুর পুনর্ব্যবহার শুধু নয়, এর রয়েছে আরো ভিন্ন কোনো ব্যঞ্জনা। উপন্যাসের শুরুতেই এমন একটি উক্তির মাধ্যমে লেখক মূলত আমাদের পাঠ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। যেহেতু মানুষ সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ সেহেতু এই সমাজ এই পরিবার থেকে গ্রহণের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে তার চরিত্র। তাই ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ উপন্যাসের যুবক শিক্ষক বা কাদের একক ব্যক্তিরূপ কেউ নয়। যুবক শিক্ষকের দ্বিধার নির্মাতা যেমন সমাজ তেমনি তার সাহস ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতাও এই সমাজ।
উপন্যাসের মূল চরিত্র হিসেবে ব্যক্তি ‘আরেফ আলী’ যতটা দৃশ্যমান তার চেয়ে ‘যুবক শিক্ষক’ অনেক বেশি প্রকট। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এক্ষেত্রে সমাজ মানস চিত্রনের চমৎকার এক বৌদ্ধিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তিনি ব্যক্তি আরেফ আলীকে একটি সামষ্টিক রূপ দান করবার চেষ্টা করেছেন। এখানে যুবক শিক্ষক অভিধাটিকে বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন রয়েছে। সাধারণত ‘যুবক’ শব্দটি প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা যৌবনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর ‘শিক্ষক’ অভিধাটির রয়েছে এক সুবিস্তৃত এবং নির্দিষ্ট কিছু প্রপঞ্চ। তিনি তাঁর এই আপাতদৃষ্টে ব্যক্তিক কিন্তু প্রকৃত অর্থে সামষ্টিক গুণ সম্বলিত এই চরিত্র সমন্ধে নিজেই বলেন-
‘কিন্তু শিক্ষকতা করে বলে তার (যুবক শিক্ষকের) বাহ্যিক আচরণ-ব্যবহার বয়স্ক ব্যক্তির মত হলেও তার মনের তরুণতা এখনো বিলুপ্ত হয় নাই। বরঞ্চ স্বল্পভাষী যুবক শিক্ষকের মনের অন্তরালে নানারকম স্বপ্ন-বিশ্বাস এখনো জীবিত।’
এই যে মনের তরুণতা, এই জীবিত স্বপ্ন ও বিশ্বাস তা এই কারণে যে, যুবক শিক্ষকের বয়স বেশি নয়। অর্থাৎ সমাজের যাবতীয় কলুষের সাথে তার সমন্ধ বেশি দিনের নয়। এই স্বল্প সমন্ধই মূলত তার আত্মপীড়নের মূল কারণ। যুবক হওয়ার দরুন তার ভেতরে যেমন সত ও সাহসী হয়ে ওঠার একটি প্রবণতা কাজ করে তেমনি শিক্ষক হওয়ার কারণেও তার রয়েছে সমষ্টির প্রতি দ্বায়িত্বের একটি মনোভাব। আবার শ্রেণি চরিত্রের কারণেই সে তার ভবিষ্যত সুখ সম্ভাবনা উবে যাওয়ার বিষয়েও সতর্ক। ফলতঃ এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার শুলুক সন্ধানে এবং কর্তব্য নিরূপণে সে পুরোপুরি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। লেখকের ভাষায়-
‘যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগী-মুখে হাল্কা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে, বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দু:খ-কষ্ট মহামারী দেখেছে, কিন্তু কখনো বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই। সে ছুটতেই থাকে।’
কাদেরকে দেখে ছুটতে থাকাটা আসলে তার অবচেতনের সেই নির্দেশনা যা তাকে প্রতিনিয়ত অপ্রিয় ও প্রলয়সম্ভাবী দ্বায়িত্ব থেকে পলায়ন করতে বলে। এ পলায়ন কর্তব্য থেকে। কারণ এই প্রথম সে কোনো একটি হত্যাকা- বা অপরাধের সাক্ষি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর আগের যত অভিজ্ঞতা তা তাকে নিশ্চিতরুপে দ্বায়িত্বের কথা স্মরণ করায় না। তার অভিজ্ঞতা বড়জোর বাস্তুসংস্থানের সাধারণ নিয়মের সীমায় বা সমাজ অর্থনীতির বড় কোনো প্রপঞ্চের ফলাফল পর্যন্ত যেখানে তার পক্ষে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু এই প্রথম একটি ঘটনার অভিজ্ঞতা সে অর্জন করেছে যা কিনা তার একটি সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করে, যার পরিণতি সর্বাংশেই তার নিরবতা বা সরবতার উপর নির্ভরশীল। ‘দম্ভ-ঔদ্ধত্য না হোক, শিক্ষক হলে অহঙ্কার না হয়ে পারে না।’ যুবক শিক্ষকের মনে হাজির হওয়া অতলস্পর্শি এই দ্বিধার মূল ভিত্তিভূমির হদিস আমরা জানতে পারি তার চরিত্র রূপায়নের এইসব বয়ান থেকেই, যেখানে একদিকে দাঁড়িয়ে তার তরুণ, স্বাপ্নিক ও মানুষের ওপর আস্থাশীল মন আর অন্যদিকে তার শ্রেণি অবস্থান যা তাকে প্রতিনিয়ত সুবিধাবাদের তালিম দিয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে এই যে বাড়তি একটা অহঙ্কারের স্থান মনের গহীনে থেকে যায় যা তাকে সমাজ ও সমষ্টির বিষয়ে এক ধরনের অভিভাবকসুলভ মনোভাবের অধিকারী করে তোলে তাও তাকে কর্তব্যকে ভুলে থাকতে বাধা দেয় প্রতিনিয়ত। (চলবে)
স্বয়ম
মন্তব্য
"এর পাল্লায় পড়ে আমার বন্ধুর মাথা খারাপ। সে আইসা ধরলো, আমি লেইখা দিতে হবে, আর সে ওইটা প্রেজেন্ট করবো।"
-আপনার বন্ধুটি কি প্রেজেন্ট করার সময় বলবেন যে তিনি এটা লিখতে অন্য কারো সহায়তা নিয়েছেন, কিংবা অন্য একজনকে দিয়ে অংশ বিশেষ লিখিয়েছেন?
সেটা না করলে কাজটা লেখা চুরির (Plagiarism) পর্যায়ে পড়ে। আমাদের দেশে এই ব্যাপারটা মেনে নেয়া হলেও, এটা একটা অপরাধ।
আপনি ভালো লেখেন, আপনি বাংলা শব্দের প্রয়োগে আপনার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। খালি এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে এটা না লিখেও একজন (হয়ত) নিজের কাজ বলে চালাবেন।
ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা
না সে করবে না বা করেনি। আর এ কারণেই পিছলানোর চেষ্টা ছিল, এটারেই মুলামুলি বলছি আরকি কৈফিয়তে।। পরে লিখতে বসে, যখন ভালো লাগলো। আর গোটা লেখাটা দাঁড় করবার পর ক্ষমা করে দিলাম। কারণ ‘চাকরীর বিষয়’ এমন কথায় ব্ল্যামেইল না করলে হয়তো আমি কখনোই লিখতে বসতাম না। যদিও আপনার কথায় আমি একমত যে, এসবকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত না।
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা
স্বয়ম
আপনার অবস্থানটা পরিষ্কার করার জন্য ধন্যবাদ।
আচ্ছা, এই সরকারি চাকরিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকেই কি এখন গ্রন্থালোচনা লিখতে হচ্ছে? ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কি, যদি জানা থাকে?
শুভেচ্ছা
গ্রন্থালোচনার বিষয়টা নতুন সংযোজন করেছে। ৩৫তম বিসিএস থেকে এটা পরীক্ষারও একটা অংশ। আর এর বাইরে, যারা চাকরীতে আছে, তাদের সম্ভবত বছরে তিনটা বই পাঠ ও তার গ্রন্তালোচনা লিখে, সবার সামনে উপস্থাপনের বিষয়টা সংযুক্ত করা হয়েছে। কোনো একজনের কর্মদক্ষতার পাশপাশি এই নিয়মিত বিষয়টিও মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়।
স্বয়ম
লেখকের বন্ধুর ক্ষেত্রে এটা মনে হয় "Plagiarism"-এর পর্যায়ে পড়ে না। লেখক এখানে যা করেছেন ইংরেজিতে তাকে Ghostwriting বলে, আর তার বন্ধু তাকে একাজে বন্ধুত্বের দাবীতে নিয়োগ করেছেন। Plagiarism বলতে যদিও - The practice of taking someone else’s work or ideas and passing them off as one’s own - সাধারণত বোঝায়, কিন্তু এখানে উহ্য কিন্তু অবিচ্ছেদ্য ও মৌলিক শর্তটি হচ্ছে --এই "taking" ও "passing off" অংশ দু'টি হতে হবে মূল লেখকের বিনানুমতিতে, সোজা কথায় এবং আপনারই ভাষায় - চুরি, 'চুরি'-র সংজ্ঞা অনুযায়ী চুরি। এখানে লেখকের বন্ধু উল্লেখিত অংশ দু'টির কোনো অংশের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করেননি। তিনি শুধু বিনানুমতিতে কোনো লেখা 'নিয়ে' এবং তারপর 'চালিয়ে' দেননি তাই নয়, তিনি দস্তুরমত সেটা মূল লেখকের কাছ থেকেই 'নিজের নামে চালাবেন বলেই চেয়ে' এবং উপরন্তু শুধুমাত্র তারই জন্য 'ফরমাশমাফিক' লিখিয়ে নিয়েছেন! সুতরাং এটা কোনোভাবেই Plagiarism বা চুরি না।
এটা সিম্পলি Ghostwriting-এর একটা উদাহরণ। আমি ১০০% নিশ্চিত ঘোস্টরাইটিং কি জিনিস আপনি খুব ভালো করেই জানেন। তবুও কয়েকটা সংজ্ঞা উল্লেখ করছি এখানেঃ
Collins অভিধানের ভাষায় এটা হচ্ছে -
ক্যামব্রিজ অভিধানের ভাষায়ঃ
আর উইকিপিডিয়ার বিবরণে ঘোস্টরাইটিং হচ্ছে --
ঘোস্ট-রাইটারের নামোল্লেখ করতেই হবে এমন কোনো বাঁধাধরা বা ইউনিভার্সাল আইন, নিয়ম, রীতি বা চল আছে বলে আমার জানা নেই। কেউ করেন, কেউ করেন না, কেউ ভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করেন। সবটাই মনে হয় চলে - এভ্রিথিং গোজ। ইন্টারনেট আউটসোর্সিং ও ফ্রিলান্সিং-এর এই জয়জয়কারের যুগে এই না করাটাই বরং মনে হয় নতুন প্যারাডাইম। Ghostwriting মনে হয় এখন বিশ্বব্যাপী দুর্দান্তভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত একটা চর্চা। বাংলাদেশেও এর চর্চা বহুল-প্রচলিত। অন্য দেশে এ প্রসঙ্গে কি রীতিনীতির চল আছে বিস্তারিত জানি না, তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা সেবা প্রকাশনীর কথা মাথায় আসছে।
সুতরাং, সব কথার সার কথা হলো -- কারো কারো জন্য ব্যক্তিগতভাবে এটা কিছুটা অরুচিকর হলেও (যা বোধগম্য এবং আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) এই সেবার প্রদানকারী বা গ্রহণকারী কেউই মনে হয় Plagiarist, চোর-গুণ্ডা-বদমাশ বা অপরাধী নন (অল্প কিছু ক্রিটিকাল ক্ষেত্র বাদে, যার উল্লেখ উইকির আর্টিকেলে আছে)। আর আমার মতে এত কথা বাদ দিয়ে শুধু একটা কমনসেন্স যুক্তিই যথেষ্ট - একটা লেখা একজন লেখকের "property", সে হিসেবে তিনি শর্ত-সাপেক্ষে বা সম্পূর্ণ নিঃশর্তে ও সর্বস্বত্ব ও অধিকার (মূল লেখক হিসেবে নিজের পরিচয়সহ) পরিত্যাগপূর্বক এটা যাকে খুশি তাকে স্রেফ দিয়ে দিতে বা দান করে দিতে পারেন। এছাড়া বিক্রি, ভাড়া, বিনিময় বা হস্তান্তরও করতে পারেন। আর যিনি গ্রহীতা হবেন, তিনি যদি নিঃশর্তভাবে এরকম সর্বস্বত্ব ও অধিকার (বিশেষত মূল লেখকের পরিচয় প্রকাশের দাবী বা অধিকার) পরিত্যাগপূর্বক কোনো লেখা দান, বিক্রয় বা বিনিময় হিসেবে পান - তখন আর সবকিছুর মতই এটাও তারই - সম্পূর্ণই তার নিজের প্রপার্টি হয়ে যায়। আর নিজের প্রপার্টি তিনি তখন - আর সব প্রপার্টির মতই - যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার রাখেন। নিজের নামে প্রকাশের অধিকার সহ। আইনকানুনের কথা জানি না, কিন্তু আমার কমনসেন্স দিয়ে এটুকুই বুঝেছি আপাতত।
****************************************
খাইছে, এতো কিছুতো জানতাম না। এতো বিরাট জটিল বিষয় দেখা যায়।
স্বয়ম
Ghostwriting এর বিষয়ে হালকা পাতলা ধারণা ছিল, এত সংজ্ঞা জানা ছিল না। ধন্যবাদ এত তথ্যবহুল মন্তব্য করার জন্য।
তবে সেবা প্রকাশনী বা পৃথিবীর অন্যান্য Ghostwriting থেকে এখানকার বিষয়টা খানিকটা আলাদা। এখানে সরকারি অফিসে চাকরীরতদের একটা কাজ করতে দেয়া হয়েছে এবং এটা অনেকটা অ্যাসাইনমেন্টের মতই মনে হল। সেখানে Ghostwriting এর সুযোগ নেয়াটা আমার কাছে কিছুটা অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে।
এই পোস্টের লেখক (স্বয়ম) এর বাংলায় যে দক্ষতাটা আছে, সেটা হয়ত আরেকজন সরকারি চাকরিজীবীর নেই। ঐ বেচারা হয়ত নিজে কষ্ট করে বই পড়ে একটা লেখা লিখলেন। কিন্তু, এরকম মানের লেখার পাশে সেটা ম্লানই লাগবে।
লেখকের মন্তব্য থেকে আরও যেটা জানা গেল:
"কোনো একজনের কর্মদক্ষতার পাশপাশি এই নিয়মিত বিষয়টিও মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়।"
তার মানে এর উপর কিছুটা হলেও নম্বর আছে। বাৎসরিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এর খানিকটা প্রতিফলন থাকবে। ধরে নিন, একই পদে কর্মরত কয়েকজন সমান পারফর্ম করল; কিন্তু একজন নিজের সাধারণ মানের গ্রন্থালোচনা উপস্থাপন করলেন; আরেকজন Ghostwriter কে দিয়ে খুবই উঁচু মানের লেখা উপস্থাপন করলেন। এখানে, হয়ত যিনি সৎভাবে কাজটি করলেন তিনি পিছিয়ে পড়লেন, অবমূল্যায়িত হলেন।
এক কথায়, এটা একরকম প্রতিযোগিতার মত। অথবা, পদোন্নয়ন বা প্রোমোশনের ক্ষেত্রে যে প্রতিযোগিতা (বা ইভ্যালুয়েশন) হয় তার একটা অংশ; হয়ত খুবই ক্ষুদ্র অংশ।
শুরুতে এধরনের Ghostwriter এর সাহায্য নেয়াটা ছোটখাট বিষয় মনে হয়েছিল। তখন ভেবেছিলাম, হয়ত এটা সরকারি অফিসে বই পড়তে উৎসাহ দেবার জন্য করা হচ্ছে। হয়ত, পুরষ্কার হিসেবে আরও বই দেয়া হবে।
কিন্তু, "কোনো একজনের কর্মদক্ষতার পাশপাশি এই নিয়মিত বিষয়টিও মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়।" -এটা পড়ার পর এধরণের Ghostwriter এর সাহায্য নেয়াটা আমার কাছে আমার কাছে অনৈতিক মনে হয়েছে।
আর ঘটনা হয়ত এখানেই থেমে থাকবে না। আমাদের সিস্টেমে যেহেতু Plagiarism দেখার ব্যবসথা নেই। Ghostwriter এর লেখা একটি সুলিখিত গ্রন্থালোচনা ঢাকায় শফিক সাহেব ব্যবহার করবেন, তার কাছ থেকে নিয়ে যশোরের বাশার সাহেব ব্যবহার করবেন, তার কাছ থেকে সিলেটের রহমান সাহেব ব্যবহার করবেন, বরিশালের চন্দ্রনাথ সাহেব ব্যবহার করবেন,
এভাবে চললে সেটা আটকানোরও কোন ব্যবস্থা থাকছে না।
@স্বয়ম: আমি কোনভাবেই আপনাকে আক্রমণ করিনি, বা আপনাকে আহত করার মত কোন কথা বলতে চাইনি। আশা করছি আপনি কিছু মনে নেবেন না। আমি পুরো সিস্টেমটার দুর্বলতার ব্যাপারে নিজের হতাশাটাই ব্যক্ত করলাম মাত্র। এবং আপনার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে আপনিও একরম একটা সিস্টেম চাইবেন সবাই নিজে বই পড়ে, নিজের লেখা দিয়েই মূল্যায়নে নম্বর পাবেন।
শুভেচ্ছা
আক্রমন হিসেবে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যায়নের বিষয়টা পরে জানতে পারি। বিসিএসে এর অন্তর্ভূক্তির বিষয়ক এক দিনের আলোচনার সূত্র ধরে। তবে প্রক্রিয়াটা এখনো জানি না। সরকারী অফিসগুলোতে অনেক কিছুই নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা হচ্ছে। এখনো তা শুরু হয়নি পুরোদমে। কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে কেবল প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছে। তবে এ ধরনের যেকোনো কিছুকে একটা চোথা ফরম্যাটে নিয়ে আসার এক বিস্ময়কর স্বভাব আমাদের আছে।
স্বীকার করতে ক্ষতি নেই, এতে আমি শুরুতে রাজি ছিলাম না। তবে এই না থাকার সাথে এতো গভীর কোনো চিন্তা ছিল না। আলোচনাটা উপকারই করেছে আমার।
অনেক ধন্যবাদ।
স্বয়ম
১।
আপনি আবারও Plagiarism শব্দটার ভুল প্রয়োগ করছেন। কোনো কাজ অনৈতিক বা অসৎ হলেই সেটা Plagiarism হয় না। এর জন্য সুনির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথম মন্তব্যে সেটা উল্লেখ করেছি। সোজা বাংলায় বললে - অন্য কোনো লেখকের লেখা নকল করে সেটা মূল লেখকের বিনানুমতিতে নিজের নামে চালিয়ে দেয়াই হচ্ছে Plagiarism। অন্যকিছু না। কারও অনুমতি নিয়েই তার লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে অন্যকোন তৃতীয় পক্ষকে প্রতারিত করা বা তার কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নেয়াকে Plagiarism বলে না (এই ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে)। তাকে 'প্রতারণাই' বলে। কিম্বা দুর্নীতি, ধোকাবাজি - এসবও বলা যেতে পারে। দুনিয়াতে হরেক রকম সুনির্দিষ্ট ধরণের ও নামের অনৈতিক কাজ আছে, যেমন চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামি-খুন-রাহাজানি-ঘুষ-সন্ত্রাস-প্রতারণা ইত্যাদি। এর সবগুলিকেই যদি Plagiarism ডাকা শুরু করি তাহলে তো মহা মুশকিল!
২।
আমি আপনার সাথে একমত। পোস্টলেখকের বন্ধুর ঘটনার কন্টেক্সটটা একটু ভিন্ন। এধরণের পরীক্ষা-টরীক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষত যেখানে বৃহত্তর জনস্বার্থ জড়িত, সেখানে ঘোস্টরাইটারের সহায়তা নেয়া অনৈতিকই। প্রতারণামূলকও। উইকিও কিছু উদাহরণ দিচ্ছে -
।
৩।
তবে আবার এটাও ঠিক, কর্মরত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একমাত্র তাদের কর্মদক্ষতার বিচার ছাড়া কর্মবিষয়ের বাইরে এমন ফ্রিস্টাইল, এলোমেলো এবং আর্বিট্রারি গ্রন্থপাঠ ও গ্রন্থালোচনা প্রতিযোগিতা-খেলাতে ফোর্স করা ও সেই স্টুপিড খেলার উপর তাদের পদোন্নয়ন বা প্রোমোশন বিন্দুমাত্রও নির্ভর করানোর এই অর্থহীণ আকাট ছাগলামি ও ফাজলামি বুদ্ধিটা যাদের মাথা থেকে বেরিয়েছে, তাদের বুদ্ধির পশ্চাদ্দেশ দিয়ে ঘোস্টরাইটিং-এর ঘোস্টদণ্ড সমূলে প্রবিষ্ট করিয়ে সবাই মিলে সেই বুদ্ধির অকালেই দফারফা করে দেয়াটাই হবে সবচেয়ে বৌদ্ধিক, নৈতিক ও জনহিতকর কাজ!
সরকারি চাকরিজীবীদের চাঁদের অমাবস্যা পড়ানোর জন্য বা তাদের সংস্কৃতিবান বানানোর জন্য আমরা সরকারকে ট্যাক্সের পয়সা দেই না। তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত সময়ে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা করুন গিয়ে, কোন আপত্তি নেই। দরকার হলে ইন্টারের ছাত্রদের সাথে হাফ-প্যান্ট পরে বিশ্ব-সাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন প্রাইভেট টাইমে। কিন্তু আমাদের ট্যাক্সের টাইমে এসব ফাজলামির প্রশ্নই উঠে না। আমরা তাঁদের ভরন-পোষণ করি সততা, কর্মদক্ষতা আর রেজাল্টের জন্য। অন্যকিছুর জন্য না। এইসব অপচয়মূলক ফাজলামি দিয়ে এসবে কোনো উন্নতি ঘটবে না। তাই এইসব ফাত্রামি বাদ্দিয়ে আগে দরকার সরকারের মাথা থেকে শুরু করে তলার দিকে নিজে সঠিক লীডারশীপ ও দায়িত্বশীলতার চর্চা করা, নিয়মিত ভিত্তিতে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে মোটিভেট করা, সুনীতি ও কর্মমূখীনতার চর্চা করা, দূর্নীতি ও গাফিলতি দমন করা আর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনে কর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রোফেশনাল ডেভেলপমেন্ট কোর্স / ট্রেনিং ইত্যাদি করানো। সাভারে মনে হয় এরকম একটা সেন্টারও আছে সরকারের। দরকার হলে সেসবের চর্চা আরও নিবিঢ়ভাবে করা হোক। সরকারী কার্যালয়গুলিকে সিরিয়াস ও কার্যকর জনমুখী ও কর্মমুখী কার্যালয় হিসেবেই দেখতে চাই, চাঁদের অমাবস্যা আর সূর্যের পূর্ণিমা পড়ানো কানাই মাষ্টার আর বিড়ালছানাদের কিচিরমিচিরে ভনভন কচিকাঁচার আসরে পরিণত হতে দেখতে চাই না।
সবশেষে আরও দু'তিনটি বিষয় উল্লেখ করি এই আইডিয়াটা কত ফালতু মনে হয় বোঝাতেঃ
৪। কাউকে জোর করে কয়টা বই বা সাহিত্য গিলিয়ে পড়ুয়া বা সাহিত্যপ্রেমী বানানো যায় না। এই জিনিসটা রিলাক্সড আনফোর্সড পরিবেশ আর নিজের অন্তর্গত অনুপ্রেরণা থেকে আসে। জোর করতে গেলে বরং উলটো ফল হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এটা প্রমাণিত সত্য।
৫। আপনার বর্ণনা থেকে মনে হলো এ বিষয়টা একটা পরীক্ষা টাইপের মত কিছু। এরকম কিছু হলে বলবো এর চেয়ে বলদামি স্টুপিড পরীক্ষা বিশ্বব্রম্মাণ্ডে আর নেই। পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতা মাত্রেই তার মূল উদ্দেশ্য সফল করা জন্য কিছু শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। এখানে সেসব কৈ? পরীক্ষার্থী বা প্রতিযোগীদের মধ্যে ফেয়ারনেস বা সমান সুযোগসুবিধা রক্ষার চেষ্টা কৈ? নকল বা দুর্নীতি করার এমন যাচাইবিহীণ অবারিত সুযোগ থাকলে, নকল / দুর্নীতি তো হবেই - না করাটাই বরং তখন অন্যায়। আমি হলে খোদ ওয়ালিইল্লাহ সাহেবকে দিয়েই রিভিউ লিখিয়ে আনতাম (উনি জীবিত থাকলে আরকি)। নাকি নকল করাটা এই স্টুপিড পরীক্ষায় অনুমোদিতই? যে যা পারে একটা কিছু লিখে আনলেই হলো? তাহলে আর এই চর্চাটার মানে কি হলো? নাকি এটা "ওপেন বুক" পরীক্ষার মতো কিছু? যত খুশি দেখে লিখো? এটা তো সেরকমও হলো না। "ওপেন বুক"-এও নিয়ম, শর্ত, নিয়ন্ত্রণ ও সমতা থাকে। এখানে কিছুই নাই। আর হ্যাঁ, এইসব "গ্রন্থালোচনার" মূল্যায়ণ করবে কে? পেশাগত সব কাজকর্ম ফেলে শুদ্ধ বাংলায় ঠিকমত কথা পর্যন্ত বলতে পারে না - এমনসব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারীরা? হাতুড়ি, গদা বা দুরমুজ দিয়ে কি মাখনের দলা ফালি করা যায়, নাকি সেই ফালি রুটিতে মাখিয়ে খাওয়া যায়? নাকি তারাও তখন ঘোস্টরাইটিং-এর মতো ঘোস্টএক্সামিনিং বা ঘোস্টএভালুএটিং করানোর জন্য "ঘোস্ট"-দের পিছনে দৌড়াদৌড়ি শুরু করবেন (যদি বুদ্ধিমানের মতো বাসার কাজের বুয়াকে দায়িত্ব দিয়ে না দেন আরকি)? প্রোমোশন নির্ধারণের জন্য পরীক্ষার্থী-পরীক্ষক সমেত এই পুরো এক্সারসাইজটাই কি তখন একটা ভীষণ "ভুতুড়ে" ব্যাপার, এমনকি একটা হরর মুভি হয়ে যাবে না? নাকি গ্রন্থালোচনাগুলি মূল্যায়ণ করার জন্য ভেড়ামারা উচ্চ বিদ্যালয় বা গাইফুর কোচিং সেন্টার থেকে - কোচিংঅলাদের ধান্ধাবাজির আরো সুযোগ খুলে দিয়ে - চুক্তিভিত্তিতে পরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে, একটা "বাৎসরিক মূল্যায়ন গ্রন্থালোচনা মিনিস্ট্রি" খোলা হবে, অথবা প্রতিটি অফিসে কাজকম্ম বাদ্দিয়ে কচিকাঁচার আসর বসানো হবে?
৬।
আপনার দুঃখিত হওয়ার কিছু নাই। কারন আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে এটা "ওপেন বুক" না হলেও, "ওপেনসোর্স" বা "ঘোস্টওপেন" টাইপের একটা এসাইনমেন্ট / প্রতিযোগিতা পদ্ধতি, যার মূল কথা হচ্ছে - "যেমন খুশি তেমন সাজো" প্রতিযোগিতার মতোই "যা পারেন য্যামনে পারেন যারে দিয়া পারেন একখান লিখ্খ্যা আনেন"। তো "ওপেন বুক"-এ সমান জানা সত্বেও গোঁ ধরে বই ওপেন না করার জন্য কেউ যদি পিছিয়ে পড়েন তাহলে তার ভুলের জন্য যেমন তিনিই দায়ী হবেন, তেমনি এই ঘোস্টওপেন-এ ভূতের সাহায্য না নিয়ে নিজেই ভূত সাজতে গিয়ে কেউ ধরা খেলে তার বলদামির জন্যও কেবলমাত্র তিনিই দায়ী হবেন। আর কেউ না। আর আমি তার মূল্যায়নকারী হলে তিনি রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট স্কিল বাবদ "মাইনাচ ১০০" নম্বর পাবেন। ২য়ত, আপনি যে "পারর্মেন্সের" কথা বললেন, এইটাই আসলে কীওয়ার্ড। তার সৎ ও দক্ষ পারফর্মেন্সের জন্যই তাকে বেতন দেয়া হয় এবং আমরা ট্যাক্স দেই। এইসব ফাজলামির জন্য না। সততা ও দক্ষতার সাথে "পারফর্ম" করে "সার্ভিস" দিয়ে এবং আমার ট্যাক্সের পয়সা ১০০% হালাল করে ও ঐ ট্যাক্স-টাইম গালগল্প করা-বা-পড়ার পিছনে অপচয় না করে (এবং অতি অবশ্যই 'চাঁদের অমাবস্যার' পাছায় লাথি মেরে), বাসায় গিয়ে পরিবারকে সময় দিয়ে বা মনোমত কাজ করে ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে পরের দিন যিনি অফিসে আসবেন সময়মত ও পূর্ণোদ্যমে - আমার কাছে তিনিই ফুলমার্ক পাবেন। আমাদের ট্যাক্স-টাইম বা পাবলিক-টাইম তিনি আমাদের পিছনে ফুলটাইম সৎভাবে খরচ করলেই আমি খুশি হবো, ঐ তথাকথিত "সৎ সংস্কৃতিসেবী" (এবং ট্যাক্স-টাইম অপচয়কারী) জাহান্নামে যাক।
ডিসক্লেইমারঃ ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রমিত বিশেষন প্রয়োগসহ মন্তব্যের নামে বিশাল একখান নিবন্ধ ফেঁদে বসার জন্য দুঃখিত। কিন্তু কিছু সরকারী কর্মচারী আর কর্তাদের দুর্নীতি আর প্রতারণার শিকার হয়ে গত কয়টা মাস ধরে যে অমানুষিক যন্ত্রণাভোগ করছি, নাকানিচুবানি খাচ্ছি, যেভাবে হুমকি-ধামকিসহ অফিসপাড়ার অলিতেগলিতে - যেখানে দেয়াল-দরজা-ছাদ-ইট-কাঠ-পাথর থেকে শুরু করে ধূলিকনাটুকু পর্যন্ত সাপের মত জিহ্বা লক-লক করে টাকা-টাকা করে আর্তচিৎকার করে, বীভৎস শীৎকার তুলে, সেইখানে হাইকোর্ট তো কোন ছার চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র পর্যন্ত নাকে দড়ি বেঁধে দর্শন হয়ে যাচ্ছে এবং পরিণামে অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তাতে আমারই রক্তজল করা ট্যাক্সের পয়সায় তাদের "চাঁদের অমাবস্যা" পড়িয়ে 'পোমোচন' দেয়া হয় শুনলে গায়ে আগুন ধরে যায়। তাই এই মন্তব্যটা আনফর্চুনেটলি এত বড় হয়ে গেল। এটা এখানে কারও প্রতি ব্যক্তিগতভাবে করা নয়। আশা করি বিরক্ত পাঠকরা নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। সবশেষে বলবো, সরকারি বাকরিজীবীদের যদি প্রোমোশনের জন্য পরীক্ষা জাতীয় কিছু নিতেই হয়, তাহলে প্রতিমাসে "লাই ডিটেক্টর" টেস্ট নেয়া হোক। কিম্বা আরো ভালো হয়, পুরনো পদ্ধতির বদলে 'ব্রেইন স্ক্যানিং'-এর মাধ্যমে লাই ডিটেকশনের যে সর্বাধুনিক পদ্ধতি বেরিয়েছে - সেগুলি প্রবর্তন করা হোক। এবং পরীক্ষাগুলি টেলিভিশনে লাইভ প্রচার হোক।
****************************************
মাঝি ভাই, যন্ত্রনাটা বুঝতে পারছি। সরকারী অফিসের অনিয়মের মাত্রা সম্পর্কে বলে কিছু হয় না। গ্রন্থালোচনার বিষয়টি নতুন সংযোজন। প্রমোশনে এটি কতটা কী এখনো জানি না। তবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কিন্তু চলমান কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেখানে এটা একটা অংশ কেবল।
আর দুর্নীতির বিপরীতে সরকার থেকে শুরু করে কারোরই কোনো মাথাব্যাথা নাই। আমরা এ বিষয়টাতে একরকম অভিযোজিত হয়ে পড়েছি বলা যায়। আমারও এ সম্পর্কিত কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আপনার সাথে সহমর্মী হওয়া ছাড়া কিছু বলার নাই।
আপনার আর মেঘলার আলোচনা আমাকে ভিষণভাবে ঋদ্ধ করলো। যদিও নিজেকে কিছুটা ভূত ভূত লাগছে। বিভিন্ন সময় এসব প্রস্তাব এড়িয়ে গেলেও এতো গভীরে চিন্তা করিনি আগে। অনেক ধন্যবাদ দুজনকেই।
স্বয়ম
মেঘলা মানুষের প্রথম মন্তব্যটি পড়ে কেন যেন এই অপ্রাসঙ্গিক পোস্টের পলিসি মনে পড়ে গেল...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
পোস্টটা পড়ে এলাম। সাক্ষীদা আপনার মন্তব্যটা এক্ষেত্র বুঝিনি বলতে হবে। এ লেখা বা তার মন্তব্যের সাথে ওই পোস্টের পলিসি ইস্যুটা কীভাবে প্রাসঙ্গিক একটু বুঝিয়ে বলবেন?
স্বয়ম
লেখা পোস্টানোর দিন "সে আইসা ধরলো, আমি লেইখা দিতে হবে, আর সে ওইটা প্রেজেন্ট করবো" অংশটা দেখেই মনে হয়েছিল। তখন লগাইতে পারি নাই। লগানোর পরে দেখি মেঘলা মানুষের চোখেও ঠিক ঐ অংশটা পড়েছে। হ্যাঁ, আপনার ব্যাখ্যাও পড়েছি- তাই অপ্রাসঙ্গিক বলা।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আমি কিন্তু কোনো পলিসিতে যাই নাই। কোনো ব্যাখ্যা দেয়ারও চেষ্টা নাই। বিষয়টা এতো গভীরভাবে ভাবি নাই এ স্বীকারোক্তি দিতে আমার দ্বিধা নাই। পাশাপাশি খচখচানিটা ছিল নিজের মধ্যে তাও বলেছি।
মেঘলা ও মন মাঝির আলোচনা থেকে অনেক কিছু স্পষ্ট হলো, যা আমার কাজে লাগবে নিঃসন্দেহে। এ কথাও উপরে বলেছি সম্ভবত।
একটা অপরাধে সহায়ক হিসেবে বেখেয়ালে কাজ করেছি বোঝার পর তা নিয়ে অহেতুক আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর এ কাজটা সম্ভবত করছিও না। এ কারণেই ওই পোস্ট ও তার মন্তব্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি তখন। এখন স্পষ্ট হলো। তাই নিজ অবস্থান পরিষ্কার করতেই কথাগুলো বলা। যা হোক, পোস্টে আপনার মন্তব্য সব সময়ই আমার কাছে বিশেষ কিছু। যদিও মূল পোস্ট সম্পর্কিত কোনো মন্তব্য না করায়, ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনি পুরো পোস্টটি পড়েছেন কিনা। আর পরের কিস্তি দেয়াটা ঠিক হবে কিনা তাও বুঝতে পারছি না। ভালো থাকবেন।
স্বয়ম
আমি মন্তব্য করার আগেই নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে দেয়া আপনার বক্তব্য আমার ভাল লেগেছে বলেই আর কথা বাড়াই নি। এই লেখাটা পোস্টানোর দিনই ঐ পোস্টের সাথে মিলটুকু মনে এসেছিল। সত্যি বলতে কি, সেদিন প্রথম অনুচ্ছেদের পর আর এগোই নি। আপনার ভাষার গাঁথুনি নিয়ে কিছু বলার নেই। লেখা নিয়ে আপাতত কিছু বলছি না, কারণ চাঁদের অমাবস্যা পড়া নেই। পড়ে নিয়ে আবার আসব। ভাল থাকুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সময় থাকলে পড়ে ফেলুন। ভালো লাগবে আশা করি। তারপর না হয় আলাপ করা যাবে।
স্বয়ম
সত্যি, মেঘলা মানুষের প্রথম মন্তব্যটি পড়ে আপনার এই মনে পড়া দেখে আমারও কেন যেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে গেল যে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় যেই ত্রূটিটি রয়ে গেছে তাহল আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রমে কার্যকারনপ্রকাশশক্তিকে ওভাররাইড করে স্মৃতিশক্তির ওপর এত বেশি জোর দেয়া হয় যে কেন যেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের জটিল সব ইউয়ারেল মনে পড়ে যায়, কিন্তু কেন যেন সেগুলি এমন অপ্রাসঙ্গিকভাবে কেন মনে পড়ে সেটা আর মনে পড়ে না। আর আমারও কেন যেন ততোধিক অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই কথাটা মনে পড়ে গেল, সেটা আর মনে পড়ছে না!
****************************************
হুম্মাঙ্কাদের্চৌদ্রির্ভাষাছাইড়া, কিকৈবার্চানপষ্টকৈরাকন্দেহি?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে, রঘুরাজ???
****************************************
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
চাঁদের অমাবশ্যা। এই উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে বরাবরই ভালো লাগে। কাহিনীর অসাধারণ উপস্থাপন, চরিত্রের রুপায়ন ও প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ আমাকে মুগ্ধ করে। এই পোষ্টের মন্তব্যগুলোও মজার।
লেখনীর জন্য ধন্যবাদ।
অসংখ্য ধন্যবাদ পাঠ ও মন্তব্যের জন্য। শুভেচ্ছা জানবেন।
স্বয়ম
নতুন মন্তব্য করুন