এখন সে কতো রাত;
এখন অনেক লোক দেশ-মহাদেশের সব নগরীর গুঞ্জরণ হ'তে
ঘুমের ভিতরে গিয়ে ছুটি চায়।
পরস্পরের পাশে নগরীর ঘ্রাণের মতন
নগরী ছড়ায়ে আছে।
কোনো ঘুম নিঃসাড় মৃত্যুর নামান্তর।
অনেকেরই ঘুম
জেগে থাকা।
নগরীর রাত্রি কোনো হৃদয়ের প্রেয়সীর মতো হ'তে গিয়ে
নটীরও মতন তবু নয়;-
প্রেম নেই- প্রেমব্যসনেরও দিন শেষ হ'য়ে গেছে;
একটি অমেয় সিঁড়ি মাটির উপর থেকে নক্ষত্রের
আকাশে উঠেছে;
উঠে ভেঙে গেছে।
কোথাও মহান কিছু নেই আর তারপর।
ঘড়িতে যখন রাত সাড়ে তিনটা, তখন ভূপৃষ্ঠের ৭০০০ হাজার ফুট উচ্চতায় ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কম্বলের নিচের আরামদায়ক শীতনিদ্রা থেকে উঠা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। না হয় কষ্ট করে উঠাই গেল, কিন্তু বাথরুমে গিয়ে যদি দেখা যায় গিজার নষ্ট তখন সেই কঠিন কাজটাই অসম্ভব হয়ে যায়। সেই অসম্ভবকেও সম্ভব করে তিন প্রস্থ গরম কাপড়ে শরীর মুড়িয়ে জীপ গাড়িতে উঠে যদি জানা যায় আরও ১০০০ হাজার ফুট উপরে উঠতে হবে এবং সেখানে খোলা ময়দানে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করতে হবে তখন মনে হতেই পারে - ধরণী দ্বিধা হও, আমি জাম্প দেই। সমতলের মানুষ আমি। ঢাকা নামক এমন এক শহরে বাস করি সেখানে কবে শীত আসে আর কবে যায় সেটা বুঝতেই কষ্ট করতে হয়। সেই আমার জন্য এমন উচ্চতা কিংবা এমন শীত সত্যিই মেনে নেওয়া কঠিন। মাঝ নভেম্বরেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে জানুয়ারির তীব্র শীতে কি হয় খোদাই মালুম।
জীবনে প্রথমবারের মত দেশের বাইরে ঘুরতে বেড়িয়েছি। আজন্ম লালিত সাধ হিমালয় দেখব। নেপাল যেহেতু যেতে পারছি না তাই ধারেকাছে দার্জিলিংই ভরসা। এভারেস্ট না দেখি, কাঞ্চনজঙ্ঘা তো দেখা যাবে। সেই অভিলাষেই ভোররাতে টাইগার হিলের পানে যাত্রা। নিশুতি রাতে রাস্তায় জনমানুষ নেই। আমাদের মতন কিছু অভিযাত্রী একই উদ্দেশ্য নিয়ে একই গন্তব্যের পানে ছুটে চলেছে। চলার পথে ঘুম নগরী অতিক্রম করবার সময় গা টা শিরশির করে উঠল। কতই না শুনেছি এই নগরীর নাম। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত এই নগরীকে কেমন জানি মৃত মৃত লাগছিল। হয়তবা এই জন্যেই জীবনানন্দ মনের মুকুরে উঁকি দিয়েছিলেন।
ঘুম রেলস্টেশন অতিক্রম করছি যখন তখন আনন্দের দোলাচলে মন নেচে উঠেছিল। দার্জিলিংয়ের যে কয়টি জায়গা দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি এই স্টেশন তার অন্যতম। ঘুমে আমরা বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির দেখেছি, বাতাসিয়া লুপ দেখেছি, টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখেছি। কিন্তু আমাকে সবথেকে বেশি আপ্লুত করেছে ঘুম রেল স্টেশন। যতটা না সৌন্দর্যের জন্য, তার থেকেও বেশি এই স্টেশনের ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য। টাইগার হিল কিংবা বৌদ্ধ মন্দিরের গল্প না হয় আরেকদিন বলব। আজ ঘুম স্টেশনের গল্প বলি।
ব্রিটিশরা তাদের অবকাশযাপনের জন্য শহর দার্জিলিংয়ের পত্তন ঘটিয়েছিল। কিন্তু সেখানে যোগাযোগের ঝক্কি ছিল মেলা। কলকাতা থেকে দার্জিলিং যেতে ৫-৬ দিন সময় লাগত। Darjeeling Himalayan Railway স্থাপনের পর এই সময় নেমে আসে ২ দিনে। এখন সময় লাগে ১৬-১৭ ঘণ্টা। কলকাতা থেকে প্রথমে ১০ ঘণ্টা ট্রেন ভ্রমণ করে নিউ জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে টয় ট্রেনে চড়ে ৬-৭ ঘণ্টায় দার্জিলিং। এই টয় ট্রেন দারুণ এক জিনিস। খুব ইচ্ছে ছিল টয় ট্রেনে ঘুরব কিন্তু সময় করতে পারি নি, বাইরে থেকে দেখেই সাধ মিটিয়েছি। ভূমিধ্বসের কারণে যদিও শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর টয় ট্রেন যাত্রা আপাতত বন্ধ, তারপরেও আগ্রহী ব্যক্তিগণ কাশিয়াং থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত টয় ট্রেনে ভ্রমণ করে সেই শখ মেটাতে পারেন।
ঘুম রেলওয়ে স্টেশন হচ্ছে Darjeeling Himalayan Railway’র সর্বোচ্চ পয়েন্ট। ১৮৮১ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় এই স্টেশন স্থাপন করা হয়। তখন পর্যন্ত এটিই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার রেলস্টেশন। বর্তমানে এটি ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন এবং পৃথিবীর ১৪তম উচ্চতম রেলস্টেশন।
স্টেশনটা চমৎকার। খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একরত্তি ময়লা নেই কোথাও।
এই স্টেশন বর্তমানে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। হয়ত এই কারণেই এত পরিচ্ছন্নতা। এই স্টেশনে বসে এককাপ কফিপানের ইচ্ছে থাকাটা নিশ্চই দোষনীয় নয়। দুঃখ হচ্ছে, এত সকালে স্টেশন ছিল বন্ধ, কোন কফিওয়ালাকেও পাই নি। এই রেলপথে বর্তমানে স্বল্প পরিসরে ট্রেন চলাচল চালু আছে পর্যটকদের জন্যই। সেই সাথে আছে ঐতিহ্যের প্রতি এখানকার অধিবাসীদের ভালোবাসা এবং ভারত সরকারের ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদ।
ঘুম রেলস্টেশনের বিপরীতে ঘুম জাদুঘরের অবস্থান। খুব ইচ্ছে ছিল জাদুঘরটা ঘুরে দেখব, কিন্তু সকাল ১০ টার আগে খুলে না বিধায় ভেতরটা দেখা হয় নি। বাইরের বাগানে রাখা ছিল Baby SIvok. এটা হচ্ছে প্রথম ইঞ্জিন যা কি না ১৮৮১ সালে টয় ট্রেন উদ্বোধনের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। আপাতত শুধু এটুকু দেখেই শখ মিটাতে হল।
ঘুম এর দূরত্ব দার্জিলিং থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার। ঘুম থেকে ২ কিলোমিটার যাওয়ার পর বাতাসিয়া লুপে রেলপথ পুরো একটা চক্কর দিয়ে ১০০০ ফুট নিচে দার্জিলিং এর দিকে নেমে গেছে। এইখানে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন যুদ্ধে যেসকল গোর্খা সৈনিক নিহত হয়েছেন তাঁদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে এটি ঘুমে’র অন্যতম দর্শনীয় জায়গা।
এখান থেকে দার্জিলিং শহরটা দারুণ দেখায়। ৩০ রুপির বিনিময়ে দূরবীন দিয়ে শহর পরিদর্শনের ব্যবস্থা আছে। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখা দেয়। নভেম্বর মাসে পুরো আকাশ থাকে মেঘ আর কুয়াশার দখলে। তাই অনুমিতভাবেই আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পারি নি। এপ্রিল-মে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস দার্জিলিং ঘুরবার জন্য চমৎকার সময়। এই সময়টাতে তাপমাত্রা যেমন থাকে সহনীয় তেমনি আকাশও থাকে পরিষ্কার। কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন মাঝে মাঝেই দেখা দেন। ভাগ্য ভাল থাকলে মাউন্ট এভারেস্টের দেখাও মেলে।
বাতাসিয়া লুপে বৃত্তাকার ট্রেনলাইনের ছবি তুলব ভেবছিলাম। কিন্তু রেললাইনই কোথায়? কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে বুঝলাম শীতের কাপড়ের নিচে ঢাকা পড়েছে ট্রেনের লাইন। লাইনের উপর হরেক রকম শীতবস্ত্রের পসরা সাজিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ দোকানীরা। মনের মত ছবি পেলাম না। তাই উইকি থেকে ধার করেই না হয় একটা ছবি দেই।
Darjeeling Himalayan Ralway তে শুটিং হয়েছে বিখ্যাত অনেক সিনেমার। এর মাঝে যেমন আছে হিন্দি Aradhana, Barfi, Parineeta; তেমনি আছে হলিউডের The Darjeeling Limited. সত্যজিৎ রায় তাঁর কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমার শুটিঙও করেছিলেন দার্জিলিঙয়েই।
ঘুম থেকে যখন ফিরছি ততক্ষণে শহরটার ঘুম ভেঙেছে। রাত্রির সেই ঘুমন্ত নগরীর পথে পথে প্রাণচাঞ্চল্য। এবারের গন্তব্য কালিম্পং। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এবং গাইড ছিলেন পুষ্কর নামের এক যুবক। ইংরেজিতে অনার্স করা পুষ্কর নেপালে ৪ বছর শিক্ষকতা করে এখন নিজের ব্যবসা দেখছে। খুব রোম্যান্টিক এবং রসিক চরিত্রের নিপাট ভদ্রলোক। আমরা যখন কালিম্পংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি তখন সে কিশোর কুমারের Mere Sapno Ki Rani গানটা ছাড়ল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই হেসে জানাল, ১৯৬৯ সালে Aradhana সিনেমার এই গানের শুটিং এই ট্রেনলাইনেই হয়েছে। আমরাও গানের আবেশে চোখ মুদলাম। জীবনটা আসলেও মন্দ নয়।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
মন্তব্য
'দ্য দার্জিলিং লিমিটেড' সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ কিন্তু দার্জিলিং জেলায় হয়নি বলেই মনে হয়। সিনেমাটি দেখে এবং সেই জেলার বাসিন্দা হিসেবে আমার অন্ততঃ তাই ধারণা।
মুভিটা দেখা হয় নি তাই সঠিক বলতে পারছি না। তবে দার্জিলিং সম্পৃক্ত মুভিগুলোর তালিকায় এর নাম আছে।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আপনার ধারণা সঠিক। উইকি জানাচ্ছেঃ
Locations: Much of the film was shot in Jodhpur, Rajasthan. The Himalaya scenes were shot in Udaipur, and the opening scene of the film was also shot on the streets of Jodhpur. The International Airport shown near the end is the old terminal building of Udaipur Airport. The scenes set in New York were shot in Long Island City.
ভালো লাগলো লেখাটি ।
সুদীর্ঘ ১২ বছর আগের কথা মনে পড়ে গেলো ।
আমারও প্রথম বিদেশ ভ্রমনের হাতেখড়ি এই শিলিগুড়ি, দার্জ্জিলিং দিয়েই ।
অবশ্য সেটা ছিলো নেপালে যাবার ট্রানজিট ভিসার সুবাদে মুফতে পাওয়া ৩ দিনের ফাঁকে ।
মাত্র তো বিদেশ ঘুরা শুরু করলাম। প্রথম যে কোন কিছুরই আবেদন মনে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সে হিসাবে দার্জিলিং আমার মনে বিশেষ অবস্থান নিয়ে থাকবে।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
ঘুম স্টেশনের বেঞ্চে শুয়ে একদান ঘুম দিয়ে ওঠার খায়েশ আমার অনেকদিনের। কিন্তু হয়নি এখনো। প্ল্যান করছি আগামী বছর যাওয়ার
লেখা ভালো লাগছে, পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভাল কথা বলেছেন। এর পরেরবার গিয়ে ঘুম স্টেশনে একদান ঘুম দিতেই হবে।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
অনেক ভালো লাগলো
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
বইয়ের বদৌলতে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং এই সবই চেনা। যদিও এখনো যাওয়া হয়নি।
লেখা ভালো লাগলো।
স্বয়ম
ধন্যবাদ। ঘুরে আসুন, নিশ্চিত করে বলছি ভাল লাগবে।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
এতবার গেছি। পুরানো হয়না। লেখা ভাল লাগল।
-----------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
ঘুমে আপনার সাথে ঘুরে আসলাম, ধন্যবাদ
গুডরিডস
ছবি দেখে কি আর প্রকৃত মজা অনুভব করতে পারবেন? সম্ভব হলে ঘুরে আসুন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন