১.
কিছু গল্পের জন্ম বইয়ের পাতায় থাকার জন্য নয়, মুখে বলার জন্য।
৩.
দাদী নানী নেই, মা গল্প তেমন বলেননি, তবে কি আমি গল্প বেশি শুনিনি? না তা নয়। আমার পাশের ঘরের দাদী প্রচুর গল্প বলতেন। তবে তা বেশিরভাগই নবী-রাসুলদের জীবনী থেকে। ঘুমানোর সময় আমার ফুপুরা গল্প বলতেন। তারা অনেক ধরণের গল্প বলতেন। দেশি রূপকথা। বিদেশী রূপকথা। পাশের ঘরের দাদীর থেকে শিখে আসা নবী রাসুলদের জীবনী। আমি এক গল্প বারবার শুনতে চাইতাম না। তাই তারা বানিয়ে গল্প বলতেন। জানা গল্পের খানিকটা পরিবর্তন করে দিতেন। আবার এখান থেকে একটু, ওখান থেকে একটু মিলিয়ে নতুন অনেক গল্প বানিয়ে ফেলতেন। আবার হয়তো আমাকে শুধরানোর জন্য আমার একটা কুকর্ম কোনও অন্যচরিত্রের কুকর্মের পরিণামের সাথে মিশিয়ে বলতেন।
তবে আমার ঝুলি রূপকথায় পূর্ণ করার কাজটা করেছিল সম্পূর্ণ অন্য কেউ। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম থেকে একটা মেয়েকে বাসার কাজে সাহায্য করার জন্য আনা হয়েছিল। মেয়েটার কিছুদূর পড়াশুনা ছিল। চিঠি লিখতে ও পড়তে পারতো। ও গ্রামে থাকতে সন্ধ্যা হলে ওর নানীর কাছে প্রচুর গল্প শুনতো। দলবেঁধে পুঁথি শুনতো। ঢাকা এসে সেসবের স্মৃতিচারণ করতো। আমার আগ্রহ ওর স্মৃতিতে ছিল না, ছিল ও কী কী শুনতে পেত তাতে। ওর তেমন কোনও ক্লান্তি ছিল আমাকে গল্প বলাতে। ঠাকু'মার ঝুলির নীলকমল-লালকমল থেকে শুরু করে চম্পাবতীর পুঁথি পর্যন্ত। তবে ওর গল্প বলায় লালকমল শুধু নখের বদলে তরোয়াল এবং থুথুর বদলে প্রদীপের গরম ঘি ছিটিয়েই ক্ষান্ত হতো না। আরও নানাবিধ অঙ্গ প্রদর্শন করতো। চুলের বদলে দড়ি। পিচুটির বদলে ইয়া বড় (হাত দিয়ে দেখাতে হবে) চুনের বল এবং ইত্যাদি।
কিছু গল্পের জন্মই আসলে মুখে বলার জন্য, রং চড়িয়ে বলার জন্য।
৪.
বেইলীরোডের সাগর পাবলিশার্স থেকে সেদিন বগলদাবা করলাম শ্রী দক্ষিনণারঞ্জণমিত্র মজুমদারের "ঠাকু'মার ঝুলির" শতবর্ষ সংস্করণ। নীল কাপড়ে বাধাই করা। উপরে সোনালী রংয়ে লেখা। ট্রান্সপারেন্ট একটা প্যাকেটও রয়েছে। সে প্যাকেটে আবার রূপালী রংয়ের লেখা।অনেকে কাছে হয়তো মনে হতে পারে এসথেটিক সেন্স তেমন ভাল নয়। তবে আমার ধারণা ভিন্ন। বইটার চেহারা এমন যে সোজাসুজি স্বর্ণ-রূপায় চকমকে রাজার দেশ হতে আমার হাতে এসে পড়েছে। এছাড়াও আছে ছবি এবং শতবর্ষ পুরোনো মুদ্রণ শিল্পের নমুনা- পেজ সেটআপ, ফ্রেমিং, ছবি এসবে। বইটা যদি চাইনিজ ভাষায় লেখা থাকতো তবুও মনে হয় কিনতাম। কিছু বই না পড়ে শুধু হাতে ধরে থেকে এবং গন্ধ শুঁকে পয়সা উসুল হয়ে যায়।
৫.
বই বিষয়ক আলোচনায় বইকেই ভুলে গেছি দেখছি। এই বইয়ের গল্পগুলো তিন ধরণের। তাই তিনভাগে সাজানো। "দুধের সাগর", এখানে মানুষই দুষ্ট ষড়যন্ত্রকারী। তাদের ষড়যন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে রাজপুত্র এবং রাজকন্যাদের জয় অনিবার্য। "রূপ তরাসী" অংশে রাক্ষসদের প্রাণ-নাশ করে রাজপুত্ররা রাজকন্যা এবং রাজত্ব নিয়ে রাজ করবেই। "চ্যাং ব্যাং"-এ এত রাজকীয় চাকচিক্য নেই, তবে যতই চালাকি কর না কেন শুভ ইচ্ছারই জয় হবেই। সবগুলো অংশের আগে অংশগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী এক খানা ছড়া। বইয়ের শুরুতে বইয়ের প্রতিনিধিত্বকারী ছড়া। বই শেষে বেশ কিছু শেষ হবার ছড়া। চিরকালীন বাংলার রূপকথার আবহ এই নীল মলাটে।
৬.
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল শতবর্ষ আগে। বইয়ের গল্পগুলো চিরকালীন। তাই বলে ভাষারীতি এবং বানান রীতি চিরকালীন হবে এমনটি নয়। বানান রীতি সংস্কারে প্রকাশকদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। এটি ধর্মগ্রন্থ নয় যে বানান রীতি সংস্করণে কিছু খোয়া যাবে। আর ধর্মগ্রন্থও সংস্কার করা হয়। সেখানে ভাষারীতি ও বানান-রীতি সংস্কারের অভাবে বইটির নতুনদের সাথে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এমনিতেই গল্প বলার মানুষের বড্ড অভাব। বইয়ের সাথে আর দূরত্ব বেড়ে গেলে কি আসলেই গল্পগুলো চিরকালীন থাকবে?
৭.
বোকাদের জন্য রূপকথায় বসবাস সহজ। আমি মানুষটা বড্ড বোকা। ছোটবেলায় আরও বোকা ছিলাম। অরুণের তরোয়ালে মরচে ধরার মত, বরুণের ধনুকের তীর আগা খসের পড়ার মত আমিও সাতদিনের জন্য বেড়াতে যাবার আগে আমার ছোটবোনকে একখানা প্লাস্টিকের পুতুল দিয়ে বলেছিলাম এটার গলা ভেঙ্গে গেলে বুঝতে পারবে আমার গলাও ভেঙ্গে গেছে! আমার বোন অতীব লক্ষী। অন্য ছোটবোনেরা হলে পুতুলের গলা ভেঙ্গে চেষ্টা দিয়ে দেখতো কিছু হয় কিনা। কিন্তু সে ভয়ে ভয়ে সে পুতুল দিয়ে খেলার ঝুঁকি না নিয়ে বাক্স বন্দি করে রেখেছিল।
রূপকথায় বসবাস দীর্ঘজীবী হোক। সকল শিশু রূপকথায় বসবাসের সৌভাগ্য লাভ করুক।
[গানশুনুনঃ https://soundcloud.com/arian-arif/ll-aj-rate-kono-rupkotha-nei, তবে আমার রূপকথা আজও আছে, আমার চাঁদের বুড়ি আজও চরকা কাটে ]
-----------------------------------------------------------
নাবিলা
মন্তব্য
ঠাকু'মার ঝুলি অরিজিনালটা আমার কখনো ছিল না। তবে আমার না থাকলেও সেটা যোগাড় করে পড়াটা কোন ব্যাপার ছিল না। আমার ছিল ঠাকু'মার ঝুলি'র একটা লোকাল সংস্করণ - ইয়াম্মোটা, চোষকাগজের, বীভৎস ড্রয়িং, আকারে ছোট। সেখানে যা গল্প ছিল সেগুলো ঠাকু'মার ঝুলি, আরব্য রজনী, পারস্যোপকথা, শাহ্নামেহ্, মসনবী, মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ, গ্রীম ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি সব জায়গা থেকে যোগাড় করা। সেখানে কিছু গল্প ছিল বেশ 'ইয়ে'। ঐ বয়সে সেগুলো পড়ে মাথা ঘুরে যাবার দশা!
আপনি লুকখ্রাপ! শেষে ওল্ড স্কুলের গানটা দিয়ে মেরে দিয়েছেন।
কে রে তুই, কেরে তুই, সব সহজ শৈশবকে
বদলে দিলি কিছু যান্ত্রিক বর্জ্যে
তুই কে রে, তুই যত বিষাক্ত প্রলোভনে
আমায় ঠেলে দিলি কোনো এক ভুল স্রোতে
চোষ কাগজের বইয়ের কথা প্রথম শুনলাম!
আরে 'চোষকাগজ' মানে নিউজপ্রিন্ট! ঐ আমলে সাদা কাগজ ছাড়া আর সব কাগজ, বিশেষত যেগুলোতে ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা যেতো না তার সবগুলোকেই আমরা চোষকাগজ বলতাম।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
:)
আমার ছোটবেলার ‘ঠাকুরমা’র ঝুলি’র গল্পগুলো একদম চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল আবার।
দেবদ্যুতি
:)
দাদা, দাদী দুজনকেই কাছে পেয়েছিলাম ছোট বেলায়। তাদের মুখে নানান গল্প শুনতাম। কাজল রেখা, শিয়াল পন্ডিত, সূচ রাজপূত্র, আরো কতো গল্প। ছোট দের একটা জগত থাকে আলাদা, কল্পনার জগত। সব সম্ভবের জগত। দুষ্টের দমন ,ভালর জয়। সত্যজিৎ রায়ের সুজন হরবোলা আর, সুকুমার রায়ের নানান গল্পও পড়তাম, আর ছিল ঈশপের গল্প। ঠাকুমার ঝুলির নানান রঙ্গিন ছবি আঁকা গল্প গুলো আমার শৈশব গুলো আনন্দে ভোরে দিত। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
ইসরাত অমিতাভ
আপনি ভাগ্যবান। গ্র্যান্ড প্যারেন্টসদের সান্নিধ্য পাওয়া লোকজন দেখলে হিংসা হিংসা লাগে।
ঠানদিদির থলে আর দাদামশাইয়ের থলে বইদুটো কি এখন কোথাও পাওয়া যায়?
তা তো জানি না। বেইলী রোডের সাগর পাবলিশার্সে দেখতে পারেন। না থাকলেও সাগর পাবলিশার্স ইন্ডিয়ান বইগুলো আনিয়ে দেয়। যদিও আমি কখনও আনাইনি।
কী সুন্দর লেখা!
ঠাকুরমার ঝুলি কখনো পুরানো হয়না।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন