মক্কার মানুষ যে হজ্জ পায় না, এই প্রবাদের অর্থ বুঝলাম যখন আমার সদ্য প্রবাসী বন্ধু জিগ্যেস করে লন্ডনের কোথায় কোথায় গেছি। কিছুক্ষন ভেবে ঘুরায়েপ্যাঁচায়ে উত্তর দিই যে এইত গেছি আর কি সবখানেই। ডাঁহা মিথ্যা কথা! এই শহর বিশাল বড়, তারচে বড় আমার আলস্য। কতবার যে জোশ উঠেছিল যে এবার যাব খালি উইকেন্ড এসে নিক; কিন্তু ঐ পর্যন্তই, তাই সাড়ে পাঁচ বছরেও আসলে বেশি কোথাও যাওয়া হয় নাই। আর মূল কথা হল যে এসব জড় বস্তু তো আর ভেগে যাচ্ছে না, দেখা যাবেখন। আর আমার কাজকর্ম স্টপ এন্ড গো স্টাইলের; সে হোক না ঘোরাঘুরি। তাই আমি মোটেও ভালো সফরসঙ্গী না, একেবারে নিচুস্তরের। কিন্তু বন্ধুবর শুরু থেকেই প্ল্যান করে বসে আছে যে ও লন্ডন গেলে আমার সাথেই যাবে।
আমি থাকি সোয়ানসি আর ও কার্ডিফ। সেই অস্ট্রেলিয়া বধ মহাকাব্যের কার্ডিফ! টিকিট কাটা ছিল হিসাব করে তাই দুজন এসে উঠলাম একই বাসে। আমাদের সেই নটরডেমের দিনগুলি থেকে ফেসবুকে জানাশোনা কিন্তু কে জানতো প্রথম দেখা হবে এই ভিনদেশে এসে! আমার আবার চলন্ত কিছুতে উঠলেই ঘুম পায় তাই ঘুম, খাওয়া আর কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণাতে কখন যেন কেটে গেল অন্যসময়ের আপাত মহাবিরক্তিকর বাসজার্নি। যাই হোক আরো ১ ঘন্টা ট্রেনে বসে থেকে অবশেষে বাসায়। রাত বেশি দেখে এদিন কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। খেয়েদেয়ে বিছানা পেতে তাই সবাই আড্ডায় জমে গেলাম।
ইচ্ছা ছিল যত সকালে পারা যায় বের হওয়া, কিন্তু সব ইচ্ছা পূর্ণ হলে তো হতোই! বের হলাম তাই সেই সাড়ে এগারোটায়। এক্কেবারে বিচ্ছিরি ওয়েদার! টিপটিপ বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ, আর ঠাণ্ডা। শীতকালে এরচে ব্রিটিশ ওয়েদার পাওয়া অসম্ভব! প্রথম গন্তব্য টাওয়ার অফ লন্ডন। প্রায় সহস্র বছরের পুরোনো এই দুর্গ কয়েদখানা, অস্ত্রশালা, রাজকীয় বাসবভন, ট্রেজারি; কি না কাজে ব্যবহৃত হয়েছে! আর এখানেই এখন রাখা আছে ভারতবর্ষ থেকে চুরি(!) করে আনা কোহিনূর।
টাওয়ার অফ লন্ডন। সামনে আইস স্কেটিং এরিয়া; টাকা খাবার ধান্দা আর কি।
ব্রিটিশদের সবকিছু নিয়ে খালি ব্যবসার ধান্দা! কিছু জাদুঘর বাদে এখানে ফ্রি কিছু নাই। আমাদের মতন গরীব স্টুডেন্টের পক্ষে তাই ২০ পাউন্ড দিয়ে টিকিট কেটে টাওয়ার অফ লন্ডন এর ভেতরে যাওয়া একটু বেশি হয়ে যায়। বাইরে থেকে দেখাই তাই সই। এর ঠিক পাশেই টেমসের উপর টাওয়ার ব্রিজ। এই এক নদীর উপর দিয়ে এরা দুনিয়ার ব্রিজ বানিয়ে রেখেছে; উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে দুশোরও বেশি! আমার বহুদিনের শখ এর নিচ দিয়ে বোট যাওয়া দেখবো তাতে ড্র ফাংশনটা দেখা যেত। এই শখও মনে হয় সহজে পূরণ হবার না।
টাওয়ার ব্রিজ
টাওয়ার ব্রিজ ও কুয়াশাচ্ছন্ন লন্ডন স্কাইলাইন প্যানোরামা
পরবর্তী গন্তব্য বিগ বেন আর পার্লামেন্ট ভবন। ভেতরে যাবার কোনো ইচ্ছা ছিল না। সবাই ঐ ঘন্টা দেখতে যায় তাই আমারও যাব আর কি। নদীর পাঁড় ধরে হেঁটে বাক ঘুরলেই আর বেশিক্ষন লাগার কথা না। তাই আমাদের ইচ্ছা ছিল হেঁটেই যাবো, এ আর এমন কি! কিন্তু বাস্তব পুরো উল্টো; হাঁটতে হাঁটতে কাহিল কিন্তু বিগ বেনের দেখা নাই। শেষমেশ গুগল ম্যাপের পরামর্শে জানলাম যে ৫০ মিনিটের হাঁটাপথ। আর এতটা পথ এসে আবার বাসে ওঠার কোনো যুক্তি নেই বিধায় বাকিপথটা পদব্রজেই পাড়ি দেয়া সমীচীন মনে হল।
পথিমধ্যে কোনো এক পানশালার দুয়ারে
দ্য গোল্ডেন হিন্ড; রণতরী ও পরে রূপান্তরিত বানিজ্য জাহাজ
ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের উপর থেকে লন্ডন আই। ভিরমি খাবার মতন টিকিটের দাম আর অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীর লাইনের কথা বলাই বাহুল্য।
দুদিনের জন্য লন্ডনে আসা বন্ধুর লন্ডন শহর সম্পর্কে জানাশোনার কাছে আমি ফেল মারলাম এবার। আমার জানা ছিল না যে পার্লামেন্ট ভবন থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে (চার্চ অফ ইংল্যান্ড)। এই জায়গাটা একটু বেশিই বিখ্যাত। স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধি, সব রাজারাণীর সমাধি, রাজকীয় বিয়ের কমিউনিটি সেন্টার; কত কিছু যে হয় এখানে!
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ১
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ২
স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধি দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা ছিল সবার মধ্যে। এই একটা জায়গায় টিকিট করার ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু বিধি বাম। ভিজিটরস আওয়ার ততক্ষণে পার হয়ে গেছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে রওয়ানা দিলাম রাণীর বর্তমান বাসবভন আর কার্যালয় বাকিংহাম প্যালেসের দিকে।
বাকিংহাম প্যালেস প্যানোরামা। ভাই আর বন্ধু ওদের মোবাইলে আর আমার ছবির ফ্রেমে আটকে গেছে।
সবাই দেখি গেটের ফাঁকে উঁকি দিয়ে কাকতাঁড়ুয়ার মতন দাঁড়িয়ে থাকা রাণীর গার্ডদের দেখছে আর পটাপট ছবি তুলছে; দেখাদেখি আমরাও গিয়ে জমে গেলাম। এতদিন জানতাম তেনারা লাল কোট পরেন। কিন্তু এদিন দেখি ধূসর; গুগল বলে ইহা শীতকালের পোশাক। মাঝে মাঝে গা গরম করার জন্যই কি না নিজের পোস্ট ছেড়ে মার্চ করে আসে। আর বাকি সময় সেই আগের মতন নট নড়ন চড়ন। এটা কোনো চাকরি হলো!
এতক্ষণের হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে বসে থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে এবার খানাপিনা করা দরকার। যাবার পথে দেখি ভিন্টেজ ক্লাসিক গাড়ি থেকে কালো পোষাক পরা মানুষ নামছে। কেমনে কি! পাশেই গ্রিন স্ক্রিন দেখে বুঝলাম যে উজবুকের মতন আমরা কর্ডন করা দেখেও শুটিং এর জায়গায় ঢুকে গেছি। মোটিভেটিং ফেক্টর ক্ষিদা হলে আর কিছুই মাথায় থাকে না, তাই অন্তত কিসের শুটিং হচ্ছে তা একবারো জিগ্যেস করার কথা কারো মনেই হয়নি।
হার ম্যাজেস্টি’স থিয়েটার
কর্নেলের মুরগির দোকানে উদরপূর্তি ও কর্নেলের জন্য অনেক দোয়া করার পর গেলাম সুভেন্যির শপে। কেনাকাটা শেষে গেলাম ঠিক পাশের পিকাডেলী সার্কাসে।
পিকাডেলী সার্কাস। বেরসিক ট্রাফিক লাইট যে ছবিতে বাগড়া দিচ্ছে সে খবর কে রাখে।
নিউ ইয়র্কের যেমন টাইমস স্কয়ার তেমনি লন্ডনের পিকাডেলী সার্কাস। বিজ্ঞাপণী বোর্ডের আলোতে ভয়াবহ আলোকদূষণ! ভাগ্যিস যে সবগুলো শুধু এক বিল্ডিঙে। পাশেই বিখ্যাত শপিং রোডগুলো; রিজেন্ট স্ট্রিট, অক্সফোর্ড স্ট্রিট। সবকিছুই বড়দিন উপলক্ষে ফেস্টিভ সাজে সজ্জিত। টাকাপয়সা না থাকলে এসবই মনে হয় যেন শুধুই মায়া। আরো হাঁটার মতন স্ট্যামিনা আর কারো অবশিষ্ট নেই বলে ঘোরাঘুরির ওখানেই ইতি টেনে বাসার রাস্তা মাপাতেই সবাইকে বেশি আগ্রহী মনে হল।
এতো হাঁটাহাঁটি করেও আসলে তেমন কিছুই দেখা হয়নি। এ কম সময়ে শুধু পায়ে হেঁটে যতটুকু দেখা যায় আর কি। আমার মতে আসল কাজই করা হয় নাই। কতগুলো উষ্টুমধুষ্টুম জাদুঘর, হাইড, রিজেন্ট পার্ক, মাদাম তুসো, রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট কোনো কিছুতেই যাওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম বন্ধুর উছিলায় আমারও যেগুলো দেখা বাকি ছিল দেখা হয়ে যাবে কিন্তু একদিনে এতকিছুর পর তা আর সম্ভব ছিল না। সান্তনা একটাই যে ওর অন্তত কোনো আক্ষেপ নেই; কিছু না হয় তোলা থাকলো পরের বারের জন্য।
অর্ণব
মন্তব্য
লন্ডন কি সারা বছরই এরকম মেঘলা আর ভেজা ভেজা থাকে নাকি?
লন্ডনের আবহাওয়া খুব বিরক্তিকর। মেঘলা আর ভেজা ভেজার সাথে বাতাসটাও থাকে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হাসিব ভাই এক লাইনে সামারাইজ করে দিলেন।
সারাটা শীতকাল মোটামুটি এরকম যায়; দিনের দৈর্ঘ্যও ছোট। তাই মানুষজন সব অপেক্ষা করে থাকে সামারের জন্য।
অর্ণব
পরিচিত শহরগুলো নিয়ে লেখা আসে কম, লন্ডন নিয়ে আরও লিখুন।
গুডরিডস
ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে। তার আগে কোথাও যেতে হবে আর কি।
ব্রিটেনকেই আপনার পরবর্তী গন্তব্য করে ফেলুন না। আপনার লেখায় আবার দেখে নেব।
অর্ণব
ভালই লাগলো একদিনের ঘোরাঘুরি।
ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অর্ণব
নতুন মন্তব্য করুন