নিজদেশে বিদেশী হিসেবে পরিচিত হওয়ার মধ্যে সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আছে ৷ আমার মনে হয় আমার মতো চেহারার লোকজন যারা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে বিদেশ ভ্রমনের কখনো সখনো সুযোগ পান তাদের সবার কমবেশি এধরণের অভিজ্ঞতা আছে ৷ বিশেষ করে বিমানবন্দর নামক স্থানে ৷ সুবিধার কথায় প্রথমে বলি ৷ যখন দেশে ফিরি, সবুজ পাসপোর্টটা ইমিগ্রেশনে দেখিয়ে পার হই ৷ তারপর যেহেতু পাসপোর্টের আর কোন কাজ নাই আমি আমার হ্যান্ডব্যাগে তা চালান দিই ৷ অথবা যখন আমার লাগেজে মদ নামক জিনিসটা (কারোর অনুরোধে বা কাউকে উপটোকন দেওয়ার জন্য) নিয়ে আসি, তখন আমি পাসপোর্টটা আমার ব্যাগে থাকে ৷ সবুজ পাসপোর্ট যে মুহূর্তে উধাও - আমি তখন বিদেশি, নিজের ইচ্ছায় হোক বা স্কেনিং মেশিনের সামনে দাঁড়ানো পুলিশের চোখে ৷ আমার চেহারা দেখেই তারা বলে- 'Sir, Sir please go this way. ' হাত ও মুখের ভঙ্গিমায় যথাসম্ভব এই বিদেশী সম্মানিত মেহমানকে তারা স্বাগত জানায় ! ইঙ্গিতে বোঝায় প্রয়োজন নাই লাগেজ স্কেনিং করার ৷ বিমান যাত্রায় ক্লান্তবিধস্ত কে আর স্কেনিং মেশিনে আমার লাগেজ-ব্যাগ চেক করাই ? তাছাড়া বাংলাদেশি হয়ে ঐ রকম নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে টানা হেচড়া ! তাই আমিও স্বানন্দে দ্রুত পা চালাই ৷ ইংরেজিতে স্বাগত জানানোর প্রতি উত্তরে সহাস্যে বলি - Thank you. একই সাথে কখনো কখনো অপরাধবোধেও অাক্রান্ত হই ৷ আমার সহযাত্রী বিমান যাত্রিদের জন্য - তারা যখন তাদের লাগেজ, পুটলাপুটলি নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে বিমান যাত্রার সর্বশেষ হার্ডল স্কেনিং মেশিন টাতে চেক করানোর জন্য ৷ ততক্ষনে আমি বিমান বন্দরের বাইরে ৷ বিদেশির প্রতি আমাদের কি ভক্তি আর দেশির প্রতি কি কড়া নিয়ম !
এবার আসি অসুবিধা বা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথায় ৷ একবার বসের অনুগ্রহে ইন্দোনেশিয়ায় গেছিলাম একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে৷ ইমিগ্রশন পার হয়ে অপেক্ষায় আছি মালয়েশিয়ান বিমানের জন্য ৷ ঠিক বিমানের ঢোকার মুখে ৷ যাব প্রথমে কুয়ালালামপুর, তারপর সেখান থেকে জাকার্তা ৷ দেখি এক তরুণ বা আমার বয়সী একটা ছেলে তার তিন-চার বন্ধুকে ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে ৷ কে জানে ইন্দোনেশিয়ায় বা মালয়েশিয়ায় কোন চাকরিবাকরি বা পড়াশোনা করে কিনা ৷ ইন্দোনেশিয়ান বা মালয়েশিয়ান ( কোন দেশের ভাষা জানিনা, যেহেতু সে পথে যাচ্ছি তাই সন্দেহ করছি ) ভাষায় সহাস্যে অতি বিনয়ের সাথে কি কি বললো বা জিজ্ঞেস করলো জানিনা ৷ আমি বললাম- 'ভাই আমি বাংলাদেশি, বাংলায় বলুন ৷ ' ভদ্রলোক সাথে সাথে গালি দিয়ে বসলো অকথ্য ভাষায় ৷ খাস বাংলায় ৷ তার রাগের কারন হতে পারে আমি ইন্দোনেশিয়ান বা মালয়েশিয়ান হয়েও মিথ্যা বলছি ইন্দোনেশিয়ান বা মালয়েশিয়ান না ৷ অথবা এমনো হতে পারে সে বিদেশি ভেবে যার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলো সে একজন তার মতোই অভাগা বাংলাদেশি ৷ তার ভাব জমানোর জন্য তার চেষ্টা-উদেশ্য বৃথা গেল, সাথে ইজ্জত তার বন্ধুদের কাছে ৷ তাই তার নিজের বা আমার উপর রাগ করার যথেষ্ট যুক্তি বিদ্যমান ৷ তার এমন আচরনে কে জানে আমার মেজাজ সপ্তমে থাকলে হয়তো অন্যান্য যাত্রীরা তাদের স্বদেশ বা বিদেশ যাত্রারম্ভে একটা বিনামূল্যে রেসলিং দেখতে পারতো ৷ আমি শুধু একটা কঠোর মুখভঙ্গি করে ঐ লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম - 'কি বললেন অাপনি ? আরেকবার বলুনতো দেখি? ' লোকটা সরে গেল তার বন্ধুদের দিকে ৷ ভাবলাম - বিমান বন্দরেও আমি বিদেশি, দেশের মধ্যেও ৷দীপুমুনিদের কাছেও ৷ আমার মতো অনেক মানুষ রীতিমতো রক্ত-মেধা-বন্ধুত্বক্ষয়ি যুদ্ধে লিপ্ত- এই দেশি বিদেশি বিতর্কে ৷ আমার চেহারাটার মধ্যে নিশ্চয় প্রচুর সমস্যা৷ দেশেও আমি বিদেশি, বিদেশে তাই ৷ কোথায় আমার দেশ ?
অরন্য ত্রিপুরা
মন্তব্য
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
কখনো উপজাতি, কখনো আদিবাসী, কখনো পাহাড়ি, কখনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী! একদেশে কত রকম পরিচয়!!
_____________
সৌমিত্র পালিত
এরকম কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই।কারণ, এরকম পর্যায়ে এখনও আমি পৌছায় নি।কিন্তু,কাহিনীটা যখন পড়তেছিলাম,মনে হচ্ছিল,বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখমুখি হয়েছি
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
নতুন মন্তব্য করুন