সন্দেশের বই নিয়ে লেখার আমন্ত্রণ দেখার পর থেকেই ভাবছি কিছু একটা নিয়ে লিখব। কিন্তু কোন বইটা নিয়ে লেখা যায় সেটা ঠিক করতে করতেই মাস পার হয়ে গেল। ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি বই কিনেছি আর সবচেয়ে কম পড়েছি! তারপরেও কোন বইটা মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে ভাবতে গিয়েই মনে হল বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কথা। অবশ্যই এটাই ২০১৫ সালের আমার আবিষ্কার।
বইটা সংগ্রহ করেছিলাম প্রকাশের পর পরই কিন্তু পড়া আর হয়ে উঠেনি। ২০১৫'র বইমেলার পরেই পড়তে শুরু করলাম বইটা, আর দেখতে দেখতেই যেন সত্যিকার অর্থেই সেই সময়টায় চলে গেলাম। বইটা শেষ করার পরেও মুগ্ধতার আবেশ আর অপূর্ণতার বিষণ্ণতার মিশেলে একটা অদ্ভুত অনুভূতি অনেকদিন ঘিরে ছিল।
লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন এটা জানার তেমন সুযোগ নেই আমাদের। রাজনৈতিক ব্যস্ততার মাঝে লেখালেখির তেমন সুযোগও তাঁর ছিল না। কিন্তু আত্মজীবনী পড়ে আক্ষেপ হচ্ছে কেন তিনি আরও কিছু লিখে গেলেন না আমাদের জন্য। পুরো আত্মজীবনীটাই অনেকটা কাউকে সামনে বসিয়ে গল্প বলার ঢঙে লেখা এবং অত্যন্ত সুখপাঠ্য। আর পড়তে পড়তেই বার বার যেন সত্যি হারিয়ে যাচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধুর জীবনের মাঝে। চোখের সামনেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ঘটনাগুলো। তাঁর সাথেই যেন লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সুরেন ব্যানার্জির বাড়ি থেকে মালেককে ছুটিয়ে আনতে।
লেখক বঙ্গবন্ধু নিজের সাথে বা পাঠকদের সাথে কোনও লুকোচুরি করেন নি। নিজের প্রতি সৎ থেকেছেন, নিজেকে ভদ্র, শান্ত, ভাল ছেলে বলে পরিচয় করানোর চেষ্টা করেননি। তাঁর জবানীতেইঃ
...যদি কোন মুসলমান চাউল না দিত আমরা দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হত।...
পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালির অবদান এবং তাদের মনোভাব যেমন এই আত্মজীবনী থেকে ফুটে উঠেছে, তেমনি আমরা দেখতে পাই কিভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিভাবে মুসলিম লীগ নেতাদের ক্ষমতার লোভ আর হঠকারিতায় একটা রাষ্ট্র "ব্যর্থ রাষ্ট্র" হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একইসাথে আমরা বঙ্গবন্ধুর চোখে দেখতে পাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, ভাসানী প্রমুখ কিংবদন্তী রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পেছনের ঘটনা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর জবানীতে। ভাসানীর পলায়নপর মনোভাব বা আপোষকামিতার কারণে বঙ্গবন্ধুর বিরক্তিও ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।
...মাওলানা ভাসানীর দরকারের সময় এই আত্মগোপনের মনোভাব কোনোদিন পরিবর্তন হয় নাই। ভবিষ্যতে অনেক ঘটনায় তার প্রমাণ হয়েছে।
ছাত্রলীগ গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর দেশজুড়ে ছুটে বেড়ানো আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধের চেষ্টা, আওয়ামীলীগ গঠনের সংগ্রাম, একজন জাতীয় নেতা হওয়ার আগে জনগণের কাছে ছুটে যাওয়া আর তাদের জন্য আপ্রাণ কাজ করে যাওয়া দেখতে পাই তাঁর লেখায়। সেই সাথে দেখতে পাই কতটা ভালোবাসতো তাঁকে এই বাংলার মানুষ। এই সাধারণ মানুষের ভালবাসাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শক্তি এবং হয়তো দূর্বলতাও।
...খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, "বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।' আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, "খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।' আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, "তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।' টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, "গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।' নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিন আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, 'মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।'
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আক্রোশ আর পুলিশের সাথে লুকোচুরি, জেলখানায় যাওয়া আর বের হওয়া, তার মাঝেই বাঙালির জন্য রাজনীতি করে যাওয়া কোনও টান-টান উত্তেজনাপূর্ণ থ্রিলারের চেয়ে কম নয়।
...জ্বর উঠেছে, নড়তে পারছি না। কি করি, তবুও উঠতে হল এবং কি করে ভাগব তাই ভাবছিলাম। ...তিনতলায় আমরা থাকি, পাশেই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তিনতলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে পড়তে হবে। দুই দালানের ভিতরে ফারাকও আছে। নিচে পড়লে শেষ হয়ে যাব। তবুও লাফ দিয়ে পড়লাম।...
বঙ্গবন্ধুর জেলখানার জীবন, রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী-সাথী সম্পর্কে তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন এই বইয়ের অনেকটা অংশজুড়ে রয়েছে সেই সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সাথে।
বঙ্গবন্ধু নামটাই যেন হিমালয়-সম একটা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। সেই আপোষহীন অটল ব্যক্তিত্বের পেছনের মানুষটাকে আমরা খুঁজে পাই এই বইয়ের পাতায়। স্ত্রী রেণুর প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর সন্তানদের কাছে থাকতে না পারার তীব্র আক্ষেপ বার বার প্রকাশ পেয়েছে লেখার মাঝে।
কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি।
আমরা দেখতে পাই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পেছনে স্ত্রী রেণুর আত্মত্যাগ। পর্দার আড়ালে থেকেই যিনি বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন যুগিয়ে গিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, আগলে রেখেছেন সংসার-সন্তানদের। ব্যক্তি শেখ মুজিবের পেছনে একজন রেণু (বেগম ফজিলাতুন্নেসা) না থাকলে হয়তো শেখ মুজিব থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে পারতেন না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পড়ে হিমালয়ের মত মানুষটাকে মনে হয় আমাদের মতই সাধারণ একজন - আবেগপ্রবণ একজন মানুষ, আমাদের মতই ক্ষুধায় কাতর হন, আমাদের মতই অসুস্থতায় কাবু হন, ভালোবাসেন, হতাশ হন। যেন আমাদেরই খুব আপনজন কেউ।
বইটি সকল বাঙালির জন্যই অবশ্যপাঠ্য বলেই মনে হয়। বাংলাদেশের, নাহ আসলে পৃথিবীর প্রতিটি রাজনৈতিক নেতার উচিৎ বইটি পড়া এবং বুঝতে চেষ্টা করা কি করে মানুষের জন্য রাজনীতি করতে হয়, একজন আওয়ামীলীগ সমর্থকের উচিৎ বইটা পড়া এই দলটির সৃষ্টির ইতিহাস আর তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানার জন্য, একজন আওয়ামীলীগের ঘোর বিরোধীরও পড়া উচিৎ আজকের দলটির সাথে সত্যিকারের আওয়ামীলীগের আদর্শের বিচ্যুতি কোথায় তা জানার জন্য, সর্বোপরি একজন বাঙালির পড়া উচিৎ তার জাতির পিতাকে জানার জন্য।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়া শেষ হয় একটা আক্ষেপ নিয়ে, একটা অপূর্ণতা নিয়ে। ঈশ... যদি বঙ্গবন্ধু লেখাটা চালিয়ে যেতেন...
--
ঘুমকুমার
মন্তব্য
এই বইটা নিয়ে লিখবো বলেও লেখা হয়নি(ভাগ্যিস লেখিনি)। ২০১৫ তে আমারও পড়া আনন্দপাঠের
একটি। খুব সাদামাটা ভাবে লিখেও কেউ কিভাবে পাঠক হৃদয়ে সিঁদ কাটতে পারেন সেটা এই বই না পড়লে বোঝা সম্ভব না। একজন রাজনৈতিক কর্মী কতটা নিষ্ঠা আর ভালোবাসা নিয়ে নিজেকে তৈরি করে যান নিরন্তর, সেটা বলে
এই বই। যারা ভাবেন একখান মুজিব কোট পরলেই হয়ে গেল, তাদের জন্য অবশ্যই পাঠ্য এই বই, সাথে পক্ষ বিপক্ষের
সবার। বঙ্গবন্ধুর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" বইটির পাঠোত্তর অনুভূতি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ জানুন ঘুমকুমার।
সেটাই।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সর্ববিষয়ে শেখ মুজিবের খুঁত ধরতে বেয়াকুল বদরুদ্দিন উমরের পিতা আবুল হাশিম (অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি) রচিত "আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি" বইটা পড়ে দেখতে পারেন। বঙ্গবন্ধু কোন রাজনৈতিক পটভূমিতে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সেটা তাঁর আগের প্রজন্মের রাজনীতিকের চোখ দিয়ে দেখতে পাবেন।
"টু রিড' তালিকায় যুক্ত করলাম।
গরীব বৃদ্ধা মহিলাটির আন্তরিকতার অংশটুকু পড়ে নিজের অজান্তেই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। পরক্ষণেই মনে হ‘ল এখনকার জাতীয় নেতৃবৃন্দের কি ঐ সময়ের মত নিঃশঙ্ক চিত্তে সাধারণ মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হবার সুযোগ আছে? শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও তারা সেটা করতে পারবেন বলে মনে হয় না। সেটা করতে গেলে হয়তো তাদের রাজীব গান্ধীর (যাকে পুষ্প ভূষিত করার ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়েছিল) ভাগ্য বরণ করার ঝুঁকি থেকে যাবে। তর্ক করা যায় যে, সাধারণ মানুষকে প্রকৃতভাবে ভালবাসতে পারলে সে ভয় থাকবে না। কিন্তু কথা হ’ল, সে ঝুঁকি তো আসবে সাধারণ বনে যাওয়া কুসাধারণ ষড়যন্ত্রকারীদের তরফ থেকে।
বইটি না পড়েই, সেটি অসমাপ্ত থেকে যাবার জন্য আফসোস হচ্ছে। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী যে রাজাকার চক্রের চক্রান্তের কারণে বইটি সমাপ্তির মুখ দেখেনি তাদের বিচার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে পারলে কিছুটা হলেও সে আফসোস তিরোহিত হবে বলে মনে করি। তার দ্বারা, সেই সাথে, এরকম আরও অনেক বই বাংলার বুকে প্রকাশিত হবার ক্ষেত্রও তৈরী হবে।
- পামাআলে
নিরাপত্তা তো একটা সমস্যা বটেই, সেই সাথে সদিচ্ছাও থাকা চাই।
বইটা পড়ে ফেলুন সময় করে। ভাল লাগবে আশা করি।
কোইনসিডেন্টলি আজকেই বইটা পড়তে শুরু করলা্ম, ৯৪ পাতায় পৌঁছেছি মাত্র।
রিভিউ ভাল্লেগেছে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
শুভ পঠন
এই বইটা তাদেরই বেশী পড়া উচিত যারা শেখ মুজিবের রাজনীতি করেন অথচ তাঁর আদর্শ ধারণ করেন না।
এই বইটা তাদেরও পড়া উচিত যারা আজো পাকিস্তানকে ভালোবাসেন অথচ জানেননা ওই পাকিস্তান সৃষ্টিতে শেখ মুজিবের কী অবদান ছিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বইটা পড়া হয়নি। এই বইমেলায় সংগ্রহ করে ফেলব আশা করি। রিভিউ ভাল লাগলো।
-আতোকেন
এই বইটি নিয়েই লেখা শুরু করেছিলাম প্রথমে। পরে মনে পড়লো, বইটি ২০১৪ সালের শেষের দিকে পড়া। তাই অন্য একটি বই নিয়ে লিখলাম। সচলে কেউ একজন এই বইটি নিয়ে লিখেছে দেখে ভালো লাগলো।
আপনার নেকেড স্ট্যাটিসটিক্স এর রিভিউটাও চমৎকার হয়েছে।
পড়া হয়নি বইটা। গতবছর পিডিএফেএ পড়তে শুরু করেছিলাম, এগোতে পারিনি। এবার বইমেলায় কিনে ফেলব আশা করি। রিভিউ ভালো হয়েছে।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
সত্যি বলতে, ভাইভার আগে বাধ্য হয়ে বইটি পড়তে বসি। কিন্তু পড়ার পর মনে হচ্ছে, আমার পড়া সেরা বই গুলোর একটা এই বই। রিভিউ ভাল হয়েছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর রিভিউ লেখার জন্য।
-------------
আব্দুল কাইয়ুম
আশা রাখি, কোনদিন পড়তে পারব এই বই। রিভিউ ভালো লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন