নিদাঘনামা (২)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৪/০২/২০১৬ - ৬:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগরে পর্ব এখানে : http://www.sachalayatan.com/guest_writer/53893

আমাদের সেই শহরটাও আদতে ছিল একটা গ্রামের প্রতিলিপি। শহর বলতে আমি তখনো একটা ছোট গলিকেই বুঝতাম শুধু। এখানকার পথে সবুজ না থাকলেও মাটি ছিল অঢেল। তখনো পিচতো দূরের কথা সুরকিও দেখিনি আমরা।

ভোর হলে পথে নেমে আসে একদল দেবদূত। তাদের মাথায় থাকে নানান সরঞ্জাম। কেউ কেউ ঝন-ঝন সুরেলা শব্দ তুলে নিরবে হেঁটে যায়। কেউ ডাকে তারস্বরে। কেউ বড় সুরেলা। ডাক শুনে শুনে আর দেখে দেখে তারা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের পড়াও এতটা মুখস্ত হতো না। কিন্তু ডাক শুনেই বলে দিতে পারতাম কোন দেবতা এলেন। পাশের বাসার বারান্দায় আমার মতোই নাদের নামে আরেকজন থাকতো বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে। চোখাচোখি হতো না। গলিটা পেরিয়ে চলে যেতে নিলেই সে তারস্বরে চিৎকার করে ফেরিওলাকে পিছু ডাকতো। এটা একটা খেলা ছিল তার কাছে। কেউ রাগতো না। এতো সময়ের টানাটানি ছিল না তখন। সকালে একেবারে সূর্য ওঠার পরপর শোনা যেত- ‘এ---ই মাঠা-মাঠা.. ...’। আমরা আড়মোড় ভেঙে উঠে পড়তাম। তারপর আসতো সবজি। এখনকার মতো একজনের কাছে সব নয়। কারো কাছে শুধু শাক, যতটা ঝাঁকিতে ধরে। যতটা নিলে মাথায় বহন করা যায়। সকাল নয়টা-দশটার দিকে শোনা যেত- ‘এ----ই পাঁচমিশালি, মলা-ঢেলা, ইচা-পুঁটি-এই পাঁচমিশালি----’ আসতো বড় মাছও। রুই কাতল আসতো একসাথে। ইলিশ তখনো এখনকার মতোই রাজকীয় ছিল, আসতো একা। এই চলতো দুপুর পর্যন্ত। একটু বেলা গড়ালে শোনা যেত- ‘পুরানা কাপড় আছে- ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড় আছে-হাঁড়ি-পাতিল’। সর্বশেষ এই হাড়ি পাতিল ডাকের আগে সবই মৃদু ডাক। এরা সাধারণত আসতো দুইজন দুইজন করে। মাঝে মাঝে আসতো শিলপাটার কারিগর। একা একা, কাঁধ থেকে ঝুলতো তার এক যাদুর ঝোলা। ‘শিল পাটা ধারাই’ বলে একটা লম্বা হাঁক দিত মাঝে মাঝে। একটা অনিয়মিত উচ্চারণের মতো ডেকে যেত সে। আনমনা হয়ে হেঁটে যতে পথ দিয়ে। কেউ ডেকে নিলে ধীরলয়ে শিলের ওপর এঁকে দিত যতেœর কারুকাজ। আসতো বেদের দল। ‘শিঙ্গা লা..গা..ই... দাঁতের পোক ফা..লা..ই’ বলে দারুণ এক সুরেলা ডাক দিত। ভলো লাগতো বড়। লুকিয়ে দেখতাম তাদের যেন না পায় আমার দাঁতে হদিস। মধ্যদুপুরের নিস্তব্ধতা তালা-চাবিওয়ালা ঝনঝন করে ভেঙে দিয়ে যাওয়ার পর আসতো লেইস-ফিতা আর সিট-কাপুড়ের বিক্রেতারা। প্রথম শব্দটা জোরে টেনে উচ্চারণ করে শেষ শব্দটা আস্তে করে এমন দক্ষতায় ছেড়ে দিত যে সে ভীষণ দারুণ এক সুর তৈরি করতো। দুপুরে আমি ঘুমাতে চাইতাম না শুধু এই সুরের টানে। শীতের দুপুরে আসতো লেপ-তোষকওলারা। সেও এক সুরেলা ডাক। বীজন দুপুরে খোলা বারান্দা থেকে দুলতে তাকা পায়ের সাথে সাথে দুলতো সে সুর।

আসতো ভিক্ষুকের দল। একেকটা দলে প্রায় সব ধরনের ভিক্ষুক থাকতো। অন্ধ, পঙ্গু, বধির, থেকে শুরু করে সুস্থ সবল। প্রতি দলেই একজন সুস্থ থাকতো। তাকে সবাই মেনে নিত বাকিদের দেখভাল করার স্বার্থে। তারা একেকজন একেক ভঙ্গিমায় হাঁটতো। পঙ্গুজনের চোখে পথ দেখে নিত অন্ধজন। তখনো যায়নি ভেঙে তাবৎ মিথজীবি সমীকরণ। একজন নেতা থাকতো গাণ গাইতো সুর করে। বাকিরা দোহারের ভূমিকা নিত। সব দল সবদিন আসতো না। তারা কারো ঘরে ঢুকতো না। মূল রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাইতো। কিছুক্ষণ দাঁড়াতো তারপর পরের বাড়ি সামনে এইভাবে পুরো গলি ঘোরা শেষে চলে যেত। আমরা এদের আওয়াজ শুনলে দৌড়ে পড়া ফেলে বারান্দা বা জানলায় হাজির হতাম। এরা আমাদের জন্য একটা উত্তেজনার উপলক্ষ্য ছিল। ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষে করার ভিক্ষুকও ছিল। এরা দল বেঁধে থাকতো না। একজনকে মনে আছে খুব। এক দশাসই নারী। ভিক্ষে চাইতো না সে, দাবি করতো। দরজা খুললেই ঢুকে পড়তো ঘরে। কিছু না পেলেও পান তার খাওয়া চাইই। তার লাল চোখ দেখে ভয় করতো বেশ। তাকে হারিয়ে ফেলে স্বস্তি পেয়েছিলাম, আজও মনে পড়ে। বাসা বদলের অনেকদিন পর নতুন বাসায় এসে যেদিন আমাদের দেখে চোখ ঝাপসা হলো তার, সেদিন বুঝেছিলাম কেবল তার চোখের সত্য রঙ। আর আসেনি কোনোদিন।

সূর্যের রাগ পড়ে এলেই আসতে শুরু করতো রাজপুত্রেরা। তাদের কারো কাছে থাকতো কাচের বাক্সের ভেতর থেকে উঁকি দেয়া গোলাপি মিঠাই। আহ্ হাওয়াই মিঠাই। আসতো শন পাপড়িওয়ালা। বাক্সের ভেতরে করে নিয়ে আসতো লাল-সবুজ লাঠি আইসক্রিম। বাক্সের উপরে থাকতো লটারির কলম। একের দামে ভাগ্যের জোরে জিতে নাও তিন। গ্রামেও আসতো তারা, তবে শুধু ধানের মৌসুমে। আসতো মিষ্টি-মধুর কটকটির ঘ্রান। শুধু পয়সায় নয়, শুধু খসখসে টাকায় নয়, ভাঙা-চোরা-শিশি-বোতলেও ঘটতে পারতো স্বার্থক বিনিময়। আমরা বিনিময় করতাম, জিহ্বায় জমাট লোভের সাথে পুরোনো সরঞ্জামের। কখনো কখনো নতুন ঝলমলে জিনিসও দিয়ে দিতাম অব্যর্থ প্ররোচনায়।

এইসব জাদুকর ও রাজপুত্রের দল কিনে নিয়েছিল আমার সমস্ত সময়। বৃন্তচ্যুত আমার সামনে তারা মেলে ধরেছিল এক অদ্ভুত ঝাঁপি। সেখানে কী নেই। সেইসব সুরেলা ডাক নিয়ে যেত আমাকে তাদের নিবাসে। যে নিবাস আমারই স্মৃতির মতন। যে নিবাসে ধুলো আছে, কাদা আছে, আছে আকাশ ছোঁয়া খড়ের গাদা। যে নিবাসের ধনুক বিকেলগুলো মরেনি এখনো।

চলবে...

স্বয়ম


মন্তব্য

মুদ্রা সংগ্রাহক এর ছবি

খাসা চলছে।চলুক....

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভেচ্ছা জানবেন

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার সেই ছোট্ট শহর কোনটা জানা নেই । আমার ছোটবেলা কেটেছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে । গল্পটা পড়তে পড়তে অল্প কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ছেলেবেলার সেই ঢাকার অলস এক দুপুরে ফিরে গেলাম । আকাশ ঢেকে দেয়া ইট-পাথরের দালান, মানুষের ব্যস্ত চলাচল আর গাড়ির ভেঁপুর মাঝে সেই শহরটা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে ।

মামুনুর রশীদ [ ভবঘুরে শুয়োপোকা ]
==========
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি

অতিথি লেখক এর ছবি

এটা ঢাকার মতোই কোনো একটা শহর আর তার মানুষের গল্প, দেখা যাক যেতে শহর তার কি নাম নেয়, মানুষগুলো কিভাবে দাঁড়ায়...

শুভেচ্ছা জানবেন

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! খুব সুন্দর লেখা, বেশ উপভোগ করেছি। আমার ছোটবেলাটা নানা শহরে ঘুরে কেটেছে। তাদের সবাইকে খুঁজে পেলাম আপনার এ লেখায়।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগায় ভালো লাগলো... অনেক ধন্যবাদ

শুভেচ্ছা জানবেন

স্বয়ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।