২০১৬ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর। এবছরের শেষ নাগাদ বারাক ওবামা পূর্ণ করবেন তার আট বছরের দায়িত্বকাল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণত রিপাবলিকান ও ডেমক্র্যাট এই দুই দলের দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে মূল নির্বাচনের বছর খানেক আগেই শুরু হয়ে যায় প্রার্থী নির্বাচনের লড়াই। প্রতি দল থেকেই সচরাচর আট-দশজন প্রার্থী হতে চান। এদের অধিকাংশই দেখা যায় নানান রাজ্যের সিনেটর কিংবা গভর্নর। এছাড়াও কেউ চাইলে প্রার্থীতার যুদ্ধে নামতে পারে। তারপর প্রতিটি রাজ্যে আলাদা করে প্রার্থী নির্বাচনের জন্য ভোট হয়, ভোট দেয় সাধারণ মানুষ। সাধারণত ডেমক্র্যাট দলের প্রার্থী নির্বাচনের জন্য ডেমক্র্যাটিক দলের সমর্থকেরা এবং রিপাবলিকান প্রার্থী নির্বাচনের জন্য রিপাবলিকান দলের সমর্থকেরা ভোট দেয়। প্রার্থী হওয়ার এ দৌড় খুব সহজ নয়। সবশেষে দুই দলের প্রার্থীর মধ্যে হয় মূল নির্বাচন। ২০০৭-এ ইলিনয়ের এক তরুণ সিনেটর ডেমক্র্যাট দলের প্রার্থীতার দৌড়ে পেছনে ফেলেন হেভিওয়েট হিলারি ক্লিনটনকে। ২০০৮-এ সেই তরুণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। যেদেশ এখনও বর্ণবাদের দীর্ঘ চর্চা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, যেদেশে এখনও শ্বেতাঙ্গের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় সেদেশে জনগণের ভোটে কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান কিছুটা অভাবিত। বারাক ওবামার স্বপ্নের কতখানি পূরণ হোল আর কতখানি অপূর্ণ সেই আলোচনা অন্য কোথাও করা যাবে, আজকে বরং কথা বলি চুয়াত্তর বছর বয়সী এক ‘বৃদ্ধ’-কে নিয়ে।
বার্নি স্যান্ডার্স যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে উত্তর-পূর্ব কোনের ছোট্ট রাজ্য ভার্মন্ট-এর সিনেটর। সিনেটর হওয়ার আগে বহুদিন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র হাউজ-এর সদস্য। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বার্নি ছিলেন ‘স্বতন্ত্র’, না ডেমক্র্যাট, না রিপাবলিকান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্বতন্ত্র হিসেবে হাউজ কিংবা সিনেটে প্রতিনিধিত্ব করা রাজনীতিবিদ বার্নি। তার রাজনৈতিক অবস্থান বামে, বিশ্বাস সমাজতান্ত্রিক ঘরানার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কঠিন। এইদেশ পুঁজিবাদের দেশ, এখানকার উদারপন্থী বা বামের রাজনৈতিক দল ডেমক্র্যাট-ও বৈশ্বিক বিবেচনায় বাম থেকে যথেষ্ট ডানে সরে এসেছে। আর ডানের রক্ষণশীল দল রিপাবলিকান ডান থেকে আরো ডানে সরে গেছে। তো এইদেশে বার্নি ২০১৫-এর মে মাসে ঘোষণা দিলেন ২০১৬-এর নির্বাচনে ডেমক্র্যাট দলের প্রার্থীতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। চাইলে স্বতন্ত্র হয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায়। কিন্তু তা করলে লাভের গুঁড় রিপাবলিকান দলের পাতে যাবার সম্ভাবনা থাকে এবং আরো নানা বিবেচনায় বার্নি ডেমক্র্যাট প্রার্থীতার জন্যই লড়বেন ঠিক করলেন। এবারও ডেমক্র্যাটদের ফেভারিট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। মাঠ মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো কিংবা বলা যায় তৈরি ছিল ক্লিনটনের জন্য। ডেমক্র্যাট দলের অঘোষিত প্রার্থী এবং ‘পলিটিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট’-এর প্রিয়পাত্র হিলারি ক্লিনটন। ২০১৫-এর মে মাসের জনমত জরিপগুলোতে দেখা যায় ৫০-৬০% ডেমক্র্যাটিক সমর্থক হিলারিকেই চায় তাদের প্রার্থী হিসেবে। সেসময় ৪-৫% মানুষ বার্নিকে ডেমক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো। অধিকাংশ মানুষ বার্নি স্যান্ডার্স নামের কাউকে চিনতোই না। এখন চিত্র ভিন্ন, একসময়ের অবশ্যম্ভাবী প্রার্থী হিলারি এখন আর সেরকম অবশ্যম্ভাবী না। এইতো কদিন আগে হয়ে গেলো প্রথম রাজ্য আইওয়া-তে প্রার্থী নির্বাচনের ভোট। ডেমক্র্যাটিক প্রার্থী নির্বাচনে হিলারির পক্ষে ভোট ছিলো ৪৯.৮% আর বার্নির পক্ষে ৪৯.৬%। আইওয়া ডেমক্র্যাটিক প্রার্থী নির্বাচন এরচেয়ে রুদ্ধশ্বাস আর কখনো হয়নি। মজার বিষয় হোল, যাদের বয়স ত্রিশের কম এমন ভোটারের মাঝে বার্নি পেয়েছে ৮৪% ভোট। তো বার্নি স্যান্ডার্সের কি এমন অবস্থান যা তরুনদের মাঝে এরকম তীব্র অনুরণন তৈরি করে, কি এমন আদর্শ যে বার্নির জনসভায় বিশ-ত্রিশ হাজার মানুষ ভীড় করে।
না, খুব অস্বাভাবিক কিছু না। শিক্ষা এবং চিকিৎসাকে বার্নি মনে করে নাগরিকের অধিকার। তার প্রস্তাব যার উচ্চশিক্ষার আগ্রহ ও যোগ্যতা আছে সে বিনা পয়সায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে, যার চিকিৎসা প্রয়োজন সে অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় থাকবে না। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের শত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিনা বেতনে পড়া যায়, সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা মেলে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, পৃথিবী জুড়ে ছড়ি ঘুরানো প্রবল পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র টাকা ছাড়া শিক্ষা দেয় না, ইনস্যুরেন্স ছাড়া চিকিৎসা দেয় না। তাই এদেশের অসংখ্য মানুষ জীবনের অর্ধেক সময় শিক্ষাঋণের বোঝা নিয়ে পার করে, বহু অভাবী মানুষ ইনস্যুরেন্স-এর অভাবে বিনা চিকিৎসায় দিন যাপন করে, কেউবা মারা যায়। এখানে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসা বীমা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সম্ভবত সবচেয়ে ব্যয়বহুল। তাই বার্নির প্রস্তাব বহু সাধারণ মানুষের মাঝে প্রতিধ্বনি করে, কিন্তু নাখোশ করে তাদের যাদের ব্যবসায় টান পড়ে বার্নির এই নৈতিক অবস্থানে।
• যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই, থাকলেও অবৈতনিক। চিকিৎসাখাত নিয়ন্ত্রন করে প্রাইভেট ইনস্যুরেন্স ও ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি, যাদের প্রভাবে ওষুধপত্র বাবদ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে আমেরিকানরা।
• গোটা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ জেল খাটে যুক্তরাষ্ট্রে এবং সেটাও তীব্র বর্ণবৈষম্যপূর্ণ। একটা উদাহরণ দেই, আঠারো থেকে ঊনিশ বছর বয়সী পুরুষ কয়েদিদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গের এগারোগুণ। মজার বিষয় হোল এসব জেলের একটা বড় অংশ প্রাইভেট।
• আমেরিকার প্রথম পাঁচটা ব্যাঙ্কের(প্রাইভেট) মোট সম্পদ সেদেশের জিডিপির অর্ধেক (আট/নয় ট্রিলিয়ন ডলার)। বোঝা যায় এসব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কতখানি। তাই ২০০৭/২০০৮-এ যখন এদেরই প্রতারণায় বহু আর্থিক প্রতিস্থান ভেঙে পড়ে, সাধারণ মানুষের টাকায় এরা উদ্ধার পায়। সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয় কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু হয় না, এর মাথায় যারা বসে আছে তাদেরও কিছু হয় না।
• ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সংগঠিত কাঠামোটিও আমার ধারণা যুক্তরাষ্ট্রে। জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎপাদন ও ব্যবহারে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব আজকের বিশ্বে মানুষকে ধাবিত করে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে। কিন্তু যাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের জ্বালানী তেলের ব্যবসা তারা এটা মেনে নিবে কেন!
এই সমস্ত ব্যবসা এসে একজায়গায় মেলে, যাকে বলে ‘পলিটিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট’। আমেরিকায় নির্বাচনে অংশগ্রহন করা, প্রার্থীতার যুদ্ধে নামা বহু টাকার ব্যাপার। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয় একটা পুরোদস্তুর নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে। রাজনীতিবিদেরা কোথায় পান এতো টাকা? আসেন ব্যবসায়ীরা, টাকা ঢালেন রাজনীতিতে। রাজনীতিকেরা আসেন ক্ষমতায়, সুগম রাখেন ব্যবসার পথ। ঠকে কারা? সাধারণ মানুষ। ভালো থাকে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তেরা নামতে থাকে নিচে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশজন ধনীর মোট সম্পদ নিচের অর্ধেক মানুষের চেয়ে বেশি।
বার্নি স্যান্ডার্স এই গোটা সিস্টেমটা ধরে টান দিতে চান, এর মূলে ঝাকুনি দেন। ন্যূনতম বেতন বাড়ানো, উচ্চবিত্তের কর বাড়ানো, বড় ব্যাঙ্কগুলো ভেঙে ছোট করা, বিচার ব্যবস্থার বর্ণবৈষম্য দূর করা, চিকিৎসার বেসরকারীকরণ বন্ধ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিনাবেতন করা- এই সমস্ত স্পর্শকাতর বিষয় আমেরিকার মানুষের কানে পৌঁছে দেন। স্বভাবতই সবার আগে বার্নি তরুনদেরই পান তার সহযোদ্ধা হিসেবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে তরুনরাই সবার আগে আদর্শের ডাকে সাড়া দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে এবার তাদের নেতা এক চুয়াত্তর বছর বয়সী ‘বৃদ্ধ’। যে বৃদ্ধ তারুন্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর সাথে লড়েছেন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধ্যে। বহু আগে, কঠিন সময়ে লড়েছেন নারী অধিকারের জন্য, সমকামীদের অধিকারের জন্য, ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে। তারুন্য আজো মনে ধরে আছেন বলেই বিশ্বজুড়ে মার্কিনীদের ছড়ি ঘুরানোর দরকার দেখেন না।
আর হ্যাঁ, বার্নি কোথা থেকে টাকা পাচ্ছেন নির্বাচনের এই অর্থযজ্ঞে? প্রতিবার সাতাশ ডলার গড়ে মোট সাড়ে তিরিশ লক্ষ বার বার্নি অর্থসাহায্য পেয়েছেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, যার প্রায় পুরোটাই এসেছে অনলাইনে। নির্বাচনী প্রচারে ব্যবসায়ীদের অর্থের প্রভাব বার্নি বোঝেন। তাই কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেননি, নেবেন না। তাই তার অন্যতম এজেন্ডা প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে ব্যবসায়ীদের অগাদ টাকা ঢালা বন্ধ করা। এই যুদ্ধে বার্নির প্রতিপক্ষ পলিটিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট, কর্পোরেট মিডিয়া, ব্যবসায়ীদের অগাদ টাকা আর সহযোদ্ধা সাধারণ মানুষ। এ এক অসম্ভব যুদ্ধ, প্রবল এক মেশিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য তরুণ-তরুণী এখন এই যুদ্ধ জয়ের স্বপ্নে বুঁদ।
ফারুক
মন্তব্য
এই স্বপ্ন আমি নিজেও দেখছি, আর তাই তো জীবনে প্রথমবার পলিটিক্যাল ডোনেশন দিলাম, এবং বলাই বাহুল্য যে বার্নিকে। হারুক বা জিতুক, সমাজতান্ত্রিক সরকারের ধারনাকে তিনিই জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছেন। এর প্রভাব আজ না হলেও কাল ঠিকই দেখা যাবে।
/----------------------------------------------------
ওইখানে আমিও আছি, যেইখানে সূর্য উদয়
প্রিয়দেশ, পাল্টে দেবো, তুমি আর আমি বোধহয়
কমরেড, তৈরি থেকো,গায়ে মাখো আলতা বরণ
আমি তুমি, আমি তুমি, এভাবেই লক্ষ চরণ।।
হ্যাঁ, বার্নি হারুক বা জিতুক এর প্রভাব পড়বে। আমিও ডোনেট করেছি।
চাই লোকটা জিতুক। কিন্তু জিততে কি দিবে?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
সেটাই
বার্নির মনোভাবকে স্যালুট!
বার্নিকে জোরালো সমর্থন জানাচ্ছি
আমেরিকা অবস্থান কালে বার্নি স্যান্ডার্সের বিতর্ক শুনেছিলাম। তাঁর সোসালিস্ট হবার অকপট স্বীকারোক্তি ভাল লেগেছিলো। বার্নি স্যান্ডার্সের জয় হোক।
নতুন মন্তব্য করুন