“আরে মিয়া মাথা ভিতরে ঢুকান। নাইলে কল্লা কিন্তু আলগা হইয়া যাইব।“
কানের কাছে বাজখাই আওয়াজে এমন ডায়লগ শুনলে পিলে চমকানো স্বাভাবিক। বাসের জানালা দিয়ে গলাটা ইঞ্চিখানেক বের করেছিলাম মাত্র। সুরসুর করে সেটা আবার ভিতরে ঢুকিয়ে সুবোধ বালকের মত সহযাত্রীর দিকে নিরীহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আমার তাকানো দেখে সোৎসাহে তিনি বর্ণনা দিতে লাগলেন কিভাবে গত সপ্তাহেই জানালা দিয়ে মাথা বের করার দুঃসাহস দেখানোর পর বিপরীত দিক থেকে আসা বাসের ধাক্কায় এক যাত্রীর মাথা থেতলে গিয়েছিল। বর্ণনা করবার সময় সহযাত্রীর মুখে সহমর্মিতার তুলনায় উৎসাহের আধিক্য দেখে খুব একটা অবাক হই নি। আজকালকার বাঙালী বলে কথা। কারও বিপদ দেখলে সাহায্য করবার চাইতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে এবং পরিচিতদের কাছে ধারাবিবরণী দিতেই আমরা বেশি পছন্দ করি। ফেসবুক চালু হওয়াতে তো পোয়াবোরো। ধারাবিবরণীর সাথে যুক্ত হয়েছে সচিত্র প্রতিবেদন। আমরা সবাই সাংবাদিক আমাদের এই সংবাদের রাজত্বে।
গন্তব্য আলীকদম। বান্দরবানের প্রত্যন্ত এই থানার সাথে জেলা শহরের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও চালু হয় নি। অধুনা আলীকদম-থানচি আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণের ফলে সুযোগ তৈরি হলেও রাস্তার দুর্গমতা পরিবহণ মালিকদের এখনও সেই রাস্তায় গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করছে না। তাই আলীকদম যেতে হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ধরে প্রথমে যেতে হবে কক্সবাজারের চকোরিয়া থানায়। সেখানে থেকে লামা এবং আলীকদম থানার উদ্দেশ্যে নিয়মিত বিরতিতে বাস এবং জীপগাড়ি ছেড়ে যায়। যার যেটা পছন্দ।
আমি উঠেছিলাম বাসে। মাতামুহুরি পরিবহণ সার্ভিসের এই বাসের আসনগুলো এতটাই সংকীর্ণ যে আমার মত দুবলা-পাতলা দু’জন কোনমতে ডাবল সিটে এঁটে যায়। যাদের প্রস্থ একটু বেশি তাঁরা কিভাবে এমন জায়গায় বসবেন ভাবছিলাম। ভাবনার সমাপ্তি ঘটাতে বিধাতা মুখ তুলে তাকালেন। বিপুল প্রস্থের অধিকারী মধ্যবয়স্কা এক ভদ্রমহিলা উঠলেন ঠেলেঠুলে বাসে ঢুঁকেই ইতিউতি তাকাতে থাকলেন কোথায় আসন ফাঁকা পাবেন সেই লক্ষ্যে। আমার পাশের আসনটা ফাঁকা ছিল। ভদ্রমহিলা আমার সাথেই বসেন কি না এই আশঙ্কায় প্রাণ যখন প্রায় উশঠাগত তখনই আমাকে স্বস্তির সাগরে ডুবিয়ে তিনি সামনের আসনেই উপবেশন করলেন এবং অবাক ব্যাপার নিজের বরাদ্দকৃত আসনের বাইরের অংশটুকু কিন্তু ঠিকই ফাঁকা রইল। বুঝলাম উনি পুরানো পাপী। নিয়মিত যাতায়াত করেন বলেই হয়ত চিকনা আসনে বিশালবপু এডজাস্ট করবার পদ্ধতি শিখে গেছেন।
আলীকদম যাওয়ার পথে ফাঁসিয়াখালির গভীর অরণ্য পাড়ি দিতে হয়। এদিকটায় মাঝে মাঝেই বুনোহাতির পাল হানা দেয়। এক জায়গায়
খালের উপর একটা বেইলি ব্রিজ দেখলাম। বর্ষাকালে খাল যখন পানিভর্তি থাকে তখন রাতের বেলা হাতিরা নাকি সদলবলে এখানে পানি খেতে আসে। এই কথা শুনেই আগ্রহের আতিশয্যে গলা বের করেছিলাম যার পরিণতিতে সহযাত্রীর বাজখাই গলার নির্দেশ শুনতে হল।
ভ্রমণ পথ এককথায় অসাধারণ। বান্দরবানের পাহাড়ি পথে যারা যান নি তাঁরা এই সৌন্দর্যের মর্ম কখনও বুঝতে পারবেন না। দিগন্ত জুড়ানো দৃষ্টিনন্দন সবুজের গালিচার বুক চিরে ছুটে চলা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা কি এক মৌনতায় হৃদয়কে আপ্লুত করে। পাহাড়ের বিশালতার সামনে নিজেকে বড় নগণ্য লাগে। মনে হয় চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাই চিরসবুজের এই রাজ্যে।
রাস্তা ক্রমেই উঁচুতে উঠছিল। ১৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর চোখে পড়ল মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরুর পূর্বে লামা এবুং আলীকদমের উপর কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। তখনই প্রথম মিরিঞ্জা’র নাম শুনি। এখানে যে একটা পর্যটন কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে সেটা জানতামই না। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতায় ২০০৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুর্গম বলে অনেকেই এখানে আসেন না। ইদানিং পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তারপরেও বান্দরবানের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের তুলনায় দর্শনার্থীর সংখ্যা এখানে অপেক্ষাকৃত কম।
জীবনের বেশিরভাগ ভ্রমণ একা একাই করেছি। এইবারেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ আর হাতে কাপড়ের ব্যাগটা ঝুলিয়ে যখন বাস থেকে নামলাম তখন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। সাথে ছাতা নেই। কি আর করা, পাশের ছোট্ট দোকানে বসে এক কাপ চা আর দুইটা টোস্ট বিস্কিট সাবার করলাম। কাপড়ের ব্যাগটা দোকান মালিকের কাছে গচ্ছিত রেখে ল্যাপটপ কাঁধে নিয়ে পর্যটন কমপ্লেক্সের দিকে দিলাম হাঁটা। একটু এগুতেই গিরিদ্বার নামের প্রবেশপথ। মিরিঞ্জা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে যাচ্ছি বলে কথা। নামকরণ একদম যথার্থ।
ভিতরে ঢুঁকে প্রথমেই যা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে বিশালাকৃতির ব্যাঙের ছাতা। চমকাবেন না, সত্যিকারের নয়, সিমেন্ট দিয়ে বানানো। এত জিনিস থাকতে এই ব্যাঙের ছাতার ভাস্কর্য কেন প্রবেশপথের পরেই স্থাপন করা হয়েছে বুঝলাম না। কোন কাহিনী হয়ত আছে যা কিনা আমার জানা নেই।
ডানপাশে তাকাতেই মনটা ভাল হয়ে গেল এক নিমেষে। এমন অবারিত সবুজ দেখলে কি আর মন খারাপ করে থাকা সম্ভব? এত উঁচু পাহাড়েও অনেকের নিবাস। দূর থেকে টিনের ঘরগুলোকে অনেক ক্ষুদ্র দেখাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল এমন একটা বাড়ি বানিয়ে থেকে যাই পাহাড়েই।
চলুন একটু টাইটানিক জাহাজের ডেক থেকে ঘুরে আসি। একি, চমকে গেলেন নাকি? চমকানোরই কথা। আটলান্টিকের অতলে ঘুমিয়ে থাকা টাইটানিক বান্দরবানে আসল কি করে? পর্যটকদের আকর্ষণ করতে মিরিঞ্জা পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে সাড়া জাগানো টাইটানিক জাহাজের ভাস্কর্য। টাইটানিকের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে পড়বে শত বছর আগের টাইটানিক জাহাজকে নিয়ে তৈরি কাহিনিচিত্র। এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায় প্রাণভরে। রাতের বেলা কুতুবদিয়া বাতিঘরের আলো চোখে পড়ে। এছাড়া পরিষ্কার দিনে নাকি বঙ্গোপসাগরও দেখা যায়। আকাশ মেঘলা ছিল বলেই হয়ত আমার চোখে পড়ে নি।
পাহাড়ে হঠাত করেই যেমন বৃষ্টি নামে, তেমনি মেঘের চাদরকে হটিয়ে দিয়ে রোদ উঠতেও সময় লাগে না। বৃষ্টির পর পাহাড়গুলোকে অপূর্ব মায়াময় লাগে। সবুজ পাহাড়ের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে পড়া সূর্যলোক কি এক অদ্ভুত মৌনতায় মনকে আপ্লুত করে। লাল রঙের কৃষ্ণচূড়াগুলো সবুজ পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে হয় এখানেই কাটিয়ে দেই একটা জীবন।
পরস্পরের সাথে সংযুক্ত তিনটা ওয়াচ টাওয়ার অতিক্রম করে সামনের দিকে এগুলে ক্রমান্বয়ে চোখে পড়ে দুই স্তরের গোলঘর মালঞ্চ যেখানে আপনজনকে নিয়ে নির্জনে বসে গল্প করা যাবে। আছে রেস্ট হাউস-কাম ওয়েটিং শেড বনরত্না। আরও আছে টেলিস্কোপ ঘর ও প্ল্যাটফর্ম। এই টেলিস্কোপ ঘরটা দারুণ। এখানে বসে জোছনারাতে চাঁদ দেখতে নাকি দারুণ লাগে। বন্ধ ছিল বলে ঢুকতে পারি নি অবশ্য। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে মিনি শিশুপার্ক। পূর্ব দিকের জোড়া সবুজ পাহাড় থেকে শোনা যায় প্রায় এক হাজার ফুট গভীর ঝিরি থেকে জল সিঞ্চনের বিরামহীন কলতান। পাহাড় দুটির নাম আছে, সুখী পাহাড় এবং দুঃখী পাহাড়।
ঘুরাঘুরি তো ভালই হল, এখন কিছু অপ্রিয় কথা বলা যাক। এই নিউজ পড়ে জানতে পারলাম সঠিক সংরক্ষণের অভাবে মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স বর্তমানে প্রশাসনের অবহেলায় হয়ে উঠেছে নেশাখোর, পতিতা ও ছিনতাইকারীদের বিচরনে নিরাপদ স্থল। ৩৩ একর জায়গায় অবস্থিত মিরিঞ্জা পর্যটনের অধিকাংশ জায়গাই দখল করে নিয়েছে পার্শ্বোবর্তী বাগান মালিকেরা। স্থানীয় লোকজন জবর দখল করে মিরিঞ্জা পর্যটনের জায়গায় ঢালু পাহাড়ে জুম চাষ করায় প্রতি নিয়ত বর্ষাতে ভেঙ্গে যাচ্ছে। তদারকি না থাকায় গরু-ছাগলের চরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে মিরিঞ্জা। আমি নিজে অনেকগুলো ছাগল দেখেছি। এছাড়া যখন গিয়েছিলাম তখন দর্শনার্থী কেবল আমি একাই ছিলাম। কোন ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে কিছুই করার থাকত না। আধা ঘণ্টা পর আদিবাসী কিছু ছাত্রছাত্রীকে দেখলাম জোড়া বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে। ভেবে দেখলাম এই অবস্থায় কোন বাঙালী দেখলে হয়ত চিন্তায় পড়তাম। আদিবাসী ছাত্রদের একজনকে অনুরোধ করায় একটা ছবি তুলে দিল। আপাতত এটাই আমার মিরিঞ্জার স্মৃতি।
মিরিঞ্জা ঘুরে এক ঘণ্টার মধ্যেই কক্সবাজার চলে যাওয়া যায়। যারা রাতে এখানে থাকতে চান না, তাঁদের জন্য আছে লামাবাজারে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিরিঞ্জা হোটেল। অল্প খরচে মানসম্মত সেবা পাওয়া যায়। আমার মতে এইটাই সেরা অপশন। কারণ, ভ্রমণে যদি আপনি নিরাপদ বোধ না করেন, তাহলে সেই ভ্রমণ আনন্দের পরিবর্তে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
মন্তব্য
ছবি দেখে ও লেখা পড়ে জায়গাটির বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলাম। কিন্তু,
এই বিষয়টি জেনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
আগ্রহ হারাবার কিছু নেই। গ্রুপ বেঁধে ঘুরতে গেলে সমস্যা হয় না। চমৎকার এই জায়গাটা দেখার জন্য একটু ঝুঁকি মনে হয় নেওয়াই যায়।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন