সেই আজিমপুর থেকে হেঁটে আসছি। কত কিছুই বদলে না গেছে! কত দিন পর? কত বছর পর আজ আমি এখানে? আজিমপুর থেকে নিউমার্কেট, নিউমার্কেট থেকে নীলক্ষেত কত ঘুরে ঘুরেই না আসতে হল এখানে! সবকিছু কেমন অচেনা লাগছে আমার। অবাক চোখে সবকিছু দেখতে দেখতে হাঁটছি। হাঁটতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তলপেটের এই ব্যথাটা আবার যেন চেপে ধরেছে। কিন্তু আমি জানতাম আমাকে এখানে কোন একদিন ফিরে আসতেই হত। আর আজ এখানে আসতেই দেখি, ভেতরের অজস্র স্মৃতি আমার দৃষ্টিটাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে।
আমার বন্ধু জহিরের কথা মনে পড়ল আমার। আজ এখানে আমার সাথে জহির থাকলে কি খুশিটাই না হত! আমার সব থেকে আপনজন ছিল জহির। প্রায়ই আমার সাথে পুরানা পল্টনে আমাদের মামার বাড়ি যেত ও। মামা আব্দুল মালেক ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ্যাসিস্ট্যান্ট একাউন্টস অফিসার । ওকে দেখলেই খুশি হতেন। জহির রাজনীতি করত। মামা মজা নেওয়ার জন্য তাদের বিখ্যাত হিন্দু মুসলিম বিতর্কে লেগে পড়তেন। বলতেন, “বুঝলে জহির, যা গিয়েছে ভালই হয়েছে, আর আমরাও যা পেয়েছি ভালই পেয়েছি!”
জহির ক্ষেপে যেত। দেশভাগের জন্য এদিকের হিন্দুরা কলকাতা পাড়ি জমালো, জহির তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারত না। ও সবসময় বলত, “এটা কোন সমাধান না। ব্রিটিশরা শালা যাওয়ার সময় আমাদের মধ্যে সুকৌশলে দ্বন্ধ ঢুকিয়ে দিয়ে গেল কেউ বুঝতেই পারছে না!”
আমি জহিরের কথায় একমত হতাম। আমাদের মুর্শিদাবাদ যে এখন একটা অন্য দেশের জায়গা এটা ভাবতেই খারাপ লাগত আমার। জহির ফরিদপুরের ছেলে। ওদের গ্রামের অনেক হিন্দুকে চলে যেতে হয়েছে। তারা কী অবস্থায় আছে কেউ জানে না! মামার সাথে ঘন্টা খানেক তর্কের পর মামা যখন জহিরের সাথে না পেরে সরে যেতেন, জহির আমায় বলত, “এটাই আমাদের সমস্যা, বুঝলি! নিজে ভাল থাকলে অন্যের দুঃখ নিয়ে ভাবি না। এই যে তোর মামার কথাই ধর, ওপাড় থেকে এসে এখানে ভাল জায়গা পেয়েছে, থাকেও বিঞ্চুপ্রিয়া ভবনটায়, আর হিন্দু দেখতে পারে না!”
আমি হেসে উঠতাম। আজ জহিরের কথা ভেবে মনটা ভারী হয়ে গেল আমার। কোথায় এখন ওরা? আর আমিই বা আবার এখানে এলাম কী করে? সব কিছু কি অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে! ওরা কি সব মেনে নিয়েছে তাহলে? আমরা কি জিতে গিয়েছি?
নাহ! বড্ড দেরী করে ফেললাম। গেইটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। চোখ মুছে গেইটের দিকে তাকালাম, অদ্ভুত সুন্দর একটা গেইট। এরকম গেইট আমি আগে কখনও দেখি নি। বাংলা হরফে লেখা,
বাংলা অক্ষরগুলো পড়ে বুকটা আবেগে কেঁপে উঠল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! কীরকম পাল্টেই না গিয়েছে এখানে সব কিছু! সবুজ গাছপালার ভেদ করে বড় বড় বিল্ডিং চোখে পড়ছে। আমাদের ওই জায়গাটা কী এখনও আছে? আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে ওখানে। আমি কি আর চিনব? সামনের এক যুবককে ডাকলাম।
-“ও ভাই আমায় কলাভবন প্রাঙ্গনটায় নিয়ে যাবেন?”
-“নিশ্চয়ই,” ছেলেটা হেসে বলল। “আমি ওদিকেই যাচ্ছিলাম।”
ছেলেটার ঘাড়ে ব্যাগ, চোখে চশমা। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এখানকার ছাত্র বুঝি?”
-“জ্বি”, ছেলেটা বলল। “আমার নাম সাব্বির, ফাইন্যান্সে আছি, অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। আপনি?”
-“আমার নাম আবুল বরকত। আমি এখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্সে ছিলাম।”
-“ছিলেন মানে?”
-“এরপর আর পড়া হয় নি...”
-“ওহ!” সাব্বির সহানূভুতির গলায় বলল। তারপর জোর করে মুখে হাসি নিয়ে এসে বলল, “অনেকদিন পর এখানে বুঝি?”
-“হ্যাঁ”
-“চলুন আপনাকে নিয়ে যাই।”
সাব্বির আমায় নিয়ে হাঁটতে থাকল। তারপর ভার্সিটির কোনটা কি সেগুলো দেখাতে লাগল। আমি মুগ্ধ নয়নে সব দেখতে লাগলাম। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! যুগের পর যুগ তুমি এভাবে বেঁচে থাকো!
ছেলেটা আমায় কলাভবন প্রাঙ্গনে নিয়ে এল। আমার শুধু সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল। সেইসব আগুনরাঙা দিন! যখন ছেলে-মেয়েরা নিজের অধিকারের কথা বলার জন্য এখানে জমায়েত হত! আজও কি ওরা ওখানে ওরকম একসাথে হয়? প্রিয় প্রাঙ্গনটা কি আজও স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়?
ভুলটা ভাঙ্গতে আমার দেরী হল না। ওখানে পা রাখতেই মনে হল কেউ আমায় কষে থাপ্পড় দিয়েছে। যে জায়গায় ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলা ভাষার জন্য জমায়েত হয়েছিল, যে প্রাঙ্গন মুখরিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে’, আজ সেই প্রাঙ্গনে উচ্চস্বরে গান বাজছে, হিন্দী গান। আমার মনে হুট করে একটা আতংক দেখা দিল। পূর্ব বাংলা কি আর পাকিস্তানের নেই? পূর্ব বাংলা কি ভারতের এখন? জহির থাকলে আজ কীভাবে নিত এটা? ও কি এভাবে চেয়েছিল?
ছেলে-মেয়েরা বিশাল মাইক লাগিয়ে হিন্দী গান বাজাচ্ছে, ছবি তুলছে, আনন্দ করছে। কীসের আনন্দ এটা? তারা সবাই নিজেদের পোশাকের উপরে আরেকটা গেঞ্জি পড়েছে। সাব্বির জানালো আজ নাকি তাদের “র্যাগ ডে” নামক কিছু, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাচ্ছে তাই আনন্দ উৎসব করছে।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাব্বিরকে ধন্যবাদ দিয়ে সরে আসলাম। তলপেটের ব্যথাটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল। আমার ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগছে। সাব্বিরের সাথে কথা বলতে বলতে এক অজানা সম্ভাবনার কথা ভেবে ভেতরটা নেচে উঠেছিল। ওকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, পূর্ব বাংলা কি স্বাধীন কোন দেশ? পাকিস্তানের দাসত্বে আর নয়?
তখন জিজ্ঞেস করতে খুব লজ্জা লাগছিল। ভাগ্যিস আর জিজ্ঞেস করি নি। কিন্তু উত্তর আমি পেয়ে গিয়েছি। আমরা হয়ত এখনও দাসত্বটা ছাড়তে পারি নি। শুধু মনিবেরই বদল হয়েছে, দাসত্বটা থেকে গিয়েছে।
ওদিন হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঢাকা মেডিকেলের ঠিক সামনে যখন মিছিলটা গেল পুলিশ আচমকা গুলি চালানো শুরু করল। সবাই ছোটাছুটি করছে এমন সময় মনে হল আমার তলপেটটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে চারপাশ। তীব্র যন্ত্রণায় আমি লুটিয়ে পড়লাম। আমাকে যখন ধরাধরি করে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আমি শুনলাম আমি ওদের বলছি, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি বাঁচব না, বিঞ্চু প্রিয়া ভবন পুরানা পল্টনে খবর পৌঁছে দিবেন...”
এরপর আর মনে নেই। আজ যখন জাগলাম অনেক দেরী হয়ে গেছে। হয়ত দেরী হয় নি, সব শেষ হয়ে গেছে। যে সম্ভাবনার কথা আমি ভাবছিলাম সেটা আসতে আরো একশ-দুইশ বছর লেগে যেতে পারে।
আমি ফিরতে শুরু করলাম। আমাকে ওই আজিমপুর গোরস্তানে আবার ফিরে যেতে হবে।
(একটি কাল্পনিক লেখা। জহির আর সাব্বির চরিত্রটির সাথে ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই)
রাসিক রেজা নাহিয়েন
মন্তব্য
অসাধারন লেখা।অনেক লেখা পড়েছি।তবে আপনার গল্প অন্য স্বাদের।ভিন্ন মাত্রার।ধন্যবাদ।
রিয়াজ নূর।
ধন্যবাদ আপনাকে।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
ভাল লাগল
@আকাশ মামুন
ধন্যবাদ।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
রাসিক রেজা নাহিয়েন
ভাল্লাগলো !
ধন্যবাদ।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। খুব ভাল লিখেছেন।
-রীনা আচার্য্য
ধন্যবাদ।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
অনুভূতিটা অন্যরকম। প্রিয় ক্যাম্পাস কত কালের সাক্ষী!
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আসলেই। তবে যখন জুনিয়র হয়ে সিনিয়রদের দেখি ঢাবিতে নর্থ-সাউথ, ব্র্যাকের ইয়ো ইয়ো পোলাপানদের মত আচরণ করতে তখন ইতিহাসটার কথা ভেবে খারাপ লাগে।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
পূর্ব বাংলায় এখন নব্য মনিব, আর আমরা চোখ খুলে ঘুমাচ্ছি। দেখুন এই লেখার জন্য আপনাকে আবার কেউ পাকিস্তানপন্থী ট্যাগ দেয় কি না। আমরা তো আবার জাত্যভিমান ভুলে যাওয়া জাতি
চিন্তার বিষয়
রাসিক রেজা নাহিয়েন
নতুন মন্তব্য করুন