-ভাবী, আমার ছেলে তো আমাকে মা ডাকছে না।
-ওকে মা ডেকে ডেকে ,ওর সাথে কথা বলেন।
শুরু হল আমার অভিযান। উঠতে ,বসতে তাকে 'মা' ডেকে কথা বলা। "কি মা... ,মা কি হয়ছে...মা তুমি খাবে, মা তুমি যাবে..."। বেশ কিছুদিন পর পরীক্ষার পালা। ছেলেকে বললাম "টুকু ,মা কোথায়?" ছেলে আমার হেসে হেসে নিজেকেই দেখিয়ে দিল।
তারপর শুরু হল বাবার অভিযান। " বাবা আসো, বাবা টা টা দাও, বাবা দেখো ..."। তারপর আবার পরীক্ষা "টুকু, বাবা কোনটা?"। পরীক্ষার ফলাফল একই। সেই বাবা ,সেই মা।
আমার অপেক্ষা বাড়তে থাকল। ছেলেটা বয়স দুই পার হল। কিন্তু স্পষ্টভাবে আমাকে উদ্দেশ্য করে তার মুখে "মা" ডাক শুনা হলো না ( শুরুর দিকে বাতাসে বাতাসে মা বলেছিল কয়েকবার)। যদিও সে এক শব্দের অনেক কিছু বলছে (যাব,খাব)। এই বয়সে তার দুই শব্দ একত্র করার কথা। কিন্তু তা না করলেও ,ভাবছি না খুব দেরী করছে। কারণ চিকিৎসকরা বলেছেন " প্রিম্যাচিয়্যুর বেবিদের এমন ডিলে থাকে"। তাই অনেক কিছু বাদ দিয়ে "মা" শব্দের মাঝে আমার অপেক্ষাটা আটকা পড়ে আছে।
যেদিন প্রথম আমি তার অস্তিত্ব অনুভব করি,সেদিন থেকে অপেক্ষা তৈরী হয় সে দেখতে কেমন হবে। তারপর যখন সে তার জন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই আমার কোলে চলে আসল, তখন অপেক্ষার খাতায় আরো অনেক কিছু যোগ হতে থাকল (কবে হাসবে,কবে বসবে,সময় চলে যাচ্ছে হাঁটছে না কেন...)। ধীরে ধীরে বসা শিখল,হাঁটা শিখল। কিন্তু "মা" কে , "মা "কোনটা তা দেখিয়ে দিতে পারল না। মাকে অনুভব করে তা মুখে মা ডাক আসল না। একদিকে তার বয়স গড়াচ্ছে আর অন্যদিকে আমার অপেক্ষার অস্তিরতা বাড়ছে।
একদিন কিছু অপরিচিত(তার জন্য) মাঝে ছেড়ে দিয়ে,কিছুক্ষন পর সামনে গেলাম। সে তার আপন জনকে পেয়েছে এমন ভঙ্গি আর হাসি নিয়ে ছুঁটে আসল আমার কাছে। হাত বাড়িয়ে জড়িয়েও ধরল। কিন্তু "মা" বলল না।
অন্য একদিন তার বাবা বাইরে থেকে দরজার কড়া নেড়ে নেড়ে আমাকে ডাকতে থাকে। আর সে দৌড়ে গিয়ে ভেতর থেকে বাবার সাথে এক তালে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। তার মুখে আমার নাম শুনে ,খুশিতে রান্না ঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে, তার বাবাকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখে, তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা ডাক না শুনলেও ,মায়ের নাম তো নিয়েছে দেখে নিজের মনে মনে হাসতে থাকলাম। একই দিনে কয়েক ঘন্টা পর বাড়ীর মালিক কড়া নাড়ল। আর টুকু বাবা তার বাবার কোল থেকে নেমে,দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আবার আগের মত করে আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল। তখন বুঝলাম নামটার সাথে সে দরজার কড়া নাড়ার সম্পর্ক খুজে নিয়েছে। পরে দেখলাম এই কাজটি যে কেউ দরজা নাড়লে সে করছে । আসলে সে তার মাকে ডাকছে না। ভাবত ভাবতে আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল কবে মা ডাক শুনবো এই অপেক্ষায়।
অন্যদিকে চিকিৎসক বলল "স্পীচ ডিলের স্পীচ থেরাপিষ্ট নিন" ।নিলাম, সপ্তাহে দুই দিন করে আসে । বিভিন্ন খেলনা ,ছবি বই সহ নানা রকম সরঞ্জাম নিয়ে আসে। তার শব্দ ভান্ডার উন্নত করার জন্য। ছেলে আমার ম্যাংগো বলে ; মা বলে না। ছেলে আমার মাঙ্কি বলে, কিন্তু মা বলে না। ছেলে আমার 'মুন" বলে ; মা বলে না।
-মা, আমার ছেলে আপেল দেখিয়ে দেই,লাল,নীল রঙ দেখিয়ে দিতে জানে। কিন্তু মা কোনটা তা দেখিয়ে দিতে জানে না। এমন কেন হচ্ছে?
-ডাকবে, ডাকবে। এক বাচ্চা একেক রকম। তাছাড়া তোরা থাকিস বিদেশে, তোকে আর জামাইকেই সারাক্ষন দেখছে। সে অন্য কাউকে দেখছে না। সমবয়সী কাউকে, মা ডাকতে শুনছে না। তার উপর ঘর থেকে বাইরে গেলে তো ইংলিশ । দেখবি মামি, মেমি, মাম্মা সব ডাকবে।
-দুই বছর হয়ে গেল। কবে সময় হবে? মামি না "মা" শুনতে ইচ্ছে করছে মা।
-ধৈর্য্য ধর হবে। অস্তির হইস না। দেশে তো অনেকে মামি ডাক শুনার জন্য মিডিয়ামে পড়ায়। আর তুই মিডিয়ামের দেশে থাইকা "মা মা" ডাক শুনতে চাস। উল্টো দুনিয়া।
মায়ের কথায় সান্তনা পেলাম কিন্তু অপেক্ষার সাথে যোগ হয়ে গেল ভয় (সংকর বংশধরের)। কয়েক বছর পর স্কুলে যাবে। মা ডাক শুনার আকুতিতে নাকি আবার মাম্মি ডাক শুনতে হয়।
(ল্যাপটপ বেহাল দশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর আমি সচলে সচল হতে পেরেছি। লিখাটি ফেব্রুয়ারী মাসে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। পূরণ হল)
এ্যানি মাসুদ
মন্তব্য
মাত্র দুবছরেই ওতো উতলা হলে চলে! কথা বলতে শুরু করলে মাথা ধরায়া দেবে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
মাথা ধরে আছে,কথা বললে ছেড়ে দিবে।
নিশ্চয়ই ও একদিন মাকে ‘মাম্মি’ না বলে ‘মা’ বলেই ডাকবে
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
এ্যানি মাসুদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনার লিখাগুলো পড়ার সময় আপনার নাম নিয়ে মনে প্রশ্ন আসে "সাক্ষী সত্যানন্দ" এর সহজ বাংলা কি হবে?
এ্যানি মাসুদ
খুব ঝরঝরে লেখনী আপনার। এটা গল্প নাকি সত্যি?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
লিখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ইহা একটি সত্যি গল্প।
এ্যানি মাসুদ
আমার ছেলেও এরকম অনেক দেরিতে কথা বলেছে। মহা ভয়ে থাকতাম, মন খারাপ হতো।
পরে এমন কথা শুরু করেছে আক্ষরিক অর্থে বুঝতে পারলাম নিস্তব্ধতা হিরন্ময়!
এটা কি আগের ঘটনা নাকি এখনকার? এখনকার হয়ে থাকলে একটু অপেক্ষা করুন।
প্রথম যেদিন মা বলে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আপনার ওপর,
সেদিন আরেকটা ব্লগ লিখে দেবেন।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
হ।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
"ডাকবে, ডাকবে। এক বাচ্চা একেক রকম।" - আমি তাই বলি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এ্যানি আপা আমার মনে হয় আপনার চিন্তার কিছুই নাই। আমার বোনের বাচ্চাটাও খুব দেরীতে কথা শিখেছিল। সম্ভবত বিদেশে ঘরে বাইরে দুধরনের ভাষার ব্যবহার হয়তো এতে প্রভাব ফেলে কিংবা আরো অন্য কারন থাকতে পারে। দেশে আশে পাশে এত লোকজন থাকে যে প্রায় দেখা যায় একজন না একজন বাচ্চাকে কোলে নেবার পরই বলে যাও মার কাছে যাও। অথবা বড় কেউ কথা বলার সময় বার বার মায়ের প্রসঙ্গ এসেই যায় যেমন মা আজকে কি খাইয়েছে?, মা কিবকেছে? ইত্যাকার নানান কথা। অনেক লোক যখন এভাবে বলতে থাকে তখন দেশে একটা বাচ্চা বুঝে যায় কাকে মা ডাকতে হবে। চিন্তাটা তবু থাকেই কেননা এইটাই সন্তান বাৎসল্য। জীবনটা জুড়ে থাকবে, ভাবিয়ে তুলবে এর জন্যই তো সন্ততি। উপভোগ করুন আর আমাদের লেখা দিন আপনার অনুভব নিয়ে।
সোহেল ইমাম
তাই যেন হয়।
মাত্র একটা লেখা পড়ে আসলাম-সেরকম''ওমা কি কিউত''!
মাথা ধরায় ফেলবে আপা। ইচ্ছা করবে মুখ বাইন্দা রাখতে। সারাক্ষণ বলবে। শেষমেষ বলবে, আমার কথাতো শোনই না, খালি অফিস থেকে এসে নিজেরাই খালি কথা বলো!
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
সাদিয়া আপু আপনার মত কি কিউত হয়? মাথা ধরার ভেতরেই যে আমার সুখটা লুকোচুরি খেলছে।
এ্যানি মাসুদ
পাঠকরা এই পর্যন্ত যা মন্তব্য করেছেন সেগুলোর ওপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে এই বিষয়টাতে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। আমার মনে হয় আপনাদের উচিত বাচ্চাকে নিয়ে অবিলম্বে counselor-এর কাছে যাওয়া। এটা খুব বড় বিষয় নয়। হয়তো এটার দরকারও নেই। কিন্তু যদি দরকার থেকে থাকে তাহলে পরে অযথা দেরি করার জন্য পস্তাবেন। তাই অবহেলা না করে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
আপনাদের সন্তানের জন্য পৃথিবীর সব শুভ কামনা রইল। আশীর্বাদ করি অচিরে তার কণ্ঠে 'মা' 'বাবা' ডাক শুনতে শুনতে আপনাদের কান ঝালাপালা হয়ে যাক।
নতুন মন্তব্য করুন