তিন প্রহরের বিলের মাঝির কথা
সুনীল আমাকে নিয়ে আক্ষেপ করেছিল।
কখন, কোন মুহূর্তে তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম বিল দেখাতে নিয়ে যাব- মনে নেই। শুধু মনে আছে, যে বিলের মাঝি ছিলাম, সেই বিল রিক্ত ও নিঃস্ব হতে শুরু করে বহু আগে থেকেই। হতে পারে সুনীলকে কথা দিয়েছিলাম, আর সুনীল তা ৩৩ বছর ধরে মনে রেখেছে। কিন্তু সে কি একটি বারের মতো ভেবে দেখেছে, যে বিলে তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, সেই বিল আদৌ আছে কিনা! সে কি একটি বারের মতো আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছে, যে আমি তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, সেই আমি-ই আছি কিনা! কোন কবি নাকি বলেছিলেন- মানুষ বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়, সময়ে-অসময়ে বদলায়। কতোটুকু বদলে গেছি, সুনীল সেটি না দেখেই যে আক্ষেপ করলো আপনাদের কাছে, ৩৩ বছর পর সেই আক্ষেপ যে অভিমানের বদলা হয়ে আমার দিকে ফিরে এসেছে, তা আমি কখনোই সুনীলকে জানাবো না। ওই তিন প্রহরের বিলের মাঝখান চিরে তখন থেকেই যে রাস্তা বানানো শুরু করলো, তিন প্রহরের বিল যে এখন ধানক্ষেত, তিন প্রহরের বিল যে আবাসন কোম্পানির সাইনবোর্ডের আস্তানা, তা আমি কখনোই সুনীলকে জানাবো না।
সুনীল ৩৩ বছরের আক্ষেপ নিয়ে মারা গেল। আর আমি, একজন মাঝি, সারাজীবন মাঝি না থাকতে পারার আক্ষেপ, অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ নিয়ে যে বেঁচে আছি- তার কী হবে?
পুঁজিবাদ
বহুকাল আগে তিনটি মাছ ধরেছিলাম- বড়, মাঝারি, ছোট।
বৈঠা বেয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখি ছোট রাইখর মাঝটিকে তাড়া করছে মাঝারি তেলাপিয়া। অন্যদিকে তেলাপিয়ার পেছন পেছন ছুঁটে আসছে বড় এক রাঘব বোয়াল। তাড়াতাড়ি করে সামনের দিকে জাল মেলে ধরলাম। তেলাপিয়া যে-ই না কামড়ে ধরেছে রাইখরটিকে, অমনিকে তেলাপিয়ার লেজে আঙটার মতো দাঁত বসিয়ে দিয়েছে বোয়াল সাহেব। আর রাইখরের মাথা যে জালে আঁটকে গেছে, তা অবশ্য পেছনের দুজনের কেউই খেয়াল করেন নাই। শিকারের লোভে সামনের বিপত্তি কে-ই বা দেখতে যায়!
টান দিয়ে ওদের বসিয়ে দিলাম নৌকার পাটাতনে। বউ বলেছে, ধনিয়া লাগবে।
ওদিকে বাসায় ফিরে দেখি ছোট ছেলে পড়ছে অর্থনীতি। বললাম, চলো বাপ, গফসফ করি। ছেলের কাছে জ্ঞান নিয়ে দেখি, অর্থনীতির তত্ত্ব আছে বড় মাছ গিলে খায় মাঝারি, মাঝারি খায় ছোটকে। ফলে ঠেকায় পড়লে মাঝারি আর ছোট মিলে প্রতিরোধ গড়ে বড়র বিরুদ্ধে। সবসময় না অবশ্য।
পাতে ঝোলের পরিমাণ বেশি হয়ে গিয়েছিল। বউ বললো, ঝোলটা খেতে হবে না, ফেলে রাখো। বরং আরেক পিস মাছ নাও। তিন মাছের তিন টুকরা না খেলে কি শরীর চলবে? শুধু তো দিনেই না, রাতেও তোমাকে কাজ করতে হয়। আহ্
কথা সত্য।
ছেলে আমার অর্থনীতি পড়ে। আর বেশি পড়ে পেপার। শুনেছি এখন নাকি ফেসবুকও পড়ে। সেদিন বলছিল বাংলাদেশের বাজার নাকি চীনা পণ্যে সয়লাব। আমরা নাকি অচিরেই মারা যাবো ওদের চাপে। ওদিকে বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি না গড়তে দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ আর চীন নাকি মার্কিনিদের বিরুদ্ধে একাট্টা। কী যানি বাপু! পুঁজিবাদ আমার সহ্য হয় না মোটেও। মাছ আর বউ হলেই চলে। কে বড়, কে মাঝারি আর কে ছোট, তা দিয়ে আমার কী? আমার দরকার মাছ! সব মাছই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
মাবিয়ার কান্না
মাবিয়া নামক যে মেয়েটি কদিন আগে আসামে স্বর্ণপদক পেলো ভারোত্তোলনে, ওর কান্না দেখে রাগই হয়েছিল। একদিকে আমরা হারামজাদাদের পতাকা নিয়ে নাচানাচি করে কুল পাই না, পাইলে নিজের পশ্চাৎদেশ বাড়িয়ে দিই ঠেলা খাওয়ার জন্য, সেখানে এসব নাকি-কান্না কীসের? দেখতে পাস না তোদের অর্জন নিয়ে কারো কোনো কথা নেই! দেখতে পাস না, তোদের অবহেলা করতে পারলে বেঁচে যায় এই দেশের লাখ লাখ পশু? দেখতে পাস না, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকাটিকে অসম্মান করার জন্য একপায়ে খাড়া অনেক জারজ সন্তান?
কাঁদিস কেন মাবিয়া? যদি পারিস, কোনোদিন, তোর ওই ভারোত্তোলনের ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে দিস ওদের। চাপা দিয়ে দিস সমস্ত পাকিপনাকে। দেখিস, সেদিন তোর সাথে কাঁধ মিলে আমিও কাঁদব।
নাদের আলী
nader80ali অ্যাট gmail.com
মন্তব্য
দারুণ! বলতে থাকুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনেক অনেক ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলাম।
অনেক ধন্যবাদ।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর।
সোহেল ইমাম
অনেক ধন্যবাদ।
নাদের আলী
সুন্দর
ধন্যবাদ
অনেকদিন পর অন্য রকম একটা লেখা পড়লাম। আপনার লেখার ধরন খুবই চমৎকার। হাত খুলে লিখতে থাকুন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
উৎসাহমূলক মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার! আরও বলুন (তাড়াতাড়ি, এই পোস্ট পরের পাতায় যাওয়া মাত্রই)। কেমন যেন সুন্দর অথচ বিষণ্ণতায় মোড়ানো লেখাটা।
শুভেচ্ছা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন