একজন জেনেটিক-পরিবেশ বিজ্ঞানী আর ম্যামথের ক্লোন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৮/০৩/২০১৬ - ১১:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মাঝে ভাবি- আমাদের সন্তানেরা যখন পেশাজীবি হবে, আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর পর, তখন তাদের কর্মক্ষেত্রটা কেমন হতে পারে; কেমন হতে পারে তাদের পদবীগুলো। হলফ করে বলতে পারি যে ত্রিশ বছর আগে আমাদের বাপ-মা’রা কখোনো ভাবতে পারেননি তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ হবে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার, আইটি (IT) স্পেশালিষ্ট, মেমস (Microelectromechanical systems) প্রসেস ইন্টিগ্রেসন ইঞ্জিনিয়ার, মাইক্রোবায়োলজিষ্ট, গ্রাফিক রেকর্ডিং আর্টিষ্ট, সুইট আলকেমি (Sweet Alchemist), ইত্যাদি ইত্যাদি; কত যে গালভরা পদবী, তা লিখে শেষ করা যাবে না (উল্লেখ্য যে শেষ পদবীটি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বিলাস নয়, সেদিন এক রান্নার অনুষ্ঠানে জনৈক কেক বিশেষজ্ঞের এই টাইটেলটা দেখে আমার তো প্রায় ভির্মি খাওয়ার দশা)। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি যেভাবে ঘোড়ার মত লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে এগোচ্ছে তাতে আজকালকার পদবীগুলো এন্ডেঞ্জার্ড স্পিসিসের গোত্রভুক্ত; অচিরেই বিলুপ্ত হল বলে!

টেড টকশোতে ডঃ বেথ স্যাপিরোর বক্তৃতা শুনতে গিয়ে মনে হল উনি বড়সড় রকমের পরিচিতি সঙ্কটে (Identity Crisis) ভুগছেন, বক্তৃতার শুরুতে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে একবার বললেন যে তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির একজন “ইমারজিং এক্সপ্লোরার” বা ভূঁইফোড় অভিযাত্রী, আরেকবার বললেন যে তিনি “আণবিক জীবাশ্ম-প্রত্নবিদ” (Molecular Paleontologist), আর সেমিনারের ব্রোশুরে লিখা ছিল যে উনি সান্টা ক্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী-পরিবেশ আর বিবর্তন বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। ওনার প্রেজেন্টেশনের আর খানিকটা শোনার পর বোঝা গেল যে কি কারণে এই টানাপোড়েন; “আণবিক জীবাশ্ম-প্রত্নবিদ” হিসেবে ওঁর কাজকারবার এক্কেবারে মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে সবার! ওনার এই কাজকারবারের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে জিনতত্ত্বের গবেষণা (Genetic Research)। দেখা যাক, সে ব্যাপারে বোধগম্য কিছু লিখতে পারি কিনা, বাঙলাভাষায়।

পাগলের প্রলাপ মনে হলেও ইদানিং বিজ্ঞানীরা বলছেন যে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল আর তরু-লতা-গুল্ম সকলে একেকটা বইয়ের মত, চাইলে পড়ে ফেলা যায় ওদের ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান; পড়বার কায়দাটা জানতে হবে অবশ্য। এই ধরুন আমরা মানুষেরা, আমাদের শরীরে সর্বমোট কোষের (Cells) সংখ্যা এক নিযুত-কোটি (১০০ ট্রিলিয়ন), এগুলোর অধিকাংশের সাইজ এক মিলিমিটারের দশ ভাগের একভাগ। প্রতিটি কোষের মধ্যে ছোট্ট কাল ফোঁটার মত নিউক্লিয়াস, আর তার ভিতরে দুই সেট পরিপূর্ণ মনুষ্য জিনোম (কেবল ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মধ্যে আছে একখানা সেট)। মজার ব্যাপার হল যে এই একেকটি জিনোমের মধ্যে ত্রিশ থেকে আশি হাজার জিন সাজানো আছে ২৩ টি ক্রোমোজোমের আকারে। পিতৃ আর মাতৃ-জিন গুলোর ভেতর খুব সামান্যই প্রভেদ, এই সামান্য প্রভেদ্ই কিন্তু কার চোখের রঙ কি রকম হবে, নাকটা লম্বা না বোঁচা হবে, কার হবে দীঘল কাল কেশ এসব ঠিক করা আছে। এই জিনোমকে তুলনা করা যেতে পারে একটা বই হিসেবে -

-জিনোম বইয়ে তেইশটি চ্যাপ্টার, এরা “ক্রোমোজোম” (Chromosome)।

-প্রতিটা চ্যাপ্টারে কয়েক হাজার গল্প, এই গল্পগুলোই “জিন” (Gene)।

-প্রতিটি গল্পে আছে প্যারাগ্রাফ, এদের নাম “এক্সন” (Exon)।

-প্রতিটি প্যারাগ্রাফে আছে অসম্ভব সুন্দর সব শব্দের সমারোহ, এরা “কোডোন” (Codon)।

-প্রতিটি বাক্যে রয়েছে অভিনব কিছু অক্ষর, এদের নাম “বেইস” (Base)।

ভাবতে পারেন - এক বিলিয়ন শব্দের সমন্বয় এই পুস্তক, প্রায় ৮০০ বাইবেল আর ১৩০০০ কোরান শরীফ সাইজের! আমি যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি করে শব্দ পড়তাম তবে এই বই পড়ে শোনাতে শতবর্ষ পেরিয়ে যেত, যদি পাশাপাশি একটি একটি করে শব্দ লিখে যেতাম এবং এক মিলিমিটার জা্যগা লাগত সেটা লিখতে, তবে এই জিনোমের দৈর্ঘ্য হত দানিয়ুব নদীর সমান। কিন্তু কি আশ্চর্য! এহেন সুবিশাল দানবাকৃতির বইখানাকে কিনা আটানো হয়েছে ছোট্ট আণুবীক্ষণিক নিউক্লিয়াসের ভিতর! এ কি আজব লীলা!

জিনোমকে বইয়ের সাথে তুলনাটা কিন্তু কেবল রূপক-অর্থে নয়। বইপুস্তক আসলে কি? তথ্যের সাংগ্রহিক সঙ্কলন; যা কিনা লিখিত হয় সরল-রৈখিক (linear), এক-মাত্রিক (one-dimensional) আর একমুখী (one-directional) আকৃতিতে; যার সার্বজনীন অর্থ, আবেদন সংজ্ঞায়িত হয় কতক কোড বা সঙ্কেতের মাধ্যমে এবং এইসব কোড তৈরী করা হয় একটা বর্ণমালার গুটিকতক বর্ণবিন্যাসের (groupings) পথ বেয়ে। জিনোমের গড়ন হুবহু একই, ওটি আক্ষরিক ভাবেই একখানা পুস্তক! কেমন অদ্ভুত শোনালো, না? মজার ব্যাপার হল যে বাংলা-ইংরেজী বইগুলো আমরা সব সময় বাম দিক থেকে ডান দিকে পড়ি, কিন্তু জিনোমের কিছু অংশ পড়তে হয় ডান থেকে বাঁয়ে আবার কিছু অংশ পড়তে হয় বাঁ দিক থেকে ডানে; অবশ্য এই বাম-ডানের ঘটনাটা ত্রিমাত্রিক জগতে কিছুটা আপেক্ষিক।

ইংরেজী বইয়ে ছাব্বিশটি হরফের ভান্ডার থেকে নিয়ে একটি-দুটি অথবা একাধিক অক্ষর পাশাপাশি সাজিয়ে বানানো হয় একেকটি শব্দ; কিন্তু জিনোমের তাবৎ শব্দ মাত্র তিনটি হরফ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, ত্রি-আক্ষরিক। আর ওর বর্ণমালায় আছে মাত্র চারটি অক্ষর বা বেইজ; A (এডেনিন), C (সাইটোসিন), G (গুয়ানিন), T (থি্যামিন)। আমাদের বইয়ের অক্ষরগুলো যেমন কালিতে লেখা হয়, জিনোম বইয়ের এসকল হরফ প্রোটিনে গড়া; আর সমতল কাগজের বদলে লেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় অন্য জিনিস- চিনি আর পেপটোডের লম্বা চেইনের ধারে ধারে হরফগুলো বসিয়ে মালার মত গড়া ডি-এন-এ পরমাণু দেখলে যে কারো মনে হবে-আরে এতো দেখছি সপ্তমাশ্চর্যকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। এরকমই দুটো বিশাল লম্বা ডি-এন-এ পরমাণু নিয়েই তৈরী একেকটি ক্রোমোজোম, আমাদের জীবন্মালা! চিন্তা করুন-যদি এই বিশাল গ্রন্থটা পড়ার কায়দা জানতে পারেন তাহলে কি মজাটাই না হয়! মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস চলে আসত হাতের মুঠোয়, রোগ-শোক বালা-মুসিবত নিরাময় করা তখন কোন ব্যাপারই হত না আর। কিন্তু এই বিদ্যা রপ্ত করা আসলে এত সহজ নয়, ডক্টর স্যাপিরোর মত ব্রিলিয়ান্ট বিজ্ঞানীদেরও এটা করতে গিয়ে রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে!


চিত্র ১- কোষ, জিনোম আর ডিএনএ

যাইহোক অনেক আগরুম-বাগরুম বলা হয়ে গেল, এবার মূল বিষয়ে ফেরত যাওয়া যাক- ডক্টর স্যাপিরোর লেকচার। ডঃ স্যাপিরো নিজের পদবী নিয়ে যতই হাতি-ঘোড়া মারুক না কেন আসলে ওনার গবেষণা এমন একটি বিষয় কেন্দ্রিক যেটা এ যুগের মনুষ্য সমাজে হরহামেশাই আলোচনা হচ্ছে, অনেকের কাছেই ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, এইতো সেদিনই প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বয়ং এই সম্পর্কে অনেক গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দিয়ে দিলেন এক বিশেষ সম্মেলনে। বিষয়টা – পরিবেশের বিরূপ পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব-উষ্ণায়ন! এটা সর্বজন বিদীত যে গত একশত বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ুর যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তাতে তাবৎ প্রানীকূলের মাথার উপর বিপর্যয় প্রায় নেমে এল বলে; পত্রপত্রিকা খুললেই আমরা ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে নিত্যদিনই কোন না কোন আর্টিক্যাল দেখি যেগুলোর শুরু অথবা শেষটা অনেকটা এরকম – “ হে মানব, প্রস্তুত হও! তোমাদের নরকবাস সমাসন্ন”। কিন্তু বেথের মত বিজ্ঞানীরা হাত পা গুটিয়ে, মাথা নিচু করে এহেন ভবিতব্য স্বীকার করে নেবার পাত্রপাত্রী নন। উনি তলিয়ে দেখতে চান আদৌ এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা আর যদি যায়ও, সেটা কিভাবে। এজন্যে জীনবিদ্যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। আগামি শতাব্দীতে, এমনকি আগামি কয়েক দশকে জলবায়ুর পরিবর্তন সমস্ত প্রজাতির প্রাণীকূলের ডিএনএ-তে যে পরিবর্তনের ছাপ ফেলবে সে ব্যাপারে কোনই সন্দেহের অবকাশ নেই। সমস্যা হল- আজকের ডিএনএ প্রোফাইল দেখে কিভাবে একশ বছর পরে কি হতে পারে তার কোন ভবিষ্যত বাণী করা যায়? মোটামুটি একটা অভিনব সমাধানও বের করে ফেলেছেন বেথের মত আণবিক জীবাশ্ম-প্রত্নবিদেরা এই কঠিন সমস্যার।

পরিবেশবিদ্যায় যাদের একটু আগ্রহ আছে এবং এ বিষয়ে পেপার-টেপার পড়েন, তাঁরা একটি গ্রাফ দেখলেই চিনে ফেলতে পারবেন – মাইকেল ম্যানের হকিষ্টিক প্লট (চিত্র-২)। হকিষ্টি্কের মত দেখতে এই রেখাচিত্রটিতে গত একহাজার বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রার অবস্থা সম্পর্কে ধারনা করা যেতে পারে; ১৯০২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নিখুঁত পরিমাপ আর বাকি সময়টার নিস্বন তথ্যভিত্তিক (Noisy Data like tree rings, ice-cores, sub-fossil pollens, etc.) আনুমানিক মাপ। একটা মজার (অথবা ভীতিজনক) ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় এতে – গত একশত বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রার অস্বাভাবিক দ্রুত বেড়ে যাওয়া। যেখানে ১০০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা প্রায় সমান ছিল, সেখানে ১৮৯০ এর পর থেকে আজ অবধি তাপের বৃদ্ধি এক ডিগ্রীরও বেশি! “এক ডিগ্রী” শুনতে তেমন কোন ব্যাপার মনে না হলেও, ভেবে দেখুন যদি এহেন হারে টেম্পারেচার বাড়তে থেকে, তবে আগামি কয়েক শতাব্দীতে কি হতে পারে বলুন তো? ঘোর কেয়ামত!

চিত্র ২- হকিষ্টিক রেখাচিত্র

ডঃ বেথ অবশ্য এতে মনে হল তেমন বিচলিত নন। কারণ উনি আরেকটি রেখাচিত্র নিয়ে আলোকপাত করলেন ওনার বক্তৃতায়, ভোষ্টক তুষার মজ্জা থেকে পাওয়া গত ৫০ হাজার বছরের তাপমাত্রার ডেটা সমৃদ্ধ গ্রাফ। কেমন অবিশ্বাস্য সব গবেষণা (চিত্র -৩)! মেরু অঞ্চলে বছরের পর বছর তুষারের আস্তরনের সাথে জমা পরতে থাকে সে সময়কার জলবায়ুর সূক্ষ সব উপাদান (বায়ুবাহিত ধূলিকণা, ছাই, রেণু, ইত্যাদি)। একেকটি গভীর আইস কোর-এ নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত এসব সূক্ষ উপাদান (Climatic Proxies) বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা হাজার বছরের পৃথিবীর তাপমাত্রা বলে দিতে পারেন। এমনই একটি আইস-কোরের ডেটা থেকে দেখা যায় যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নতুন কোন ব্যাপার নয়, আগেও ঘটেছে এমন ঘটনা।

চিত্র ৩ – মেরু তুষার মজ্জা থেকে নিখুঁতভাবে বের করা পঞ্চাশ হাজার বছরের তাপমাত্রা

গ্রাফটার অনুভূমিক অক্ষে (x-axis) আছে এখন থেকে কত বছর পুরোনো দিনের ব্যাপার, সে সংখ্যাটা; আর দুটা অনুলম্বিক অক্ষের (y-axis) প্রথমটাতে আছে বর্তমান অর্থাৎ শূণ্য বছরের তুলনায় বাতাসের তাপমাত্রার পার্থক্য (নীল রেখার জন্যে); আর ডানদিকের দ্বিতীয়টাতে আছে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ (হলুদ রেখাটার জন্যে)। একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে দেখা যায় যে গত একশ বছরে যেমন করে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়েছে তার চাইতেও অনেক অনেক দ্রুত গতিতে টেম্পারেচারের পরিবর্তন ঘটেছিল আজ থেকে পনেরো থেকে বিশ হাজার বছর আগে। সে সময়টা এসেছিল হলোসীন আইস এজ বা তুষার যুগের ক্রান্তিলগ্নে । কি আজব ব্যাপার! তাহলে কি গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর দায় একদমই মানুষের নয়, অন্য কোন কারণ যার জন্যে বিশ হাজার বছর আগেই এমন ঘটনা ঘটেছিল? এতদিন যে বিজ্ঞানীদের একটা বড় দল পরিবেশ নিয়ে মানব সম্প্রদায়ের যথেচ্ছাচারকেই দায়ী করছিলেন সেগুলো কি আসলে মিথ্যে কথা, তাহলে কি সুবিধাবাদী রিপাব্লিকান রাজনীতিবিদরাই ঠিক - এমন বিতর্ক করে অর্থহীনভাবে সময় নষ্ট করবার পাত্রী নন ডঃ বেথ। বরং এই উষ্ণায়ন সেই সময়ের প্রাণীজগতের উপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা জানতে ডঃ বেথের মত অনেকেই আশ্রয় নিচ্ছেন ফসিলের ডিএনএ বিশ্লেষণ পক্রিয়াতে, উদ্দেশ্য হল যে– এই তথ্য থেকেই হয়তো বের করা যাবে আমাদের সমাসন্ন বিপর্যয় মোকাবেলার উপায়। তবে কাজটা খুব একটা সহজ নয়; বিশেষ করে যখন কোন মৃত-প্রাগৈতিহাসিক জিনোমের অনুক্রমিক বিন্যাস (Sequencing) করতে গিয়ে দেখা যায় বহুদিন ধরে যেন-তেন ভাবে পড়ে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ঢুকে পড়েছে জিনের ভিতর। প্রায় সময়ই দেখা যায় যে এসব ফসিলের হাড্ডি-গুড্ডিতে মূল প্রাণীটির ডিএনএর খুব সামান্য অংশই অক্ষুন্ন আছে, বাকিটা কলুষিত থাকে হাজার বছরে জমে ওঠা বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টিরিয়া, উদ্ভিদের ডিএনএতে; এমনকি স্বয়ং প্রত্নতত্ত্ববিদের জিনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ওগুলোতে, খোড়াখুড়ির সময় ধুলোবালিতে হাঁচি-কাশি সামলাতে পারে কজন! তবে,হাঁ, ফসিল যদি খুব ঠান্ডা কোন জায়গা থেকে খুঁড়ে তোলা যায় তবে তাতে বিজাতীয় ডিএনএর সংক্রমনের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একদম উত্তর-পশ্চিমের এলাকাগুলো আর উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার যে জায়গাগুলো স্যারা পালিনের ব্যাকইয়ার্ড হিসেবে বিখ্যাত সেসব জায়গাতেই দেখা গেছে এ ধরনের হিমায়িত খুঁতহীন জীবাস্মর ছড়াছড়ি। বেরিংজিয়া (Berengia) নামেই বেশী পরিচিত এই এলাকার চেহারা বিশ-ত্রিশ হাজার বছর আগে ছিল একদম অন্যরকম। এখনকার মত প্রাণহীন হিমশীতল তুন্দ্রা ছিল না এটা সেসময়; পশমি (wooly) ম্যামথ (আজকালকার হাতির প্রায় একই সাইজের), ম্যাস্টাডন, পশমি গন্ডার, দু-তিন ধরনের ঘোড়া, ষোলফুট লম্বা দানবাকৃতির কাল ভালুক, আরও অসংখ্য নাম না জানা প্রাগৈতিহাসিক প্রাজতির বিচরন সমৃদ্ধ একটা সুফলা-নয়নাভিরাম তৃণভূমি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। একটা মজার কথা না বললেই নয়, এখন যেখানে বেরিং সাগর, বেরিং প্রণালী এশিয়া আর আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সেই সুপ্রাচীন কালে কোনই বিভাজন ছিল না এই দুই মহাদেশের। আর সে ভূব্রীজের উপর দিয়েই এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে অভিবাসন চালাত এসব প্রাণীকূল। বলা যেতে পারে আমেরিকার অভিবাসী সমস্যার সূত্রপাত সেই প্রাগৈতিহাসিক কালেই !

চিত্র ৪-বেরিংজিয়ার ম্যাপ

চিত্র ৫-বেরিংজিয়া ত্রিশ হাজার বছর আগে (আর্টিস্টের তুলিতে)

তারপর তুষার যুগ চলে গেল, বরফ গলে সাগরের জলের উচ্চতা অনেক বেড়ে উঠল, তলিয়ে গেল বেরিংজিয়ার ভূব্রীজটা, হারিয়ে গেল মেগাথনদের পায়ের আওয়াজ। কিন্তু ঠান্ডায় জমানো মাটির নীচে চাপা পড়ে রইল ইউনিক সব ফসিলের ভান্ডার। ডঃ বেথের অভিযাত্রী-বিজ্ঞানী দলের জন্যে এ যেন স্বর্ণখনি! হিমায়িত মাটি, যাকে কি না বলে পার্মাফ্রস্ট (Permafrost), তা গলিয়ে বের করে আনতে শুরু করলেন সাতশ হাজার বছর আগের ঘোড়া, ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর পুরোনো ম্যামথ, বাইসন, গুহা সিংহ, ইত্যাদি, ইত্যাদির সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত জিনোম ভর্তি হাড়-গোড়। একেক সময়ের জিনোম কোডের বিশ্লেষনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে লাগল একেকটি স্পিসিজের ইতিহাস – ওদের খাদ্যাভাস কেমন ছিল, ওদের বিচরন ক্ষেত্রের পরিবেশ কি ছিল, ওরা কি সেই মহূর্তে বিলুপ্তপ্রায়, নাকি বিলুপ্তির হুমকি কাটিয়ে জৈবিক-বৈচিত্রে (Bio-diversity) ভরপুর ওদের জ্ঞাতিগুষ্টি, বাতাসের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে চলতে পারছে কি না; টেড টকশোতে এহেন তথ্যসম্ভারের কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর স্যাপিরোর চোখদুটো চকচক করে উঠছিল, উত্তেজনাতে হাত-পা ছোড়াছুড়িও বাদ পড়ছিল না – আবেগোচ্ছাসে ভরা পাগলা-বিজ্ঞানীদের যা হয় আর কি!

বক্তৃতার এক পার্যায়ে একটু কপট রাগ, একটু কপট অভিমান ভরা কন্ঠে বললেন যে উনি প্রায়ই যখন এসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা নিয়ে বাজেট কমিটি বা বিদগ্ধ একাডেমিয়াদের কাছে কোন প্রেজেন্টেশন করেন তখন শেষমেষ সবার একটাই প্রশ্ন থাকে – "তোমার এই জেনেটিক বিদ্যা আর সিকোয়েন্সিং কাজে লাগিয়ে তুমি কবে পশমি ম্যামথের ক্লোন বা হুবহু জীবন্ত রেপ্লিকা বানাবে?" বলে কি , হায়! এদিকে কেয়ামত আসন্ন, আর পরিবেশ-টরিবেশের চিন্তা বাদ দিয়ে এরা কিনা চায় ম্যামথের মত প্রাগৈতিহাসিক দানবের পূনরুজ্জীবন!

(অদূর ভবিষ্যতে মাম্যথের ক্লোন বানাবার চ্যালেঞ্জ, যদি সত্যিই ক্লোন করা সম্ভব হয় তবে প্রকৃত প্রাক্রিয়াটা কি আর এ ধরনের ক্লোন গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলাতেও যে ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে আলোকপাত করার চেষ্টা করব)

-- অনিরুদ্ধ বাশার, এরিজোনা, মার্চ ২০১৬

সূত্রঃ

১) Ridley, Matt. Genome: The Autobiography of a Species in 23 Chapters. Perennial 2000

২) Shapiro, Beth. How to Clone a Mammoth: The Science of De-Extinction. Princeton Univ. Press, 2015

৩) Mann, Michael. The Hockey Stick and the Climate Wars: Dispatches from the Front Lines. Columbia University Press. ISBN 978-0-231-15254-9

৪) https://youtu.be/DajRM7VyeZ4


মন্তব্য

সজীব ওসমান এর ছবি

আপনার লেখার হাত ভাল। বেশ গল্প গল্প ভাব আছে। বেশি বেশি লিখবেন আশা করছি।

কয়েকটা ব্যাপার উল্লেখ করছি-

১. মানুষের জেনোমে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার জিন থাকার তথ্যটা কোথা থেকে নিয়েছেন?

২. মানুষের প্রতিটা ক্রোমোজমে কয়েক হাজার জিন থাকেনা।

৩. লেখাটার একটা জিনিস বেশ ভাল লেগেছে- কিছু ইংরেজী শব্দের চমৎকার বাংলা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কিছু সাধারন শব্দের বাংলা ব্যবহার করেন নি। যেমন, টেম্পারেচার, র্আটিকেল ইত্যাদি। পরেরবার লক্ষ্য রাখবেন আশা করছি।

বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে থাকুন, শুভকামনা।

Aniruddha Bashar এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সজীব! আসলে তথ্যসূত্র (১) থেকে সংখ্যাটি নিয়েছিলাম। বইটা একটু পুরোনো। জিনোম সিকোয়েন্সিঙ্গের শুরুতে ধারনা করা হত ১০০,০০০ এরও বেশি প্রোটিন-কোডিং জিন আছে; কিন্তু দেখা গেল আধুনিক গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে যে সংখ্যাটি মাত্র ২০০০০ - ২৫০০০। আরেকটা কথা - প্রোটিন-কোডিং জিন জিনোমের মাত্র ১.৫%, বাকি বিশাল অংশ জুড়ে আছে নন-কোডিং জিন, আরএনে, ইত্যাদি। ও, আরেকটা কথা - আমি মোটেই এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই; শুধু গল্পের গন্ধ পেলাম বলে এ ব্যাপারে লিখলাম।কিছু ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিবেন! লইজ্জা লাগে

সজীব ওসমান এর ছবি

হুম। জিনের সংখ্যার তথ্যটা ভুল। আবার জিনের সংখ্যার কথা বললে সাধারণভাবে ননকোডিং ডিএনএ'র জায়গাগুলিকে বোঝায়না।

যাকগে, লেখা ভাল হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আজব লীলা পর্যন্ত পড়লাম, দারুণ লাগছে। কিন্তু এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে ক্লাসের দিকে। ফিরে এসে বাকিটা পড়ব।
-----মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

কঠিণ.........
এ্যানি মাসুদ

রুমা নাসরিন এর ছবি

পুরোটা পড়েছি। লেখার স্টাইল এর কারনে পড়তে খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছ।লেখকের জন্য অনেক শুভ কামনা ...keep writing...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

বেশ লাগলো, লিখতে থাকুন--

Aniruddha Bashar এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ! হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখার ভঙ্গীটা সুন্দর। আরো লেখা আশা করছি। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সোহেল ইমাম

Aniruddha Bashar এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ! হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক লেখা।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

Aniruddha Bashar এর ছবি

লিখবো, উৎসাহ দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ! হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।