যৌনতা এবং অনুবাদের স্বাধীনতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/০৪/২০১৬ - ১১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এ বছর পুরো রবীন্দ্র রচনাবলী চীনা ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। চৌদ্দজন অনুবাদকের দীর্ঘ ছয় বছরের কাজের ফসল "দ্যা কমপ্লিট ওয়ার্কস অব টেগোর" নামের তেত্রিশ খণ্ডের গ্রন্থটি প্রকাশ করছে চীনের শীর্ষস্থানীয় পিপলস পাবলিশিং হাউস। রবি ঠাকুরের বিপুল বাংলা সাহিত্যকে চীনা ভাষায় অনুবাদ শ্রমসাধ্য কাজ। অনুবাদক দলের ইয়াঙ ইউমিং বলছেন " রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি, প্রাচীন উপনিষদ্, মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলির মর্মবাণী ঘুরে ফিরে এসেছে। এ সমস্ত ধর্মগ্রন্থ কিংবা সাহিত্য এবং তাঁদের সংস্কৃত ভাষা-- এদের সাথে আমাদের পূর্ব পরিচয় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং দর্শন ছিল। তিনি লিখেছেন 'অনেক দিন ধরে অনেক রকম লেখা লিখে এসেছি সেই উপলক্ষে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হল'। তাঁর রচনায় এমন অনেক শব্দ ছিল যা অভিধানে খুঁজে পাইনি। অনুবাদের প্রয়োজনে এমন অনেক নতুন বিষয় আমাদের জানতে হয়েছিল।"

বাংলার সমস্ত সুন্দর যার স্পর্শে সুন্দরতম হয়েছে, তাঁর প্রতি অন্য ভাষার এবং অন্য দেশের মানুষগুলোর ভালোবাসার কথা আগে জানা ছিল না। তবে আমার এ লেখাটা রবীন্দ্রনাথের অন্য এক চৈনিক সংস্করণ সংক্রান্ত।

গত দুই দশক ধরে ফং টঙ চীনের জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বিতর্কিত লেখক। তরুণরাই তাঁর লেখা ছয়টি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সংগ্রহ ও একটি কবিতার বইয়ের প্রধান পাঠক। ফং টঙ লেখালেখিতে যৌনতাকে প্রবলভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। তাঁর নিজের ভাষায় "সেক্সুয়ালিটি ইজ অলমোস্ট মাই ট্রেডমার্ক"। তাঁর যুক্তি হচ্ছে "বারান্দায় বসে আপনি গায়ে রোদ মাখবেন কিন্তু আশেপাশের ধূলা-ময়লা আর শব্দদূষণ এড়িয়ে যাবেন, এটা তো হয় না।" ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ফং টঙ রবীন্দ্রনাথের ৩২৬টি ইংরেজী কবিতার সংকলন ‘স্ট্রে বার্ডস’ চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বইটি প্রকাশিত হবার কয়েক মাস পর থেকে চীনা এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো বইটার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল। তাঁরা এ অনুবাদকে "অশ্লীল" এবং "ঋষিপ্রতিম রবীন্দ্রনাথকে অপমান" বলে আখ্যা দেয়া দিয়েছে। সমালোচনার প্রতিযোগিতায় কমিউনিস্ট সরকারের মুখপত্র বলে পরিচিত চায়না ডেইলি এবং পিপলস ডেইলি সবচাইতে এগিয়ে ছিল। চায়না ডেইলিতে চলচ্চিত্র সমালোচক রেমন্ড ঝাঁ একে "যৌনতায় আচ্ছন্ন লেখকের কুরুচিকর সেলফি" বলেছেন। পিপলস ডেইলি সম্পাদকীয়তে লিখেছে "এটা অনুবাদ সাহিত্যের উপর সন্ত্রাসী হামলা"। চায়না ডেইলি এনিয়ে কার্টুনও ছেপেছিল। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে প্রকাশক বাজার থেকে বইটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ফং টঙ কি লিখেছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
THE world puts off its mask of vastness to its lover.
It becomes small as one song, as one kiss of the eternal

ফং টঙের অনুবাদের অর্থ ছিলঃ
The vast world unzips its trousers in front of its lover
Long as a tongue kiss
Slim as a verse

অন্য একটা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
THE GREAT earth makes herself hospitable with the help of grass.

আর ফং টঙের অনুবাদের অর্থ ছিলঃ
The great earth makes herself horny with the help of grass


(চায়না ডেইলিতে প্রকাশিত কার্টুন)

‘স্ট্রে বার্ডস’ প্রত্যাহার করা নিয়ে চীনের বুদ্ধিজীবী সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। প্রবীণরা বলছেন ফং টঙের অশ্লীল কাজের বিরুদ্ধে এরকম পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে নবীন লেখকরা বই প্রত্যাহার করার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন ফংয়ের লেখা কুরুচিকর হলেও এতে তাঁর লেখালেখির স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী লি হে'র মত অনেকেই বলছেন "এটা চীনা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ যেখানে লেখক তাঁর স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর রেখেছেন"। নারীবাদী লেখিকা লিউ লিউ লেখককে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়ে লিখেছেন "ফ্যান্টাস্টিক"! চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইবো-তে ফং টঙের ৮০ লক্ষ ফলোয়ারদের অনেকেই তাঁকে ভাঙ্গা কলসির কানা ছুড়ে না মেরে বরং ফুল দিয়ে নিজেদের ভালোবাসা জানিয়েছে।

সংবাদপত্রগুলোতে ফং টঙ একটা লেখা পাঠিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে লেখা খোলা চিঠি। তিনি যা লিখেছেন তা সংক্ষেপে বলতে গেলে...

পূজনীয় মিস্টার ঠাকুর,

আপনার সাথে কখনো দেখা হয় নি, আমার অকৃত্রিম শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। সেই ছেলেবেলায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে আপনার কবিতা পড়েছিলাম। আমাদের দেশের সাহিত্যিকরা কবিতাগুলো অনুবাদ করেছিলেন। এখন বইপড়ুয়াদের সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। সে কারণে বর্তমানে আপনার জনপ্রিয়তাও কম।

আমার অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর আপনি ইন্টারনেটে ফিরে এসেছেন। কেউ বলছে এই অনুবাদের জন্য ফেং টঙকে পুরস্কৃত করা উচিত। কেউ বলছে এই অনুবাদ পড়ে রবীন্দ্রনাথ শোকে এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন। সেনাসদস্যদের মত ভারতীয় মিডিয়া অনুবাদ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমি আপনাকে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আপনার কবিতা অনুবাদের কারণ আহামরি কিছু নাঃ আপনার কবিতা ছিল আমার শৈশবের ভালোলাগা, আপনার ছোট ছোট কবিতাগুলোর গভীরতা, এবং আপনি এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী।

‘স্ট্রে বার্ডস’ অনুবাদের তিন মাস ছিল আমার জীবনের দারুণ কিছু দিন। নাপা ভ্যালির কাছে পুরানো একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম। বাড়িটার সামনেই ছিল ফল এবং ফুলের সুশোভিত বাগান। বাতাসের সাথে সাথে উইন্ড চাইমগুলো নেচে যেত। আট হাজার শব্দের ৩২৬টি কবিতা অনুবাদের সময়টাতে আমি একশ বোতল ওয়াইন পান করেছি। কোন কোন দিন একটা লাইন নিয়ে অনেকটা সময় কেটে যেত। লেখা শেষে আবারো পান শেষে মোহময়তার জগতে চলে যেতাম। ওয়াইনের গ্লাসে দিনের আলো অস্ত যেত। আমার হৃদয় কাব্যে ভরে উঠত।

পঞ্চাশ বছর বয়সে লেখা আপনার এই কবিতাগুলোর বেদনা শিশুরা কোনদিন জানবে না। সমালোচকরা বলছেন আমি আপনার কবিতার পবিত্রতা নষ্ট করেছি। আমার বইটা এখন লাইব্রেরির শেলফে নাই! তবে পৃথিবীর সব পাখিকে হত্যা করা হলেও ভোরের আলো ফুটবে।

আপনার অনুগত,
ফং টঙ

চীনের এক তরুণ লিখেছেন, "সবাই কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে?! অনুবাদ খারাপ হলে লোকে তো বইটা এমনিতেই কিনতো না। কেন বইটা প্রত্যাহার করা হল? এখানে তো আইন ভাঙ্গার মত খারাপ কোন ঘটনা ঘটেনি "। আমাদের স্কুলের সময়টাতে তসলিমা নাসরিনের 'লজ্জা' নিষিদ্ধ হয়েছিল। কয়েকজন বন্ধু মিলে তিন-চারগুণ দাম দিয়ে কিনে বইটা পড়েছিলাম। এক্ষেত্রে একই ঘটনাই হল। ‘স্ট্রে বার্ডস’ প্রত্যাহারের খবরটা জানাজানি হওয়ার পর অনেকে বইয়ের দোকানে একটা কপি জোগাড় করার চেষ্টা করেন। পত্রিকায় লেখা হয়েছে বইটার কপি ৫০ হাজারের উপর বিক্রি হয়েছে। কবিতার বই বিক্রির পরিসংখ্যানে এটা রেকর্ড!

_______________
সৌমিত্র পালিত


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আমি লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে। সময় এবং পাঠককে সিদ্ধান্ত নিতে দিন কোনটা টিকবে কোনটা টিকবে না। লেখকের টুটি চেপে ক্রিয়েটিভ কাজের বারোটা বাজানোর প্রয়োজন কি?

অতিথি লেখক এর ছবি

পাঠকের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত কে কোনটা পড়বে বা পড়বেনা, অনাহুত কর্তৃপক্ষের কাজ নয় সমস্ত পাঠকের হয়ে বই নির্বাচন করে দেওয়া।

সোহেল ইমাম

স্পর্শ এর ছবি

তবে 'প্রকাশকের' সম্ভবত কিছু দায়িত্ব আছে। ছাইপাস কিছু লিখে আনলেই, 'প্রচুর বিক্রি হবে' ভেবে সেটা ছাপিয়ে ফেলাটা সেই দায়িত্বে অবহেলা কিংবা নিজের অবস্থানকে এক্সপ্লয়টেশন করার সামিল। তবে এই দায়িত্ব 'নৈতিক' একে আইনীরুপ দেবার কিছু নেই।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ সেই নৈতিক দায়িত্বতো থাকতেই হবে, কবে আপনার সাথেই সুর মিলিয়ে বলতে চাই একে “আইনী রূপ দেবার কিছু নেই” - এসব ব্যাপারে আইনটা ভয়ই জাগায়।

সোহেল ইমাম

স্পর্শ এর ছবি

আপনার থেকে নতুন কিছু জানলাম! চলুক

এই ফংটং মনে হচ্ছে কাউকাওয়াসের চাইনিজ পুত্র! প্রথম আলো খবর পেলে একেও জীবনানন্দ পুরষ্কার দিয়ে দিত।

গায়ের জোরে বই উচ্ছেদ করার বিরূদ্ধে। ঐ অনুবাদের প্রতিকার হিসাবে সহিহ অনুবাদ তো করা হচ্ছিলোই। অবশ্য নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে অন্যের লেখা অনুবাদ করার সময় কতটুকু পরিবর্তন করলে সেটাকে অনুবাদ না বলে অনুবাদকের অরিজিনাল কন্ট্রিবিউশন বলতে হবে সেটাও আলোচনা সাপেক্ষ।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইয়ে, মানে... হুবহু এই কথাগুলাই কইবার চাইছিলাম, রবিবুড়ার দাড়ির কসম।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

"রবিবুড়ার দাড়ির কসম" দেখে হুমায়ূন আজাদের প্রবচনগুচ্ছের কথাটা মনে পড়ল। "ঋষি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলে বাল্যকাল থেকেই তাঁর জন্মাব্দ ১৮৬১র আগে দুটি বর্ণ যোগ করতে আমার ইচ্ছে হয়। বর্ণ দুটি হচ্ছে খ্রিপূ।"
____________
সৌমিত্র পালিত

এক লহমা এর ছবি

এক্কেবারে আমারো মনের কথা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এক লহমা এর ছবি

লাফাং

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

"নারী" বইয়ের কথা মনে পড়ছে। প্রথম পরিচয় ঘটে নিষিদ্ধ্ব বই হিসেবে। সাথে সাথে পড়ার ইচ্ছা জেগে ছিল। কিন্তু পড়তে পারিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে নিয়া পড়া প্রথম বই ছিল এটি।
অনুবাদ করতে গিয়ে মূল লেখকের মূল ভাবনা থেকে সরে গেলে কেমন যেন লাগে। মনে হয় লাউ এর জায়গায় মুলা ঝুলছে। ব্যক্তিগত মতামত।
তবে পাঠক হলে অন্য কথা।পাঠক নিজের মত করে অনেক কিছুই অনুধাবন করতে পারে। রলা বার্থ তাঁর
" The Death Of Author " এ বলেছেন বই লিখার পর লেখকের মৃত্যু ঘটে আর পাঠকের জন্ম হয়।
ধন্যবাদ দাদা। জানলাম অনেক কিছু।
এ্যানি মাসুদ

অতিথি লেখক এর ছবি

মাসুদ ভাই, মূলা ঝুলার কোন চান্সই নাই, এটা তো মাটির নিচে থাকে। হাসি পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
____________
সৌমিত্র পালিত

এক লহমা এর ছবি

চলুক ভালো লাগল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

এখনকার সময়ে কোন বই নিষিদ্ধ করা বা দোকান/লাইব্রেরির শেলফ থেকে সরিয়ে ফেলা একটা হাস্যকর কাজ। দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে প্রকাশিত কোন বই যদি চীনারা নিজেদের জন্য দরকারী মনে করেন তাহলে সেটার চীনা অনুবাদ বের হতে সাত দিন সময়ও লাগে না। প্রকাশের পর আবার সেই চীনা অনুবাদ বইয়ের নানা প্রকারের সফট ভার্সান পাঠকের নাগালে আসতে কয়েক ঘন্টা সময়ও লাগে না। তো এমন পরিস্থিতিতে গণচীনে বা অন্যত্র কোন বই নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে সেই বইয়ের প্রকাশ্য বিক্রি হয়তো কমানো যায়, কিন্তু তাকে পাঠকের নাগালের বাইরে পাঠানো যায় না। এমনকি ছহীহ্‌ রাহের কোন মুরুব্বী রাহ্‌বার পোলাপানদেরকে যদি সেই বই পড়তে মানা করেন তাহলে নাদানের দল সেই বই পড়ার জন্য আরও উঠেপড়ে লাগে।

দুনিয়াজুড়ে শেক্সপীয়রের নাটকগুলোকে ভেঙেচুরে নানা আকারে, নানা পদ্ধতিতে সাজিয়ে চলচ্চিত্র, নাটক, শ্রুতিকথন, পালা ইত্যাদি বানানো হচ্ছে। বর্তমান সময়ের কনটেক্সটে, ভিন্ন স্থান-কাল-পাত্রের কনটেক্সটে, ভিন্ন সংস্কৃতি-রুচির কনটেক্সটে সেগুলোকে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে কি শেক্সপীয়রের জাত গেছে, নাকি তাঁর রচনার মহত্ত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে? নাকি এতে শেক্সপীয়র চর্চ্চা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে? সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘দেবদাস’, পিটার ব্রুকের ‘মহাভারত’ – এগুলোর কোন্‌টাতে মূল লেখার ‘পবিত্রতা’, ‘সতীত্ব’ ইত্যাদি রক্ষা পেয়েছে? এবং তাতে কি পাঠক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ব্যাসের রচনা সম্পর্কে ভুল মেসেজ পেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূজার গান/কবিতাকে অনায়াসে প্রেমের গান/কবিতা বলে চালানো যায়। ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এতো মধুর’ – এই বাক্যদ্বয়কে অনায়াসে ভক্তিবাদের বাইরে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাঁর লেখার অর্থ কে কীভাবে নেবেন সেটা পাঠকের জ্ঞান, রুচি, ব্যাকগ্রাউন্ড, পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। একজন অনুবাদক যদি তাঁর কবিতার ভক্তিরসকে আদিরসে প্রকাশ করতে পারেন তাতে ক্ষতি কী! অতি সুশীল পাঠক ঐসব ‘অশ্লীল’ বই না পড়লেই পারেন। তার বদলে তিনি কোন অধিকারবলে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্যে ক্ষোভ এবং যুক্তি দুটোই আছে। আমি বরং খুব হালকা একটা ঘটনা বলি। আমাদের ভার্সিটির সুইমিংপুলের পাশে কফির দোকান আছে। কয়েক মাস আগে সকালে এক কাপ কফি খেতে দোকানটায় গেলাম। খুব কাছেই মনে হচ্ছে পরিচিত একটা গান বাজছে। মাঝে মাঝে অনেক পরিচিত কোন গান শুনলে মনে হয় না "এই গানটা কোথায় যেন শুনেছি"! আমিও মনে করার চেষ্টা করছিলাম। একটু পরেই বুঝলাম এটা "জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ..."। বাঁশির কম্পোজিশন এবং ধীর লয়ের জন্য বুঝতে দেরি হয়েছিল। লোকজন সুইমিংপুলে শরীর ডুবিয়ে রবীন্দ্রনাথের মিউজিক শুনছে। এতটুকুতে তো 'গুরুদেবের' জাত চলে যায় নাই!
____________
সৌমিত্র পালিত

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর চোখের বালিতে মূল উপন্যাসের বাইরে গেছেন। উপন্যাসে বিনোদিনী- মহেন্দ্রর শারীরিক সম্পর্ক ছিল কি! বিনোদিনী তো উপন্যাসে মহেন্দ্রকে বলে নাই "সঙ্গ করবে, চিহ্ন রাখবে না তাই কি হয় বল?" আর মহেন্দ্রর মা রাজলক্ষীও উপন্যাসে বিনোদিনীকে "আমার ঘরে কোথায় বসে হাগব তা আমি ঠিক করব" এবং "ভাতারখাকী মাগী" বলেন নাই।

১৯০৬ সালে পত্রিকাতে প্রকাশিত "চোখের বালি" উপন্যাসের বিজ্ঞাপনটাও খুব 'পবিত্র' ছিল কি!

"অতিশীঘ্র এই উপন্যাস পাঠ করুন! নরনারী, যুবক-যুবতী বিবাহিত অবিবাহিত, যাঁহারা নূতন বিবাহ করিয়াছেন, যাঁহাদের বিবাহ পুরাতন হইয়াছে, যাঁহাদের প্রেমে ভাটা পড়িতেছে, যাঁহারা স্ত্রীকে মনের মতো করিতে চাহেন, যাঁহারা সুখের দাম্পত্যপ্রেম চাহেন, তাঁহারা "চোখের বালি" নিশ্চয়ই পাঠ করিবেন।"
____________
সৌমিত্র পালিত

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মৌলিক রচনায় যৌনতা দিয়ে ফাটায়া ফালাক, যা খুশি তা লিখুক, সমস্যা নাই। পাঠকই তারে বিচার করবে। কিন্তু অন্যের লেখা বিকৃতভাবে নতুন পাঠকশ্রেনীর কাছে উপস্থাপন আর তা নিয়া বাণিজ্যটাকে ঠিক লেখকের স্বাধীনতা বলতে পারছি না।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয় ঋতুপর্ণ ঘোষ রবি ঠাকুরের গল্পকে অনেকভাবে ভেঙ্গেছিলেন। নৌকাডুবি, চোখের বালি অথবা চিত্রাঙ্গদায়। ঋতুপর্ণের চোখের বালিতে যৌনতা প্রবলভাবে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। আর চিত্রাঙ্গদায়! রবি ঠাকুরের প্রেমের নৃত্যনাট্যর পটভূমিতে পরিচালক ঋতুপর্ণ অনেকেরই মতে "আধুনিক বাঙালির যৌনচেতনায় সত্যিকার ‘সাবালকত্ব’ এনেছেন"। নজরুল ভাই, দৃশ্যটা মনে আছে? ঋতুপর্ণ শুয়ে আছেন লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশন টেবিলে। শরীরের উপর উজ্জ্বল আলো, নেপথ্যে বাজছে "বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে"? এ রবীন্দ্রনাথকে কেউ কোনদিন দেখেছে? তারাশঙ্করের গল্প থেকে নির্মিত 'অন্তরমহল' তো অবশ্যই দেখেছেন। বাঙ্গালী জমিদার ভুবনেশ্বর চৌধুরীর বড় বউ রজঃস্বলা মহামায়ার হাহাকার রক্ত এবং অশ্রুজলে মিলেমিশে একাকার। চলচ্চিত্রের এই গল্পগুলোকে কি আপনি মূল গল্পের বিকৃতি বলবেন? তবে আমরা জানি ঋতুপর্ণের মধ্যে সীমাহীন সততা ছিল। 'ফার্স্ট পারসন' বইয়ের প্রথম খণ্ডে তিনি লিখেছিলেন "আমার নিভৃত রবীন্দ্র সান্নিধ্য চিরকালের। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার ঘুমপাড়ানি গানের কবি। আর একটু বড় হতেই তিনিই আমার 'ঘুম ভাঙানিয়া' ... আমার রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে চিরকাল আমার সমবয়সী।"
ফং টঙ্গের মধ্যে সততা আছে কিনা আমি জানিনা, নাকি পুরোটাই ব্যবসায়িক। তবে তাঁর কবিতার যৌনতায় আমি শৈল্পিকতা দেখি নাই।
____________
সৌমিত্র পালিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।