• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

রিকশার ছবি : ঐতিহ্যে ফেরা, না ফেরা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৬/০৪/২০১৬ - ২:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“রিকশার ছবি আর আঁকা হয়না” - ঠিক এরকম একটা সময় থেকে রাজশাহীর রিকশায় যখন আবার ছবি ফিরে এলো তখন এর রূপ-প্রকৃতির মধ্যে ঘটে গেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। রিকশার ছবির ঐতিহ্য বলতেই আমরা বুঝতাম চিত্রতারকাদের প্রতিকৃতি। সিনেমার নায়ক নায়িকারাই ছিলেন রিকশার টিন ক্যানভাস জুড়ে। অন্য বিষয়ও এসেছিল কিন্তু আধিপত্যটা ছিল রূপালী পর্দার মানুষদেরই। এ শুধু টিন ক্যানভাসেই নয় জনচিত্তের ক্যানভাসেও এই রঙ্গীন পৃথিবীর নারী-পুরুষরাই ছিলেন বিপুলভাবে অস্তিত্ববান। জীবন সিঁড়ির নাবালকত্বের ধাপ থেকে সাবালকত্বের ধাপে পা রাখার আগেই দু’টো পয়সা যেমন তেমন করে হাতিয়ে সিনেমা হলের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার দৃশ্যটা খুব পুরনো নয়। পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা হলে যাওয়ার সেই পারিবারিক উৎসবটাও সেই সময়েরই ঘটনা। পরের সপ্তাহে কি ছবি আসছে তা নিয়েও শেষ নেই জল্পনা কল্পনার। হাটে, বাজারে, ছেলে বুড়োদের আড্ডায়, বাড়ীর মেয়েদের মজলিসেও একবার সিনেমার গল্প শুরু হলে থামতেই চাইতোনা। রিকশার ছবিতেও তাই অপ্রতিরোধ্য ভাবেই তারাই এসে পড়লেন যারা সেই সময়ে সত্যিকার অর্থেই জনচিত্তে রাজাধিরাজের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রিকশার ছবি যখন একটা থমকে যাওয়া পর্বের পর আবার আঁকানো শুরু হলো এই চিত্রতারকারা তখন কিন্তু আর ফিরে এলেননা। রিকশার ছবি আঁকানো চললো। আঁকা হতে থাকলো দেদার ছবি কিন্তু রূপালী পর্দার মানুষ গুলোকে আর রিকশার ছবিতে পাওয়া গেলনা। অন্তত রাজশাহীর রিকশা অলঙ্করনের ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন মাত্রায় রিকশার ছবির ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করলো।

রিকশার অলঙ্করন আর সাজসজ্জার বিষয়টি ঠিক কবে থেকে শুরু হয় সে সম্পর্কিত ইতিহাস কেউই যত্ন করে তুলে রাখেননি। আর সেই সাজসজ্জায় চিত্রতারকাদের প্রতিকৃতি বা চলচিত্রের দৃশ্য কিভাবে কখন রিকশার টিনের ক্যানভাস অধিকার করে নেয় তার সাল তারিখ যথাযথ ভাবে নির্ণয় করা দুস্কর। সম্ভবত পঞ্চাশের দশক থেকেই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়ে থাকবে। জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিকের লেখায় পাচ্ছি রিকশার ছবির প্রবাদ প্রতিম শিল্পী আর.কে. দাস ১৯৫৩ সালে রিকশার ছবি আঁকছেন আর সেই ছবির বিষয় গুলোর মধ্যে চিত্রতারকারাও রয়েছেন। বাংলাপিডিয়ার মতে প্রথমটা যারা সিনেমার বিলবোর্ড ও অন্যান্য বিজ্ঞাপনচিত্র আঁকতেন তারাই রিকশার ছবি আঁকা প্রথম শুরু করেছিলেন বলেই রিকশার ছবিতে চিত্রতারকাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল। এটা খুবই সম্ভব কেননা বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড সহ বিজ্ঞাপনচিত্র যারা আঁকতেন সিনেমার বিলবোর্ড ও রিকশার অলঙ্করনেও সেই বানিজ্যিকধারার শিল্পীদেরই ব্যবহার করা ভিন্ন অন্য কোন উপায় ছিলনা। এই শিল্পীরা প্রায়শই শিল্প সংক্রান্ত কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। ছবি আঁকানোর ব্যক্তিগত আগ্রহই তাদের এই দক্ষতা গড়ে দিয়েছিল। এই শিল্পীরাই যখন রিকশা অলঙ্করনে আত্মনিয়োগ করলেন তখন চিত্রতারকাদেরই বিষয় করলেন আর তাই পরবর্তীতে অন্য বানিজ্যিক শিল্পীদের দ্বারা ক্রমান্বয়ে অনুসৃত হতে শুরু করে।

চলচিত্র রিকশার ছবির প্রধান বিষয় হয়ে ওঠার পেছনে আরেকটি কারন সম্ভবত জনমানসে চলচিত্রের সার্বজনীন আবেদন। নাগরিক বিনোদনের ক্ষেত্রে চলচিত্র জনমানসে যে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল তাই রিকশার ছবিতে অমোঘভাবে চলে এসেছে। সাধারন মানুষকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহন করেই শিল্প রচিত হয়। রিকশা অলঙ্করনের শিল্পও সে সংযোগ এড়াতে পারেনি, আর তাই দেখি জনচিত্তে যা সার্বজনীনভাবে আলোড়ন তুলছিল তার প্রতিফলনেই রিকশার ছবিতে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তা অনেকটা সময় ধরে অনুসৃতির ফলে ক্রমেই একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল।

জনমানসে চলচিত্রের আবেদন বিষয়টি খুবই ব্যাপক এবং গভীর মনস্তাত্ত্বিক আলোচনার অবকাশ তৈরী করে দেয়। এ প্রসঙ্গে খুব গভীরে না গিয়েও চলচিত্র সম্পর্কে জনচিত্তের প্রতিক্রিয়া নিয়ে দু’কথা বলাই যায়। মূলতঃ সিনেমার পোষ্টার অবলম্বনেই রিকশার ছবি গুলো আঁকা হতো এক সময়। সিনেমার পোষ্টার সিনেমার বিজ্ঞাপন। সুতরাং সিনেমার পাত্রপাত্রিদের প্রতিকৃতি রোমান্টিকভাবে ও আকর্ষনীয় রূপ দিয়েই সেখানে উপস্থাপন করা হয় যাতে মানুষ সিনেমাটি দেখতে আগ্রহী হয়। নায়ককে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন সে সাধারন সাদামাটা দৈনন্দিন জীবনের ছাপোষা অক্ষম মানুষটি নয়। সে দাঁড়ায় বীরের মত, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গীই বলে দেয় সে কোন মতেই সাংসারিক সীমাবদ্ধ মানুষ নয় বরং বিপুল ভাবেই সক্ষম মানুষ, সাহসী, জেদি এবং শক্তিমান। পোষ্টারে প্রায়ই নায়ককে ক্রুদ্ধ, মারকুটে ভঙ্গীতে এবং অনেক সময়ই রক্তাক্ত চেহারায় উপস্থাপনের একটা নাটকীয়তা অত্যন্ত সচেতন ভাবেই সৃষ্টি করা হয়। জীবন সংগ্রামে অবসাদগ্রস্ত সাধারন মানুষের কাছে এর আবেদন সামান্য নয়। সাধারন জীবনেও মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ক্রমাগত লড়াইয়ের মধ্যেই থাকে। এই লড়াইটা যে সব সময় বিজয় এনে দেবে বা দেয় তা নয় কিন্তু লড়াইটা তাকে চালিয়েই যেতে হয়। সিনেমায় অবসর বিনোদনের সুযোগে নায়কের চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে সাধারন মানুষ সেই বিজয়ের স্বাদই পেতে চায় এবং সেই স্বাদই তার নিজস্ব জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে ক্রমাগত আশাবাদ যুগিয়ে যেতে থাকে।
সিনেমার নায়কের সাথে হয়তো ঘটনায় সাধারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী মেলেনা সব সময় কিন্তু সিনেমা হলের আলো-আঁধারী পরিবেশে বৈসাদৃশ্য অতিক্রম করে দর্শক নায়কের সাথেই এক হয়ে যায়। চলচিত্র উপভোগের এই অভিজ্ঞতাই পোষ্টারের স্থিরচিত্রে যত্নের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়। পোষ্টারের নায়িকার ছবিও সেভাবেই শুধুমাত্র একটি মহিলার ছবি মাত্রই থাকেনা তার সাথে আকাঙ্খার অনেক গুলো রং এসে মেশে। একটা মায়াবী নেশাময় জীবনের প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে তোলে চলচিত্র যার প্রভাবে বাস্তব জীবনের তুচ্ছতার উপরেও এক পোঁচ রঙের তুলি বুলিয়ে দেয় কেউ। সিনেমার পোষ্টার এই মায়াবী জগতের হাতছানি হয়ে ওঠে। সিনেমায় কে কে অভিনয় করছেন, সিনেমাটি কোন সিনেমা হলে চলছে এসব খবর ছাড়াও সিনেমার পোষ্টারটি তাকিয়ে থাকার একটা অবকাশও তৈরী করে দেয়। অনেক তরুনকেই দেখা যেত নিজের ঘরের দেয়ালে সিনেমার কোন না কোন পোষ্টার সাঁটিয়ে রাখতে। পথ চলতে সিনেমার পোষ্টারের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যও প্রায়ই দেখা যেত। সিনেমার পোষ্টার এভাবেই অনেকখানি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা চরিত্র পেয়ে যায়। আর এই পোষ্টার থেকেই রিকশার ছবিতে যে তারকাদের প্রতিকৃতি আঁকা হতে থাকে তা কেবল বিশেষ নামধারী অভিনয় শিল্পীই থাকেননা হয়ে ওঠেন সাধারন মানুষের আকাঙ্খার প্রতিমুর্তি। চলচিত্র এভাবেই হয়ে ওঠে এক অনন্য ধারার মিথ। এই মিথ যেমন অভিনেতার মানুষী চরিত্রকে দৈবরূপে অভিষিক্ত করে আবার সেই দৈবচরিত্রের সাথে সাধারন মানুষের এমন একটা আন্তরিক যোগাযোগও প্রতিষ্ঠা করে দেয় যা ধর্মীয় বা পৌরাণিক মিথে সম্ভব ছিলনা। এই যোগাযোগের ফলেই সাধারন সাদামাটা জীবনের মানুষটিও নিজেকে দৈবচরিত্রে এক করে অনুভব করার অবকাশ পেয়ে যায়। সিনেমা শ্রেফ অবসর বিনোদনের একটা মাধ্যম মাত্র থাকেনা হয়ে ওঠে এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সমতুল্য যা তার জীবনেও সঞ্চারিত হয়ে যায়। আর এই ভাবেই চলচিত্র জনমানসে সার্বজনীন একটা আবেদন সৃষ্টি করে। আর এই সার্বজনীন আবেদনের ওপরই রিকশার ছবির ঐতিহ্যের ভিতটি গড়ে উঠেছিল।

রিকশার ছবি যখন থেকে আঁকা শুরু হয় সেই সময়ে চলচিত্র ছাড়া আর কোন বিষয়েরই এরকম সার্বজনীন আবেদন সম্ভবত ছিলনা। জোড়া ময়ুরের ছবি কিংবা তাজমহলের ছবির বহুমাত্রিক হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। চলচিত্রে সময়ের সাথে সাথে নতুন তারকা মুখ, নতুন ভঙ্গীমা যেমন ভাবে দর্শকনন্দিত হয়ে উঠতে পেরেছে স্থির অপরিবর্তনীয় বিষয়ের আবেদন সে তুলনায় খুব বেশি হবার কথা নয়। রিকশার ছবি বলতেই তাই অনেকেরই মনের চোখে ভেসে ওঠে সিনেমা তারকাদেরই ছবি। সিনেমা দৃশ্য থেকে উজ্জ্বল রঙে রিকশার টিনের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা এই ছবিই ছিল রিকশার ছবির ঐতিহ্য। ঢাকার রিকশায় এই ঐতিহ্য এখনও আছে। কিন্তু রাজশাহীতে রিকশার ছবি ঠিক সেই ঐতিহ্যে ফিরতে পারলোনা। এই ফিরতে না পারার পেছনে যে সময় আর ঘটনাগুলো কলকাঠি নেড়েছে তারও হিসাব নিতে হয়। যেমন চলচিত্র, বিশেষতঃ বাংলাদেশের চলচিত্র আর সাধারন মানুষের মনের কোঠায় আগের অবস্থান নিয়ে থাকতে পারেনি। অতিবানিজ্যিকরনে শিল্প মান খুইয়ে বাংলাদেশের চলচিত্র মোটা দাগের যৌনাবেদন আর ভারতীয় ছবির নকলকেই আত্মস্থ করতে চাইলো। ফল হলো বিপুল সংখ্যক দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সপরিবারে সিনেমা হলে বসে সিনেমা উপভোগের আর উপায় রইলোনা।

সেই শূণ্যস্থানে প্রথমটা ভিডিও ক্যাসেট, পরে সিডি-ডিভিডি, এবং আরো পরে কেবল-টিভির অজস্র চ্যানেলের মাধ্যমে ঢুকে পড়লো ভারতীয় চলচিত্র। ঠিক কোন সময়ে ব্যাপারটা ঘটেছিল বলা মুশকিল, কিন্তু দেখা গেল রাজশাহীর রিকশায় রিকশায় ভারতীয় চলচিত্রের তারকারা শোভা পাচ্ছেন। শাহরুখ খান, সালমান খান, সঞ্জয় দত্ত, অজয়, অমিতাভরা জুড়ে রইলেন রিকশার টিনের ক্যানভাস। হিন্দী ছবির নায়িকারাও পিছিয়ে ছিলেননা। কাজল, ঐশ্বরীয়া, রাণী মুখার্জি থেকে শুরু করে ক্যাট্রিনা, কারিনা অবধি দখল করে নিলেন রিকশার এবং জনচিত্ত দু’টোরই ক্যানভাস। সে সময় বাংলাদেশের চলচিত্রে তারকা ছিলোনা বললে ভুল হবে কিন্তু সেই দু’একজন আর তাদের প্রভাব বৈশাখের শীর্ণ নদীর ধারার মতই ক্ষীণ হয়ে এসেছিলো।

মানুষ মূলতঃ ভারতীয় চলচিত্র তারকাদের নিয়েই মেতে ছিল। বাংলাদেশের টিভি নাটকের নায়ক নায়িকারা অবশ্য ছিলেন এবং তাদের জনপ্রিয়তা তখনও বিন্দু মাত্র হ্রাস না পেলেও তারা ঠিক রিকশার ঐতিহ্যের মধ্যে সেভাবে প্রবেশ করতে পারেননি। ফল এই দাঁড়ালো রাজশাহীর রিকশা গুলোর দিকে তাকালে বাংলাদেশী চিত্র তারকাদের দেখা পাওয়াই দুস্কর হয়ে উঠলো। দেশের অন্যান্য জায়গার মতই রাজশাহীতেও সিনেমা হল গুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। রাজশাহী শহরে চারটা সিনেমা হলের মধ্যে তিনটাই ভেঙ্গে ফেলে সে জায়গায় বহুতল ভবন নির্মানের কাজ শুরু হয়ে যায়। সিনেমা হলের ব্যবসাকে কেউই আর লাভজনক ভাবছিলেননা এ সময়। এ সময় রাজশাহীর রিকশার ছবিতে কেবল ভারতীয় তারকাদেরই আঁকানো হতো।

কিন্তু এই ছবি আঁকানোও বন্ধ হয়ে যায়। তখন সম্ভবত ২০০৯-১০ সাল। রিকশার ব্যবসার মন্দাই এর কারন। এ সময় রিকশা মালিকদেরও রিকশায় ছবি আঁকানোর ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ছিলনা। রাজশাহীর মুজাহিদুল ইসলাম মুজাহিদ ১৯৮৭-৮৮ সাল থেকে রিকশার ছবি আঁকছেন। রিকশায় ছবি আঁকানো বন্ধ হয়ে গেলে তিনিও ব্যস্ত হয়ে পড়েন ট্রাকের গায়ে অলঙ্করনে। অন্য শিল্পীরাও কমবেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্যধারার বাণিজ্যিক ছবি আঁকানোতে, অনেকে ছবি আঁকার কাজটাই দিলেন ছেড়ে। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় ২০১৩-১৪ সালের দিকে। রিকশার কাঠামোতেই ব্যাটারী ও মোটর সংযোজন করলে রিকশার ব্যবসা আবার ফিরে আসতে শুরু করে। আর সেই সাথেই আবার রিকশায় ছবি আঁকানো শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিকে পুরনো প্যাডেল মারা রিকশার কাঠামোর সাথেই মোটর লাগানো হতো, পরে ধাতব কাঠামো নির্মিত নতুন রিকশা তৈরী হতে শুরু করলো। এই নতুন ধরনের রিকশার নির্মাণ পরিকল্পনার সাথে শিল্পী মুজাহিদ শুধু জড়িতই ছিলেননা এই রিকশা গুলোয় ছবিও তিনিই প্রথম আঁকাতে শুরু করেন। ক্রমে শিল্পী সেরাজুল, শিল্পী জামালও তার সাথে সাথে রিকশার ছবি আবার আঁকাতে শুরু করেন। এই দু’জনও রিকশার ছবি আঁকা ছেড়ে ট্রাকের অলঙ্করনে যোগ দিয়েছিলেন এক সময়। প্রথম দিকে আবার নতুন করে রিকশার ছবি আঁকাতে গিয়ে শিল্পী মুজাহিদ ও সহ শিল্পীরা সিদ্ধান্ত নেন তারা চিত্র তারকাদের ছবি রিকশায় আর আঁকবেননা। তার পরিবর্তে যেমন ধরনের গ্রামদৃশ্য ট্রাকের গায়ে তারা আঁকতেন তাই রিকশায় আঁকাতে শুরু করলেন। শিল্পী মুজাহিদকে এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরে এক সময় জিজ্ঞেস করলে জানান ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে মানুষের ছবি আঁকানো ঠিকনা বলেই তারা তারকাদের ছবি আর আঁকাননি। রাজশাহীর অন্য শিল্পীরাও এ ধারাটাই অনুসরন করেছেন। রুনুআর্টের আরিফুল ইসলাম রুনুকেও একই প্রশ্ন করলে তিনিও জানান আঁকার ধারাটা বদলে গেছে এখন চিত্রতারকাদের ছবির জায়গায় প্রাকৃতিক দৃশ্যই বেশি আঁকানো হচ্ছে। কিন্তু এ সম্পর্কে তিনি ধর্মীয় কোন নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ না তুলে জানান এখন আসলে এরকমই আঁকা হচ্ছে বলেই তারকাদের ছবি আসছেনা। এক সময় শিল্পী রুনু ও মুজাহিদও তারকাদের ছবি প্রচুর আঁকিয়েছেন সেই শিল্পীরাই এখন অনুসরন করছেন অন্য ধারা। শিল্পী আরিফুল ইসলাম রুনুও স্বীকার করেন শিল্পী মুজাহিদ ও তার কয়েকজন সহশিল্পী এই প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো নিয়ে রিকশার ছবি আঁকার ফলেই এই ধারাটার শুরু হয়েছে এবং সেটাই আর সবাই এখনও অনুসরন করে চলেছেন।

তবে এই পরিবর্তনটা যে কেবল কয়েকজন মাত্র শিল্পীর সিদ্ধান্তেই এসেছে এমনটা মনে হয়না। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের চলচিত্র সাধারন মানুষের মনের কোঠায় যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তা আর পরে বজায় থাকেনি। কিছু সংখ্যক মানুষ হয়তো তখনও এবং এখনও বাংলাদেশের চলচিত্র দেখেন, কিন্তু আগের আমল গুলোয় দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মনে চলচিত্রের যে সর্বগ্রাসী আবেদন ছিল তা আর নেই। রিকশায় যখন ভারতীয় চিত্রতারকাদের ছবি আঁকানো হতো তখনই দেশীয় চিত্রতারকারা সর্বসাধারনের মনে অনেকখানি আবেদনই হারিয়ে ফেলেছিলেন। রাজশাহী শহরে সিনেমা হল গুলো ভেঙ্গে ফেলে বানিজ্যিক বহুতল ইমারত নির্মার্ণও দেখিয়ে দেয় সিনেমা আর সেভাবে লোক টানতে পারছেনা।

২০১৩-১৪ সালের দিকে বাংলাদেশের জনমনেও একটা পরিবর্তন আসছিল। যেমন যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে শাহবাগের গনজমায়েত, যা সারা দেশে একটা বড় রকমের আলোড়ন তুলেছিল। যুদ্ধপারাধীদের ফাঁসির দাবীতে যেভাবে সারা দেশের মানুষ এক হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল তাকে জাতীয়তাবোধের পুনরুত্থান হিসেবেও দেখা যায়। সেই সাথে ক্রিকেট খেলায় লাগাতার বিজয়ের মধ্যে দিয়েও এই জাতীয়তাবোধই পুষ্টি পেয়েছে। আগে যেখানে বাংলাদেশের মানুষ ভারত বা পাকিস্তানের ক্রিকেট দলকে সমর্থন করে খেলা উপভোগ করতো সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয় গুলো জাতি হিসেবে গৌরববোধ ও আত্মশ্লাঘার একটা বড় সুযোগ নিয়ে আসে। ঠিক এরকম একটা সময়ে ভারতীয় চলচিত্র উপভোগ করতে থাকলেও ভারতীয় চিত্রতারকাদের নিয়ে আগ্রহের আতিশয্যও অনেকখানি কমে এসেছিল। ক্রিকেট মাঠে ভারতীয় দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা, ভারতসীমান্তে বাংলাদেশীদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী কর্তৃক বিভিন্নভাবে অত্যাচরিত হওয়ার বিষয় গুলোও দেশের মানুষকে অনেকখানি ভারত বিমুখ করে তোলে। ভারতের সাথে পররাষ্ট্র পর্যায়ে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক অসঙ্গতির বিষয়টিতো ছিলোই। আর এ সমস্ত কারনেই ভারতীয় চিত্র তারকাদের আবেদন জনমনে আর আগের মত থাকেনি। আর এই জাতীয়তাবোধের আলোকেই সাধারন মানুষ উপলব্ধী করেছে হিন্দী ছবির তারকাদের নিয়ে অন্তত বাংলাদেশের মানুষের গর্ববোধ করার কোন মানে হয়না। রিকশার ছবিতেও তাই ভারতীয় চিত্র তারকাদের ফিরে আসার এ সময়ে কোন উপায় ছিলনা। তেমনি বাংলাদেশের চলচিত্র শিল্পও অনেক আগেই জনসাধারনের মনোযোগ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। ঢাকায় যেহেতু চলচিত্র শিল্পের প্রতিষ্ঠানটির এবং চিত্রতারকাদের অবস্থান সে কারনে ঢাকার রিকশার ছবির ঐতিহ্যে বিশেষ রকমফের হয়নি কিন্তু অন্যান্য জেলায় চলচিত্রের আবেদন আর শক্তিশালি ছিলনা। রাজশাহীতে তাই ভারত বা দেশীয় চিত্রতারকারা আর রিকশার ছবির বিষয় হয়ে এলেননা।

এই জনমনের সাথে রিকশার ছবির নাড়ির যোগই কিন্তু রিকশার ছবির ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত হতে দেয়নি। রিকশার ছবির শিল্পীরা বরাবরই সাধারন মানুষের আকঙ্খার সাথেই তাদের শিল্পকে যুক্ত করে সৃষ্টি করে গেছেন। এই যোগসূত্রটি সজীব ছিল বলেই বিলুপ্তির প্রান্ত থেকেও রিকশার ছবি আবার ফিরে এসেছে। আবার এই যোগসূত্রের সজীবতার কারনেই চিত্র তারকাদের রিকশার ছবির যে ঐতিহ্যটা ছিল তা থেকে শিল্পীরা সরেও এসেছেন। এই সরে আসাটাও রিকশার ছবির ঐতিহ্যে নতুন বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে। তাই বলতে হয় রিকশার ছবি আপন ঐতিহ্যে যেমন ফিরে এসেছে তেমনি এও সত্য যে ঠিক ঐতিহ্যের সেই পূর্ব প্রকরনে কিন্তু ফেরেনি।

কেবল চিত্রতারকাদের প্রতিকৃতিই যখন রিকশার ছবির বিষয় ছিল সেই ধারাটা বন্ধ হয়ে যেতেই কিন্তু অন্য ধারায় এই ঐতিহ্য সজীবতার সাথেই প্রবাহিত হয়েছে। বহুদিনের অনুসরনে পূর্বের এই ধারাটি কিন্তু অনেক খানিই সরসতা হারিয়ে ছাঁচেঢালা একঘেয়ে হয়ে উঠছিল। “সিনেমা” এই একটি বিষয়কে নিয়ে চর্বিতচর্বন আর একটা শিল্প ঐতিহ্যে তেমন করে অভিনবত্ব যোগ করতে পারছিলনা। নায়িকার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী আর নায়কের অস্ত্র হাতে ক্রুদ্ধ মুর্তি ক্রমেই আবেদন হারাচ্ছিল। রিকশার ছবি যেন কেবল চিত্রতারকাদের নিয়েই আঁকা হবে এমনটাই দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এই রকম একটা অবস্থা থেকে যখন রাজশাহীর শিল্পীরা চিত্রতারকাদের ছেড়ে অন্য বিষয় নিয়ে আঁকাতে চাইলেন তখন তার মধ্যে দিয়ে সাধারন মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনটাই তাদের ছবিতে ফুটে উঠলো। আর এর ফলেই রিকশার টিনের ক্যানভাসে বিচিত্র সব বিষয় আসতে শুরু করলো। বর্তমান সমাজ মানসের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী চরিত্রটাই উঠে আসতে শুরু করলো রিকশার ছবিতে। এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী চরিত্রটাই রিকশার ছবির ঐতিহ্যে চমদপ্রদ বিষয় বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে। ট্রাকের গায়ে আঁকা ছাঁচেঢালা গ্রামদৃশ্য গুলোর অনুকরন করতে গিয়ে রাজশাহীর শিল্পীরা ক্রমেই এই গ্রামদৃশ্যে অভিনবত্ব নিয়ে এসেছেন। প্রথম দিকে যে ছবি গুলো নেহায়েত ছাঁচেঢালা একটা ছক অনুসরন করে আঁকা মনে হতো পরবর্তীতে তা এতখানিই বিচিত্র হয়ে ওঠে যে এখন দেখলেই বোঝা যায় শিল্পীদের সৃজনী শক্তি যেন স্ফুরিত হয়ে উঠেছে। একটা গ্রামদৃশ্যের সাথে আরেকটা গ্রামদৃশ্যের কোন মিল নেই, ছবি গুলো একটার পর একটা দেখে গেলেও আর একঘেয়ে লাগেনা। শ্রেফ প্রাকৃতিক দৃশ্য রচনায় শিল্পীদের প্রতিভা এতখানিই সৃজনশীল হয়ে উঠেছে যে চমৎকৃত হতে হয়। নগর জীবনের যান্ত্রিকতারে অবসাদে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যেই মানুষ খোঁজে মুক্তির হাওয়া। তাই এই দৃশ্য গুলো রচনাতেই শিল্পীরা তাদের অন্তরের মমতা ঢেলে দিয়েছেন।

ধর্মীয় অনুশাসন বা নিষেধাজ্ঞার কথা মাথায় রেখে রিকশার ছবির ধারায় একটা পরিবর্তন এলেও তা যে শিল্পের ধারাকে ব্যহত করেনি তা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। যে মানুষ আঁকানোকে এড়িয়ে যাবার জন্যেই শিল্পীদের কয়েকজন চিত্রতারকাদের প্রতিকৃতি রিকশার ছবিতে আর আনলেননা তা কিন্তু পুরোটা সাফল্য পেলোনা। রিকশার ছবিতে মানুষ এসেই পড়লো। শিল্পের আন্তরিক টানেই তা এসেছে। আবার এই বদলটার কারনেই জনচিত্তের সাম্প্রতিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী চরিত্রটাই প্রধান হয়ে উঠে রিকশার ঐতিহ্যে একটা অভিনব মাত্র যোগ করে দিয়েছে। রিকশার টিনের ক্যানভাসে আগের ঐতিহ্যে যেখানে কেবল খ্যাতিমান, জননন্দিত বড় বড় চিত্রতারকারা জুড়ে থাকতেন সেখানে সাধারন ছাপোষা মানুষের ব্যক্তি চরিত্রটার আকাঙ্খাই ক্রমে মুর্ত হয়ে উঠেছে। বড় বড় তারকাদের ছবি ছাড়া যেখানে রিকশার ছবিতে প্রবেশাধিকার ছিলনা সেখানে রিকশা মালিকের যুবকপুত্র বা শিশুর ছবিও অনায়াসে চলে আসছে। কোন কোন রিকশা মালিক নিজ নিজ রিকশার নামকরনও করছেন আর সেই নামকরনে ক্রমে সৃজনশীলতার ছাপও চলে আসছে, যেমন “গোধুলী ঘর”, “মেঘ”, “রুদ্র”, “গুনগুন গুঞ্জন”। আবার একটা রিকশার পেছনে দেখা যাচ্ছে লেখা আছে “এই গাড়ির নাম পালকি”। রাজশাহীর হেতমখাঁ’র ফারুকমিস্ত্রি তার নিজের রিকশা গুলোয় ছবির বদলে শিল্পীদের দিয়েই লিখিয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন উক্তি, যেমন “চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ি”, “মানুষ কেন গরীব হয়”, “ছোট থেকে বড়”, “ঘুম হারাম হয়েছে” ইত্যাদি। অনেকে রিকশা শিল্পীকে দিয়ে নিজের পছন্দের ছবিও রিকশায় আঁকিয়ে নিচ্ছেন। শিল্পী মুজাহিদের কাছ থেকেই জানা যাচ্ছে এক রিকশা মালিক নিজের মোবইলে একটা প্রকৃতিক দৃশ্যের ছবি দেখিয়ে আবদার করছেন এই ছবিটাই তার রিকশায় আঁকিয়ে দেবার জন্য। রিকশার ছবিতে তাজমহল একটা পরিচিত বিষয় কিন্তু রাজশাহীর রিকশার ছবিতে সেই বিখ্যাত তাজমহলের ছবির সাথেই আঁকানো হচ্ছে রাজশাহীর রেলষ্টেশনের ছবি, রাজশাহীর নওহাটার মোড়ের বিশাল তিন আমের ভাস্কর্যের ছবিও। মুক্তিযুদ্ধের স্মরনে নির্মিত রাজশাহীর স্থানীয় স্মৃতিসৌধ “স্মৃতি অম্লান”ও রিকশার ছবিতে জায়গা করে নিয়েছে। ঠিক সেভাবেই রিকশার ছবিতে এসেছে রাজশাহীর বিখ্যাত শাহ মখদুমের মাজার দরগার স্থাপত্যের ছবিও। অত্যাধুনিক স্পোর্টসকার বা জমকালো মোটরবাইকের প্রতি তরুনদের দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। প্রায় তরুনের ঘরের দেয়ালেই স্পোর্টসকার অথবা মোটর বাইকের ছবির পোষ্টার অনেকদিন ধরেই শোভা পায়। রিকশার ছবিতেও সেই আকঙ্খার ছবিটি চলে এসেছে। সেই সাথে এমন এমন ছবি চোখে পড়ছে যা এই বছর দু’য়েক আগেও কেউই রিকশার ছবিতে কল্পনাও করতে পারতেননা। এই ছবিগুলো অনেকটা শিল্পধারায় নতুন নিরীক্ষার মত অনেকটা। কেউ জানেনা কেমন দেখাবে রিকশার ছবি হিসেবে কিন্তু আঁকিয়ে ফেলছেন হয়তো রিকশা মালিকের অনুরোধে কিংবা শিল্পীর নিজস্ব খেয়ালেই। এভাবেই বিস্তৃত ধানক্ষেতের ছবি, সাদামাটা তিন বা চারতলা দালানের ছবি কিংবা নীলআকাশকে পেছনে রেখে টিনের ক্যানভাসের নিচের দিকটায় কেবল বড় বড় ঘাসের ছবি। চিত্রতারকাদের প্রতিকৃতির ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে যেন রিকশার ছবি নিজের সম্ভাবনা আর সীমাটাকেই খতিয়ে দেখতে চাইছে, বিচিত্র বিষয়কে রিকশার ছবিতে এনে নিরীক্ষামূলক কাজও করতে চাইছেন শিল্পীরা।

১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে বাংলাদেশে একটা ধর্মীয় ঝোঁক এলে রিকশার ছবিতে চিত্রতারকাদের প্রতিকৃতি আঁকার ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ওঠে সম্ভবত সরকারী মহল থেকেই। এবটা প্রচ্ছন্ন নিষেধাজ্ঞাও ছিল আর তার প্রভাবে রিকশায় চিত্রতারকা বা চলচিত্র ভিত্তিক দৃশ্য আঁকানোর মাত্র কমে গিয়ে গ্রামের দৃশ্যের ব্যবহার একটু বেশি হারেই শুরু হয়ে যায়। জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিকের লেখায় এসময়টার কথা বিদ্ধৃত আছে তার Bangladeshi Arts of the Ricksha প্রবন্ধে। এ সময়ের প্রতিভাবান ও শক্তিশালী রিকশা অলঙ্করন শিল্পীরাও এই নিষেধের বেড়া মেনে নিলেও রিকশার ছবিকে সজীব রেখেই প্রবাহিত করেছিলেন অন্য ধারায়। সে সময় ঢাকার রিকশায় পশু-পাখিকে ব্যবহার করে ছবি আঁকা হতে থাকে। মানুষ আঁকানো ঠিকনা এরকমটা ধর্মীয় (?) নিষেধের প্রতিক্রিয়াতেই মানুষের স্থানে পশু পাখির ব্যবহার শুরু করেন শিল্পীরা। বাঘ সিংহ বর সেজে পাগড়ি মাথায় বিয়ে করতে যাচ্ছে, বিভিন্ন পশুরা মিলে বন ভোজনে ব্যস্ত, শহরের রাস্তায় বিভিন্ন পশু রিকশায় গাড়িতে ঘুরছে, জনসভায় কোন একটা পশু ভাষন দিচ্ছে অন্যরা শুনছে ইত্যাকার কোতুককর ও কৌতুহল উদ্রেক করার মত ছবিও সে সময় আঁকা হচ্ছিল। ১৯৮২ নাগাদ অবশ্য এই অবস্থাটা কেটে গিয়ে আবার রিকশার ছবিতে চলচিত্র জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। চিত্রতারকারা আবার রিকশার টিনের ক্যানভাসে মহাসমারোহেই ফিরে এলেন।

২০১৩-১৪ সালের দিকে সাময়িকভাবে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর রিকশার ছবি আঁকানো পুনরায় শুরু হওয়ার সময়টিতেই দেশে আরেকবার ধর্ম সংক্রান্ত একটা বাড়াবাড়ির প্রাদুর্ভাব ঘটে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি থেকে বাঁচাতেই বিপুল অর্থ ও মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন গুলোকে জড়ো করে হেফাজতী জোট যুদ্ধাপরাধীদের স্বার্থেই মাঠে নামে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে বক্তব্য দিতে থাকে। এর মধ্যেই রাজনৈতিক নৈরাজ্যে একটা আবহের ফলেই রাজনীতি থেকে মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল এবং ধর্ম একমাত্র আশ্রয় এ বিশ্বাসে একটু একটু করে ধর্মের দিকেই জনমানসের মনোযোগ ঘুরে যাচ্ছিল। এর প্রভাবেই সম্ভবত নারীদের মধ্যে বোরখা ও হিজাব ফ্যাশন হিসেবে জনপ্রিয়তাও অর্জন করে ফেলে। সমাজের অন্যান্য স্তরেও আচার প্রধান ধর্মীয় জঝাঁকের একটা প্রাবল্যও দেখা যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করে তাদের রক্ষা করতে হেফজতীরা ধর্মকে বাগিয়ে ধরে জেলায় জেলায় মাদ্রাসা ছাত্র ও বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীদের সহায়তায় জনসভা করতে থাকলে ধর্মীয় জ্বরের প্রকোপ আরো কিছুটা বেড়ে ওঠে। এই এত হাঁকডাক সত্ত্বেও কিন্তু মানুষ নিতান্ত আচারটা পালন করলেও তার বেশি ধর্মকে গ্রহন করতে পারেনি। ঠিক এই সময়েই রাজশাহীর রিকশার শিল্পীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন তারা আর চিত্রতারকাদের অর্থাৎ মানুষের ছবি রিকশায় আঁকাবেননা। প্রায় ১৯৭৭-৭৮ সালের মতই পরিস্থিতি। এবং সে সময়ের মতই চিত্রতারকাদের ছবি বাদ দিয়ে গ্রামবাংলার দৃশ্য আঁকানোয় একটু বেশি রকম ঝোঁকটাও দেওয়া হচ্ছিল। আগের আমলের ঘটনাই দেখিয়ে দিয়েছে ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধাবাদীদের ফায়দা লোটার একটা মোচ্ছব কিছুদিন চললেও সাধারন মানুষের মানসিক গঠনে তা বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। রিকশার ছবিতে পরবর্তী বছর গুলোয় চিত্রতারকাদের ফিরে আসাই দেখিয়ে দেয় মধ্যপ্রাচ্যীয় সংস্কৃতি বাঙ্গালী মানসে শিকড় গাড়তে ব্যর্থ হয়েছে এবং ধর্মীয় গোড়ামীটা বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটা উৎপাত মাত্র। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নৈরাজ্যের প্রতিক্রিয়াতে সাধারন মানুষ ধর্মের কোলে সাময়িক আশ্রয় নেবার একটা প্রয়াস নিলেও তা স্থায়ীত্ব পাবার সম্ভাবনা প্রায় নেই। আশির দশকে রিকশার ছবি চলচিত্র তারকাদের ছবি আঁকানোর মধ্যে দিয়ে আবার ঐতিহ্যে পুনরাবর্তন করলেও, বর্তমান সময়ে ঠিক সেভাবে আগের ঐতিহ্যে হয়তো ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। কারন বাংলাদেশের চলচিত্রশিল্প এখনও তার হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। রিকশার ছবির প্রত্যাবর্তনের এখনকার এই সময়েও আমরা দেখছি ধর্মীয় নিষোধাজ্ঞা সফল হয়নি কিন্তু চলচিত্রকে রিকশার ছবির বিষয় হিসেবে গ্রহন করার মত অবস্থা এখনও অনুপস্থিত। রিকশার ছবির ঐতিহ্য ফিরে এলেও এবার ঠিক পূর্বতন ঐতিহ্যে কিন্তু ফিরতে পারলোনা। চলচিত্রকে মাধ্যম করে যে ঐতিহ্য রিকশার ছবিতে গড়ে উঠেছিল ঠিক সেই মাপের কাজ এখনও রিকশার ছবিতে দেখা যাচ্ছেনা। রিকশার ছবি ফিরে এলেও তাই যেন ঠিক নিশ্চিত নয় কোন পথে এগোতে হবে, এই ঘোর লাগা সময়ে মানুষও খানিক দিশেহারা; এখন সময়ই বলবে রিকশার ছবি কোন প্রকরনের ভেতর আগের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করবে না ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

সোহেল ইমাম

রিকশার ছবি নিয়ে আগের লেখা গুলোর লিংক
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55743
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55592
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55561


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

দীর্ঘ লেখা, তথ্যবহুল। সেই সাথে লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ লেখটিতে আলাদা একটি মাত্রা যোগ করেছে, আমার মতে এটি এই সিরিজের সেরা প্রয়াস। কিন্তু কেমন যেন একটা উপসংহার উপসংহার গন্ধ পাচ্ছি! শেষ করে দিচ্ছেন নাকি সোহেল ইমাম?

------মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মোখলেস ভাই। ঠিক শেষ হচ্ছেনা, কাজটা চলছেই। এখনও বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি, দেখা যাক। তবে আপনার নজরকে ফাঁকি দিতে পারবোনা জানি। এক অর্থে ঠিক এই মুহূর্তে হয়তো উপসংহারের মতই লেখাটা।

সোহেল ইমাম

ঈয়াসীন এর ছবি

চমৎকার। (Y)

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

সোহেল ইমাম

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, আশরাফ ভাই।

সোহেল ইমাম

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

(Y)

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। :)

সোহেল ইমাম

সুমন চৌধুরী এর ছবি

(Y)

আশির দশকে ঢাকার রিক্সার পেছনে প্রায়ই দেখা যেত "দুলাল আর্ট"।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঢাকার রিকশার অলঙ্করন নিয়ে আমারও জানার আগ্রহ। ঢাকায় বিশেষ যাওয়া হয়না এখনকার রিকশার ছবিও বন্ধুদের ছবি থেকে দু’একটা দেখেছি মাত্র। আমার মনে মনে হয় ঢাকার রিকশা নিয়ে আরো লেখা উচিত বিশেষ করে যারা দেখছেন মন দিয়ে। লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

সোহেল ইমাম

শামীম রুনা এর ছবি

ভাল লাগলো

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

রাজশাহীর রিকশার ছবিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো হিন্দী ছবির নায়ক সঞ্জ দত্তের প্রতিকৃতি। এটা বলছি ২০০০- ২০১০ এর মধ্যকার ঘটনা।
রিকশার পেছনে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা একবার নয়। পাকিস্তান আমলেও এসেছিলো এই নিষেধাজ্ঞা। ১৯৬৫ সালের দিকে। বিষয়টার কিন্তু কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তৎকালীন শিল্পীদের বক্তব্য ছাড়া কোন লিখিত নথি আমি পাইনি। হতে পারে যে রিকশার লাইসেন্স যারা নিয়ন্ত্রণ করে সেই স্থানীয় সরকারী অফিসারদের উপর মৌখিক কোন আদেশ ছিলো! সেটাকেই তারা এক্সিকিউট করেছে। তবে ক্রস চেক করলে কিন্তু একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকার রিকশাচিত্রী আর কে দাস (রাজকুমার দাস) এবং সৈয়দ আহমেদ হোসাইন একই ধরনের কথা বলেছেন। সময়ের হিসেবে দু এক বছর এদিক ওদিক হতে পারে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

লিখিত নথি সম্ভবত কখনওই ছিলনা, আপনি যেভাবে বললেন সেভাবেই হয়তো তা প্রয়োগ করা হতো। আপনিই কি অনার্য তাপস? আমি মনে করি আপনার হাত দিয়েই রিকশার অলঙ্করন নিয়ে আরো ভালো লেখা আমরা পাবো। অপেক্ষায় আছি ভাই। :)

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।