এক
ছেলেবেলায় পড়া ছড়া এবং কবিতার মত কোরানের কয়েকটা সুরাও মনে আছে। আমাদের স্কুল এসেম্বলির শুরুতেই থাকত কোরান তেলওয়াত। সবাই ঘুরেফিরে কয়েকটি সুরা পাঠ করত। তাই অর্থ না জেনেও মুখস্থ হয়ে গেছে।এসেম্বলির এ ধারনা ব্রিটিশরা আবিষ্কার করেছিল। ১৯৪৪ সালে প্রণীত ব্রিটেনের শিক্ষা আইনের সেকশন পঁচিশে আছেঃ কার্যদিবসের শুরুতে প্রত্যেক স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে এসেম্বলিতে ধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন করবে। আইনটির ২৫(৪) অনুচ্ছেদে লেখা ছিলঃ তবে বাবা-মা'র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মীয় প্রার্থনা অথবা ধর্ম শিক্ষা হতে অব্যাহতি পাবে। আমার কাছে হাত দুটো বুক আর পেটের মাঝামাঝি রেখে মাথা নিচু করে তেলওয়াত শোনাটাই স্বাভাবিক মনে হত। তখন টিভির অনুষ্ঠান শুরু হত কোরান পাঠের পর (সপ্তাহের বিভিন্ন দিন বাইবেল, ত্রিপিটক আর গীতা পাঠ থাকত)। "পবিত্র কোরান শিক্ষার আসর আলোর দিশারি" শেষে কার্টুন দেখানো হত, আমি আধঘণ্টা ধরে আলোর দিশারি দেখতাম। এসেম্বলির ধর্মীয় প্রার্থনা নিয়ে আমাদের এবং বাবা-মা'দের আপত্তির কি আছে!
দুই
ব্রিটেনের ২০১১ সালের লোকগণনাতে "আপনার ধর্ম কি?" প্রশ্নের উত্তরে ৫৯.৩% নিজেদের খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী বলেছিল। ২৫.১% বলেছে তাঁদের কোন ধর্ম নাই আর ৭.২% প্রশ্নটার কোন উত্তর দেয়নি। ৪.৮% বলেছে মুসলিম এবং ০.৪% নিজেদের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলেছে। সামাজিক এই বৈচিত্র্যতার কারণে ব্রিটেনের জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (জিসিএসই, আমাদের দেশের এসএসসির মত) পরীক্ষায় ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ছাড়াও নিধার্মিকতা এবং মানবতাবাদের মত বিষয়ে শিক্ষাথীদের জ্ঞানের বিকাশ। অবশ্য এ উদ্দেশ্যের সাথে ব্রিটিশ শিক্ষামন্ত্রী নিকি মরগানের কথার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর মতে "দেশটির স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শেখাতে হবে যুক্তরাজ্য একটি খ্রিস্টান দেশ এবং সেই সাথে তাদের নিধার্মিকতার উপর ধর্মকে প্রাধান্য দেয়াও শেখাতে হবে।" এতে অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই। আমাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য "প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা" ভুলে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন "সম্প্রতি প্রণয়ন করা কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তার ভিত্তি হবে ইসলাম।"
তিন
ব্রিটেনে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রণীত জিসিএসই'র ধর্মশিক্ষার পাঠ্যক্রমে খ্রিস্টান, ক্যাথলিক, ইহুদি, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখ ধর্মশিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। এ সাতটি থেকে যে কোন দুটি ধর্ম শিক্ষাথীদের বেছে নিতে হবে। ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় শতাধিক দার্শনিক-শিক্ষাবিদ-শিক্ষক পাঠ্যক্রমে মানবতাবাদকেও অন্তর্ভূক্ত করার জন্য দাবি জানায়। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে আর্চবিশপ রোয়ান উইলিয়ামসের মত ২৮ জন ধর্মীয় নেতাও মানবতাবাদকে অন্তর্ভূক্ত করার আবেদন করেন। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ব্রিটিশ মানবতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় তিনটি পরিবার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাদের ভাষায় "আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসীদের নিয়ে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে বাস করি । তাই আমাদের ছেলেমেয়েদের সমস্ত বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটা গুরুত্বপূর্ন বলে মনে করছি। জিসিএসই'র পাঠ্যক্রমে ধর্মবিশ্বাসের তুলনায় মানবতাবাদকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বইগুলো পড়লে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সত্য এবং নৈতিকতার উপর শুধুমাত্র ধর্মগুলোর একাধিপত্য আছে। এ শিক্ষায় আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বাদ দেয়া হয়। আমি চাই না আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অসম্পূর্ন থাকুক।" আদালত প্রদত্ত রায়ে বিচারক বলেছেনঃ স্কুলের পাঠ্যক্রমে সমাজে বিদ্যমান ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শকে অন্তর্ভুক্ত না করাটা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার সামিল। তিনি রায়ে বলেছেন মানবতাবাদের মত বিষয়কে ধর্মশিক্ষা থেকে বাদ দেয়াটা আইনের ত্রুটি।
(জিসিএসই পরীক্ষার ইসলাম ধর্মের প্রশ্ন)
চার
স্কুলজীবন নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে স্পষ্ট অথবা আবছা কত কত স্মৃতি! প্রিয় বন্ধুর পাশাপাশি বসে শিশুসুলভ সব দুষ্টামির মধ্যে কি যে আনন্দ! ধর্ম ক্লাসগুলোর স্মৃতি আমি ভুলে যেতে পারি না। এই ক্লাসটার আগে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে 'মুসলমান' বন্ধুর পাশের জায়গাটা ছেড়ে বের হয়ে যেতাম। আমরা দুজন মাত্র ছাত্র। হিন্দু ধর্মের শিক্ষক প্রায় আসতেন না। যেদিন আসতেন ব্যাপারটা আরো বিশ্রী হয়ে যেত। সেদিন অন্য ছাত্রটা ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যেত। তাঁর ধর্মের কোন শিক্ষক স্কুলে ছিল না। তাঁর নামটা এখনো মনে আছে। ন্যায়ধীশ চাকমা।
পাকিস্তান এবং এরকম কিছু দেশ ছাড়া আর কোথাও ছাত্রছাত্রীদের একমাত্র নিজ ধর্ম পড়ানোর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঘানা এবং লাইবেরিয়ার মত দেশগুলোতেও স্কুলে ছেলেমেয়েদের প্রধান সব ধর্মগুলো পড়তে হয়। আমাদের দেশে এটা যতদিন হবে না ততদিন আওয়ামী ওলামা লীগ "পহেলা বৈশাখকে মুসলমানদের ইসলামহীন করার অপতৎপরতা" এবং "মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান বিচারপতি" নিয়ে কথা বলে হাততালি পাবে।
_______________
সৌমিত্র পালিত
মন্তব্য
হুমম, বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে নীতিগতভাবে বিলিতি মানে পৌঁছেছে।
অপেক্ষা করি, একদিন বিচারিক ব্যাবস্থাও নিশ্চয় সে মানে পৌঁছুবে।
সোমিত্র'দা, অন্যান্য ধর্মের প্রশ্নের স্যাম্পলগুলোও কি দেয়া সম্ভব?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এগুলো দেখেন...
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405014-QP-JUN13.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405013-QP-JUN13.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405012-QP-JUN14.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405010-QP-JUN14.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405009-QP-JUN14.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405007-QP-JUN14-CR.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/subjects/AQA-405001-QP-JUN14.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/resources/rs/AQA-80622A-SMS.PDF
http://filestore.aqa.org.uk/resources/rs/AQA-80621B-SQP.PDF
নতুন মন্তব্য করুন