আমার পাসওয়ার্ড তুমি তোমার নাম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৫/০৫/২০১৬ - ১০:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি নীলা, বছর কয়েক হল আমেরিকায় বসবাস করছি। এখানে আসার প্রথম দুইমাস আমার শ্বাশুড়ি আমার সাথে ছিলেন। কিন্তু দুই মাস পর আম্মার হাঁসফাঁশ শুরু হয়ে যায়। তিনি এখানে, অর্থাৎ বরফের দেশে সারাদিন ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে পারবেন না। আরও কিছু অসন্তোষ্টি ছিল যেমনঃ ঘর থেকে বাহির হলেই হাঁটো দেখানো মেয়ে, মুরব্বী না মেনে যার তার সামনে "যা-তা করা" দেখলেই ক্ষেপে যেতেন (আম্মার মতে যা-তা)। তাছাড়া খাওয়াতে শান্তি নাই যেমনঃ লেবুতে লেবু লেবু কোন ঘ্রাণ নাই, মাংসের ভেতর কোন রস নাই, লন্ড্রীতে ধোঁয়া কাপড় পরিষ্কার লাগে না। যেই কথা সেই কাজ, চলে গেলেন দেশে। এই দুই মাসে আমার অবসর সময় কাটতো নাম্বার ডায়াল করে। আম্মা দেশে সবার সাথে কথা বলতে চাইতেন। আমি ছিলাম তাঁর পি এ । পাশে বসে বসে খুব মজা পেতাম তাঁর কথোপকথন শুনে।

" মুরগী কয়টা ডিম দিছে" "বাড়ীর সামনের সবজি ক্ষেতে পানি দিচ্ছে নাকি " " পাশের ঘরের নতুন বউয়ের বাচ্চা হইছে "

সব খুটিনাটি জানতে চাইতেন । বয়স ষাট উর্দ্ধ হলেও আম্মার স্মরণ শক্তি বলতে গেলে ছেলে আর ছেলের বউয়ের চেয়ে ভাল। আমরা ভুলে যেতাম অনেক কিছু, কিন্তু আম্মা মনে করিয়ে দিতো।

আম্মা যাওয়ার পর থেকে আমি আর বাবুর বাবা , আমাদের ভুলে যাওয়া রোগের যন্ত্রণা সামাল দিয়ে দিয়ে দিন পার করছি। ভুলে গিয়ে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করি। যেমনঃ ডলার পরিশোধ করার পর বাজারের একটা-দুইটা প্যাকেট দোকানে ফেলে আসা। কাপড় ড্রাইয়ে দিয়ে আনতে ভুলে যাওয়া, পার্কিং সময় ভুলে গিয়ে গাড়ি টো করার পর খুঁজাখুঁজি করা ইত্যাদি।

আম্মা চলে যাবার পর একাকী আমার অবসরও বেশ কিছুদিন আম্মার মত করে কেটে ছিল। দেশে ফোন করে আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম " মুরগী ডিম কয়টা দিচ্ছে " " কাঁকরোল বড় হয়েছে কিনা" "পুকুরের পদ্ম ফুল আছে কিনা" "ফুলের টপগুলো ঠিক আছে না ভেঙ্গে গেছে" । এইভাবে আমিও দুই মাস পার করে দিলাম। কি করব আমেরিকাতে প্যাকেট হয়ে আসছি, কত নিয়ম কানুন। আজ এই অফিসে যাও ,কাল ঐ অফিসে যাও। ইনস্যুরেন্স ছাড়া এটা হবে না,ওটা পাবো না। সোশ্যাল সিকিউরিটি ছাড়া চলা যাবে না। গ্রীন কার্ডের জন্য এটা কর ,সেটা কর। সকাল থেকে দুপুর এসব করে পার করতাম, ফাঁকে হালকা রান্না করতাম, কখনো রাতে কোথাও দাওয়াতে যেতাম, তারপর ফোন নিয়ে দেশে কথা বলতে বসে যেতাম। ধীরে ধীরে বিরক্তি আমার মনেও দানা বাঁধতে শুরু করে। ইচ্ছা করে চলে যায়। চাইলেই কি হয় !

জীবনকে মানিয়ে নিতে তারপর থেকে শুরু করি আস্তে আস্তে হাঁটা আজ এক ব্লক, কাল দুই ব্লক, পরশু পাশের পার্কে গিয়ে বসা, তরশু সেণ্ট, নিকেল, ডাইমের হিসাব ঘুলিয়ে পাকিয়ে হালকা কেনাকাটা করা। ধীরে ধীরে আশপাশের পাঁচ-দশ মাইল একা যাওয়া আসার সাহস জুটানোর চেষ্টা চলতে থাকে। বর্তমানে হাঁশিল ঘরের খুটিনাটি কেনা, লন্ড্রী করা, বাচ্চাকে স্কুলে নেওয়া, আনা, ডাক্তারের কাছে যাওয়া ইত্যাদি যোগ হয়েছে। রুটিন মাফিক নিয়মে একদিন বাজার করতে বেরিয়ে জন্ম হয়েছে আজকের "পাসওয়ার্ড" গল্পের। এই গল্পের পিছনে রয়েছে ছোট ছোট কিছু অনুঘটকমূলক ঘটনা।

ঘটনা-১
ছেলে বড় হয়ে উঠছে। এখন আমার ঘরের কাজের পাশাপাশি চাকরি নামক কাজে যুক্ত হওয়া উচিত ভাবছিলাম কিছু দিন যাবত। আশেপাশের বাচ্চাদের স্কুল গুলোকে টার্গেট করেছিলাম। কেননা আমি আবার চাকরি করতে গিয়ে ছেলেকে ডে কেয়ারে দিতে নারাজ। মা চাকরিতে যাবে, ছেলে পড়তে যাবে। দুইজন এক সাথে যাবো আর ফিরে আসবো। এই হল পরিকল্পনা। তাই পরিচিত এক ভাবী যিনি স্কুলে চাকরি করেন। তাকে বলে রেখেছিলাম। যাতে আমার জন্য চেষ্টা করেন। কেননা এখানে নিয়োগ যতটা না সার্কোলারের মাধ্যমে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে এক পরিচিত অপর পরিচিতের নাম সুপারিশ করে। ভাবীর পরামর্শ মত স্কুল টিচিং এর জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট ঘরে তৈরীও রেখেছি। যাতে করে সুপারিশের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকি। তিনি ফোন করে ছিলেন মূল ঘটনার আগের দিন। বাইরে থাকায় কথা বলা হয়নি। পরে রিপ্লাই দিব দিব করে দেইনি।

ঘটনা-২
কোন একদিন ইমেইল পাসোয়ার্ড শক্ত থেকে শক্ততর করতে গিয়ে সহজ কিন্তু লম্বা ধরনের কোড দিয়েছিলাম। আমি তো বিশেষ কেউ নই যে প্রতিদিন নিয়ম করে ইমেইল চেক করতে হবে । যা হবার তাই হল, অন্য একদিন খুলতে গিয়ে দেখি লম্বা কাল্পনিক সংখ্যাগুলো ভুলে গেলাম। সাথে সাথে ফোন নাম্বারে রিকভারি দিতে অনুরোধ পাঠিয়ে আবার নতুন করে (তবে পুরাতন ভঙ্গিমায়) কোড সেট করি। আমরা দুজনেই একই স্টাইলে কোড সাজায়, যাতে না ভুলি । উল্লেখ্য, তাকে আমার বদলানো কোড জানানো হয়নি।

মূল ঘটনাঃ

১/
ছেলেকে স্কুলে দিয়ে, চলে গেলাম "কি ফুড" এ বাজার করতে।সাধারণত কাজ না থাকলে দুজন একসাথে যায়। সেদিন বাড়ীওয়ালা রান্না ঘরের ফুটো হওয়া বেসিনের নালী সংষ্কার করতে আসবে বলেছিল। তাই বাবুর বাবা ঘরে ছিল। সিরিয়াল,পাস্তা, পাউরুটি, সবজি, ১% মিল্ক,চিজ...... লম্বা তালিকা নিয়ে এক এক করে শপিং কার্ট ভর্তি করছি। এমন সময় সেই ভাবীর ফোন আবার । তিনি জানালেন তার স্কুলে একজন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আমার একটা সুযোগ আছে। যেহেতু স্কুলের অনান্য সহকর্মীরাও নিজ নিজ পরিচিতের জন্য কথা বলছেন সেহেতু তিনি সেদিনই স্কুল ত্যাগের পূর্বে আমার সিভিখানা দাখিল করতে চান। আদেশ দিলেন যেন কালবিলম্ব না করে তাকে সেটি ইমেইল করি।

২/
এই দিকে মুঠো ফোন চার্জ অপশনে হলুদ বাত্তি জ্বলছে। আমার ছেলে নার্সারি ট্রেকের কার্টুন দেখে দেখে প্রায় এমন অবস্থা করে। তাড়াতাড়ি করে বাবুর বাবাকে ফোন করে বললাম "আমার সিভিখান ল্যাপটপের ডকুমেন্ট থেকে নিয়ে ইমেইলে এটাচ করে ভাবিকে পাঠিয়ে দাও"। কিছুক্ষন পর বাবুর বাবা ফোন করে বলে " কি রে পাসোয়ার্ড মিলে না বলে কেন" । হায় হায় ! মনে পড়ল ঘটনা নাম্বার দুইয়ের কথা।
ঐদিকে ব্যাটারীতে লাল দাগ । তাড়াতাড়ি করে বললাম "মিলবে মিলবে লিখো আমার পাসওয়ার্ড তুমি তোমার নাম" । "ওকে " বলে লাইন কেটে দিল।

৩/
আস্তে আস্তে আমি লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম ডলার পরিশোধ করতে । এমন সময় আবার বাবুর বাবার ফোন " কি দিছো এটা মিলছে না, তোমার বাজার শেষ?" । আর আমি " হুম ,কেন মিলবে না " বলেই অন্য মনষ্ক ভাবে চিন্তা করছিলাম আর কখনো কি বদলাই ছিলাম, অপর প্রান্তে কোন আওয়াজ নাই। শেষ শক্তি টুকু আমাকে দিয়ে মোবাইল বেচারা কোমায় চলে গেছে। বিল পরিশোধ করেই হাঁটা দিলাম বাসার দিকে। পাঁচ-ছয় ব্লকের ভেতর মোটামুটি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সবকিছুর দোকান আছে।

৪/
কার্ট খালি করে ঘরের দুয়ারে কয়েকবার নক করলাম । খুলছে না। ভাবছি বাবুর বাবা গেল কই। বিশ মিনিট আগেও কথা হল। সে বাসায় আছে তাই আমার নিজের চাবিটাও রেখে গিয়ে ছিলাম। কি মুশকিল ! মোবাইলে চার্জ নাই, বাসায় ঢুকতে পারছি না, বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি!
আরো পনের মিনিট পর আমার ছেলের বাপ আসল। তিনি আমার কষ্ট কমাতে আমাকে আনতে বেরিয়ে পড়ে ছিলেন। তার বার্তা আমি শুনতে পাইনি মোবাইল কোমায় চলে যাওয়ায়।

৫/

-বদলায়ছো কবে? কেমনে পাসোয়ার্ড দাও, খুলে না। ক্যাপ্স লক অন করতে হবে নাকি? যাগগে ,আমার মেইল থেকে দিছি, ভাবী পাইছে কিনা জিজ্ঞেস করো।

- তুমি কেমনে লিখলা তাই বল।

- তুমি না বললা পাসওয়ার্ড আমার নাম। আমার নামই দিছি। আমার ডাক নামও দিছিলা নাকি?

-হি হি হাঁ হাঁ।
(হাঁসি আমার থামে না। গাবলা তো আমিই লাগাইছি।)

-হাঁসির কি বললাম আমি?

- হিহিহি.........।

-???????।

-"আমার পাসওয়ার্ড তুমি তোমার নাম/amarpasswordtumitomarnam " বুঝছো কিছু?

-............। (কোন কথা নাই । তাকিয়ে ছিল পাসওয়ার্ড দাতার দিকে।)

এ্যানি মাসুদ


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনার লেখা ভালো লাগে। কেমন সুন্দর গোছানো একটা শৈলীতে এগিয়ে যায় আপনার গদ্য।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি পড়ার জন্য ধন্যবাদ ইমাম ভাই। আপনার মত পারি না। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছুটা ডিটেকটিভ ঘরনা গল্প হয়ে যেতে ধরছিলো... যাইহোক ২৪ ডিজিটের পাসওয়ার্ড দেইখা টাসকিত দেঁতো হাসি

মিতা চার্বাক

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি ধন্যবাদ।

এক লহমা এর ছবি

ঝকঝকে মিষ্টি গল্প।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দাদা।
এ্যানি মাসুদ হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।