আমার সমস্যা তো নামে নয়, নাহয় থাকলোই বিদঘুটে একটা নাম। তবে কিনা আনোয়ার খুব চালাক ছেলে। অবন্তীর প্রতি আমার দুর্বলতা তার নজর এড়ায়নি। ছেলেটার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে খেলো করা। কলেজের দেয়াল পত্রিকায় বেনামে একটা লেখা লিখেছে, লেখার নাম - ঘাঘটের কুলে ধইঞ্চার সারি। পড়ে আমার ব্রহ্মতালু যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। গল্পের প্রধান চরিত্র নদীর পারে উবু হয়ে বসে কাশের ডগা চিবোয় আর ঢেউ গোনে। শেষের বাক্যটি বড়ই নিদারুণ ………অতঃপর ঢেউ গুনিয়া গুনিয়া ক্লান্ত গণক আকাশ বাতাস কাঁপাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, অগুন্তি! অগুন্তি!
এইসব যন্ত্রণা ছাপিয়ে শরতের প্রশান্ত মেঘের মত বুধবার আসে। আসে তাঁতের শাড়ি কাঁচের চুড়ি, আর বিনুনি। আমাদের প্রায়ান্ধকার শ্রেণীকক্ষে জ্বলে ওঠে আলো, ডিমের কুসুমের মত কোমল সে আলোয় আমি দগ্ধ হই। কিছু একটা করা প্রয়োজন।
একদিন ক্যাশবনে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মাথায় চিন্তাটা এলো। আনোয়ারকে মেরে ফেললে কেমন হয়? কী হয় যদি পুঁতে ফেলি ওর মৃতদেহটা ঘাঘটের কোলে! স্বাভাবিক অবস্থায় এমন ভাবনায় মানুষের শিউরে ওঠার কথা। কিন্তু আমি কি আর স্বাভাবিক আছি! আমার খুব খুশি খুশি লাগলো। পুঁতেই ফেলবো বেয়াদবটাকে।
কিন্তু কীভাবে? পুঁততে হলে মারতে হবে, মারতে হলে আনোয়ারকে এখানে পেতে হবে। পেলেই যে মেরে ফেলতে পারবো এমন নিশ্চয়তা কোথায়? জীবনে একটা মুরগিও তো কাটিনি কোনদিন।
অবাক হচ্ছেন, তাইনা? আগে পুরোটা শুনে নিন, তারপর নাহয় যা বলার বলবেন। এতো আজকের গল্প নয়, পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কাহিনী।
ঘাগটের মেঠোপথ পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই ছিমছাম সব বাড়ি, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের আবাস। নারকেল আর সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা লাল রঙের দোতলা বাড়িটা অবন্তীদের। বাড়ি ছুঁয়ে থাকা বিশাল খেলার মাঠটির এক কোনে ছোট্ট বালিয়াড়ির মত একটা জায়গায় কয়েকটি ভলিবল কোর্ট। আনোয়ার খেলে ভালোই, তবে খেলতে কী আর যায় সে! যাকগে, খেলুক আর নাই খেলুক, সে যে সন্ধ্যে বেলায় ঘাঘটের তীর ধরে বাড়ি ফেরে এটিই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কে না জানে, সন্ধ্যে হলে বন বাদাড়ে........................
একটা মানুষ মারতে কী লাগে? ফাঁসুড়ে ডাকাতেরা শুনেছি রুমাল কিংবা গামছা দিয়েই সেরে ফেলত। একদিকে রুপোর একটি টাকা বেঁধে অন্যদিকটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে হ্যাঁচকা টান। কিন্তু আমিতো ফাঁসুড়ে নই, লেঠেলও নই যে লাঠির একটা বাড়িতে…
বন্দুকে বড় বেশি শব্দ, তাছাড়া পাবোই বা কোথায়! ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম ছুরিই সই। বাসায় একটা আছে, তবে ওটা দিয়ে বড়জোর আমটাম কাটা চলে। আমার চাই শক্তপোক্ত, ধারালো একটা ছুরি। বেশ হতো যদি একটা কুকরি বা খঞ্জর পেতাম, বাঁকানো ফলায় যে একটা নান্দনিক ব্যাপার আছে এটা নিশ্চয়ই আপনি অস্বীকার করতে পারেন না?
এই ধ্যারধ্যারে গাইবান্ধায় নন্দনতত্ত্বের চর্চা কে করে বলুন! শেষমেশ জুটল একটা গরু জবাইয়ের ছুরি।
ততদিনে কার্তিক পেরিয়ে পৌষ নেমে এসেছে, এখন সন্ধ্যে ঘনায় হুট করে। মুশকিল হল, আনোয়ারকে একা পাচ্ছিনা। কী যে অসহ্য এই প্রতীক্ষা! মলিন হয়ে আসা ঘাঘটের কাশ বনে ঘুরি ফিরি, চাদরের তলায় বেল্টের সাথে গুঁজে রাখা ছুরিটা নিশপিশ করে যেন খাঁচায় পোরা জানোয়ার একটা। অস্ত্র সাথে থাকলে ভয় ডর যে কোথায় পালায় কে জানে! আজকাল সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমে এলেও বসে থাকি ঠায়, মাথার উপর জ্বলজ্বল করে আকাশ। অবন্তীদের ছাঁদ ঘেঁষে ওঠে কালপুরুষ, ধীরে অতিধীরে, হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়, পাশে পাশে চলে লুব্ধক, আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। আমিও কালপুরুষের মতোই উদ্যত অস্ত্র হাতে প্রতীক্ষায়, কাছে ঘেঁষতে দেবনা কাওকে লুব্ধকের কাছে।
পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহ, শুক্লপক্ষের রাত। বিলীয়মান চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম দুর থেকে একটা সাদা কাপড়, শূন্যে ভেসে ভেসে এগিয়ে আসছে মেঠো পথ ধরে। আনোয়ার কী? আরে সেই তো! আমার শরীর জুড়ে জানেন, কেমন আশ্চর্য একটা শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো! কাশের বনে গুড়ি মেরে বসে রইলাম, যেন ক্ষুধার্ত সিংহ এক, নাকি তৃষিত চাতক!
আনোয়ার লাগাম টেনে ধরা ঘোড়ার মত সহসা থমকে দাঁড়ায়, আমি টের পাই সাদা জামার আড়ালে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ধুকপুক করতে থাকা ওর হৃদপিণ্ডের অস্থিরতা।
ঃ স্যার আপনি? কী যে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
আনোয়ারের হাতে তিন ব্যাটারির একটি টর্চ।
আমি হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে বললাম,
ঃ কেমন আছো আনোয়ার। এতো দেরি করে ফিরলে আজ?
ঃ খেলা শেষ হতে দেরি হয়ে গেলো, আপনি এখনও বাড়ি যান নি?
চাদরের তলায় ছুরিটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি। হাতলটা লোহার, শীতের রাতে বরফের মতো ঠাণ্ডা।
ঃ এই ফিরছিলাম।
ঃ আপনার চোখ যে রক্তজবার মতো লাল! শরীর ভালো আছে তো?
ঃ শরীর ঠিকই আছে। এখানে বড্ড বেশি বাতাস, চোখে ধুলো টুলো উড়ে এসে পড়েছে হয়তো।
ছেলেটা বড় বেশি কথা বলে। আর বলেও একদম চোখের দিকে তাকিয়ে। আমার হঠাৎ করেই অবসন্ন লাগতে শুরু করলো। ক্লান্ত গলায় বললাম,
ঃ চল আনোয়ার, বাড়ি ফেরা যাক।
কালপুরুষ, লুব্ধক আর পঞ্চমীর চাঁদ পেছনে ফেলে আমরা দুজন হেঁটে চলেছি ধ্রুব তারার দিকে। থেকে থেকে হাওয়া বইছে শনশন, সে হাওয়ায় ভেসে আসছে প্যাঁচার হুমহুম, শেয়ালের ডাক, কোন এক হতভাগ্য মোরগের অন্তিম চিৎকার।
আমাদের একপাশে প্রবহমান ঘাঘট, অন্য পাশে নিশ্চল নিথর ধুধু মাঠ। মেঠো পথ ধরে জীবন আর মৃত্যুর সহযাত্রা। নাকি এটাই জীবন! অনন্ত নক্ষত্ররাজির ভিড়ে টিমটিম করে টিকে থাকা অনুল্লেখ্য প্রভা।
------চলবে
প্রথম কিস্তির লিংকঃ
মন্তব্য
আপনিও দেখা যায় একটা গল্প শেষ না করেই আরেকটা শুরু করে দেন! "শুশুক"-এর পরের পর্ব কখন আসবে?
বাছুরের যখন শিং গজায় তখন যেখানে সেখানে গুঁতোগুঁতি না করলে তার শান্তি নেই। আমার অবস্থাও অনেকটা অইরকম। উত্তর চল্লিশে এসে শিং গজাচ্ছে। লিখছিলাম অন্টারিওর আদিবাসীদের কাহিনী, হুরন ক্যারল। অর্ধেকটা লিখে বোর লাগছিলো, থামিয়ে শুরু করলাম আরেকটা লেখা। ফসল বিলাসী হাওয়া আমার এক বন্ধুর সাথে মাছ ধরতে যাওয়ার গল্প। এটাও এগিয়েছে অনেক দুর। কিন্তু ততদিনে মাথায় ভর করেছে শুশুক। শুশুক লিখতে লিখতেই অবন্তী এলো আমার ভাবনা জুড়ে। অবন্তী আর একটা কিস্তিতেই শেষ হবে। তারপর অসমাপ্ত লেখাগুলো, প্রথমেই শুশুক। পড়ার জন্য ধন্যবাদ এমরান।
----মোখলেস হোসেন।
আপনার গদ্য শৈলী আমাকে বারবার মুগ্ধ করে। আপনিই সত্যিই একজন যাদুকর। ভেবেছিলাম এই পর্বে গল্পটার একটা হেস্তনেস্ত করবেন, আপনিতো ফের সাসপেন্সে ঝুলিয়ে দিলেন। চলুক , আনন্দ যত দীর্ঘায়ীত হয় ততই ভালো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনার মতো পরিশ্রমী হতে পারছি না সোহেল ইমাম। আবার ফাঁকিবাজি করে লিখবো এমন মেধা নিয়েও জন্মাইনি। লিখতে আমার মোটামুটি জান বের হয়ে যায়। সেজন্যেই এই দেরি।
---মোখলেস হোসেন
ভালোই চলছে, আরও চলুক
ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ।
---মোখলেস হোসেন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এর পর কিছু বালু আর সিমেন্ট দিয়া যাবেন। আপনার কাছে থেকে বেশ কিছু ইটা প্রাপ্তি হয়েছে আমার।
----মোখলেস হোসেন।
ভালো হয়েছে তবে আগের পর্বটা বেশি ভালো ছিল প্রিয় লেখক। এই পর্ব কি একটু তাড়াহুড়ায় লেখা? টাইপো আছে কিছু, দুয়েকটা বাক্যও একটু কেমন। তবে ,আপনার লেখা তো, খারাপ হবার জো নেই, চিন্তার কিছু নেই।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
ধন্যবাদ দেবদ্যুতি। কোন এক বিচিত্র কারণে নিজের ফাইল থেকে কপি করে সচলে পেস্ট করতে পারছিলাম না। সচলের টেক্সট বক্সে নতুন করে টাইপ করতে গিয়ে কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। পুরো কিস্তিটাও টাইপ করে কুলিয়ে উঠতে পারিনি সময়ের অভাবে। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার। নীড় সন্ধানী যেমনটা বলেছিলেন, গল্প আর এভাবে খণ্ডিত আকারে প্রকাশ করবো না।
----মোখলেস হোসেন
চমৎকার চলছে। দুইপর্ব একসঙ্গে পড়লাম।
দুটো ব্যপারে খটকা আছে, ১. বকের দল কি নৌকার উপর চক্কর দিয়ে ওড়ে? ২. গরু জবাইয়ের ছুরি কি বেল্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা যায়? গরু জবাইয়ের ছুরি কিন্তু অনেক বড় হয়।
আপনার লেখা পছন্দ হলো। অপেক্ষা সহ্য হয়না বলে কিস্তুিতে লেখা পড়তে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এটা পড়তে চেষ্টা করব।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
বকের দল নৌকার উপর দিয়ে চক্কর দিয়ে উড়ে বেড়ায় কিনা মনে নেই। বকের দল শেষ দেখেছি বগামারা নামের এক চরে, আমার মেজ খালার বাড়িতে, সেও আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। । গরু জবাইয়ের ছুরিও শেষ দেখেছি ২০০১ সালের কোরবানির ঈদে। নাহ, বেল্টে বাঁধা আসলেই অসম্ভব।
পড়েছেন বলে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
----মোখলেস হোসেন।
নতুন মন্তব্য করুন