"তিতাস একটি নদীর নাম। কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণ পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বউ নিয়া মাঝি ওপারে যাইতে ভয় পায় না।
তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মত বক্রতা নাই, কৃপণের মত কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।
কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারীদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে, উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তাহারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।"
তিতাস নদী নিয়ে চমৎকার এই কথাগুলো লিখে গেছেন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মন তাঁর “তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসে। বলা হয়ে থাকে “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসের মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীকে সম্ভবত ততটা বিখ্যাত করতে পারেন নি যতটা না অদ্বৈত মল্লবর্মন তিতাস নদীকে তাঁর উপন্যাসের মাধ্যমে করতে পেরেছেন। এর একটা কারণ এটা হতে পারে পদ্মা উরফে গঙ্গা অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত। থাক, এইসব তাত্ত্বিক আলোচনায় না যাই। আমরা বরং তিতাস নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসি। তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে দীর্ঘদিন আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। আমি জানতাম তিনি জীবনে একটাই উপন্যাস লিখেছিলেন। পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি তিনটি উপন্যাস যথাক্রমে তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬), সাদা হাওয়া (১৯৯৬) এবং রাঙামাটি’র (১৯৯৭) রচয়িতা। তবে একটা ব্যাপারে লেখককে দুর্ভাগা বলাই যায়। ক্ষণজন্মা এই ঔপন্যাসিক জীবদ্দশায় তাঁর উপন্যাসগুলোর গ্রন্থাকারে প্রকাশ দেখে যেতে পারেন নি। নিজের লেখা উপন্যাস গ্রন্থাকারে পর নতুন বইটি উল্টেপাল্টে ঘ্রাণ নেওয়ার অনুভূতি যে কতটা আনন্দের সেটা কেবল একজন লেখকই বুঝতে পারেন। এই আনন্দ তিনি উপভোগ করতে পারেন নি বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়।
প্রাইমারী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে যখন পড়তাম তখন আমাদের ক্লাসরুমগুলোর নামকরণ করা হত নদীর নামে। আমাদের সেকশনের নাম ছিল তিতাস। অনেক আগে থেকেই তাই মনের ভিতর সুপ্ত একটা বাসনা ছিল তিতাস নদী দেখার। হাওর, নদী কিংবা পুকুর সবসময়ই আমাকে টানে। নদীতে সাঁতরানোর আনন্দ তারা কিভাবে বুঝবে যারা সাঁতার জানে না কিংবা জানলেও বাড়ির পাশের পুকুর কিংবা শহরের সুইমিং পুলই যাদের ভরসা। হঠাত করেই সুযোগটা এসে গেল। আমার বেশিরভাগ ঘোরাঘুরিই হয় কাজের সুবাদে। গত মাসেই অফিসিয়াল ট্যুরে ঢাকা থেকে কুমিল্লা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছি। সকালে নবীনগর থানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শুনলাম স্থলপথে যেতে হলে অনেক ঘুরে যেতে হবে এবং রাস্তার অবস্থা খুবই নাজুক। সহজে যাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে তিতাসের বুক চিড়ে লঞ্চ অথবা স্পীডবোটে। শুনেই মনটা ভাল হয়ে গেল। যাক, অবশেষে তিতাসের দেখা পাচ্ছি তাহলে।
প্রায় ৯৮ কিলোমিটার গড় দৈর্ঘ্যর তিতাস নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমানা সংশ্লিষ্ট নদী হিসেবে পরিচিত। নদীটির উৎপত্তি হয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরায়। সেখানে বাংলা ভাষায় হাওড়া নদী এবং স্থানীয় কোকবোরোক ভাষায় সাঈদ্রা নদী নামে তিতাস নদীর নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঐ নদীটি তিতাস নদী হিসেবে পরিচিতি পায়। ভারতীয় অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কাছাকাছি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা দিয়ে নদীটি প্রবেশ করে শাহবাজপুর টাউন অঞ্চলের সীমানা ঘেঁষে এটি আরো দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে ভৈরব-আশুগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে বহমান অন্যতম বৃহৎ নদীমেঘনার সাথে একীভূত হয়ে যায় তিতাস নদীটি। তিতাস ও মেঘনা নদীকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে একটি উপকথায় বলা হয়েছে যে, তিতাস নদী মেঘনার কন্যা বা মেয়ে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মূল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে গোকর্নঘাট নামে একটা জায়গা আছে। এই সেই স্থান যেখানে অদ্বৈত মল্লবর্মনের জন্ম এবং এখানেই তিনি শৈশব এবং কৈশোর কাটিয়েছিলেন। নবীনগর যেতে হলে এখান থেকেই লঞ্চ অথবা স্পীডবোটে উঠতে হবে। লঞ্চে সময় লাগে সোয়া ২ ঘণ্টা, ভাড়া ১০০ টাকা। আর স্পীডবোটে সময় লাগে ৪০ মিনিট, ভাড়া ১৭০ টাকা। আমাদের হাতে সময় ছিল কম। অতএব স্পীডবোটই ভরসা।
চলুন প্রাণ ভরে তিতাসের সৌন্দর্য উপভোগ করি।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় মানুষ।
নদীর মাঝেই মাছের চাষ।
মাছ ধরার জন্য বিশাল পরিধি নিয়ে জাল গুটানো চলছে।
একলা মাঝি।
আকাশ এত মেঘলা, যেও নাকো একলা
এখুনি নামবে অন্ধকার।
কচুরিপানার রাজত্বে আঁটকে যাওয়া নৌকা।
নদীর বুক চিড়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা স্পীডবোট।
উত্তাল নদীতে চলছে মাছ ধরা।
নিঃসঙ্গ লঞ্চঘাট
প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন বৈশাখ মাস।
তিতাস ভ্রমণ শেষে আবারও গোকর্ণঘাটে এসে অদ্বৈত মল্লবর্মনের বাড়ির খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কাছেই তাঁর পৈতৃক ভিটাখানি আছে যদিও তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ সেখানে থাকে না। লেখকের বাড়ি দেখার আগ্রহ থেকে সামনে অগ্রসর হলাম। একজন অটোওয়ালা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। গিয়ে অবশ্য হতাশ হতে হয়েছে কারণ পৈতৃক ভিটায় নতুন ঘোর উঠেছে যা দেখা না দেখা একই। তবে ভাল লাগলো লেখকের একটা ভাস্কর্য দেখে। ৯৮ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১২ সালের ১লা জানুয়ারি অদ্বৈত মল্লবর্মণের পৈতৃক বাড়ীতে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং জেলা পরিষদের অর্থায়নে ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মকে লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ দিতেই হয়।
সামনে বর্ষাকাল আসছে। তিতাসের আসল সৌন্দর্য কিন্তু বর্ষাকালে। এখন থেকেই প্ল্যান করে রাখুন। চাইলে তিতাস হয়ে হাওরাঞ্চলেও একটা ঢুঁ কিন্তু আপনি মারতেই পারবেন। নদীর অপার্থিব সৌন্দর্য কি জিনিস সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। অগ্রিম স্বাগতম।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
মন্তব্য
কৃতজ্ঞতা রইলো। নদীটা দেখার সাধ ছিল অনেক দিন, কুয়োর ব্যঙের জীবনের ভেতর থেকে কবে বের হয়ে দেখবো তার আগেই অন্ততঃ আপনার উপস্থাপনায় এক ঝলক দেখা হয়ে গেল। পদ্মা পারের মানুষ ছবিতে জীবন্ত নদীটাকে আঁচ করা তাই অনেকটাই সহজ। ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আহ, পদ্মাপারের কথা মনে করিয়ে দিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে পদ্মার সাথে অন্যরকম আত্মীয়তা অনুভব করি। তবে পদ্মা নদী দেখতে কষ্ট লাগে। ধু ধু বালুচর নদীটাকে একপ্রকার হত্যাই করেছে বলা যায়। কিশোরগঞ্জ গ্রামের বাড়ি হওয়ায় হাওরাঞ্চলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে একধিকবার। যৌবনপ্রাপ্ত নদীতে সাঁতার কাটার থেকে বড় আনন্দ আর কিসে আছে? ইচ্ছে আছে নদী নিয়ে আরও কিছু ব্লগ লেখার। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
তিতাসবিষয়ক লেখার চেয়ে ছবিই বেশি হয়েছে। তবুও ভালো লেগেছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইয়িদ রফিকুল হক
ইচ্ছে করেই ছবি বেশি দিয়েছি। নদীর সৌন্দর্য কি কেবল বর্ণনা করে বোঝানো যায়?
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
প্রথম উপন্যাসের প্রায় ৪০ বছর পর দ্বিতীয় উপন্যাস লিখলেন? মাঝের এতোটা কাল কেন কিছু লেখেননি কে জানে।
লেখকের ভিটে টা বোধ করি জবর দখল হয়ে গেছে ?
তৃতীয় ছবিটা সবেচেয়ে ভালো লাগলো।
আপনার এই ঘোরাঘুরির চাকরিতে একদিকে আমাদের জন্যে ভালই, কারণ আমরাও তো সাথে সাথেই ঘুরছি
গুডরিডস
লিখেছিলেন আগেই, প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস প্রকাশের ৪০ বছর পর। ভদ্রলোক তার অনেক আগেই পরপারে চলে গেছেন। এছাড়া ছোটগল্প কিছু লিখেছিলেন। কিন্তু উপন্যাস এই তিনটাই।
ভিটে তো সেই কবেই জবরদখল হয়ে গেছে। উনার দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা নাকি থাকেন এখন যদিও কারও সাথেই পরিচয় হয় নি আমার।
ভাই আমি তো দেশ ঘুরি, আপনার মত দেশের বাইরে ঘুরার ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয়ে উঠে না। আপনার "রিগা থেকে সারায়েভো" পড়ার পর থেকেই পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ঘুরবার ইচ্ছে করছে। দেখি কোনদিন সুযোগ পাই কি না।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে। বলতে পারেন তিতাস পারেই বড় হয়েছি। তিতাসে সাঁতরে বেড়িয়েছি। এই তিতাস আমাদের রক্তে। যদিও কর্ম সূত্রে আজ আর তেমন তিতাস পারে যাওয়া হয়না। আপনার লেখাটায় নিজের অতীতটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। বর্ষার তিতাস দেখার আমন্ত্রণ রইলো।
বর্ষার তিতাসের সৌন্দর্য সত্যিই মোহনীয়। দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আবারও পপ্পন?
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
অনেক সুন্দর লিখেছেন আপনি। তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খণ্ডজীবন। ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো - সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন