গাইবান্ধায় দমবন্ধ লাগছিলো, ঈদের ছুটিতে ঢাকায় ফিরে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। কোন তাড়া নেই, ব্যাস্ততা নেই, প্রগাঢ় আলসেমিতে দুপুর অবধি শুয়ে বসে সময় কাটছে আমার। একদিন খুব ইচ্ছে হল সিনেমা দেখার। গুলিস্তানের তখন রমরমা, শহরে এয়ারকন্ডিশন্ড হল তো ওই একটাই।
মীর জুমলার কামানের সাথে লাগোয়া ছোট্টমতো দোকানটা চালাতো মনসুর নামের এক বিহারি। মনসুরকে চিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনগুলো থেকে। দুটো সিঙ্গাড়া আর এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে মনসুরকে জিগ্যেস করলাম কোন ছবি চলছে এখন। সে বলল, বিলাতি।
পোস্টারটা দুই রঙের, লাল আর কালো। এক কোনে গ্রেগরি পেক, তাঁর বিখ্যাত কণ্ঠা তুলে মাথাটা একটু বাঁকিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন। পেক সাহেবের চোখে একটি সানগ্লাস, আমাকে দেখছেন কিন্তু আমি তাঁর অভিব্যাক্তি বুঝতে পারছিনা। চুলোয় গেল সিনেমা দেখা।
টিকাটুলির মোড়ে, এখন যেখানে সাইন্টিফিক পরীক্ষানিরীক্ষার রসদপত্র পাওয়া যায় ঠিক সেইখানে ছিল ঝলমলে দোকান প্যারী দ্য গ্র্যান্ডি। দোকানের মালিক সাইফুদ্দিন সাহেব আমলিগোলার খান পরিবারের বড় ছেলে, দারুণ অমায়িক। সানগ্লাস চাইতেই দেরাজ খুলে একগাদা বের করে রাখলেন টেবিলের উপর।
নাহ, কোনটাই পেক সাহেবের মতো নয়। আমার হতাশ লাগে।
ঃ কী ধরনের সানগ্লাস খুঁজছেন আপনি?
ঃ কী করে যে বোঝাই! আচ্ছা গ্রেগরি পেকের নতুন ছবিটা দেখেছেন?
আমার কথা শেষ হবার আগেই ঘর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন সাইফুদ্দিন সাহেব।
ঃ সে কথা আগে বলবেন তো! ওই গ্লাস দিয়ে আপনি কী করবেন ইয়াং ম্যান? ওটা আপনার বয়সের সাথে যায়না বলেই এগুলো দেখাচ্ছিলাম। এই যে নিন, পড়ে দেখুন।
ধরে দেখলাম, পড়ে দেখলাম। কিন্তু মনে একটা খচখচানি থেকেই গেলো।
সাইফুদ্দিন সাহেব আমার দিকে গভীর একটা দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর স্যুটের পকেট থেকে একটা সানগ্লাস বের করে চোখে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
ঃ দেখুন তো এটা কিনা?
ভদ্রলোকের গলার স্বরটাই যেন বদলে গিয়েছে। মুখের সেই অমায়িক হাসিটা অদৃশ্য, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল অতলস্পর্শী কোন এক কুয়োয় তলিয়ে যাচ্ছি আমি। কোন মতে টেবিল খামচে ধরে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে নিয়েছেন তিনি।
ঃ কত দাম এটার?
ঃ দাম তো আপনি দিতে পারবেন না, তাছাড়া এ জিনিসের ওভাবে দাম হয় না। সানগ্লাসটার বাটে একটা চিহ্ন আছে, চিনতে পারছেন?
চিনতে না পারার কোন কারণ নেই। ছোট্ট করে খোদাই করা একটা স্বস্তিকা।
ঃ এটা জার্মানিতে তৈরি, বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে এরকম অনেকগুলো তৈরি হয়েছিলো স্বয়ং গোয়েবলসের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে। জিনিসটা কাজের। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, এমনিই দিচ্ছি একটা। ম্যানুয়াল টাও রাখুন। কোন যন্ত্রপাতির ব্যাপার নয়, পড়লেই বুঝতে পারবেন। মাস তিনেক সময় লাগবে অভ্যস্ত হতে।
কাঁপা কাঁপা হাতে সানগ্লাসের বাক্সটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে অমায়িক কণ্ঠে ডাক দিলেন সাইফুদ্দিন খান।
ঃ অ্যানাটমি নিয়ে একটু পড়বেন ভাই সময় পেলে।
দেখতে দেখতে ছুটি ফুরিয়ে গেলো, আবার গাইবান্ধা, আবারও বুধবার। কীভাবে যে দিন কাটছে আপনাকে বোঝাতে পারবো না। অনেকটা গল্প লেখার মতো, আপনি শেষটা জানেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না ঠিক কেমন করে সেখানে পৌঁছুবেন। তাই লিখছেন, কাটছেন, ভাবছেন, মাঝে মাঝে খাতা কলম গুটিয়ে স্রেফ বসে থাকছেন চোখ বন্ধ করে। সে এক অসহ্য, অকহতব্য, কুৎসিত স্থবিরতা।
এর মাঝে কত রূপ যে দেখলাম ঘাঘটের! বর্ষায় যাকে মনে হয়েছিলো প্রমত্তা, চৈত্রে সে যেন কিশোরীর চুলের ফিতে। কাশের বনটা উধাও, সেখানে চিকচিক করছে রুপোলি রুপোলি বালু, থেকে থেকে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো নলখাগড়ার ঝোপ। বড় নৌকা গুলোকে আজকাল চোখে পড়েনা। মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধুই শুন্যতা, কে জানে কোথায় চলে গিয়েছে বকের দল। মাছরাঙাদের উল্লাস নেই, নেই পানকৌড়ির ডুবসাঁতার, চরাচরে শুধুই আমি, আমার দীর্ঘশ্বাস— একটা সানগ্লাস আর ড্রেকের অ্যানাটমি।
জীববিদ্যা আমার বিষয় নয়, কলেজের লাইব্রেরি খুঁজে খুঁজে যে কয়েকটি বই পেয়েছিলাম তাতে মানব দেহ নিয়ে তেমন কিছুই লেখা নেই। ড্রেকের বইটা ঢাকা থেকে ফেরার পথে নিয়ে এসেছি। মানুষের শরীর যে কতো বিচিত্র! এই হৃদপিণ্ডের কথাই ধরুন না, কেমন পাঁজরের তলায় লুকিয়ে থেকে ধুকপুক ধুকপুক করে বেজে চলেছে অবিরাম। কায়দা করে শক্ত একটা খোঁচা মারতে পারলেই, ব্যাস। কিন্তু অত সহজ নয় যেমনটা ভাবছেন। বুকের ওই খাঁচাটা কি আর এমনি এমনি থাকে! তার চে বরং অনেক সহজ ঘ্যাঁচ করে হাতের কি পায়ের কোন একটা রগ কেটে ফেলা। সবচে ভালো হয় যদি শ্বাসনালীতে……।
তবে মানুষের শরীরটাই তো সব নয়! মন বলেও একটা কিছু আছে। বড় বিচিত্র সেই মন। যার জন্য এত কিছু, সেই অবন্তী যে কখন হারিয়ে গেলো মন থেকে বলতে পারবো না। বুধবার হলে সে আসে বটে, সে তো আর সাতটি মেয়েও আসে আমার ক্লাসে। অবন্তী এখন আর অনন্যা নয়, অন্যতম মাত্র। কিন্তু জানেন আনোয়ারের উপর থেকে রাগটা দিন দিন গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয়েছে।
সুযোগ এলো বসন্তে। ঘাগটের তীরে দখিনা হাওয়ায় যখন দোল খায় সদ্য জেগে ওঠা কাশের কচি ডগা। ফিরে আসা বকের দলের উড়ে যাওয়া, মাছরাঙ্গাদের চকিৎ উল্লাস আর ক্রমশ ফুলে ওঠা নদীর কুলুকুল ধ্বনিতে যখন দশদিক জুড়ে প্রাণের আহবান।
অনেক দুরে, যেখানে আকাশ নেমে এসেছে খোলা মাঠের সীমানায়, সেই খানে উঁকি দেয় কালো একটি বিন্দু। আমার সানগ্লাসে প্রতিভাত হয় তার অবয়ব, আনোয়ার। আহারে, হাট্টাকাট্টা ছেলেটা জানতোই না।
সানগ্লাসটা এখনও আছে, এই যে পকেটেই, দেখুন না! কিন্তু অনেকদিন হল আর কাজ করেনা। কেন জানিনা, চোখে দিলে কেবল আলিম চৌধুরীর চোখ, খুবলে নেয়া সেই চোখ দুটো দেখি।
নিয়তিকে অস্বীকার করে কী লাভ বলুন! আমার সে দিন, আমার সে তারুণ্য এখন অস্তমিত। তবে পৃথিবী তো আর থেমে নেই। একটু পরেই নতুন প্রযুক্তিটা দেখবেন। আজকাল আর চোখে পড়তে হয়না। একেবারে মাথার ভেতরে, মগজের গহিনে, খোদাই করে দেয়া, সেই ছোট্ট স্বস্তিকাটার মতো। একটা জিনিস অবশ্য অবিকল আগের মতোই আছে। বাঁকানো ফলার সেই নান্দনিক দিকটা আপনি নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারেন না?
আচ্ছা আপনার কণ্ঠার হাড়টা একটু বেশি উঁচু কী! অবশ্য তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই। অ্যানাটমিটা ওরা ভালোই জানে। এই এসে পড়লো বলে।
সমাপ্ত।
প্রথম কিস্তির লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55936
দ্বিতীয় কিস্তির লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55953
মন্তব্য
উইকেন্ডটা আসুক, আগের পর্বের সকল প্রত্যাহার করে একবারে পড়ে ফেলব।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যানন্দ।
--মোখলেস হোসেন।
আমি গল্পটা বুঝতে পারিনি!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আমার কয়েকজন বন্ধুও এই একই কথা বলেছেন। কী বোর্ড নিয়ে বসতে হবে আবার। ধরে নিন এটা ওয়ার্কিং পেপার ছিল। পড়ার জন্য ধন্যবাদ, অনার্য সঙ্গীত।
----মোখলেস হোসেন।
গল্পোটা বুঝতে পারি নাই।
আমিই বোঝাতে পারিনি, যদিও ভেবেছিলাম প্রয়োজনীয় ক্লু গুলো আসগর আলী দিয়েছিলেন। ঠিক কোন জায়গা থেকে লেখাটিকে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো। আফসোস, সম্পাদিত লেখা আপনাদের কাছে তুলে ধরতে পারবো না। অতিথি লেখকের সম্পাদনার সুযোগ নেই। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
----মোখলেস হোসেন।
লেখাটির যে অংশ সম্পাদনা করতে চান সেটা করেন। তারপর তিনটা গল্প একসঙ্গে জুড়ে একত্র করে প্রকাশের জন্য দেন। সঙ্গে একটা নোট লিখে দেন কেনো লেখাটা আবার প্রকাশ করতে দিচ্ছেন, কেনো সম্পাদনা করতে পারেননি, কেনইবা এভাবে সম্পাদনা করলেন! মডুর মনমর্জি ভালো থাকলে প্রকাশিত হয়ে যাবে
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ অনার্য সঙ্গীত। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী আবার পাঠিয়ে দিলাম। দেখা যাক কী হয়।
--মোখলেস হোসেন
পুরো সিরিজটা আগ্রহ নিয়ে পড়লাম, শেষেরটা বুঝতে না পেরে একটু আশাহত হলাম। কমেন্টে ভেঙেই বলেদিন না হয়।
শুভেচ্ছা
ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। গল্প তো আর প্রেসক্রিপশন মেডিসিন নয় যে মোড়কে লিখে দিলাম কী বোঝাতে চেয়েছি। গল্পটিতে বেশ কিছু দুর্বলতা ছিল। তাই নতুন করে লিখে পুরোটা একসাথে জমা দিলাম। মডারেটরের মর্জি হলে প্রকাশ পাবে। আপনার সদয় মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ।
--মোখলেস হোসেন
আপনার লেখা প্রথম পাতা থেকে এর মধ্যেই সরে এসেছে দ্বিতীয় পাতায়। এখন আশা করছি আপনার আরো একটা লেখা। এই গল্পটাই যদি সম্পাদনা করতে চান সেটা কিংবা অন্য কোন নতুন গল্প। আপনার অনন্য লেখনীর জন্য মনটা সব সময়ই উৎসুক থাকে। অপেক্ষায় আছি ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। নতুন পুরনো মিলে বেশ কয়েকটি লেখায় মেতে আছি। তবে অবন্তী সম্পাদনা করে আরেকবার জমা দেয়ার বুদ্ধিটা লোভনীয়। সম্পাদনা করে রেখেছি, ভাবছি পাঠিয়েই দেই। জানিনা মডারেটররা কী ভাবে নেবেন বিষয়টি। তবে চেষ্টায় তো কোন দোষ নেই, কী বলেন?
--মোখলেস হোসেন।
সত্যি, ”অবন্তী” লেখাটা আবার পড়তে চাইছি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন