চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ির রাস্তাটা চমৎকার। এক সহযাত্রীর কাছে শুনলাম অল্প কিছুদিন আগেই নাকি সংস্কার করা হয়েছে। তারও আগে রাস্তা খুব ভাঙাচোরা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই রাস্তার প্রতি এত মনোযোগ ছিল না। কারণ এখান দিয়ে লোকের যাতায়াত কম হয়। ইদানিং যদিও লোকজনের যাতায়াত অনেক বেড়েছে; তারপরেও যশোরের বেনাপোল-পেট্রোপোল সীমান্ত দিয়ে ঘণ্টায় যত লোকের আনাগোনা হয় বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে নাকি সারাদিনেও এত লোকের আনাগোনা হয় না। বাঙালী বেশিরভাগই ভারত ঘুরতে গেলে কলকাতায় যায় তাই স্বাভাবিকভাবেই বেনাপোল সীমান্তের উপর চাপ বেশি পড়ে। ওখানকার অবকাঠামোও নাকি অনেক উন্নত। ভারতীয়দের এই দিকটা ভালো। যেখানে গুরুত্ব দেওয়ার সেখানে ঠিকই গুরুত্ব দেয়, আর যেখানে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই সেখানে কৃচ্ছসাধন করে। তবে আমার মতে আন্তর্জাতিক সীমানার স্থাপনাগুলো একটু উন্নত হওয়া উচিৎ কারণ দেশের ইমেজের একটা ব্যাপার জড়িত থাকে কি না।
যেসকল বাংলাদেশী পর্যটক সড়কপথে দার্জিলিং ভ্রমণে ইচ্ছুক তাঁদের সিংহভাগই বুড়িমারী দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তবে এরথেকেও সুবিধাজনক পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া থানায় অবস্থিত বাংলাবান্দা স্থলবন্দর ব্যবহার করা। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব যেখানে প্রায় ৮০ কিলোমিটার সেখানে বাংলাবান্ধা থেকে দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্থলবন্দরটি পুরোদমে চালু হয়েছে। যারা সড়কপথে নেপাল অথবা ভুটান যেতে ইচ্ছুক তাঁদের এখন পোয়াবোরো। কারণ বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৫৮ কিলোমিটার এবং ভুটানের ফুন্টলসিং সীমান্ত ১৩০ কিলোমিটার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে বাস ছাড়ার পর ২৫ মিনিট পর্যন্ত আমার মোবাইলে বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক ছিল এবং বাসায় কথাও বলেছি। এই ২৫ মিনিটে কম করে হলেও ভারতের ১৫ কিলোমিটার ভিতরে এসেছি। এমনিতে সীমান্তে সব মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্কই পাওয়া যায়। যেই দোকান থেকে ডলার ভাঙিয়েছিলাম সেখানকার মালিকের কাছেই গ্রামীণফোনের সিমকার্ড আছে। নাম্বার দিয়ে বলেছে পরেরবার আসার আগেই ফোন করতে তাহলে যত টাকাই এক্সচেঞ্জ করতে হয় বন্দোবস্ত করে রাখবেন। বায়োমেট্রিকের পরের কাহিনী অবশ্য জানি না।
নতুন জায়গা দেখার আনন্দই অন্যরকম। পুরোটা সময় চারপাশটা কেবল তাকিয়ে দেখেছি। একটা জিনিস দেখে খুব মজা পেয়েছি সেটা হচ্ছে প্রায় বাড়ির পাশেই ছোট্ট করে চায়ের বাগান। মানে আমাদের গ্রামের বাসাবাড়িতে যেমন বিভিন্ন ফলের গাছ আর বাসার পাশে ধানক্ষেত থাকে, তেমনি এখানে আছে ছোট পরিসরে চায়ের বাগান। এভাবে চলতে চলতেই একসময় তিস্তার দেখা পেলাম। এই নদী নিয়ে মমতাদি তো বেশ জল ঘোলা করছেন। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তিস্তা চুক্তির নাকি একটা বিহিত করবেন। হলেই হয়। এদিকের তিস্তায়ও পানি কম। চর পড়েছে বিভিন্ন স্থানে। নদীর উপর বসানো ব্রিজটা বিশাল।
বাস যখন শিলিগুড়ি’তে পৌঁছাল ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পৌনে তিনটা। পেটে প্রচণ্ড খিদে। পেটে দানাপানি না পড়লে মাথা কাজ করবে না নিশ্চিত। কোথায় খাওয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করার কোন অবকাশ পাই নি। কারণ Central Plaza-র যেই পাশে টিকেট কাউন্টার সেখানে দাঁড়িয়েই রাস্তার বিপরীত পাশে একটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়েছে। ঢাকা হোটেল নামের এই রেস্টুরেন্টের খদ্দের বেশিরভাগই বাংলাদেশী যারা কি না ঠিক দুপুরবেলাতেই বাস থেকে এইখানটাতে নামেন। অনিন্দ্যের অবশ্য খাবার নিয়ে বেশ সন্দেহবাতিকতা আছে। যে কোন জায়গায় সে খায় না। রেস্টুরেন্টের বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাঁর পছন্দ হয় নি। এক দোকান থেকে বার্গার আর স্যান্ডউইচ কিনে দুপুরের লাঞ্চ সেরে ফেলা তাঁর পক্ষে সম্ভব কিন্তু ভাত ছাড়া লাঞ্চ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। রাস্তার পাশের হোটেলে লাঞ্চ করা নিয়েও আমার আপত্তি নেই। অতএব আমার গন্তব্য ঢাকা হোটেল।
এতকাল শুনে এসেছি পশ্চিমবঙ্গে খাবার বেশ সস্তা। কথাটা মিথ্যে নয়। মাত্র ৭০ রুপিতে পেট পুরে লাঞ্চ সারলাম। শিলিগুড়ি বেশ গুরুত্বপূর্ণ শহর। আসামসহ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর প্রবেশপথ এটি। বাংলাদেশের আর যে কোন একটা বিভাগীয় শহর এর মতোই। এখান থেকে জলপাইগুড়ি খুব বেশি দূরে না। শিলিগুড়ি আসার পথে জলপাইগুড়ি পার হয়েই আসতে হয়। আহ জলপাইগুড়ি। ডুয়ার্সের চা-বাগান তো জলপাইগুড়িতেই। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন এর সুবাদে ডুয়ার্সে যাওয়ার একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় নেই। জলপাইগুড়িতে রেল স্টেশন এবং বিমানবন্দর দুইই আছে। যারা কলকাতা হয়ে দার্জিলিং যেতে চান তারা প্রথমে ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন এ আসেন। সেখান থেকে সোজা দার্জিলিং। সরাসরি আকাশপথে দার্জিলিং যাওয়া সম্ভব নয়। আগে জলপাইগুড়ির বাগাডোরা বিমানবন্দরে আসতে হবে, সেখান থেকে জিপে করে দার্জিলিং।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শিলিগুড়ি থেকে আমরা জিপে করে দার্জিলিং যাব। দার্জিলিং মোড় নামক একটা জায়গা থেকে জিপ ছাড়ে। দুইভাবে যাওয়া যায়। এক হচ্ছে আপনি পুরো জিপটাই রিজার্ভ নিতে পারেন। প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার রুপি খরচ পড়বে। যদি ৮-১০ জনের গ্রুপ নিয়ে বের হন তাহলে সেটাই ভাল। আরেক হচ্ছে জিপ স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকবেন। জনপ্রতি ১৫০ রূপির বিনিময়ে যে কোন একটা ভাড়া জিপে উঠে পড়ুন। আমরা যেহেতু মাত্র দুই জন তাই দ্বিতীয় পথই ভরসা। সন্ধ্যে হয়ে গেলে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে কোন জিপ ছেড়ে যায় না।
দার্জিলিং মোড়ে পৌঁছালাম বিকেল সোয়া চারটার দিকে। শীতের বিকেলগুলো খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। যেই বাসে করে শিলিগুড়ি এসেছি সেখানকার বেশিরভাগ যাত্রীই দার্জিলিং এর পথিক। ১০ জনের একটা দল তৈরি হতে তাই খুব একটা সময় লাগলো না। বিপত্তি বাঁধল জিপ ভাড়া করতে গিয়ে। কার্শিয়াং (দার্জিলিং এর আগের একটা ষ্টেশন) কোন একটা রাজনৈতিক প্রোগ্রামের কারণে বেশিরভাগ জিপই রিজার্ভ হয়ে গেছে। যেই কয়টা জিপ ফাঁকা আছে সেগুলোও অনেক ভাড়া চাইছিল। আমরা শুধু দুজন থাকলে কোন ব্যাপার ছিল না। যে কোন একটা ভাড়া জিপে উঠে যেতাম। কিন্তু দল হওয়াতে হয়েছে সমস্যা। দলের দুজন সদস্য আবার বেশি খরচ করতে ইচ্ছুক নন। তাই তারা ঘুরে ঘুরে দামাদামি করছেন। ফলে বেশ কয়েকটা জিপ আমাদের সামনেই ভর্তি হয়ে চলে গেল। অবশেষে যখন কোনোক্রমে একটা জিপ বন্দোবস্ত করা গেল তখন দেখা গেল ৩ জনের কোন খোঁজ নাই। উনারা শহরে সিমকার্ড কিনতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। বিরক্তির একশেষ। এই কারণেই বিশাল গ্রুপ নিয়ে ভ্রমন করতে ইচ্ছা করে না। মনে মনে হারিয়ে যাওয়া তিনজনের মুন্ডুপাত করছি এমন সময়ই সাইমুমের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়।
সাইমুমের ব্যাপারে এইবেলা কিছু বলে নেওয়া যাক। আমাদের পরের তিনদিনের ভ্রমণে সে অনেক কাহিনীর জন্ম দিতে যাচ্ছে। ভ্রমণের শুরুতে আমাদের পরিকল্পনা ছিল দার্জিলিং পৌঁছে দুজন মিলেই একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখব। ৪ সিটের একটা ট্যাক্সিক্যাবে ড্রাইভারের পাশে একজন এবং পিছনে ২ জন বসতে পারে। ভাড়া যেহেতু একই সেহেতু ৩ জন থাকলে মাথাপ্রতি খরচটা কম পড়ে। ঢাকায় থাকাকালীন আমরা চেষ্টা করেছিলাম আরও একজন ভ্রমণসঙ্গী যোগাড় করতে কিন্তু পারি নি। ভারতে প্রবেশের পর একজন সফরসঙ্গী পাব এমনটা আশা করি নি। কারণ এককভাবে খুব কম সংখ্যক মানুষই বাংলাদেশ থেকে দার্জিলিং ঘুরতে আসেন। বাসে সাইমুম আমাদের পিছনের সিটে বসে আসলেও আমরা খুব একটা খেয়াল করি নি। জিপস্ট্যান্ডে যখন দাঁড়িয়ে আছি তখন সে নিজে থেকেই আমাদের সাথে পরিচিত হতে আসল। একা একা দার্জিলিং যাচ্ছে কেন জিজ্ঞেস করতেই দারুণ এক ইতিহাস বর্ণনা করল।
সাইমুম কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বর্তমানে সিলেটে একটা আইটি ফার্মে চাকুরি করছে। অবসর কাঁটায় ফেসবুকে। এইভাবে অবসর কাঁটাতে কাঁটাতেই এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। দিন যায়, সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়। দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় দেখা করবে। সাইমুমের পক্ষে ইন্দোনেশিয়া যাওয়া সম্ভব না আবার ওর প্রেমিকার পক্ষে বাংলাদেশ আসা সম্ভব না। তাই দুজনেই ভারতে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী মাস পাঁচেক আগে সাইমুম ভারতের ভিসা করিয়ে ফেলে। এবং এরপরই বাংলা সিনেমার মত কাহিনীতে টুইস্ট চলে আসে। সাইমুমের প্রেমিকার এক প্রাক্তন প্রেমিক ছিল যার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পরেই মেয়েটা সাইমুমের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। সেই প্রাক্তন প্রেমিক হঠাত করেই ইন্দোনেশিয়া ফিরে এসে আবারও প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করে এবং প্রেমিকাও তাতে সম্মতি দেয়। ত্রিভুজ প্রেমের এই খেলায় ট্র্যাজিক হিরোতে পরিণত হয় সাইমুম। এদিকে ভিসার মেয়াদও প্রায় শেষ। বাংলাদেশীদের জন্য ভারতের ভিসায় এন্ট্রি সিল না লাগালে পরবর্তীতে ভিসা পাওয়া বেশ কঠিনই হয়ে যায়। ভিসা রক্ষার্থেই তাঁর এখানে আসা এবং আমাদের সাথে সাক্ষাৎ। আমাদের সফরসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিতেই সে একপায়ে রাজী।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীদের খোঁজ অবশেষে পাওয়া গেল। কালবিলম্ব না করেই সবাই জিপে উঠলাম। ভাগ্যক্রমে আমার আসন পড়েছিল ড্রাইভারের পাশের সিটে। তারমানে পুরো পথটা দেখতে দেখতে যাব। মনে মনে এমনটাই তো চাইছিলাম। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে অজানা শিহরণে শরীর কেমন জানি কেঁপে উঠল। অবশেষে যাচ্ছি তাহলে দার্জিলিং।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার। রাস্তা ভাল হলে সমতলের ৭৭ কিলোমিটার অতিক্রম করতে দেড় দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় হিসাব আলাদা। ড্রাইভার বলেই দিল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগতে পারে পৌঁছাতে। লাগুক, ক্ষতি নেই। গাড়িতে যেহেতু উঠেছি সুতরাং দেরীতে হলেও পৌঁছানো নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। বরং পথের সৌন্দর্য উপভোগের দিকে মন দেওয়া যাক।
শহর ছেড়ে বের হতেই চমৎকার রাস্তার একদিকে চা-বাগান আর একদিকে রেললাইন চোখে পড়ল। এই লাইনগুলো ব্রডগেজ কিংবা মিটারগেজ লাইনের চেয়েও আকারে ছোট এবং বিখ্যাত Darjeeling Himalayan Railway-র অংশ। ১৮৮১ সালের ব্রিটিশরা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য এই রেললাইন তৈরি করে। এই নিয়ে পরবর্তীতে লেখব। যাওয়ার পথে একটা আর্মি ক্যাম্প পড়ে। শুকনা আর্মি ক্যাম্প। ক্যাম্পের আগে আছে এক জঙ্গল। সেই জঙ্গলের প্রবেশপথে দেখি এক অচেনা ব্যক্তির ভাস্কর্য। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই বলল “ইয়ে তো ঠাকুরি সাহাব।“ চিনতে পারলাম না। পরবর্তীতে ইন্টারনেট ঘেঁটে ভদ্রলোকের পরিচয় বের করলাম। ইনি গোর্খালি সংগীত কিংবদন্তী ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরি। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সাবেক এই ক্যাপ্টেন অনেকগুলো বিখ্যাত দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের সুর করেছিলেন। যার মাঝে বিখ্যাত হচ্ছে Kadam Kadam Badaye Ja এবং Subh Sukh Chain. শুধু তাই নয়, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের অনুরোধে তিনি ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রণ সঙ্গিতায়ন করেছিলেন এবং মহাত্মা গান্ধীকে শুনিয়েছিলেন যা বর্তমানেও প্রচলিত।
শুকনা আর্মি ক্যাম্পটা চমৎকার। ক্যাম্পের ভিতর ছবি তোলা নিষেধ তাই ছবি তুলতে পারছিলাম না। তবে সাইমুম দেখি চুপেচাপে ঠিকই ছবি তুলছে। কয়েকবার সতর্ক করেও লাভ হচ্ছে না দেখে চুপ করে গেলাম। আর্মি ক্যাম্পের ভিতরে একটা ব্রিজ পার হতে হয়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে মুগ্ধতায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য যা বর্ণনাতীত। একটা খরস্রোতা পাহাড়ি পাথুরে নদী তীব্রবেগে অসীমের পানে ছুটে চলছে। যেদিক থেকে নদীটার আগমন সেদিকে মুখ ব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য পাহাড়। পাহাড়গুলোর একজনের পিছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে যেন এক সিঁড়ি তৈরি করেছে যা বেয়ে স্বর্গে চলে যাওয়া যাবে। বেশিক্ষণ মোহাবিষ্ট হওয়ার সুযোগ ছিল না। গাড়ি আবারও ছুটে চলল দার্জিলিং এর পানে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর গাড়ি উত্তর দিকে ঘুরে যাওয়া শুরু করল। এতক্ষণ যেই পাহাড়গুলোকে ডান পাশে নিয়ে চলছিলাম সেগুলো এখন নাক বরাবর। আমরা সোজা পাহাড়গুলোর দিকেই ছুটছি। রাস্তাটা অসাধারণ। যতদূর চোখ যায় সরলরেখার মত সোজা এগিয়েছে অসীমের পানে। যেখানে রাস্তার শেষ সেখানেই যেন পাহাড়ের শুরু। দুপাশে নাম না জানা হলুদ ফুলের সমাহার। অবাধ্য বাতাস গাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে আমাদের চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার। এমন কোন পথে ভ্রমণ করেই কি জন ডেনভার তাঁর সেই বিখ্যাত Country road গানটি গেয়েছিলেন? গানে তিনি West Virgina-র পানে ছুটার আকাঙ্খা করেছিলেন আর আমরা ছুটছি দার্জিলিং এর পানে, এইটুকুই পার্থক্য।
দূর থেকে মনে হচ্ছিল রাস্তাটা বোধহয় পাহাড়ের পাদদেশেই থমকে যাবে। সেটা না হয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠতে শুরু করল। একটা তোড়ন দেখে বুঝতে পারলাম আমরা গোর্খাল্যান্ড এ প্রবেশ করেছি। এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। ভারত সিকিম দখন করার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের জন্য আলাদা একটা রাজ্য গোর্খাল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে আসছিল। ভারতের দক্ষিণে অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেই আন্দোলন জোরদার হয়েছে। এই নিয়ে দার্জিলিং এবং তৎসংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে দীর্ঘদিন বন্ধ (হরতাল) চলছিল। শেষ পর্যন্ত গোর্খা জনমুক্তি পরিষদ এর নেতা সুভাস ঘিসিং এর সাথে দিল্লীস্থ কেন্দ্রীয় এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের এক চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্শিয়াং অঞ্চলকে সীমিত আকারে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পাশাপাশি Gorkha Territorial Administration গঠন করা হয়েছে। ঐ আন্দোলনের সময় দার্জিলিং এর হোটেল ব্যবসায় ধ্বস নেমেছিল কারণ টুরিস্ট আগমন একদম শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছিল। দার্জিলিং যদি টুরিস্ট জোন না হত তাহলে গোর্খাল্যান্ড প্রতিষ্ঠা ঠেকানো সম্ভব হত না। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির করা একটা উক্তি এখনও কানে লেগে আছে। তিনি বলেছিলেন, “৪৭ সালে একবার বাংলা বিভক্ত হয়েছে, আমি বেঁচে থাকতে আরেকবার বাংলাকে বিভক্ত হতে দিব না।“ কিন্তু মমতাদি সম্ভবত এটা ভুলে গেছেন, বিচ্ছিন্নতার ঢেউ কোন অঞ্চলে একবার শুরু হলে সেটা ঠেকানো অসম্ভব। সময়ই ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করবে।
আমরা ক্রমাগত উপরে উঠছিলাম। চারপাশের দৃশ্য ছিল মনোমুগ্ধকর। একপাশে খাদ আর অন্যপাশে বিশাল পাহাড়। সেই পাহাড়গুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে দালানকোঠা। ভাবলে অবাক হতে হয়, কিভাবে যুগের পর যুগ ধরে এমন দুর্গম স্থানে এইসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
কার্শিয়াং পৌঁছুলাম সূর্যাস্তের ঠিক পরপর। কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং এর দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। এখানে ভারতের নামীদামী বেশ কিছু বোর্ডিং স্কুল আছে। আরও আছে মিশনারি স্কুল। এখানকার তাপমাত্রা দার্জিলিং থেকে কিছুটা কম কারণ দার্জিলিং এর উচ্চতা আরও বেশি। কার্শিয়াং পার হয়ে ৫ মিনিটের একটা ব্রেক দিলেন ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নামা মাত্রই ঠাণ্ডায় শরীরে কাঁপন ধরে গেল। শিলিগুড়ি থেকে ৩৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় রওনা দিয়েছিলাম। এখানে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রীর বেশি নিশ্চই হবে না। ব্যাগ থেকে শীতের কাপড় বের করে পড়ে নিলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছি আগামী কয়েকদিন শীতের কাপড়ের আস্তরণ থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।
এরপর একটানে দার্জিলিং। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন একদিকে আর বাকিরা অন্যদিকে রওনা হল। দার্জিলিং এর শহর জুড়েই হোটেল। আপনি যত উপরের দিকে (আপহিল) উঠবেন হোটেলের ভাড়া তত বেশি পড়বে। উপর থেকে দার্জিলিং শহর পুরোটা দেখতে পাব এই ভরসায় উপরের দিকে চললাম। এরপরের কাজটা কষ্টদায়ক। যেহেতু আগে থেকে হোটেল বুকিং দিয়ে আসি নি তাই থাকার জায়গা বের করতে বেশ কষ্ট হল। অনেকের কাছ থেকে শোনা খুব পীড়াদায়ক এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম জীবনের প্রথমবার। বেশ কয়েকটা হোটেলে আমাদেরকে থাকতে দেয় নি কেবল বাংলাদেশী বলে। এটা যে কত অপমানদায়ক অনুভূতি সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছিল তারপরেও পাহাড় ভেঙে উঠছিলাম হোটেলের খুঁজে। শেষ পর্যন্ত বিধাতা সদয় হলেন। Hotel Aliment-এ দিনপ্রতি দু’হাজার রুপিতে দুটো রুম পেলাম। ঠিক হল একটা রুমে আমি আর অনিন্দ্য থাকব, অন্য রুমটাতে সাইমুম একা থাকবে। রাতের খাবারের অর্ডার দিয়েই রুমে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। গরম পানি দিয়ে চমৎকার একটা গোসল দেওয়ার পর শরীরটা শান্ত হল। সেই সাথে দার্জিলিং ভ্রমণের উত্তেজনাও আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। অবশেষে তাহলে চলেই এলাম দার্জিলিং?
দার্জিলিং, রাত ৯ টা।
১৩ নভেম্বর ২০১৫, শুক্রবার।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
মন্তব্য
আপনার ঝরঝেরে বর্ণনার যাদুতে আপনার পিছেই যেন উড়ে চলছি। চলুক এই ভ্রমন কথা, দারুন লাগছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে বর্ণনার মাধ্যমে দার্জিলিং এর প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ অসম্ভব। সম্ভব হলে একবার ঘুরে আসুন। সারা জীবন গল্প করার মতন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে পারবেন।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
প্রথম পেইজে থাকা নিয়ে মতের খানিক পার্থক্যে পাঠকের মন ভরলো ...
পরের পোস্টের অপেক্ষায়!
☼ মানুষিক সৈনিক ☼
ইনশাল্লাহ খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আপনি এইসব হিন্দুয়ানী জায়গায় ঘুরতে গেছেন কোন সাহসে?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আমি দুর্বল ঈমানের বান্দা। ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান যাওয়ার সাহস নাই। তাই হিন্দুস্তানই ভরসা। আপনে পিছে লাগছেন কেনু? তবে ভাল দিক হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আপনার জবান ফুটেছে। পপকর্ণের ফ্যাক্টরি কি বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
১। ইন্ডিয়া গেছেন, মুম্বাই গিয়া জিন্দাপীসের মাজার দেইখা আইসেন।
২। ওকে, আমি আবার পপ্পন মোডে ফেরত গেলাম।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
১। জিন্দাপীস সাহেবের দরগায় গিয়া ঈদের সেলামি চাইবার ইচ্ছা আছে। পীস ফাউন্ডেশন শুনেছি যাকাতের টাকা যেন তাঁদেরকে দেওয়া হয় সেই নিয়া নাকি ক্যাম্পেইন চালাইছিল এককালে।
২। আপনি এই মুডেই থাকেন। পপ্পন মুডে যাওয়ার দরকার নাই ভাইডি।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আহ! অপূর্ব! আমার জীবনের ট্র্যাজেডি কি জানেন আজো ভারতে যাওয়া হলোনা, অথচ আমার পেশাগত কিংবা নেশগত দুই কারনেই সবার আগে যেই দেশে যাবার কথা সেটা হল এই ভারত! যেখানে কিনা জিম করবেট এর জন্ম, যেখানে কিনা তিনি লিখেছেন তাঁর অমর গ্রন্থগুলো! হিমালয় এর নিচের দিককার অংশ মানে যেখানে গাছ আছে, যেখানে বুনো বিড়ালেরা আছে সেইখানে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নেবার মত পবিত্র কিছু আমার কাছে নেই। বাংলা ভাষার প্রায় সব প্রিয় লেখকেরাই একের পর এক অন্যবদ্য বই রচেছেন এই প্রিয় জায়গাগুলি নিয়ে আজো হলো না যাওয়া। সবার আগে ক্লাস টু তে পড়বার সময় যে বইটা পড়ে দারজিলিং এর প্রতি মোহ তৈরি হয়েছিল সেটার নাম দার্জিলিঙে হৈ হৈ কান্ড। কলকাতার কোন এক স্কুলের ছেলেদের ফুটবল খেলায় জেতার পুরষ্কার হিসেবে দল বেধে দারজিলিং যাওয়া। আর এরপর তো ফেলুদা, টেনিদা, আর অনিমেষ এর গল্প পড়ে এই পুরো উত্তরবঙ্গ হয়ে গেছে স্বপ্নের এক ভূমি। বিশ্বাস করুন আপনার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি একলা একলা আনমনে হাসছিলাম! লিখে যান আরো! আহ হিমালয়!
প্রত্যেকের মনের গহীনেই কিছু না কিছু স্বপ্ন লুকায়িত থাকে। আমার যেমন স্বপ্ন এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করা। সেটা যদি সম্ভব নাও হয় অন্তত হিমালয়ের পাদদেশ ধরে যেই রাস্তা চলে গেছে ভুটান থেকে ভারত, নেপাল হয়ে পাকিস্তান অবধি সেই রাস্তায় ভ্রমণ করা। জানি না আদৌ সেটা সম্ভব হবে কি না। অন্তত এভারেস্টের বেজক্যাম্প অবধি তো যেতেই চাই। পাইনের জঙ্গলের বুক চিরে ছুটে চলা খরস্রোতা নদীতে নৌকা বাইতে চাই। আরও অনেক কিছুই তো চাই। স্বপ্নের কি আর কোন পরিসীমা আছে?
দার্জিলিং যাওয়া খুবই সহজ। একটু সময় বের করে ঘুরে আসুন। খুব ভাল লাগবে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আপনি যদি ছবি তোলার দিকে আরেকটু মনোযোগ দিতেন, ভালো হতো। যদি ছবিগুলো ঝাপসা ওঠে, বা ভালো না আসে, তাহলে পোস্টে যোগ না করলেও তেমন ক্ষতি হবে না। দৃশ্যগুলো আপনার চোখে যেমন এসেছে, ক্যামেরার চোখে তেমন না এলে লেখার ওপরই ভরসা রাখুন। পাঠকের হাতে তখন কল্পনার বিকল্পটা রয়ে যায়। কিন্তু একটা ঝাপসা বা গড়-না-ছোঁয়া ছবি দিলে সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।
চমৎকার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। এই পর্বের ছবিগুলো প্রায় সবই গাড়ির ভিতর থেকে গাড়ি চলাকালীন সময়ে তোলা হয়েছিল। পুরাতন মডেলের অলিম্পাস ডিজিটাল ব্র্যান্ডের ক্যামেরা দিয়ে (যা কি না ইতিমধ্যে একবার সারাইখানা থেকে ঘুরে এসেছে) এর থেকে ভাল ছবি আর কিই বা আশা করা যায়? পরবর্তী পর্বের ছবিগুলোতে এই সমস্যা থাকবে না আশা করছি।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
দারুণ বর্ণনা!
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন