• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

অবন্তী (শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ মোতাবেক সম্পাদিত)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/০৭/২০১৬ - ৪:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সানগ্লাসটার জন্যই যা একটু মন খারাপ হয়।

ভারি ফ্রেম আর বড় কাঁচ, এইধরনের সানগ্লাস ক'টাই বা চোখে পড়ে আজকাল? মানুষের রুচি বদলায়, সেই সাথে প্রযুক্তি। এখন সময় মিনিয়েচারের। টুথপিকের মতো ফিনফিনে ডাঁটি, তার সাথে কোনমতে আটকে থাকা দুফালি সরু কাঁচ, যাকে বলে রিমলেস। ওতে কি আর চোখ ঢাকে? সানগ্লাস তো নয়, যেন নাকের বিকিনি।

বলছিনা যে আমার সানগ্লাসটা খুব পর্দানশীন ছিল। আমি চোখ লুকিয়ে চলার মানুষ নই, সানগ্লাস পড়তাম অন্য একটা কারণে। কখনও ইঁদুর মেরেছেন কি? খাঁচায় আটকা পড়া ইঁদুরের চোখে চোখ পড়লে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। হাতের লাঠি হাতেই রয়ে যায়, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলতে থাকা ইঁদুরটা বেঁচে থাকে আরও কিছুদিন। সানগ্লাসটাকে বলতে পারেন আমার আর ইঁদুরদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অলঙ্ঘনীয় একটি দেয়াল।

অবন্তী তখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। এই বয়সে কেউ চুলে বিনুনি বাঁধেনা। অবন্তী বাঁধত, সেই সাথে তাঁতের শাড়ি। তাঁতের শাড়ির কথা ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠে পিঠ জুড়ে এলিয়ে থাকা একরাশ খোলা চুল, অথবা যত্ন করে বাঁধা খোঁপা। অবন্তীকে দেখে অবাক হয়েছিলাম খুব।

সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি, ঢাকা থেকে অনেক দুরের একটা জায়গায় পোস্টিং। শুনেছি কোন এক বুড়ি নাকি রেললাইনে গরু বেঁধে চলে গিয়েছিলো। ড্রাইভার ট্রেন থামাতেই আধপাগল এক ইংরেজ সাহেব ভাবলেন, একটু নেমে দেখা যাক। তারই ফলশ্রুতি ধ্যারধ্যারে একটি জনপদ, গাইবান্ধা। এখানে একটি কলেজে আমার আপাত নির্বাসন। কী আছে এইখানে, কে আছে? ঢাকায় অগুনতি মানুষ, হাজারটা যাবার জায়গা, অথচ বাঁক ফিরলেই চেনামুখের সাথে দেখা হয়ে যায়না। আমি চাইলেই জনারণ্যে হারিয়ে যেতে পারি, পারি ভেসে যেতে চেনা আড্ডায়। গাইবান্ধায় আমার চেনা কেউ নেই, তবে আমাকে অনেকেই চেনে। সরকারি কলেজের মাস্টারি তখন এতোটা সহজলভ্য ছিলোনা।

অন্য শিক্ষকেরা কেউ আমার বয়সি নন, একটা পঁচিশ বছরের ছোকরাকে আড্ডায় ডাকতে তাদের খুব একটা উৎসাহ নেই। ভালোই হয়েছে, একদল আধবুড়ো মানুষের সাথে কী আর গল্প হতে পারতো আমার! দিন কাটছে একা একা, কখনও বাড়িতে, কখনও নদীর পারে, কখনো বা স্রেফ কলেজের মাঠে হাঁটাহাঁটি করে।

এই নিস্তরঙ্গ জীবনে অবন্তী এলো ঝড়ের মতো, আমার খোলা চুলের চিত্রকল্পটা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে। ওর কোমর ছুঁয়ে যাওয়া বিনুনির সে কী মাদকতা, আহা!

সেদিন ছিল বুধবার। দুপুরের পর উপস্থিতি এমনিতেই কম থাকে, বৃষ্টির দিন বলে ক্লাসের অর্ধেকটাই ফাঁকা। যারা আছে তাদের সম্ভবত আর কিছু করার নেই। ব্ল্যাকবোর্ডটা চক দিয়ে লিখে প্রায় ভরিয়ে এনেছি, এমন সময় ঠক ঠক একটা শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি অনিচ্ছুক জনতার কেউ ঝিমুচ্ছে, কেউ বা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোর্ডের দিকে। একটু যারা সাহসী তারা আমার চোখ এড়িয়ে টুকটাক গল্প গুজবে ব্যাস্ত। ওদের দোষ দিতে পারিনা। আমি নিজেই আমাকে শিক্ষক হিসেবে পেতে চাইতাম কিনা সন্দেহ! পড়াতে ভালো লাগেনা, চাকরিটা করছি সে কিছু একটা করতে হয় বলেই।

দরজায় দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য সুন্দর একটি মেয়ে। গায়ের সাথে লেপটে রয়েছে আধভেজা তাঁতের শাড়ি, মুখে বিন্দু বিন্দু জলের ছাঁট, হাত দুটো কাঁচের চুড়িতে ছাওয়া, যেন বুদ্ধদেব বসুর কবিতা থেকে উঠে আসা কোন চরিত্র।

ঃ দুঃখিত, বৃষ্টির জন্য আসতে দেরি হয়ে গেলো। আমার নাম অবন্তী।

ক্লাসের সবাই যেন দম বন্ধ করে বসে ছিল নামটা শোনার জন্য। একটা মৃদু গুঞ্জন দানা বেঁধে উঠে, নামটা সবার পছন্দ হয়েছে।

ঃ বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?
ঃ আমি এই ক্লাসের ছাত্রী স্যার, আগে নাটোর কলেজে ছিলাম। বাবার বদলির চাকরি, আমরা পরশুদিন এখানে এসেছি। কলেজে আজই প্রথম।

কোন কারণ নেই, অথচ মনে হচ্ছে যেন গনগনে সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে কুলকুল করে ঘামছি। কোনমতে ঢোক গিলে বললাম,

ঃ ঠিক আছে, এরপর যেন আর দেরি না হয়। যাও, বস গিয়ে।

অবন্তী পৃথিবীর সমস্ত আলস্য নিয়ে তিন পা হেঁটে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। বুঝতে পারছেনা কোথায় বসবে। ক্লাসে পিন পতন নিস্তব্ধতা। প্রতিটি ছেলের হৃদস্পন্দন টের পাচ্ছি আমি, প্রতিটি মেয়ের ঈর্ষা।

আমার ক্লাসে দুটো দরজা। লেকচারের একটা পর্যায়ে ছেলেরা পেছনের দরজা দিয়ে চোরের মতো বেরিয়ে যায়, আমি দেখেও না দেখার ভান করি। আজকে কেউ যায়নি। ক্লাসটাও কেমন দুম করে শেষ হয়ে গেলো। সময় কখনো কখনো বড়ই দ্রুতগামী, বড় নিষ্ঠুর।

সে আমলে ঘাঘট নদীর চেহারা ছিল অন্যরকম, বুক চিড়ে উড়ে যাওয়া ব্রিজটা ছিলোনা। কুল ছাপানো কাশবন পেরিয়ে পায়ে চলা পথ, অনেকটা হাঁটলে তারপর বসতির শুরু। গাইবান্ধার আশেপাশে আরও দুটো নদীর কথা মনে পড়ে, ব্রহ্মপুত্র আর বাঙালি। কিন্তু আমাকে টেনেছিল ঘাঘট, কী যেন একটা আছে ওই নামে!

সময় পেলেই ঘাঘটের তীরে গিয়ে বসে থাকি। একটা দুটো নৌকা চলে যায় পাল তুলে, ডানায় শত বর্ষার শিহরণ তুলে উড়ে যায় তুষার শুভ্র বকের দল, কোন এক মাছরাঙার চকিত উল্লাস, একটি পানকৌড়ির টুপ করে ডুবে যাওয়া, আর আমার আকাশ পাতাল ভাবনা।

অবন্তীর দেখা মেলে শুধু বুধবারে, সপ্তাহে ওই একটিই ক্লাস। সে আসে বিনুনি দুলিয়ে, বসে থাকে, হাসে, কথা কয়। ক্লাস যেন উপচে পড়ে আজকাল। কিছু নতুন মুখ দেখি, এরা অন্য ক্লাসের, অবন্তীর অনুগামী। আনোয়ার এদেরই একজন। অবন্তীর সাথে ওর বেশ ভাব। প্রথম প্রথম উপেক্ষা করতাম। ইদানীং ইচ্ছে করে ঘাড় ধরে বের করে দেই।

আনোয়ার এলেই অবন্তীর চোখে কাশ ফুলের ঢেউ খেলে যায়। আমার অসহ্য লাগে। শুনেছি মেয়েরা নাকি অনেক কিছু বুঝতে পারে, অবন্তী বোঝে কী!

একদিনের কথা। ঘাঘটের তীরে বুঁদ হয়ে বসে থেকে টের পাইনি কখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এমনিতে বেলা থাকতে থাকতেই চলে আসি, আমার আবার ভূতের ভয়টা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। দোয়া দরুদ জপতে জপতে হনহন করে ছুটে চলেছি, জোনাকির মায়াবী আলোয় জায়গাটা দারুণ অপার্থিব দেখাচ্ছে। এমন সময়, যেন মাটি ফুঁড়ে সে বেরুলো।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার পাশে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে আনোয়ার।

ঃ পাক্কা একঘণ্টা স্যার। খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আসে পাশে কেউ নেই যে সাহায্যের জন্য ডাকি। আবার এই অন্ধকারে সাপখোপের মধ্যে আপনাকে রেখেও যেতে পারছিনা। আল্লার অসীম রহমত যে আপনার জ্ঞান ফিরেছে।

কাশের বনটা পায়ে চলা পথ থেকে বেশ উঁচুতে, তার উপর নিরেট অন্ধকার। নেমে এসেই আচমকা আনোয়ারের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটা ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, অন্ধকারে ওর মুখ দেখিনি। কেবল দেখেছিলাম একটা সাদা কাপড়, মানুষের অবয়ব নিয়ে শূন্যে ভেসে আছে।

ঃ আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে স্যার। বাসায় ফিরছিলেন বুঝি? ঃ হু
ঃ চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই।
ঃ আমি একাই যেতে পারবো, মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিলো, এখন ঠিক আছি।

পরদিন সেই বুধবার। আগের রাতের ধাক্কা সামলে কলেজে পৌঁছুতে একটু দেরি হয়ে গেলো। আমাদের কলেজটা বেশ বড়, সামনেই একটা খোলা মাঠ, মাঠ পেরিয়ে পুকুর, তারপর দালান। অবন্তীকে দেখলাম পুকুর পারে, দুটি মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই আঁচল দিয়ে মুখ চেপে হেসে উঠলো। অবন্তী জানে। ইচ্ছে করছে আনোয়ার কে খুন করে ফেলি।

যাকে ভালোবাসি, যার সান্নিধ্যে আসার জন্য প্রাণ হাহাকার করে, তার তাচ্ছিল্য যে কত বেদনার তা কেমন করে বোঝাই আপনাকে! আমার মাথাটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগলো। চলতে গিয়ে একটা হোঁচট খেলাম, ছোট্ট একটা হোঁচট। কিন্তু তাতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে।

আনোয়ার যখন আমাকে হাত ধরে টেনে উঠাচ্ছিলো তখন চারপাশে রীতিমত একটা জটলা। জটলার শোরগোল ছাপিয়ে শুনতে পেলাম অবন্তীর হাসি, কী মধুর অথচ নির্মম সেই কিন্নর ধ্বনি!

ক্লাসে গিয়ে দেখি বোর্ডে চক দিয়ে বড় বড় করে লেখা, ধইঞ্চা।
ধইঞ্চা কী জিনিস তা আমি জানিনা।

জানতে পারলাম দুদিন পর, কেমিস্ট্রির শিক্ষক মাহবুব সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে। দস্তরখানের চারপাশে রকমারি খাবার, একটা শাক দেখে অচেনা লাগায় জিগ্যেস করলাম,

ঃ এটা কী শাক মাহবুব সাহেব?
ঃ ধইঞ্চা শাক, চিনলেন না! আমি তো শুনলাম এইটা আপনের খুব পছন্দ। খুব ভালো জিনিস, মাথা ঠাণ্ডা রাখে।

অন্যান্য শিক্ষকরাও দেখলাম ধইঞ্চা শাকের বিবিধ গুণাগুণ নিয়ে যথেষ্টই ওয়াকেবহাল।

আমি আসগর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র, দেখতে শুনতে খারাপ নই, একটা কলেজের মাস্টার, অপেক্ষা করছি কবে মার্কিন দেশে পড়তে যাবো, সেই আমার সমস্ত অর্জন মুছে গিয়ে জেগে উঠলো নতুন পরিচয়, ধইঞ্চা।

সব শিক্ষকেরই একটা নাম থাকে, ছাত্রদের দেওয়া। আমাদের প্রিন্সিপালের নাম যেমন মদন টাক। ছাত্রদের কল্পনা শক্তিতে আমি অভিভূত। লিকলিকে ঠ্যাং, প্রশস্ত মধ্যাঞ্চল, হঠাৎ জেগে উঠা নলখাগড়ার ছড়ির মতো কণ্ঠার হাড়, আর পিথাগোরাসের নিখুঁত বৃত্ত সম নিটোল তেল চকচকে একটি টাক - সার্থক নামকরণ। তবে এইসব নামটাম নিয়ে শিক্ষকেরা খুব একটা মাথা ঘামান না। আমিও ঘামাইনি, অন্তত শুরুতে।

আমার সমস্যা তো নামে নয়, নাহয় থাকলোই বিদঘুটে একটা নাম। তবে কিনা আনোয়ার খুব বুদ্ধিমান ছেলে। অবন্তীর প্রতি আমার দুর্বলতা তার নজর এড়ায়নি। কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একটা লেখা বেড়িয়েছে, যদিও বেনামে কিন্তু আমি নিশ্চিত এটা আনোয়ারেরই কাজ। লেখার নাম - ঘাঘটের কুলে ধইঞ্চার সারি। পড়ে আমার ব্রহ্মতালু যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। গল্পের প্রধান চরিত্র নদীর পারে উবু হয়ে বসে কাশের ডগা চিবোয় আর ঢেউ গোনে। শেষের বাক্যটি বড়ই মর্মান্তিক………অতঃপর ঢেউ গুনিয়া গুনিয়া ক্লান্ত গণক আকাশ বাতাস কাঁপাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, অগুন্তি! অগুন্তি!

এইসব যন্ত্রণা ছাপিয়ে শরতের প্রশান্ত মেঘের মত বুধবার আসে। আসে তাঁতের শাড়ি কাঁচের চুড়ি, আর বিনুনি। আমাদের প্রায়ান্ধকার শ্রেণীকক্ষে জ্বলে ওঠে আলো, ডিমের কুসুমের মত কোমল সে আলোয় আমি দগ্ধ হই। কিছু একটা করা প্রয়োজন।

একদিন ক্যাশবনে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মাথায় চিন্তাটা এলো। আনোয়ারকে মেরে ফেললে কেমন হয়? কী হয় যদি পুঁতে ফেলি ওর মৃতদেহটা ঘাঘটের কোলে! স্বাভাবিক অবস্থায় এমন ভাবনায় মানুষের শিউরে ওঠার কথা। কিন্তু আমি কি আর স্বাভাবিক আছি! আমার বেশ খুশি খুশি লাগলো। পুঁতেই ফেলবো বেয়াদবটাকে।

কিন্তু কীভাবে? পুঁততে হলে মারতে হবে, মারতে হলে আনোয়ারকে এখানে পেতে হবে। পেলেই যে মেরে ফেলতে পারবো এমন নিশ্চয়তা কোথায়? জীবনে একটা মুরগিও তো কাটিনি কোনদিন।

অবাক হচ্ছেন, তাইনা? আগে পুরোটা শুনে নিন, তারপর নাহয় যা বলার বলবেন। এতো আজকের গল্প নয়, পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কাহিনী।

ঘাগটের মেঠোপথ পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই ছিমছাম সব বাড়ি, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের আবাস। নারকেল আর সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা লাল রঙের দোতলা বাড়িটা অবন্তীদের। বাড়ি ছুঁয়ে থাকা বিশাল খেলার মাঠটির এক কোনে ছোট্ট বালিয়াড়ির মত একটা জায়গায় কয়েকটি ভলিবল কোর্ট। আনোয়ার খেলে ভালোই, তবে খেলতে কী আর যায় সে! যাকগে, খেলুক আর নাই খেলুক, সে যে সন্ধ্যে বেলায় ঘাঘটের তীর ধরে বাড়ি ফেরে এটিই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

একটা মানুষ মারতে কী লাগে? ফাঁসুড়ে ডাকাতেরা শুনেছি রুমাল কিংবা গামছা দিয়েই সেরে ফেলত। একদিকে রুপোর একটি টাকা বেঁধে অন্যদিকটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে হ্যাঁচকা টান। কিন্তু আমিতো ফাঁসুড়ে নই, লেঠেলও নই যে লাঠির একটা বাড়িতে…

বন্দুকে বড় বেশি শব্দ, তাছাড়া পাবোই বা কোথায়! ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম ছুরিই সই। বাসায় একটা আছে, তবে ওটা দিয়ে বড়জোর আমটাম কাটা চলে। আমার চাই শক্তপোক্ত, ধারালো একটা ছুরি। বেশ হতো যদি কোনো কুকরি বা খঞ্জর পেতাম, বাঁকানো ইস্পাতে যে একটা নান্দনিক ব্যাপার আছে এটা নিশ্চয়ই আপনি অস্বীকার করতে পারেন না?

এই ধ্যারধ্যারে গাইবান্ধায় নন্দনতত্ত্বের চর্চা কে আর করে বলুন! শেষমেশ জুটল একটা গরু জবাইয়ের ছুরি, ঢালাই লোহার।

ততদিনে কার্তিক পেরিয়ে অগ্রাহায়ন নেমে এসেছে, সন্ধ্যে ঘনায় হুট করে। মুশকিল হল, আনোয়ারকে একা পাচ্ছিনা। কী যে অসহ্য এই প্রতীক্ষা! মলিন হয়ে আসা ঘাঘটের কাশ বনে ঘুরি ফিরি, চাদরের তলায় বেল্টের সাথে গুঁজে রাখা ছুরিটা নিশপিশ করে যেন খাঁচায় পোরা জানোয়ার একটা। অস্ত্র সাথে থাকলে ভয় ডর কোথায় পালায় কে জানে! আজকাল সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমে এলেও বসে থাকি ঠায়। মাথার উপর জ্বলজ্বল করে আকাশ, অবন্তীদের ছাঁদ ঘেঁষে ওঠে কালপুরুষ, ধীরে অতিধীরে, হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়, হাত ছোঁয়া অথচ অনতিক্রম্য দূরত্বে তার পাশে পাশে চলে আকাশের উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধক।

পৌষের প্রথম সপ্তাহ, শুক্লপক্ষের রাত। বিলীয়মান চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম দুর থেকে একটা সাদা কাপড়, শূন্যে ভেসে ভেসে এগিয়ে আসছে মেঠো পথ ধরে। আনোয়ার কী? আরে সেই তো! আমার শরীর জুড়ে জানেন, কেমন আশ্চর্য একটা শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো! কাশের বনে গুড়ি মেরে বসে রইলাম, যেন ক্ষুধার্ত সিংহ এক, নাকি তৃষিত চাতক!

আনোয়ার লাগাম টেনে ধরা ঘোড়ার মত সহসা থমকে দাঁড়ায়, আমি টের পাই সাদা জামার আড়ালে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ধুকপুক করতে থাকা ওর হৃদপিণ্ডের অস্থিরতা।

ঃ স্যার আপনি? কী যে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!

আনোয়ারের হাতে তিন ব্যাটারির একটি টর্চ।
আমি হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে বললাম,

ঃ কেমন আছো আনোয়ার। এতো দেরি করে ফিরলে আজ?
ঃ খেলা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো, আপনি এখনও বাড়ি যান নি?

চাদরের তলায় ছুরিটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি। লোহার হাতলটা শীতের রাতে বরফের মতো ঠাণ্ডা।

ঃ এই ফিরছিলাম।
ঃ আপনার চোখ যে রক্তজবার মতো লাল! শরীর ভালো আছে তো?
ঃ শরীর ঠিকই আছে। এখানে বড্ড বেশি বাতাস, চোখে ধুলো টুলো উড়ে এসে পড়েছে হয়তো।

ছেলেটা বড় বেশি কথা বলে। আর বলেও একদম চোখের দিকে তাকিয়ে। আমার হঠাৎ করেই অবসন্ন লাগতে শুরু করলো। ক্লান্ত গলায় বললাম,

ঃ চল আনোয়ার, বাড়ি ফেরা যাক।

কালপুরুষ, লুব্ধক আর পঞ্চমীর চাঁদ পেছনে ফেলে আমরা দুজন হেঁটে চলেছি ঘাঘটের তীর ধরে। থেকে থেকে হাওয়া বইছে শনশন। সে হাওয়া বয়ে আনে প্যাঁচার হুমহুম, শেয়ালের ডাক, কোন এক হতভাগ্য মোরগের অন্তিম চিৎকার।

আমাদের একপাশে প্রবহমান ঘাঘট, অন্য পাশে নিশ্চল নিথর ধুধু মাঠ। মেঠো পথ ধরে জীবন আর মৃত্যুর সহযাত্রা। নাকি এটাই জীবন! অনন্ত নক্ষত্ররাজির ভিড়ে টিমটিম করে ভেসে থাকা অনুল্লেখ্য প্রভা

গাইবান্ধায় দমবন্ধ লাগছিলো। ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এলাম বুক ভরে নিশ্বাস নিতে। কোন তাড়া নেই, ব্যাস্ততা নেই, প্রগাঢ় আলসেমিতে দুপুর অবধি শুয়ে বসে সময় কাটছে আমার। একদিন ইচ্ছে হল সিনেমা দেখার। গুলিস্তানের তখন রমরমা, শহরে এয়ারকন্ডিশন্ড হল তো ওই একটাই।

মীর জুমলার কামানের সাথে লাগোয়া ছোট্টমতো দোকানটা চালাতো এক বিহারি, নাম মনসুর। দুটো সিঙ্গাড়া আর এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে মনসুরকে জিগ্যেস করলাম কোন ছবি চলছে এখন। সে বলল, বিলাতি।

পোস্টারটা দুই রঙের, লাল আর কালো। এক কোনে গ্রেগরি পেক, তাঁর বিখ্যাত কণ্ঠা তুলে মাথাটা একটু বাঁকিয়ে আমার দিকে চেয়ে। পেক সাহেবের চোখে একটি সানগ্লাস, আমাকে দেখছেন কিন্তু আমি তাঁর অভিব্যাক্তি বুঝতে পারছিনা। চুলোয় গেল সিনেমা দেখা।

টিকাটুলির মোড়ে, এখন যেখানে সাইন্টিফিক পরীক্ষানিরীক্ষার রসদপত্র পাওয়া যায় ঠিক সেইখানে ছিল ঝলমলে দোকান প্যারী দ্য গ্র্যান্ডি। দোকানের মালিক সাইফুদ্দিন সাহেব আমলিগোলার খান পরিবারের বড় ছেলে, দারুণ অমায়িক। সানগ্লাস চাইতেই দেরাজ খুলে একগাদা বের করে রাখলেন টেবিলের উপর।

নাহ, কোনটাই পেক সাহেবের মতো নয়। আমার হতাশ লাগে।

ঃ কী ধরনের সানগ্লাস খুঁজছেন আপনি?
ঃ কী করে যে বোঝাই! আচ্ছা গ্রেগরি পেকের নতুন ছবিটা দেখেছেন?

আমার কথা শেষ হবার আগেই ঘর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন সাইফুদ্দিন সাহেব।

ঃ সে কথা আগে বলবেন তো! ওই গ্লাস দিয়ে আপনি কী করবেন ইয়াং ম্যান? ওটা আপনার বয়সের সাথে যায়না বলেই এগুলো দেখাচ্ছিলাম। এই যে নিন, এটা পড়ে দেখুন।

ধরে দেখলাম, পড়ে দেখলাম। কিন্তু মনে একটা খচখচানি থেকেই গেলো।

সাইফুদ্দিন সাহেব আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর স্যুটের পকেট থেকে একটা সানগ্লাস বের করে চোখে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

ঃ দেখুন তো এটা কিনা?
ভদ্রলোকের গলার স্বরটাই কেমন বদলে গিয়েছে। মুখের সেই অমায়িক হাসিটা অদৃশ্য, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল অতলস্পর্শী কোন এক কুয়োয় তলিয়ে যাচ্ছি আমি। কোন মতে টেবিল খামচে ধরে দাঁড়ালাম। হয়তো জ্ঞান হারাতাম, যদি তিনি চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে না নিতেন।

ঃ কত দাম এটার?
ঃ দাম তো আপনি দিতে পারবেন না, তাছাড়া এ জিনিসের ওভাবে দাম হয় না। সানগ্লাসটার ডাঁটিতে একটা চিহ্ন আছে, চিনতে পারছেন?

চিনতে না পারার কোন কারণ নেই। ছোট্ট করে খোদাই করা একটা স্বস্তিকা।

ঃ জার্মানির জিনিস, খোদ গোয়েবলসের নির্দেশে বানানো। যুদ্ধের পর ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন দিকে, কিছু যায় কোরিয়ায়, কিছু ভিয়েতনামে, কিছু পেয়েছি আমরা। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, এমনিই দিচ্ছি একটা। ম্যানুয়াল টাও রাখুন। কোন যন্ত্রপাতির ব্যাপার নয়, পড়লেই বুঝতে পারবেন। মাস তিনেক সময় লাগবে অভ্যস্ত হতে।

কাঁপা কাঁপা হাতে সানগ্লাসের বাক্সটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে অমায়িক কণ্ঠে ডাক দিলেন সাইফুদ্দিন খান।

ঃ অ্যানাটমি নিয়ে একটু পড়বেন ভাই সময় পেলে।

দেখতে দেখতে ছুটি ফুরিয়ে গেলো, আবার গাইবান্ধা, আবারও বুধবার। কীভাবে যে দিন কাটছে আপনাকে বোঝাতে পারবো না। অনেকটা গল্প লেখার মতো, আপনি শেষটা জানেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না ঠিক কেমন করে সেখানে পৌঁছুবেন। তাই লিখছেন, কাটছেন, ভাবছেন, মাঝে মাঝে খাতা কলম গুটিয়ে স্রেফ বসে থাকছেন চোখ বন্ধ করে। সে এক অসহ্য, অকহতব্য, কুৎসিত স্থবিরতা।

এর মাঝে কত যে রূপ দেখলাম ঘাঘটের! বর্ষায় যাকে মনে হয়েছিলো প্রমত্তা, চৈত্রে সে যেন কিশোরীর চুলের ফিতে। কাশের বনটা উধাও, সেখানে চিকচিক করছে রুপোলি বালু, থেকে থেকে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো নলখাগড়ার ঝোপ। বড় নৌকা গুলোকে আজকাল চোখে পড়েনা। মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধুই শুন্যতা, কে জানে কোথায় চলে গিয়েছে বকের দল। মাছরাঙাদের উল্লাস নেই, নেই পানকৌড়ির ডুবসাঁতার, চরাচরে শুধুই আমি, আমার দীর্ঘশ্বাস— একটা সানগ্লাস আর ড্রেকের অ্যানাটমি।

জীববিদ্যা আমার বিষয় নয়, কলেজের লাইব্রেরি খুঁজে খুঁজে যে কয়েকটি বই পেয়েছিলাম তাতে মানব দেহ নিয়ে তেমন কিছুই লেখা নেই। ড্রেকের বইটা ঢাকা থেকে আনিয়ে নিয়েছি।

মানুষের শরীর যে কতো বিচিত্র! এই হৃদপিণ্ডের কথাই ধরুন না, পাঁজরের তলায় লুকিয়ে কেমন ধুকপুক ধুকপুক করে বেজে চলেছে অবিরাম। কায়দা করে শক্ত একটা খোঁচা মারতে পারলেই, ব্যাস। কিন্তু অত সহজ নয় যেমনটা ভাবছেন। বুকের ওই খাঁচাটা কি আর এমনি এমনি থাকে! তার চে বরং অনেক সহজ ঘ্যাঁচ করে হাতের কি পায়ের কোন একটা রগ কেটে ফেলা। সবচে ভালো হয় যদি শ্বাসনালীতে……।

তবে মানুষের শরীরটাই তো সব নয়! মন বলেও একটা কিছু আছে। বড় বিচিত্র সেই মন। যার জন্য এত কিছু, সেই অবন্তী যে কখন হারিয়ে গেলো মন থেকে বলতে পারবো না। বুধবার হলে ও আসে বটে, সে তো আর সাতটি মেয়েও আসে আমার ক্লাসে। অবন্তী এখন আর অনন্যা নয়, অন্যতম মাত্র। আমার মনটা পাল্টে গিয়েছে, সানগ্লাসের পৃথিবীটা কেমন যদি জানতেন! অবশ্য পুরোটা দেখা হয়নি তখনও, ম্যানুয়ালের নির্দেশনা অনুযায়ী আমার আরেকটা স্তর পেরুনো বাকি। আমকে পথ দেখাবে আনোয়ার।

সুযোগ এলো বসন্তে। ঘাগটের তীরে দখিনা হাওয়ায় যখন দোল খায় সদ্য জেগে ওঠা কাশের কচি ডগা। ফিরে আসা বকের দলের দাপুটে উড়ান, মাছরাঙ্গাদের চকিৎ উল্লাস আর ক্রমশ ফুলে ওঠা নদীর কুলুকুল ধ্বনিতে যখন দশদিক জুড়ে ছড়িয়ে থাকে প্রাণের আহবান।

এক বিকেলে, অনেক দুরে, যেখানে আকাশ নেমে আসে খোলা মাঠের সীমানায়, সেই খানে উঁকি দেয় কালো একটি বিন্দু। আমার সানগ্লাসে প্রতিভাত হয় তার অবয়ব, আনোয়ার। কী নিঃশঙ্ক চিত্তেই না এগিয়ে আসছে হাট্টাকাট্টা ছেলেটা! আমার চাদরের তলায় ছটফট করে ওঠে কালপুরুষের আহবান।

সানগ্লাসটা এখনও আছে, এই যে পকেটেই, দেখুন না! অনেকদিন হল নির্জীব, ধকল তো আর কম যায়নি! ফজলে রাব্বি, আজাদ, রুমি, আলতাফ মাহমুদ………নামের কোন শেষ নেই ভাই। গাইবান্ধা থেকে রায়েরবাজার, আসগর আলীর গল্প কী আর একটা দুটো!

নিয়তিকে অস্বীকার করে কী লাভ! আমার সে দিন, আমার সে তারুণ্য এখন অস্তমিত। খুব মন খারাপ হয় সানগ্লাসটার জন্য। আজকাল চোখে দিলে কেবল আলিম চৌধুরীর চোখ, খুবলে নেয়া সেই চোখ দুটো দেখি। তবে পৃথিবী তো আর থেমে নেই, বসে ছিলেন না সাইফুদ্দিন খান। একটু পরেই নতুন প্রযুক্তিটা দেখবেন। এখন আর চোখে পড়তে হয়না। একেবারে মাথার ভেতরে, মগজের গহিনে খোদাই করে দেয়া সেই স্বস্তিকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত আসগর আলী। কী করে ভাবেন অবন্তী আপনার, আপনাদের!

আচ্ছা আপনার কণ্ঠার হাড়টা একটু বেশি উঁচু কী! না না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। অ্যানাটমিটা ওরা ভালোই জানে। এই এসে পড়লো বলে।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পাঠকদের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় গল্পটিতে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। সম্পাদনা করে আবার জমা দিলাম। আশা করছি প্রকাশিত হবে।
--মোখলেস হোসেন।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনি অনেক কষ্ট করে লিখেছেন। পাঠকের মন্তব্যও সাদরে গ্রহন করেছেন। সেইজন্য অনেক কৃতজ্ঞতা।

একবার মনে হলো, এড়িয়ে যাই। কিন্তু আপনার পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই, মন্তব্যটা করা উচিত মনে হলো।

গল্পটা আমি এবারও বুঝতে পারিনি। তবে অন্তত দুটো সম্ভাব্য মানে করতে পেরেছি। যে মানেটা বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হচ্ছে সেটা অবন্তীর এতো চমৎকার গল্পটার সঙ্গে সেভাবে মিলছে না। আপনার লেখা খুব সুন্দর। সুন্দর বলেই এই লেখাটা আবার পড়েছি। আগেরগুলোও পড়েছি। আমি প্রায়শই লেখা পড়তে শুরু করে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে আর পড়িনা। আপনার ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি।

এতো সুন্দর লেখেন, অথচ আপনি পাঠককে বোধহয় ঠিকঠিক বুঝতে পারেন নি। আপনি যেভাবে ভাবছেন পাঠক সেভাবে হয়তো ভাবছে না। হয়তো আপনার মতো অতোদূর ভেবে উঠতে পারছে না। পাঠকের দুর্বলতার কথা মনে রাখাও লেখকের একটা দায় বলে মনে হয় আমার।

একটা আটপৌরে প্রেমের গল্প হিসেবে এটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র আপনার লেখা এবং বর্ণনার গুণে লেখাটা আটপৌরে লাগেনি। শেষের দিকে গল্পটা আর প্রেমের থাকলোনা। অন্তত আমার কাছে নয়। অনেক বেশি বিস্তৃত হয়ে গেল। এতো ছোট একটা লেখার পক্ষে অতো বিস্তৃত মানে ধরে ফেলা খুব সহজ বলে মনে হয়না আমার। সেইখানে গল্পটা হারলো।

কিন্তু এসব কোনো সমালোচকের কথা নয়। সাধারণ পাঠক হিসেবে যা মনে হলো সেটা বললাম। লেখকের দক্ষতা এবং পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতেই এতো কথা বলা। আবার বলে রাখি, আপনার লেখা অন্তত আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। আপনার ভবিষ্যতের লেখাগুলোও পড়বার আগ্রহ রইলো।

শুভেচ্ছা।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

কীভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছিনা অনার্য সঙ্গীত। গল্পটি আপনি এতোটা মনোযোগ নিয়ে পড়েছেন! এই গল্পের ভাবনা আমার মাথায় এসেছিলো রাজীব খুন হবার পর। খুনের সাথে জড়িত ছিল নর্থ সাউথ ইউনিভারসিটির কয়েকজন ছাত্র। আমি নিজে এন এস ইউ এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র। এন এস ইউ তে ছাত্র রাজনীতি নেই। কিন্তু তারুণ্যের একটা অদ্ভুত শক্তি রয়েছে, রয়েছে নিজেকে প্রকাশ করবার দুর্নিবার একটি আকাঙ্ক্ষা। রাজনীতি বিবর্জিত পরিবেশে এতগুলো তরুণ প্রানের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ছাই চাপা আগ্নেয়গিরির মতো অবদমিত থাকবে কতদিন! আমি একটা বিস্ফোরণের আশংকায় ছিলাম। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে তাই ঠিক করি এই অবদমিত শক্তিকে একটা সাংগঠনিক রূপ দেবো। এন এস ইউ এর প্রায় সমস্ত ক্লাব আমাদের ওই ক'জনের হাতে তৈরি। আমরা এন এস ইউ কে ভালবেসেছিলাম, আমরাই আনোয়ার। একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আসগর আলীদের নিয়ে আমরা যথেষ্ট মস্করা করেছি সে সময়।

ভালোবাসা এমনই, ভালোবাসা মানুষকে নিয়ে যায় বিচিত্র গন্তব্যে। আমার গল্পে অবন্তীর বিনুনিতে আমি দেখেছি বাংলাদেশকে। আসগর আলীও এই বাংলার মানুষ, বাংলাকে ভালবেসেছিলেন নিজের মতো করেই। অবন্তীর কাছে পৌঁছুতে না পারার যন্ত্রণায় দগ্ধ স্বার্থপর একটা মানুষের মনোজাগতিক টানাপোড়েনের বর্ণনা দিয়ে গল্পের শুরু। একটা সময় তাঁর পরিচয় হয় সাইফুদ্দিন খানের সাথে। সাইফুদ্দিন খান আরও উচ্চমার্গের অস্তিত্ব, আসগর আলীর দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দেন এই লোক। আসগর আলীর কাছে অবন্তী তখন অর্থহীন। অবন্তী নয়, আসগর আলী তাড়িত তখন অন্য কোন স্বপ্ন নিয়ে যা স্পর্শ করতে প্রয়োজন আনোয়ারদের অপসারণ।

আসগর আলীরা হত্যা করেছে রুমিদের, আলতাফ মাহমুদদের। আমরা তাদেরকে চিনি, একটা দৃশ্যমান সানগ্লাসের আড়ালে থেকে ধ্বংস করে গিয়েছেন আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, স্বপ্ন।

কিন্তু নিবরাসকে চিনতে পারেন কী? বুঝতে পারেন রোহান কিম্বা অর্ক কে? আমার আপনার আশপাশ দিয়েই তাদের বেড়ে উঠা, বিচরণ। আমরা তাদের ব্যাখ্যা করতে পারছিনা, কেবল বলছি ব্রেন ওয়াশড, একেবারে মগজের গহিনে খোদাই করে দেওয়া। একই ম্যানুয়াল পড়া, একই রকম নির্মম, নিজের কাজটা করতে জানে শল্যচিকিৎসকের দক্ষতায়, এক্সিকিউশনারের নির্মমতায়। ভাবছেন অবন্তী শুধুই আমাদের!

আরও অনেক কিছুই লিখতে পারতাম। কিন্তু মেঘলা মানুষকে যেমন বলেছি, গল্প তো প্রেসক্রিপশন মেডিসিন নয় যে বোতলের মোড়কে লিখে দেবো কী বোঝাতে চেয়েছি। দিন শেষে এটা আসগর আলীর ভাষ্য, কিছুটা বুঝি, কিছুটা অসংলগ্ন। কিন্তু এটাই তো জীবন!

-----মোখলেস হোসেন।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আমার কাছেও এই মানেটা বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হচ্ছিলো। কিন্তু সেটাকে অবন্তী'র চমৎকার প্রেমের সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম না।
গল্পের শিরোনাম অবন্তী না হয়ে চশমা, আনোয়ার বা আসগর আলী হলে সম্ভবত আমি আমার চিন্তায় গল্পটাকে একপেশে ভালোবাসার আখ্যান করে রাখতে চাইতাম না। অথবা শিরোনাম 'অবন্তী' হলেও যদি গল্পের গন্তব্যে অবন্তী চরিত্রটির অন্য কোনো ভূমিকা থাকতো।

কিন্তু গল্পটা ভালো। তাতে সন্দেহ নেই। আপনার পরের লেখা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

মুদ্রা সংগ্রাহক  এর ছবি

এবার মনে হচ্ছে বুঝতে পেরেছি। অনার্য সঙ্গীত এর সাথে একমত নই। অবন্তীর প্রতি প্রেমের প্রথম অংশটা খুবই প্রাসঙ্গিক - একরোখা তুমুল প্রেমও মগজ ধোলাই এর ক্ষেত্রে অন্তরায় নয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মুদ্রা সংগ্রাহক।
---মোখলেস হোসেন

himisir এর ছবি

আসগর আলীর সাথে পরিচয়ের পরের অংশ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। লেখকের সাহায্য কাম্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসগর আলীর সাথে সাইফুদ্দিন খানের পরিচয়ের কথা বলছেন? গোলমালটা তো ওখানেই! বোঝা মুশকিল কী হয়েছিলো। ব্ল্যাক হোলের কথাই ধরুন না, ইভেন্ট হরাইজনের ওপারে কী হয় সেটা কি অবজার্ভার বুঝতে পারেন? কিন্তু কিছু একটা হয় নিশ্চয়ই, নইলে আসগর আলী, নিবরাস এরা পারে কী করে? আর আমরাই কেন বলিঃ ছেলেটাতো ভালোই ছিল, কী যে হয়ে গেলো! ভেবে ভেবে একটা সময় ভাবলেশ হীন হয়ে যাই, কিন্তু তল খুঁজে পাই না।

আমি চাইলে বিষয়টি খোলাসা করতে পারতাম, আসগর আলীর অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও খানিকটা লিখতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করলো না। এই বিষয়টি আমি পাঠকের মর্জির উপর ছেড়ে দিতে চাই।

পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ himisir
----মোখলেস হোসেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

গল্পটা যখন প্রথম পড়ি তখন বুঝতে না পারার বিষয়টির চেয়েও যেটা মনে হচ্ছিল সেটা হলো গল্পটা আরো একটু বেশি পরিসর দাবী করে। সমালোচনা নয়, পাঠক হিসেবেই মনে হয়েছে কিছু কিছু জায়গায় আরো একটু বিশদ বর্ণনার দরকার ছিল। এমন নয় সমস্তটাই জলের মত স্বচ্ছ করে বুঝিয়ে দেওয়া, কিন্তু আরো কিছু কথা খরচ করার মত আর কি। কিন্তু অবশ্যই লেখক পাঠকের ছক বাঁধা বোধে পা রেখে রেখে চলবেননা নিশ্চয়, তারও কিছু কৌশল, কিছু পরিকল্পনা থাকেই। হয়তো পাঠকের অনভ্যস্ততা বা অভিনবত্বের কারনেই সে রসাস্বাদনে বাধা পড়ে। মোখলেস ভাই আপনি আমার প্রিয় লেখক, আপনার ক্ষমতা এখনও অসামান্য বলেই আমি বিশ্বাস করি। সাহিত্য কতখানি বুঝি জানিনা, তবে আপনার কাছ থেকে আরো অনেক অসামান্য সৃষ্টি অনিবার্য ভাবে আসবেই এটা জানি। সে জন্যই আপনার প্রত্যেক লেখাই আগ্রহ নিয়ে পড়ি।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাপরে!!! অনেক ধন্যবাদ সোহেল ইমাম।
---মোখলেস হোসেন

মেঘলা মানুষ এর ছবি

এবার বুঝতে পেরেছি। চমৎকার একটা লেখা! আর পাঠকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্পাদনা করে আবার লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। তা না হলে, একটা অতৃপ্তি থেকেই যেত।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই জন্যেই সচলায়তনকে আমার পছন্দ, মেঘলা মানুষ। ফিডব্যাকটা খুবই জরুরী।
---মোখলেস হোসেন

জিপসি এর ছবি

আপনার ধৈর্যশক্তি দেখে আমি বিস্মিত টোকন ভাই। সচলায়তনে আপনাকে নিয়মিত দেখতে চাই।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

আরে, আপনি আমাকে চেনেন দেখছি! আপনার ধৈর্যেরও প্রশংসা করছি। সময় নিয়ে আমর লেখাটি পড়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ।
----মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

একেবারেই ব্যক্তিগত অভিমত দিচ্ছি, মানার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। লেখক যদি পাঠকের মত অনুযায়ী লেখাকে পুনর্নির্মাণের পথে হাঁটেন তাহলে লেখক জনপ্রিয় হতে থাকেন, কিন্তু নিজের স্বকীয়তা হারাতে থাকেন। অনলাইন মিডিয়ায় পাঠক নিজের মতামত জানাতে পারেন, এটা লেখকের জন্য বিশাল পাওয়া। সেই মতামতের মধ্য থেকে ভুল সংশোধনের পরামর্শগুলো গ্রহন করতে হবে, পরবর্তী লেখাগুলোতে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। কিন্তু চিন্তা বা ভাব প্রকাশের পদ্ধতির ব্যাপারে পাঠকের পরামর্শ নেবার বিপদ আছে। সেই বিপদে পড়ে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল লেখক মুকুলই থেকে গেছেন, ফুল হয়ে আর ফুটতে পারেননি।

একটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের কথা বলি। আমার বিবেচনায় আপনি ১০০ মিটার স্প্রিন্টের খেলোয়ার নন্‌, ২৬ মাইল ৩৮৫ গজ দৈর্ঘ্যের ম্যারাথনের খেলোয়ার। সুতরাং উপন্যাস বা বড় গল্পে বেশি মনোযোগ দিলে সম্ভবত আপনার প্রতিভা ও দক্ষতার যথাযথ প্রতিফলন ঘটবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
----মোখলেস হোসেন

 সুমন্ত এর ছবি

অনেক দিন পর নতুন কোন লেখকের একটা গল্প এত আগ্রহ নিয়ে এক টানে পড়ে শেষ করলাম। ভাষার ব্যবহার, গল্পের গাঁথুনি, কাহিনীর বৈচিত্র্য, সবই খুব চমৎকার লাগছিল। অসাধারণ। আপনার পরবর্তী লেখাগুলো পড়ার জন্য অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব।

তবে অনেকের মতই আমারও কিছু পর্যবেক্ষন আছে। গল্পটা এগোচ্ছিল খুব ভাল। কাহিনীর গতিও ছিল চমৎকার। কিন্তু কেন যেন মনে হল, শেষ দিকে গিয়ে লেখক হঠাত অল্প কথায় অনেক কিছু বলে ফেলতে চেষ্টা করলেন। এত সুন্দর করে যে কাহিনীর গাঁথুনি তৈরি হল, সেটার শেষটা কেন যেন অত ভাল লাগল না। মনে হল অল্প কিছু বাক্যে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। খেই হারিয়ে ফেলতে হয়।

নিজেকে খুব পরিণত পাঠক মনে করি না কখনই, কিন্তু পড়ি বেশ অনেকই। খুব ভাল লেখা পড়লে অনেক অনেক ভাল লাগে। লিখতে থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সুমন্ত। আমি গল্পটিকে একটা যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু মন বলল যা হচ্ছে তা ব্যাখ্যার বাইরে, দুর্বোধ্য। একজন গবেষক হয়তো বিশ্লেষণ করে আমাদের জানাতে পারবেন যা হয় তা কেন হয়। আমি ভেবেছি ঝিরিঝিরি বসন্তে পথ চলতে গিয়ে বেমক্কা আছাড় খাওয়ার পড় মানুষের কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাহনিটাকে। পুরান ঢাকার ভাষায়, 'তব্দা লাইগা গেছি'।

--- মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

"মানুষের শরীর যে কতো বিচিত্র! এই হৃদপিণ্ডের কথাই ধরুন না, পাঁজরের তলায় লুকিয়ে কেমন ধুকপুক ধুকপুক করে বেজে চলেছে অবিরাম। কায়দা করে শক্ত একটা খোঁচা মারতে পারলেই, ব্যাস। কিন্তু অত সহজ নয় যেমনটা ভাবছেন। বুকের ওই খাঁচাটা কি আর এমনি এমনি থাকে! তার চে বরং অনেক সহজ ঘ্যাঁচ করে হাতের কি পায়ের কোন একটা রগ কেটে ফেলা। সবচে ভালো হয় যদি শ্বাসনালীতে……।
তবে মানুষের শরীরটাই তো সব নয়! মন বলেও একটা কিছু আছে। বড় বিচিত্র সেই মন।"
.
প্রিয় লেখক আপনার এই চরণ গুলো মনে অন্যরকম একটা অনুভূতির জন্ম দিল।

RuhulAminBD

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ রুহুলআমিনবিডি।

---মোখলেস হোসেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।