(এই পোস্টে উদ্ধৃত সকল তথ্য, উপাত্ত ও বিশ্লেষণ 'Institute for Energy Economics and Financial Analysis' থেকে প্রকাশিত 'Risky and Over-Subsidised: A Financial Analysis of the Rampal Power Plant' নিবন্ধটি থেকে নেওয়া। এই লেখাটি মূলত ঐ নিবন্ধটির কিছু উল্লেখযোগ্য অংশের অনুবাদ। আগ্রহী পাঠক যারা আরও বিস্তারিত জানতে এবং মূল নিবন্ধটি পেতে আগ্রহী তারা এই লিঙ্ক থেকে এটি সংগ্রহ করতে পারেনঃ
http://ieefa.org/wp-content/uploads/2016/06/Risky-and-Over-Subsidised-A-Financial-Analysis-of-the-Rampal-Power-Plant-_June-2016.pdf)
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেটি 'মৈত্রী সুপার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প' নামে পরিচিত সেটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (BPDB) অধীনে পরিকল্পিত এগারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অন্যতম। প্রস্তাবিত এই আমদানিকৃত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি BPDB এবং ভারতের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা NTPC লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে, 'বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি লিমিটেড' (BIFPCL) নামে পরিচালিত হবে। এ প্রকল্পটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পশুর নদীর অববাহিকায় প্রায় ১৮৩৪ একর জায়গা জুড়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে যেটি কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। উল্লেখ্য সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি জাতীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এছাড়া এটি রামসার কনভেনশন মনোনীত জলাভূমি এবং ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক অফ বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের একটি অংশ। সুন্দরবনের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের বাংলাদেশী অংশে দুটি পৃথক বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ভারতীয় অংশে একটি অভয়ারণ্য রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ সমীক্ষায়ও রামপাল প্রকল্পটির উত্তরের অংশে পরিবেশগত সংবেদনশীল এলাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্দরবন প্রাণবৈচিত্রে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বাঘ ও ইরাবতী ডলফিনের আবাসস্থল। এসব কিছু মিলিয়ে এটি সুস্পষ্ট যে এটি পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি এলাকা।
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশগত সমীক্ষায় রামপাল প্রকল্পটি “Wind risk zone” এর অন্তর্গত বলা হয়েছে। গত ২৫ বছরে এলাকাটি ১৬টি বড় ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস ১০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অথচ প্রস্তাবিত এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ০.৮৭৫২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বন্যায় কিম্বা জলোচ্ছ্বাসে এ কেন্দ্রটি প্লাবিত হলে 'অ্যাশ স্ল্যারি পন্ড' থেকে বিষাক্ত বর্জ্য ছাই আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটাতে পারে। (২০০৮'এ যুক্তরাষ্ট্রের টেন্যাসি অঙ্গরাজ্যের কিংস্টোনের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এরকম একটি দুর্ঘটনায় ৪২ লাখ ঘনমিটার ছাই আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে কল্পনাতীত দূষণ ঘটায় যার মাশুল যুক্তরাষ্ট্র আজো দিয়ে যাচ্ছে। আগ্রহীরা এই সূত্রগুলি অনুসন্ধান করে দেখতে পারেনঃ
সূত্র ১: http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/23249246
সূত্র ২: http://www.scientificamerican.com/article/tennessee-coal-ash-spill)
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশগত সমীক্ষায় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির কথা স্বীকার করা হলেও এ প্রকল্পটির জন্য 'সর্ব্বোচ্চ ঐতিহাসিক জলোচ্ছ্বাস' ৫.৫ মিটার (যেটি বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যের ব্যতিক্রম) উল্লেখ করে প্রকল্প এলাকাটির উচ্চতা ৫.৫ বাড়াতে বলা হয় । পরে NTPC এটাকে আরো কমিয়ে ৫ মিটারে নামিয়ে নিয়ে আসে। এখানে উল্লেখ্য যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং সাগরের তাপমাত্রা ও উচ্চতা বৃদ্ধির পটভূমিতে নিকট ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা এবং ভয়াবহতার মাত্রা দুটোই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এরকম যে কোন একটি দুর্যোগ থেকে বিষাক্ত বর্জ্য ছাই আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত উচ্চ বলে এই নিবন্ধে আশঙ্কা করা হয়েছে। এর সাথে প্রকল্পটির অবস্থানগত দুর্গমতা এই ঝুঁকিটাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, "the area is remotely accessible due to poor road and communication network. Pedestrian access through some rural earthen roads, which easily become muddy and damaged due to rain, is the modest mode of communication.” যে কোন দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় এই দুর্গমতাকে সমীক্ষায় গভীর উদ্বেগের বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কয়লা পরিববন এবং নদী খননের পরিবেশগত ঝুঁকিঃ
২০১৬ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালাতে চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হবে। উল্লেখ্য এই কয়লার, শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা কম (~৪,৭০০ কিলক্যালরি/কেজি), বর্জ্য ছাই এর পরিমাণ বেশি, এবং প্রস্তাবিত ৮০% প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টরে চালাতে বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন টন কয়লার দরকার পড়বে। এই কয়লা আমদানি করা হবে সমুদ্রগামী জাহাজে যেগুলি নোঙর করবে আকরাম পয়েন্টে (যা কিনা সুন্দরবনের ভিতরে)। সেখান থেকে ছোট বার্জে করে সুন্দরবনের ভিতর থেকে পশুর নদী দিয়ে রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রে সেই কয়লা আনা হবে। এই নিবন্ধে এই পরিবহনের প্রক্রিয়ায় পানি ও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বহুমাত্রিক এবং অতি উচ্চ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
আকরাম পয়েন্ট থেকে কয়লা পরিবহনের জন্য এবং নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য 'আউটার বার' থেকে মোংলা বন্দরে ৩০ মিলিয়ন ঘনমিটার এবং মোংলা বন্দর থেকে প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত ২.১ মিলিয়ন ঘনমিটার পলি উত্তলন করতে হবে। এছাড়া নাব্যতা বজায় রাখার জন্য প্রতি বছরই খনন কাজ চালিয়ে যেতে হবে। 'আউটার বার' থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত বার্ষিক খননের ব্যয়ভার বাংলাদেশ সরকার বহন করবে যার পরিমাণ ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ফলে এ প্রকল্পের জীবনকালে বাংলাদেশ সরকারকে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫০০০ কোটি টাকা) ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। এছাড়া প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর মোংলা বন্দর থেকে প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত খনন কাজের জন্য বার্ষিক ৪ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার প্রদান করবে। এই খননের ফলে নদীর তলদেশ থেকে অপসারিত পলি পাড়ে জমা রাখা হবে। এর ফলে পলিতে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ এবং মিথাইল মারকারি, আর্সেনিক, সীসা, ক্যাডমিয়ামসহ অন্যান্য ভারী ধাতু খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়বে। এর ফলে ইতিমধ্যে হুমকির মধ্যে থাকা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট জলজ জীবন ও এর উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। (যাদের Fate and Transport of Pollutant নিয়ে সম্যক ধারণা নেই, তাদের জ্ঞাতার্থেঃ উপকূলীয় অঞ্চলের পলি অত্যন্ত বিপজ্জনক দূষকের আধার (sink)। বছরের পর বছর ধরে উজান থেকে পানি যত দূষক বয়ে নিয়ে আসে সেগুলো নদীর তলদেশে পলিতে সঞ্চিত হতে থাকে। পলির রাসায়ানিক ধর্মের কারণে এতে সঞ্চিত দূষকের পরিমাণ উপরিভাগের পানির তুলনায় শত সহস্র গুণ বেশি। খনন কাজের ফলে এই ঘনীভূত দূষিত পদার্থ পানিতে এবং আশেপাশের এলাকায় খাদ্য শৃ্ঙ্খলে চলে আসে। খাদ্যশৃঙ্খলের Bio-accumulation এবং Bio-concentration'র কারণে যা আরো অনেকগুণ প্রবর্ধিত হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এ কারণে উপকূলীয় অঞ্চল কিম্বা দূষিত কোন অঞ্চলে খনন কাজ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা হয়।)
পরিবেশগত সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্নঃ
এ প্রকল্পটির পরিবেশগত সমীক্ষা করার দায়িত্ব BPDB দেয় বাংলাদেশের সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে Center for Environmental and Geographic Information Services (CEGIS). নরওয়ে সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি সংস্থা Council of Ethics এ পরিবেশগত সমীক্ষাটি পর্যালোচনা করে কিছু গুরুতর বিষয়ে অপ্রতুলতা তুলে ধরেছে। যার মধ্যে রয়েছেঃ
• কয়লাবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হলে পরিস্থিতি কিভাবে সামলান হবে
• এ ধরনের দুর্ঘটনায় কোন কোন পক্ষের কি কি দায়িত্ব থাকবে
• ম্যানগ্রোভ বেল্টের মধ্যে দুর্ঘটনা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা; এবং
• ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা
কাউন্সিল তাদের পর্যালোচনায় আরো উল্লেখ করে যে, সাধারণত পরিবেশগত সমীক্ষা ডেভলপারের অর্থায়নে বাইরের পরামর্শদাতাদের দিয়ে করিয়ে থাকে। কর্তৃপক্ষ এই রিপোর্ট ব্যবহার করে ডেভলপারের উপর বিধি-নিষেধ কিম্বা শর্ত আরোপ করে। কিন্তু এই সমীক্ষাটা করা হয়েছে সরকারের অধীনের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে NTPC কিম্বা BIFPCL'র প্রভাব প্রশ্নসাপেক্ষ। কাউন্সিলের মতে, this lack of clarity undermines confidence in the assertion “that the EIA provides an objective, comprehensive analysis.” এছাড়া এই কাউন্সিল তাদের পর্যালেচনায় সুন্দরবনের পরিবেশগত সংবেদনশীল এলাকা থেকে এপ্রকল্পের ভৌগলিক দূরত্ব নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদিও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এরকম কোন শিল্প কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে গড়া যায় না। কিন্তু ভারতের আইন অনুযায়ী এ ধরনের কোন শিল্প অনুমোদন পায় না, কেননা সেখানে পরিবেশগত সংবেদনশীল বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধো এধরনের শিল্প নিষিদ্ধ। এ নিবন্ধে আইনের এ ফাঁকটি ব্যবহার করে শিল্পটির অনুমোদন পাওয়ার জন্য রামপালকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।
এই নিবন্ধে রামপাল প্রকল্পটির যে ১০ টি প্রধান দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলঃ
এ প্রকল্পের প্রকৃত খরচ তিনটি বড় ভর্তুকির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে যার মোট পরিমাণ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। এ ভর্তুকি আসছেঃ
নদী খননে ও নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণে ভর্তুকিঃ নদী খনন ও নাব্যতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে এ প্রকল্পের জীবনকালে প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে।
আয়কর রেয়াতঃ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ের উপর বাংলাদেশ কর বিভাগ ১৫ বছর কর রেয়াত দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পের জীবনকালে বাংলাদেশ ছাড় দিচ্ছে প্রায় ৯৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়াও Bharat Heavy Electricals Limited (BHEL) এবং BIFPCL মূল্য সংযোজন কর ছাড় পাবে। তবে এই মূল্য সংযোজন করের ছাড় এই হিসাবে গণনা করা হয়নি।
সুদ ছাড়ঃ ভারতের EXIM Bank এ প্রকল্পে সুদে ছাড় দিচ্ছে, যার পরিমাণ প্রায় ৯৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই প্রকল্প বাংলাদেশের বিদ্যুৎের দামের উপর উর্ধ্বমুখী চাপ ফেলবেঃ
এ তিনটি বড় ভর্তুকির পরেও এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাংলাদেশের গড় বিদ্যুৎের দামের থেকে ৩২% বেশী (ভর্তুকি বাদ দিলে প্রকৃতপক্ষে ৬২% বেশী)। এ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎের খরচ ভর্তুকি সহ ৭.৭৮ টাকা এবং ভর্তুকি বাদে ৯.৫ টাকা। এ বাড়তি দাম পোষাতে বাংলাদেশ সরকারকে হয় বিদ্যুৎের দাম বাড়াতে হবে নয়তো আরো ভর্তুকি দিয়ে সেই খরচ মেটাতে হবে। তবে এর যেটাই করা হোক না কেন তা অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
স্থানীয় প্রতিরোধঃ
এ প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং শুরু থেকেই স্থানীয় জনগণের জোরালো প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ ও পুর্নবাসন নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আক্রান্ত জমির মালিকদের অভিযোগ এ এলাকার প্রতি একর জমির দাম ৬ লাখ টাকা; কিন্তু সরকার তাদেরকে দিয়েছে এর অর্ধেকেরও কম, একর প্রতি ২.৭ লাখ টাকা। এছাড়া এ প্রকল্পটি থেকে দূষণের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি, এবং কৃষি ও মৎস্যজীবি মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কাও প্রতিরোধের অন্যতম কারণ।
বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতায় ব্যয় বৃদ্ধিঃ
বড় আকারের কয়লাচালিত বিদ্যুৎপ্রকল্প পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নে যেতে প্রায় এক দশক সময় লাগে। এপ্রকল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন কারণে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ইতিমধ্যে বেশ কয়েক দফা পিছিয়েছে যার ফলে এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ভার বেশ কয়েক দফা বেড়েছে। এই ব্যয়ভার যতই বাড়বে ততই এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎের খরচও বাড়তে থাকবে।
উচ্চাভিলাষী ৮০-৮৫% প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর (PLF):
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৮০-৮৫% প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টরে (PLF) চলবে বলে হিসাবে দেখানো হয়েছে। অথচ ২০১৫ সালে চীনের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুরির গড় PLF ছিল ৫০% ও নীচে; ২০১৩ সাল থেকে যেটা সব সময় ৬০% এর নীচে রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় PLF ৫৫% এবং ভারতে সাম্প্রতিক কালে এটা ৫৮%। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কিভাবে চলতিধারা অতিক্রম করে এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জন করবে তা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
আমদানিকৃত কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারদর পরিবর্তনের ঝুঁকিঃ
যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম গত কয়েক বছরে স্থিতিশীল রয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে এটা খুব বেশী তারতম্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তারপরও আমদানিকৃত জ্বালানী নির্ভর প্রকল্প সব সময় বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। কোন কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানী বাজারের অস্থিতিশীলতা, মুদ্রার দরপতন কিম্বা আন্তর্জাতিক কার্বন নীতির পরিবর্তনের কারণে আরোপিত করের কারণে এ দর পরিবর্তন হতে পারে। অপ্রত্যাশিতভাবে বাংলাদেশ তার দেশীয় উৎপাদিত কয়লায় নির্ভরশীলতা গড়ে তুলতে খুব বেশী আগ্রহ দেখায়নি।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রবণ এলাকায় প্রকল্পটির অবস্থানঃ
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একটি দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় স্থাপন করা হচ্ছে, যেখান থেকে আবকাঠামোগত ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির কারণে বড় ধরনের আর্থিক ও পরিবেশগত ক্ষতির অতি উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
জরুরী পরিস্থিতি ও দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য ও পরিকল্পনার অনুপস্থিতিঃ
এ প্রকল্পটি একটি দুর্যোগপূর্ণ, পরিবেশগত সংবেদনশীল এবং যোগাযোগে দুর্গম একটি এলাকায় স্থাপিত হলেও আপদকালীন এবং দুর্ঘটনার কারণে সৃষ্ট জরুরী পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সেটা কিভাবে সামলান হবে কিম্বা তার জন্য কার কি দায়িত্ব থাকবে তার কোন নির্দেশনা নেই।
ভারতের এক্সিম ব্যাংক অর্থনৈতিক ঝুঁকিঃ
এ প্রকল্পে অর্থায়ন করে ভারতের এক্সিম ব্যাংক অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়বে। রামপাল প্রকল্পটি এক্সিম ব্যাংকের মোট প্রদত্ত ঋণের একটা বড় অংশ দখল করে রাখবে। এর ফলে ব্যাংকটির আন্তর্জাতিক বাজারে থেকে তহবিল সংগ্রহের সামর্থ্য বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাছাড়া কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পগুলিতে সব সময় পুনঃ বিনিয়োগের ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার লোকসান আরও বাড়বেঃ
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা প্র্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান দেয়। রামপাল প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎের অতিরিক্ত খরচ সামাল দিতে এটি আরো নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়বে। এই বাড়তি খরচের বোঝা বাংলাদেশ সরকারকে আরো বড় বাজেট ঘাটতির মধ্যে ফেলবে এবং ভোক্তার উপর আরো বেশী খরচের বোঝা চাপিয়ে দেবে।
রামপাল প্রকল্পটি অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অগ্রহণযোগ্য মাত্রার উচ্চ ঝুঁকিতে পূর্ণ। বাংলাদেশের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানের (PSMP) ৫ টি প্রধান লক্ষ্যের ৩ টির সাথে এ প্রকল্পটি সাংঘর্ষিক। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে কয়েক হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হবে এবং তার সাথে যে আনুষাঙ্গিক ঝুঁকি জড়িত তাতে গ্রহণযোগ্য খরচে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে না। আর আর্থিক লোকসানের ঝুঁকির সাথে বাস্তবায়নের সময়কার মূল্যস্ফীতি যোগ করলে বলা যায় এ প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের PSMP'র লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশের উচিৎ হবে আমদানিকৃত কয়লা নির্ভর শিল্প না গড়ে বরং ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল সৌরশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। সকল ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক লোকসান বিবেচনা করে রামপাল প্রকল্পটি বাতিল করা উচিৎ।
_________________________________________________
সৈকত
মন্তব্য
লেখাটা আরও কয়েকটি সোর্স ব্যবহার করে হলে ভালো হতো
লেখার শিরোনাম এবং লেখার কিছু অংশ পড়ে মনে হতে পারে ভর্তুকি একটা খারাপ জিনিস। আসলেই কি তাই? শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনে ভর্তুকি এগুলো টিকে থাকতে সাহায্য করে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এ পোস্টের শুরুতেই যেমনটা বলা হয়েছে এটি একটি নিবন্ধের অনুবাদ, তাই বাড়তি সূত্র ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, কারণ সেটা বাহুল্য হতো। আগ্রহীরা বিশদ তথ্য, উপাত্ত ও সূত্রের জন্য মূল নিবন্ধটা দেখতে পারেন। আশি এখানে শুধুমাত্র আমার নিজের ব্যক্তিগত কয়েকটা টিকায় সূত্র উল্লেখ করেছি।
ভর্তুকি ভালো না খারাপ সেটা খুব বিশদ আলোচনা - সব ভর্তুকি যেমন ভালো না, তেমনি সব ভর্তুকি খারাপও না। তবে যে প্রকল্পটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তার পিছনের অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশের ব্যাপারটা পরিস্কার থাকা দরকার, আসলেই সেই দাবিটা যথাযথ কিনা।
রিপোর্টে চোখ বোলালাম, আগ্রহ জাগানিয়া লেখা। রিপোর্টের একাডেমিক ধাঁচ রামপাল বিষয়ক পরবর্তী আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুটি পয়েন্ট সম্পর্কে বলে যাই।
১. গবেষক মাত্রই উপাত্তের ব্যাখ্যা নিজের মত দিতে পারেন। এক্ষেত্রে গবেষকের মোটিভেশন বোঝাটা জরুরী। IEEFA সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে পারলে ভাল হত। তাদের নিজেদের ওয়েবসাইটের বাইরে এই সংগঠন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য নেই, এমনকি তাদের ওয়েবসাইটের সব রিপোর্টই ২০১৬ সালের।
২. কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমাধান হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ এর কথা বলা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে এটা কোন বাস্তবসম্মত সমাধান নয়। সৌরবিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের জন্য যেসব প্রোডাক্ট এই মুহূর্তে আছে সেগুলোর দক্ষতা অনেক অনেক কম। যেসব প্রযুক্তি প্রচলিত আছে সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা আরো অনেক কম। এই মুহূর্তে সৌরবিদ্যূৎ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এই প্রযুক্তিটি এখনো যথেষ্ট পরিপক্ক নয়। অনেকটা এন্ড্রয়েডের প্রথম দিকের মোবাইল ফোনের মত। সুতরাং এই প্রযুক্তিটি পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত একে বিকল্প ধরে নিয়ে অনেক টাকা বিনিয়োগ করা হবে অনেক বড় ভুল। যেহেতু এ বিষয়ক গবেষণায় আমাদের কোন বিনিয়োগ নেই, প্রযুক্তিটি পরিপক্ক হবার আগে আমাদের আসলে কিছু করার কোন মানে নেই। তাহলে যে বিদ্যূৎ দরকার সেটা উৎপাদন হবে কি দিয়ে? গ্যাসে সমস্যা, কয়লায় সমস্যা, তাহলে সমাধানটা কি?
মজার ব্যাপার হল একই সমাধান তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ কমিটির রামপাল নিয়ে প্রকাশ করা বুকলেটেও দেয়া হয়েছিল। আগ বাড়িয়ে সেই বুকলেটে বলা হয়েছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানী থেকে নাকি ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এই ঘাটতি মেটানো হবে। শেহাব ভাই বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও বামপন্থী এক্টিভিস্টরা সেই বিশেষজ্ঞদের নাম প্রকাশ করেনি। করলে তাদের ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করতাম এই ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কোন জাদুবলে উৎপাদন করা হবে।
"ভালো জায়গায় বসতে পারাতে দুটো সুখ। একটা ভালো জায়গা পেয়েছে বলে এবং দ্বিতীয়টা তার চেয়েও বড়। বেশ আরাম করে বসে চীনে-বাদাম খেতে খেতে অলস নিরাসক্ত ভাবে তাকিয়ে দেখতে, অন্যেরা ফ্যা-ফ্যা করে কি ভাবে ভালো জায়গার সন্ধানে ঘুরে মরছে। পরিচিত এবং অপ্রিয় লোক হলে তো কথাই নেই। 'এই যে, ভড় মশাই জায়গা পাচ্ছেন না বুঝি?' বলে ফিক করে একটুখানি সদুপদেশ বিতরণ করবে 'কেন, ঐ দিকে তো মেলা জায়গা রয়েছে', বলে হাতখানা মাথার উপর তুলে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে দেবে। তার থেকে কেউই বুঝতে পারবে না, কোন দিকে জায়গা খালি ।"
-জলে ডাঙ্গায়, সৈয়দ মুজতবা আলী
এই সৌরবিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য জ্বালানী থেকে ১০হাজার মেগাওয়াটের মশকরাটা আসলে মুজতবা আলীর থেকেই এসেছে।
বাংলাদেশ সরকার আগামী ২০২১ সালের ভিতর ১.৭ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে জাতীয় বিতরণ ব্যবস্থায় যোগ করার পরিকল্পনা করেছে যেটা ২০৩০ সালের ভিতর বাড়িয়ে ৬ গিগাওয়াট করার পরিকল্পনা আছে। কোথা থেকে কিভাবে এ বিদ্যুৎ আসবে তার বিস্তারিত বিবরণ সরকার আপনাকে দিতে পারবে। তবে অন্যরা এর ভিতরে নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে কে কি অর্জন করেছে তার কিছু খবর আপনাকে দিয়ে যাইঃ
পর্তুগাল এ বছরের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে উৎপাদিত বিদ্যুৎের ৯৫% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করে, যার পরিমাণ ৪১৩৯ গিগাওয়াটঘন্টা। এ বছরের মে মাসে টানা ৪ দিন তারা শুধুমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়েই তাদের যাবতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
https://en.wikipedia.org/wiki/Renewable_energy_in_Portugal
অন্যদিকে একটি উন্নয়নশীল দেশ গত বছরের ২৮৫ দিন নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে তাদের সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সংবাদের শিরোনাম হয়। দেশটি হল কোস্টারিকা। দেশটির বর্তমান ৯৯% বিদ্যুৎের জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সংগৃহীত হয়।
http://www.huffingtonpost.com/entry/costa-rica-renewable-energy-climate_us_56798c79e4b014efe0d6f524
ফিলিপাইনের সরকার আগামী ২০৩০ সালের ভিতর তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎের ৫০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছে। ২০১৩ সালে তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎের ২৬.৪৪% ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করা যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০০০ গিগাওয়াটঘন্টা।
https://en.wikipedia.org/wiki/Renewable_energy_in_the_Philippines
আমাদের বাড়ির কাছের ভূটানের প্রায় সকল বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করা। তবে সেটি তাদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব না। তারা হল পৃথিবীর প্রথম 'কার্বন নেগেটিভ' দেশ - অর্থাৎ তারা যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে, তার থেকে বেশী সংগ্রহ (sequester) করে।
https://www.ted.com/talks/tshering_tobgay_this_country_isn_t_just_carbon_neutral_it_s_carbon_negative?language=en
তিউনিসিয়া থেকে আগামী ২০১৮ সালে ২ গিগাওয়াট শুধুমাত্র সৌরশক্তি থেকে সংগৃহীত বিদ্যুৎ যুক্তরাজ্যে রপ্তানীর একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাজ্যের ২৫ লক্ষ বাড়ির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
http://www.bbc.com/news/science-environment-29551063
কানাডার সবচেয়ে জনবহুল অঙ্গরাজ্য অন্টারিওর ৯০% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া। ১০% জীবাশ্ম জ্বালানিও কিন্তু কয়লামুক্ত।
কোস্টারিকার জনসংখ্যা সাতচল্লিশ লক্ষ, বাংলাদেশের প্রায় সতেরো কোটি। ভূটানের জনসংখ্যা সাড়ে সাত লক্ষ (যেটা মোহাম্মদপুর বা মিরপুরের জনসংখ্যার সাথে তুলনীয়)। কোস্টারিকা নবায়নযোগ্য শক্তির একটা বড় অংশ আর ভূটানের প্রায় পুরোটা আসে জলবিদ্যুৎ থেকে, যেটার সুযোগ বাংলাদেশে খুবই সীমিত।
ওন্টারিওর যে তথ্য দিলেন, সেটা ভুল। একটু কষ্ট করে তথ্যগুলো দেখে নিন [সূত্র]। আপনার এবং পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্যে পাইচিত্র জুড়ে দিলাম।
ওন্টারিওর মতো ৩৫% বিদ্যুৎ নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যোগানোর উদ্যোগ নিলে এই আপনিই ফুকুশিমার লিঙ্ক দিয়ে বলবেন নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কতো ঝুঁকিপূর্ণ। ওন্টারিওর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে তাই তারা কয়লায় যায় না, যেভাবে এতোদিন আমরা যাই নি। কষ্ট করে কানাডার আরেক প্রদেশ আলবার্টার তথ্যগুলোও দেখে নিলে দেখবেন কী হারে তারা কয়লা ব্যবহার করে [সূত্র]।
দুনিয়ার প্রায় সব জায়গাতেই এখনও নবায়নযোগ্য শক্তি জীবাশ্ম জ্বালানির পরিপূরক হিসেবে, প্রতিস্থাপক হিসেবে নয়। বাংলাদেশে সীমিত বায়ুশক্তি এবং যথেষ্ট পরিমাণ সৌরশক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো সম্ভব, কিন্তু তার আপফ্রন্ট কস্ট জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় এখনও অনেক বেশি।
বাই দ্য ওয়ে, ঢাকাবাসীদের হাগা থেকেও কিন্তু প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এই হাগা থেকে ঠিকমতো মিথেন উৎপাদন করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ এবং সার একসাথে পাওয়া যেতো। হাগাবিদ্যুৎ নিয়েও সরকারকে চাপ দিতে হবে।
আমি মনে হচ্ছে আপনাকে আমার মন্তব্যটির উদ্দেশ্য বুঝাতে পারিনি। আমার মন্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ er ঘাটতিটিকে একটি প্রকৌশলগত সমস্যা হিসেবে দেখা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো আমলে না নিয়ে আপনি যদি চেরি পিক (cherry pick) করে তথ্য উপাত্ত দেখাতে থাকেন তাহলে এই বিতর্কের কোন শেষ হবে না। আমি আমার পয়েন্টগুলো আরেকটু ব্যাখ্যা করি।
প্রথমত আপনি সোলার সেলের দক্ষতা (efficiency) এবং নির্ভরযোগ্যতা (reliability) নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। ধরে নিচ্ছি আপনি একমত। তারপরেও সাধারণের সুবিধার্থে আরেকটু ব্যাখ্যা করি। এই মুহূর্তে সোলার সেলের দক্ষতা ৪০% এর আশেপাশে এবং সেটি মূলত গবেষণাগারে। যেসব পণ্য (product) এই মুহুর্তে বাজারে আছে সেগুলোর দক্ষতা আরো কম। বাজারে থাকলেও উপাদানর (material) কারণে সেগুলোর দাম অনেক। সেমিকন্ডাক্টরে যেমন সিলিকন অনেকদিন টিকে ছিল সেরকম একটি উপাদান (material) পেতে এবং সেটি গবেষণাগার হয়ে বাজারে আসতে অনেক দেরি। রেফারেন্স দিতে পারছি না তবে যতদূর মনে পরে এসব পণ্য দিয়ে কখনোই ব্রেক-ইভেন (break even) অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত টাকা পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব নয়। সোলার কোম্পানীগুলো গবেষণায় প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করছে এবং সেই টাকা তুলে আনার জন্য আধা-খেচড়া পণ্য বিক্রী করে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের প্রসঙ্গে আসি। আমাদের দেশে সরকারিভাবে অনেক জায়গা নিয়ে কোন কিছু করা প্রায় অসম্ভব। সরকার যেটা করছে সেটা হচ্ছে প্রণোদনা দিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানীগুলোকে দিয়ে সোলার সেল বিক্রি করছে, সেটিও সাধারণ মানুষের কাছে। এখন ধরুন একটি কোম্পানী x% দক্ষতার এবং p বছর চলবে এমন সোলার সেল বিক্রি করে এবং আপনি অনেক টাকা বিনিয়োগ করে সেটি কিনলেন। এখন আগামী বছর যদি আরেকটি কোম্পানী x+১০% দক্ষতার এবং p+৫ বছর চলবে এমন একটি পণ্য আনে, তখন কি আগের বিনিয়োগটি অর্থহীন হয়ে গেল না? অন্তত প্রযুক্তিটি পরিণত হবার আগে বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করা অনেক বড় ভুল।
দ্বিতীয়ত এখন আসি আপনার মন্তব্যের ব্যাপারে। আলোচনাটা হবে বাংলাদেশকে মাথায় নিয়ে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর মাঝে সবচাইতে বড় উৎস তিনটিঃ পানি বিদ্যূৎ, বায়ুকল আর সোলার সেল। পানি বিদ্যূৎ দিয়ে বিদ্যূৎ উৎপাদনের মত আর কোন উৎস আমাদের নেই। আর বায়ুকল চালাবার মত বাতাসের বেগ আছে এমন জায়গা যতদূর জানি বাংলাদেশে খুবই কম। সেখান থেকে বড় অংকের বিদ্যূৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। এরপরে রইল সোলার সেল। সরকারিভাবে বড় আকারের উদ্যোগ নিতে অনেক জায়গার প্রয়োজন যেটি আমাদের নেই। আপনাকে মাথায় রাখতে হবে সীমিত জমিতে ১৮কোটিরও বেশি মানুষ নিয়ে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সেটি অনেক প্রচেষ্টার পরে। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি সেটিকে বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ চান? যতদূর দেখেছি সরকারের চিন্তা হচ্ছে বাসার ছাদগুলোকে সোলার সেলের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা। আসুন দেখা যাক সেখানে কি কি সমস্যা রয়েছে।
সোলার সেলের দক্ষতা নির্ভর করে বেশ কিছু ফ্যাক্টরের (factor) উপর। যেমন ধরুন সোলার সেলের সূর্যের সাথে কোণ, সেলটি কতটুকু পরিষ্কার, আলোর তীব্রতা প্রভৃতি। বিষুব রেখার কাছাকাছি বলে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পায়, তারপরেও বছরের সময়ের উপর ভিত্তি করে সেলের দক্ষতার পরিমাণ বেশ উঠানামা করে। সূর্যের সাথে অপটিমাম (optimum) কোণে রাখতে সেন্সর ব্যবহার করা যায় যেটি খরচ বাড়াবে বই কমাবে না। এরপরে আছে পরিষ্কারের ব্যাপারটি। সেলের দক্ষতা ধুলিকণার উপর ভিত্তি করে অনেকটাই কমে যেতে পারে। যেহেতু সেলগুলো ব্যক্তি মালিকানা সেগুলো কত নিয়মিত পরিষ্কার করা হবে সেটির কোন নিশ্চয়তা নেই। আর আলোর তীব্রতার ব্যাপারটি বুঝতে বর্ষাকাল আর শীতকাল এই দুই সময়ের কথা চিন্তা করুন। এখন আপনি চিন্তা করে বলুন তো আপনার কাছে বাংলাদেশের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানী বিকল্প বলে মনে হচ্ছে কি না?
উপরের সবগুলো সমস্যাই প্রকৌশলগত সমস্যা এবং সেগুলোর সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু কথা হচ্ছে এ নিয়ে গবেষণায় আমাদের কোন উদ্যোগ নেই, তাই অন্য কেউ এগুলোর সমাধান বের না করা পর্যন্ত আমাদের কি এখানে চোখ বন্ধ করে বিনিয়োগ করা উচিৎ? ভেবে দেখুন।
শেষে আসি পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের ব্যাপারে। সমসাময়িক ইস্যু সম্পর্কে ধারণা থাকলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন চীনের কার্বন নিঃসরণ নিয়ে আমেরিকা খুবই উদ্বিগ্ন। শুধু তাই নয় আমেরিকা নানাভাবে চীনকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এখানে ট্রিভিয়া হচ্ছে আপনি কি জানেন আমেরিকাতে জনপ্রতি (per capita) কার্বন নিঃসরণ চীনের প্রায় তিনগুণ? বছরপ্রতি সর্বমোট নিঃসরণে চীন আমেরিকার চাইতে বেশি কিন্তু গত ৩০ বছরের যোগফলে আমেরিকার কার্বন নিঃসরণ চীনের চাইতে বেশি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আমেরিকার সরকার নিজেদের জন্য বড় কোন উদ্যোগ নিচ্ছে বলে আমার চোখে পড়েনি। আমি যেটা বুঝাতে চাইছি সেটা হল নিজের ভাল সবাই বোঝে। ব্যক্তিগতভাবে কোন উদ্যোগ যদি সরাসরি বাংলাদেশকে প্রভাবিত না করে, সেটি করতে আমার কোন সমস্যা নেই। কথাটি শুনতে স্বার্থপরের মত মনে হতে পারে কিন্তু এটাই সত্যি। আমি কার্বন নিঃসরণ কম করছি বলে কেউ আমাকে বিনামূল্যে কিছু দেবে না। উন্নতি করতে হলে পরিবেশকে প্রভাবিত করেই করতে হবে। সম্ভব হলে যত কম করা সম্ভব। এখন আপনি সিদ্বান্ত নিন আপনি বামপন্থীদের দেয়া নবায়নযোগ্য জ্বালানীর মোয়া খাবেন নাকি বাস্তবসম্মত কোন সমাধান নিয়ে এগুবেন।
বায়ু বিদ্যুত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুত উতপাদনের পরিমাণ সর্বোচ্চ বাতসরিক গড় ৫০০ মেগাওয়াট, সার্ভে মতে। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সার্ভেমতে সোলার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ পরিমাণ ৬,০০০ মেগাওয়াট। সুতরাং ১০ বছর পরেও যে বিদ্যুত চাহিদা থাকবে তার ক্ষুদ্র একটা অংশই শুধু সোলার দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে। বাকিটা কয়লা, গ্যাস, নিউক্লিয়ার দিয়েই পূরণ করতে হবে। বাই দা ওয়ে, সোলারের লোড ফ্যাক্টর এরাউন্ড ৩০% হতে পারে। এবং রাতের বেলা কোন সোলার প্রোডাকশন থাকবে না, তখন পুরো বিদ্যুত চাহিদার পুরোটাই মেটাতে হবে প্রথাগত জ্বালানি দিয়ে। তাই দৈনিক এই বিশাল কয়েক হাজার মেগাওয়াটের ফ্লাকচুয়েশন ব্যবহার করতে বিশেষায়িত মাস্টারপ্ল্যান লাগবে এবং সম্ভবত, বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনেও বড় ধরনের বিনিয়োগ লাগবে।
অন্টারিওর বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে আমার দেওয়া তথ্যটা ভুল না। 'স্থাপিত ক্ষমতা' আর 'উৎপাদন করা' এ দুটোর মাঝে ফারাক আছে। আপনি কোন একটি কাজ করার সক্ষমতা রাখেন, আর আপনি কাজটা করেছেন এ দুটো জিনিস নিশ্চয় এক না (এ প্রসঙ্গে একটা বহুল প্রচলিত কৌতুকের কথা মনে পড়ে গেল, খুব সম্ভবত আপনিও কৌতুকটা জানেন)। ২০১৫ সালে অন্টারিওর মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎের ১০% জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে এসেছিল। সূত্রটা দেখে নিবেনঃ
http://www.ieso.ca/Pages/Power-Data/Supply.aspx
"ওন্টারিওর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে তাই তারা কয়লায় যায় না, যেভাবে এতোদিন আমরা যাই নি।"
বরং আপনার দেওয়া এই তথ্যটা ভুল। অন্টারিওর গ্যাসের চাহিদার একটা বড় অংশ মেটানো হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা গ্যাসে, যে কারণে কানাডা পৃথিবীর শীর্ষ ২০ টি গ্যাস আমদানিকারক দেশের একটি।
http://www.indexmundi.com/g/r.aspx?v=139&t=20
বরং ২০০৮ সালে অন্টারিওর উৎপাদিত বিদ্যুৎের ১৪.৫% আসত কয়লা থেকে। কয়লা থেকে দূষণের জন্য যেটাকে তারা ধাপে ধাপে কমিয়ে ২০১৩ সালে বিলুপ্ত করেছে। (এখানে দেওয়া প্রথম সূত্রটা দেখে নিবেন)
দূষণ এবং নির্গমন বিবেচনা করলে যে কোন জীবাশ্ম জ্বালানীর থেকে আণবিক শক্তি অনেক স্বচ্ছ। আণবিক শক্তির প্রধান ঝুঁকি হল এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আণবিক শক্তির ঝুঁকি হিসাবে সবসময় ফুকুশিমাকে টেনে আনা প্রাসঙ্গিক না। ফুকুশিমার প্রাকৃতিক দুর্যোগটি একটি অতি বিরল মহাপ্রলয়। আপনি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট মহাপ্লাবনেও টলবে না এমন সহনশীল কোন প্রকল্প দাঁড় করাতে পারবেন না। কিন্তু যেটা করতে পারেন সেটা হল দুর্যোগপূর্ণ এবং সংবেদনশীল এলাকা এড়িয়ে প্রকল্পটি নিরাপদ জায়গায় স্থাপন করা এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবলম্বন করা।
এখানে বাংলাদেশের প্রক্ষিতে বিকল্প জ্বালানির সম্ভাবনা ও বাস্তবতা আলোচনা করা উদ্দেশ্য ছিল না। সেটা করতে গেলে আলাদা বিশদ পোস্ট দিতে হবে। এ পোস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল রামপাল প্রকল্পের অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ঝুঁকিগুলো তুলে ধরা। তবে কিছু কিছু পাঠক নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে যেভাবে মুজতবা আলী দেখিয়ে গেলেন তাদেরকে বিকল্প জ্বলানির বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থান জানানোর জন্য আমার আগের মন্তব্যটা করা।
বিকল্প জ্বালানি অনেকভাবেই আসতে পারে। আপনি যেমন বললেন, বায়োগ্যাস থেকে আসতে পারে আবর্জনা পুড়িয়ে ওয়েস্ট বায়োম্যাস থেকে আসতে পারে। আরো অনেকভাবেই আসতে পারে... এবং আমার মনে হয় না কেউ দাবি করবে আমাদের সকল জীবাশ্ম জ্বালানী নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে কিম্বা আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমাদের সকল বিদ্যুৎ বিকল্প জ্বালানী থেকে সংগ্রহ করতে হবে। তবে আমরা যদি এ মূহুর্ত থেকে সক্ষমতা অর্জনের উপর জোর না দিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে অসম্ভবের খাতায় ফেলে দেই তাহলে কখনোই সক্ষমতা অর্জন করতে পারব না; যেমনটা পারিনি খনিজ অনুসন্ধানে কিম্বা বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মানে। নইলে এই মেগাবাজেটের প্রকল্পগুলো ঋণের বোঝা না হয়ে আমাদের কর্মসংস্থানের মূল উৎস হয়ে উঠতে পারত।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, যারা সব সময় তাদের সীমাবদ্ধতাটাকে বড় করে দেখে তারা সব সময় পিছিয়ে থাকে; আর যারা তাদের সামর্থ্যের সদ্বব্যবহার করে তারা সফল হয়; আর যারা উদ্বাবন ও সৃষ্টিশীলতায় দক্ষতা অর্জন করে তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়। আমার মনে হয় এটা বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য...
ফুকুশিমার ঘটনা যে বিরল, সেটা যদি স্বীকার করেন, তাহলে নিশ্চয়ই এটাও মানবেন যে আপনার এই অনুবাদ পোস্টে বিশদভাবে রামপাল এলাকায় যে ৫.৫ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এসে সব ছাই ভাসিয়ে একাকার করার কথা লেখা আছে, সেটিও সম্ভাব্য-কিন্তু-বিরল মহাপ্রলয়েরই উদাহরণ। এই উদাহরণগুলো সামনে টানলে মংলা বন্দর আর চট্টগ্রাম বন্দর দুটোকেই বন্ধ করে দিতে হয়।
"ওন্টারিওর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে" বলেছি, "ওন্টারিওর মাটির নিচে প্রাকৃতিক গ্যাস আছে" সেটা তো বলি নি। পোড়ানোর মতো গ্যাস তাদের নাগালে যথেষ্ট আছে বলেই তাদের জীবাশ্মজ্বালানি অবকাঠামো এখন গ্যাস-হেভি, যেমনটা আমাদের এখন। নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের যথেষ্ট সরবরাহ আছে বলে তারা গ্যাস প্ল্যান্টগুলোকে সম্ভবত পিকিং প্ল্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করে, সে কারণে বিদ্যুতের এনার্জি মিক্সে আপনি ১০% পাচ্ছেন। এটা তখনই সম্ভব হয়, যখন চাহিদার অতিরিক্ত স্থাপিত ক্ষমতা থাকে। বাংলাদেশে কি এই সিনারিও প্রযোজ্য?
আলবার্টার তথ্যগুলো এড়িয়ে গেলেন কিন্তু। কয়লা আছে বলে?
আপনার পোস্টে আপনি ক্যাপিটাল ড্রেজিংকে উপকূলীয় এলাকায় "খনন" হিসেবে দেখাচ্ছেন। মংলা বন্দরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং হয় নি এতকাল? সেই পলি কোথায় রাখা হয়ে আসছে, বা সেগুলো থেকে কী পরিমাণ দূষণ ছড়িয়েছে?
আপনি বিকল্প জ্বালানি নিয়ে বিশদ আরেকটা পোস্ট লিখুন সময় নিয়ে।
আপনার যুক্তিমতে চলতে চাইলে, মংলা বন্দরের উন্নয়নের কাজ বন্ধ করে দেয়া উচিত। একটা চীনা কোম্পানির সাথে মংলা বন্দরের উন্নয়নের চুক্তি হয়েছে। ২০২১ সালে মংলার জাহাজ সক্ষমতা প্রতি বছরে ১০০০ এ উন্নিত করার লক্ষ্য আছে। এছাড়া পদ্মা সেতুর পুরোদমে চালু হওয়ার প্রভাবে যখন খুলনা, যশোর এলাকাতে শিল্পকারখানা বেড়ে যাবে, তখন সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জাহাজ চলাচল কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। মংলা বন্দর বন্ধ করে দেয়া একটা যৌক্তিক সমাধান।
আর নয়ায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ, প্রণোদনা বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই সরকারকে চাপ দেয়া উচিত। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির যে বর্তমান মূল্য পড়ে, তা বিদ্যুতের গড় দামে আপওয়ার্ড পুশ দিবে।
এই রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে, রামপালের বিদ্যুতের দাম পড়বে সাড়ে ৮টাকা/ইউনিট। যেখানে সোলার সেলের বর্তমান মূল্য পড়ে ১০ টাকা/ইউনিট। এবং এই রিপোর্টটি মূলত ভারতের সোলার সেল কোম্পানিগুলোর বিপণনের একটা বিজ্ঞাপন হিসেবেই পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ, তাদের গবেষণা অসংলগ্ন এবং ভারতে বিদ্যুতের সোলারের মূল্য হ্রাসের একটি উদাহরণ দেয়া হয়েছে। যেটি বাংলাদেশে সম্ভব করতে গেলে, দেশেই সোলার সেল নির্মাণের সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানি করা সোলার প্যানেল দিয়ে কখনোই স্বল্প খরচে সোলার বিদ্যুত উতপাদন সম্ভব নয়।
সৈকত সাহেব, আপনার এই অনুবাদ ফিচারের নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় নিয়ে কিছু বলার আছে-
১। এ প্রকল্পের প্রকৃত খরচ তিনটি বড় ভর্তুকির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে যার মোট পরিমাণ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
নদী খননে ও নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণে ভর্তুকিঃ
আয়কর রেয়াতঃ
সুদ ছাড়ঃ ভারতের
* নদী খননঃ যতদূর জানি, আপনিও নিশ্চয়ই জানেন যে, মংলা বন্দরকে সচল রাখার জন্য পশুর নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করা অতি আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারকে এ প্রকল্পের জীবনকালে যে প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে বলেছেন, তা কি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য, নাকি মংলা বন্দর সচল রাখার জন্য?
* আয়কর রেয়াতঃ আপনি বলেছেন- "এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ের উপর বাংলাদেশ কর বিভাগ ১৫ বছর কর রেয়াত দিচ্ছে"। সরকার কি শুধুমাত্র এই বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্যই ১৫ বছরের কর রেয়াত দিচ্ছে, নাকি অন্যান্য বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্যও এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে? একটু খোঁজ নিয়ে বলবেন? যদি শুধুমাত্র এই বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্যই কর রেয়াত দিয়ে থাকে, তবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ, কিন্তু যদি অন্যান্য বিদ্যুতকেন্দ্রও এ সুবিধার আওতায় থাকে তাহলে?
* এক্সিম ব্যাংক তথা ভারত সরকার এই প্রকল্পে কম সুদে ঋণ দিলে IEEFA এর সমস্যা কোথায়? আপনারই বা সমস্যা কি?
২। স্থানীয় প্রতিরোধঃ স্থানীয় প্রতিরোধ বলতে কি তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, বিভিন্ন বাম দলের বিরোধিতা বুঝায়? নাকি রামপালে বসবারত জনগনের প্রতিরোধ বুঝায়? IEEFA তাদের প্রতিবেদনে অবশ্য বাম দল, বিভিন্ন রক্ষা কমিটি, ইত্যাদি গ্রুপের মিছিলের ছবি সূত্র হিসেবে দিয়েছে। রামপালের স্থানীয় জনগনের তেমন কোন বিরোধীতার কথা আমার জানা নেই, আপনার আছে কি?
৩। বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতায় ব্যয় বৃদ্ধিঃ হ্যাঁ, প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতায় ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে, তবে এটা শুধু রামপালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সকল প্রকল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
৪। উচ্চাভিলাষী ৮০-৮৫% প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর(PLF): IEEFA এর প্রতিবেদনে দেখলাম ওরা ৮০% মেনে নিয়েছে।
৫। আমদানিকৃত কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারদর পরিবর্তনের ঝুঁকিঃ এই ঝুঁকি শুধু রামপাল প্রকল্পের জন্যই নয়, পৃথিবীর তাবৎ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই প্রযোজ্য, কি আর করা।
৬। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রবণ এলাকায় প্রকল্পটির অবস্থানঃ এই লাইন বরাবর শুধু রামপাল প্রকল্প নয়, আরও অনেকগুলি প্রকল্প বিদ্যমান, এবং আরও অনেক প্রকল্প পাইপলাইনে আছে। ঝুঁকি আছে, তবে তা এককভাবে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের জন নয়।
এ ছাড়া আপনি জানিয়েছেন- "এ তিনটি বড় ভর্তুকির পরেও এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাংলাদেশের গড় বিদ্যুৎের দামের থেকে ৩২% বেশী (ভর্তুকি বাদ দিলে প্রকৃতপক্ষে ৬২% বেশী)। এ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎের খরচ ভর্তুকি সহ ৭.৭৮ টাকা"। এ বিষয়ে IEEFA তেমন কোন সূত্র উল্লেখ করে নি, বাংলাদেশে এখন কোন প্লান্টের বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কত, এ বিষয়ে আপনার কোন লিঙ্কের খবর জানা থাকলে দেয়ার অনুরোধ করছি।
উন্নত দেশে প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর কম হওয়ার কারণ হচ্ছে, সেখানে (সাধারণত) বেইজ লোড কাভার করা হয় নিউক্লিয়ার আর (সাম্প্রতিককালে) অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তিচালিত প্ল্যান্টে, আর পিক লোড কাভার করা হয় জীবাশ্মজ্বালানিচালিত প্ল্যান্টে। ওন্টারিওর যে উদাহরণটা সৈকত দিলেন, সেটা দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশে তো বেইজ লোড কাভার করতে গিয়েই কম্বলের নিচ থেকে পা বের হয়ে যায়, সেখানে প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর তো বেশি হবেই। দেশে যেসব প্ল্যান্ট প্রাকৃতিক গ্যাসে চলে, সেগুলোর প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর কতো? ৪৫০ মেগাওয়াটের মেঘনাঘাট সিসিপিপির প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ২০০৭ সালে ছিলো ৮৮.২১% [সূত্র]। রামপালের পিএলএফ ৮০% হলে জয় শারদার ভুরু এতো উঁচুতে ওঠার তো কোনো কারণ দেখছি না।
কোল বেসড প্লান্ট লোড ফ্যাক্টর এর অনেক গুলো উদাহরণ আছে এই লিঙ্ক-এ। কোথাও সর্বোচ্চ ভ্যালু দেখলাম ৬৩.৮%। বাংলাদেশে সেটি ৮০% হবে এমন ভাবার কোন বাস্তব ভিত্তি আছে বল মনে হয় না।
https://en.wikipedia.org/wiki/Capacity_factor
একটু কষ্ট করে এখানে সপ্তম পাতায় জাপানের কয়লাচালিত বিদ্যুতের অবস্থাটা দেখেন [সূত্র]।
ভালো পোস্ট। মূল কথা হলো- দ্বিগুণ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার জন্য সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে, এমন কোনো প্রকল্প সমর্থন করা যায় না। যা হোক এ বিষয়ে জয় সারদার হাফিংটন পোস্টের একটা নিবন্ধের অনুবাদের লিংক দিলাম-
http://bonikbarta.com/news/2016-06-26/78903/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A7%8E-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%9A%E0%A7%9F/
স্বয়ম
অতার শ্রী রাম চন্দ্রের রামপালে কয়লা পোড়ানো হবেই। আপনি আমি ভগবানদের লীলা-খেলা ভঙ্গ করতে পারব না।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন