১।
মন্তাজ মাষ্টারের অন্তিম মুহুর্ত। মানুষটি সুস্থই ছিলেন। সারাজীবনে দুই একবার জ্বর, সর্দি, কাশি হয়েছিল। বছর চারেক আগে হটাৎই অসুস্থ্য হলেন। একটা মাইল্ড স্ট্রোক হল। এরপরে সুস্থ্য হয়ে মাস ছয়েক না যেতেই আবার অসুস্থ্য। এবার ধরা পড়ল ডায়াবেটিস। গ্রামের মানুষের মনটা খারাপ হল। বছর দুয়েক পরে একদিন মাথা ব্যথায় অস্থির অবস্থা। উচ্চ রক্তচাপ। গত বছর কিডনিতে সমস্যা হবার মাস ছয়েকের মধ্যে ডাক্তার বললেন খারাপ খবর। এরপরে আবার আরেকটা স্ট্রোক। মাস খানেক থেকে বিছানায়। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, এখন শুধু অপেক্ষা। রসুলপুরের একজন প্রানের মানুষ, একজন অদ্ভুত রকমের মানুষ আজ জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন, সবাই বুঝতে পারে। ৬৪ বছরের মন্তাজ মাষ্টার আজ চলে যাবার অপেক্ষায়।
বুধবার আছরের নামাজের পরে, শমসের চেয়ারম্যান তার বাড়ীতে এলাকার বিশিষ্ট কয়েকজন মানুষকে ডেকেছেন। বিষয় মন্তাজ মাষ্টারের চিকিৎসা, সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা। আর হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। তাই, কিছু হলে দাফন ও কুলখানি কিভাবে করলে সফল হবে ও মন্তাজ মাষ্টারকে মরনোত্তর সম্মান জানান সঠিকভাবে হবে? সেটিই আলোচনার বিষয়বস্তু। শমসের চেয়ারম্যান রাস্তার কোন কিনার দিয়ে হাঁটবেন? সেটিতেও তিনি লাভ খুঁজেন। সবাই সেটি জানে। কিন্তু কারণটি কেউই জানে না। আকাশের হাজার ঘুড়ির মধ্যে কোনটা যে কখন শমসের চেয়ারম্যানের লাটাইয়ে বাঁধা থাকে? - সেটি কেউই বোঝে না। শমসের চেয়ারম্যান কিভাবে জানি প্রতিবার নির্বাচনে সহজে জিতে যায়। ভোটের আগে যদিও সবাই মনে করে হাড্ডাহ্ড্ডি লড়াই হবে। শমসের চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান হতে প্রথম পাঁচ বছরে অনেক খরচ করেছেন। পরের দশ বছরে সেটি তুলে, বিষয় সম্পত্তি আহামারি না হলেও মোটামুটি করেছেন।
শমসের মাষ্টার কিঞ্চিত চিন্তিত। দু:শ্চিন্তা নয়, মূলত আশ্চর্য্য হবার মত বিষয়। মন্তাজ মাষ্টার দীর্ঘদিন মাষ্টারি করেছেন স্কুলে। আরও অনেক শিক্ষক থাকলেও পাশ করে যাবার পরেও তার ছাত্ররা তাকে শুধু যে মনে রেখেছেন তাই নয়, মন থেকে শ্রদ্ধাও করেন। গতবার ঢাকায় একটা বাজেট বহুদিন ধরে আটকায় ছিল বিধায় তিনি মন্ত্রনালয়ে গেলেন। শুরুতে এডিশনাল সচিব সাহেব ব্যাসিক হওয়াতে শমসের সাহেবের দিকে একবারও না তাকিয়ে হটাত করে ফাইলে ডুবে গেলেন। একটু চিন্তা করে শমসের চেয়ারম্যানকে বললেন -
- এই রাস্তাটা কি রসুলপুর থেকে মোড়লগঞ্জ যাবার রাস্তা?
- জ্বী স্যার, জ্বী স্যার।
- মন্তাজ স্যার কেমন আছেন?
- স্যারের অবস্থা গত তিন বছরে বেশ খারাপ হয়েছে।
শমসের চেয়ারম্যান বিশদ বলবার পরে সচিব স্যারের মনটা খারাপ হল। তিনি পিওনকে ডেকে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে শমসের চেয়ারম্যানকে বললেন আধা ঘন্টা অপেক্ষা করতে।
আধা ঘন্টা পরে ডাক পড়ল। সচিব সাহেব একটি ছোট কার্টুন শমসের চেয়ারম্যানকে দিয়ে বললেন -
- মন্তাজ স্যারকে দিবেন। স্যারের নাম্বারটা দেন।
- স্যার তো ফোন ব্যবহার করেন না।
- আচ্ছা, তাহলে আপনি আমার সাথে একটু কথা বলে দেবার ব্যবস্থা করবেন।
- স্যার, আপনি কোন বছর স্কুলে পড়েছিলেন?
- আমি রসুলপুরে পড়াশুনা করিনি। ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছিলাম, বাবা টিএনও ছিলেন। আমি অংকে দূর্বল ছিলাম। তাই বাবা স্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সপ্তাহ তিনেক ছিলাম। স্যার যাদু করে অংক শেখালেন। অংক আমি ভয় পেতাম। সেই আমি মেট্রিকে অংকে লেটার পেলাম।
২।
শমসের চেয়ারম্যান আশ্চর্য্য হয়েছেন দেখে ও বুঝে যে, গত সপ্তাহ থেকে গ্রামে কিছু ঘটনা ঘটছে, যেটি তার চিন্তার বাইরে। গতকাল খবর এসেছে, স্থানীয় সরকারের এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আসছেন মন্তাজ মাষ্টারকে দেখতে আগামী শনিবার। কিছু একটা করতে তো হবে। এই জাতীয় মানুষের সম্মানে কি করা যায়? মূলত সেটিই প্রধান আলোচনা। তবে, সেটি না বলে, মন্তাজ মাষ্টারের জন্য কি করলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খুশী হবেন? সেটিই আলোচনা করতে হবে। চেযারম্যান বোঝে কখন কি করতে হয়? অবাক লাগে, এই চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পিতা এই থানায় শিক্ষা অফিসার থাকাকালীন, তিনি এক বৎসর ক্লাস সেভেনে পড়েছেন। এতবড় মানুষ চলে আসতেছেন মন্তাজ মাষ্টারকে দেখতে? অবাক ব্যপার!
এলাকার মসজিদটা বেশ বড়। জুম্মার নামাজেও লোকের সমস্যা হয় না। সেখানে গত জুম্মায় নাকি মসজিদের বাইরে শদুয়েক লোক নামাজ পড়েছে। কেউ কারণ না বললেও, সবাই বুঝতে পেরেছে, মন্তাজ মাষ্টারের আশু রোগ মুক্তি অথবা শান্তিতে মৃত্যুর জন্য। কোন কারণ ছাড়াই, পাঁচটি পাঠা বলি ও দুর্গাপুজার কাছাকাছি বাজেটের মত খরচে পুজো দেয়া হয়েছে মন্দিরে। হিন্দু ব্যবসায়ীরা কেউ চাঁদা দেয়নি। তাই প্রথমে গুজব মনে হলেও, যখন শোনা গেল যে, এলাকার নরসুন্দর অমূল্য, মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে বাহাত্তর টাকা পয়ত্রিশ পয়সার পুরোটাই পুজোতে দিয়েছে, তখন চেয়ারম্যানের বিশ্বাস হয়েছে। মুসলমানের জন্য গ্রামে হিন্দুদের পুজা? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
মন্তাজ মাষ্টার এই গ্রামের মানুষ নন। পাশের জেলার মানুষ ছিলেন মন্তাজ স্যার। স্যারের বাবা ভুমি অফিসে চাকরি করতেন ও একা থাকতেন। পরিবার দেশের বাড়ীতে থাকত। ৭১ এর ২৫ শে মার্চ পরিবার বেরাতে আসল। ঐ দিন রাতেই দেশে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। মন্তাজ মাষ্টারের পরিবার, দেশের বাড়ী যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন ২৮ তারিখে। ২৯ তারিখ ভোরে রওনা করতে হবে। রসুলপুরে দুজন মানুষ সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা তৈরী করে। একজন মন্তাজ স্যারের বাবা, অন্যজন শমসের চেয়ারম্যানের বাবা। এই দুজনের মধ্যে অল্পদিন হলেও অনেকটা বন্ধুত্বের মত সম্পর্ক হয়েছিল। ২৮ তারিখ বিকেলে মন্তাজ স্যারের বার বছর বয়সের ছোটভাই পতাকাটি নিয়ে বাসার বাইরে দুই হাতে ধরে কিছুক্ষণ উড়িয়েছিল, যেন ঘুড়ি ওড়াবার মত মজা পাচ্ছিল ছেলেটি, নতুন জায়গায় এসে। কিন্তু, কত বড় সর্বনাশের বীজ যে তখনই বপিত হয়েছিল, কেউই বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারল বার ঘন্টা যেতে না যেতে। ফজরের নামাজ পড়বার জন্য মন্তাজ স্যারের বাবা প্রস্তুতি গ্রহন করছিল। হটাৎ একটি গাড়ী আসবার আওয়াজ পাওয়া যায়। সেই আওয়াজ মন্তাজ স্যারদের কোয়ার্টারের কাছে থামে। সকাল বেলা গাড়ী আসবার কথা ছিল যাবার জন্য। কিন্তু এত তাড়াতাড়িই চলে আসল কেন? এই ভেবে মন্তাজ স্যারের বাবা নিজে থেকেই দরজা খোলেন। নক করতে হয়নি। রাজাকার দস্তগীর মন্তাজ স্যারের বাবাকে বলেন -
- যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আপনার সাথে আলাপ করতে হবে।
- এত ভোরে? পেছনে কে?
আশেপাশ থেকে কোয়ার্টারের মসজিদে নামাজ পড়তে দুই একজন বাসা থেকে বের হয়েছেন। তাই রাজাকার দস্তগীর অনেকটা শারীরিক বল প্রয়োগেই মন্তাজ স্যারের বাবাকে ঠেলে ভেতরে নিয়ে যায়, যাতে তাকে না দেখে। ইতোমধ্যে মন্তাজ স্যারের মা প্রথমে বের হন। রাজাকার দস্তগীরের পিছে পিছে বাসায় ঢোকা দুইজনের একজন মন্তাজ স্যারের বাবারে বেয়োনেট চার্জ করেন ও বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা মন্তাজ স্যারের মা চিৎকার করে এগিয়ে আসতে গিয়ে, চিৎকারের পরিবর্তে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। বারান্দা থেকে গুলিবিদ্ধ মন্তাজ স্যারের মা পড়ে যাবার পরে একটু এগিয়ে জীবনসঙ্গীর হাতটা ধরতে এগোবার চেষ্টা করেন। স্বামীর হাতটা ধরবার মত এই শেষ সুযোগটাও তিনি পান না। এক হাত দুরেই বেয়োনেট চার্জে তিনি প্রান হারান। এরপরে পাক মেজর বলে -
- হোয়্যারস দ্যা বয়?
এই বলে বাসার সবাইকে হত্যা করে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায় কলোনির পরের রোডেই থাকা মন্তাজ স্যারের বাবার অফিসেরই একাউন্টেন্টের বাসায়, সে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছে প্রথম রাতেই। মন্তাজ স্যারদের বাসা থেকে বেরোবার পরে সামনে অগ্রসর পাক মেজরকে একজন সোলজার জাক গিয়ে থামিয়ে, তার কোলে থাকা ছয়মাস বয়সের মন্তাজ স্যারের বোনটিকে দেখিয়ে বলে কি করবে? মেজর তার সোলজারের মানসিক দূর্বলতাকে গালি দিতে দিতেই কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে আবর্জনার মত ছুড়ে ফেলে পাশের বাঁশঝাড়ে। বাচ্চার কোন আওয়াজ পাওয়া যায় না। তার আধা ঘন্টা পরেই সুইপারদের নিয়ে আসে দস্তগীর। তখন ভোরের অলো ফুঁটতে শুরু করেছে। ময়লা আবর্জনা ফেলবার যে গাড়ী ছিল পৌরসভার, সেটিতে সব লাশ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজাকার দস্তগীর যদিও পরের দিকে সামনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাতে সহায়তা করেন, কিন্তু সেদিন তিনি আশে পাশের লোকদের বলতে থাকেন -
- সবই নিয়তি। মানুষগললোকে মারা পাক বাহিনীর ঠিক হয় নাই। এখন ভালভাবে দাফনটা করতে পারলেই হয়।
রাজাকার দাস্তগীরের নেতৃত্বে জনা পনের লোক সেই রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা রসুলপুরের প্রায় পঁচিশজনের লাশ রসুলপুর ঘেঁষে প্রবাহিত ঝুমকা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে লাশগুলি কোথায় গেল? কি হল? কেউ জানে না। মন্তাজ স্যারের বয়স তখন আঠার ছুইছুই। সে রাতে মন্তাজ স্যারের বেঁচে যাওয়াটাও একটি আশ্চর্য্যজনক ব্যপার। জনই দুইজন জানত, মন্তাজ মাষ্টারের বেঁচে যাবার খবর। একজন শমসের চেয়ারম্যানের মা। কিল্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে তিন কাউকেই বলেননি। আরেকজন হচ্ছে, শমসের চেয়ারম্যানের মা যাকে ভয়পেয়েছিলেন, রাজাকার দস্তগীর।
৩।
মন্তাজ মাষ্টার নামের একটি মানুষ যে রসুলপুরের কেউ হতে পারে, তা কিন্তু মানুষজন স্বাধীনতার পরে সেভাবে জানত না বা ভাবেনি। না ভাবাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। রসুলপুরের সাথে ঐ পরিবারের যোগসূত্র তো ছিল অস্থায়ী মন্তাজ মাষ্টারের বাবার চাকরি। ঐ পরিবার রসুলপুরে যেন জীবনটাই দিতে এসেছিল। মার্চের ২৫ তারিখ মন্তাজ মাষ্টারের বাবার কর্মস্থলে প্রথমবারের মত এসে, ২৯ তারিখ দিনটা শুরু হবার আগেই পরিবারটিকে জীবন দিতে হয়। মন্তাজ মাষ্টারের বাবার পরে মানুষজন চিনেছিল মন্তাজ মাষ্টারের ছোট ভাইটিকে, পতাকা ওড়াবার কারণে। শমসের চেয়ারম্যানের বাবা যেহেতু ছিলেন মন্তাজ মাষ্টারের বাবার বন্ধু, সেই সম্পর্কে চেয়ারম্যানের বাবা মা যাবার আগের দিন দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তারা শুনেন মন্তাজ মাষ্টার সেদিন বিকেলেই দেশের বাড়ীর উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। আর ঐ বাড়ীতে যে সেদিন একটি মানুষ কম ছিল, হত্যা করবার পরে লাশের লিষ্ট টালি করতে গিয়ে দেখে রাজাকার দস্তগীর। তবে, সেটির কোন গুরুত্বই ছিল না।
দেশ স্বাধীন হবার আটমাস পরের ঘটনা। একদিন মোটামুটি লম্বা গোছের একটি ছেলেকে রসুলপুর বাজারের মাঠের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন। বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসা দুই একজন মাঝি বলে -
- এই পোলাটাকেই তো গত দুদিন ধরে ঝুমকা নদীর পাড় ঘেষে হাঁটতে দেখা গেছে।
ছেলেটিরর শরীরে প্রচন্ড জ্বর। জ্ঞান ফেরার আগেই তাকে স্থানীয় দুই তিনজন হ্সপাতালে নিয়ে যায়। এর দুদিন পরে ছেলেটিকে সরকারী কোয়ার্টারের কেয়ারটেকার কোয়ার্টারের সামনে সারা রাত দাড়িয়ে থাকতে দেখে। এরপরে হাল্কা গুঞ্জন উঠলে শমসের চেয়ারম্যান তখন বাসায় প্রথম বলে -
- মা, কোয়ার্টারের সামনে একটা পাগল ছেলে সারারাত দাড়ায় ছিল। পোলাটা নাকি দুইদিন আগে নদীর পাড়ে দুইদিন হাইটা বাজারে আইসা অজ্ঞান হয়ে যায়।
শমসের চেয়ারম্যানের বয়স তখন তের মাত্র। তাকে সাথে নিয়ে তার মা কোয়ার্টারেক সামনে গিয়ে মন্তাজ মাষ্টারকে দেখে চিনতে পারে। এখান আসার পরে পরিবারটি চারদিন থাকলেও, একদিন তাদের শমসের চেয়ারম্যানের মা দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়। শমসের চেয়ারম্যানের মা একে একে জিজ্ঞেস করে -
- বাবা, কবে আসলা? বাসায় আসতে পারতা। তোমার শরীর খারাপ?
এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে চলে যায়। কারো সাথে কোন কথা বলেনি এখন পর্যন্ত ছেলেটি। সবাই বুঝতে পারে, সেই ভুমি অফিসে চাকরি করা, এই এলাকায় প্রথম পাকবাহিনীর হাতে খুন হওয়া পঁচিশজনের মধ্যে সেই অফিসারের পরিবারের কপালগুনে বেঁচে যাওয়া ছেলে। কিন্তু নামটি রেউ জানে না। সেদিন দুপুরের অগে ছেলেটিকে প্রথম কথা বলতে দেখা যায় পুরোহিতের ভাইয়ের সাথে। এরপরে পুরোহিতের ভাই ছেলেটিকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেদিন বিকেলে ছেলেটিকে বাস স্ট্যান্ডে দেখা যায়। এরপরে আর কেউ দেখতে পায় না।
মাস তিনেক পরে ছেলেটি আবার রসুলপুরে আসে। এবার ছেলেটিকে আগের চেয়ে অনেক ভাল মনে হয়। বেশভূষাতে যত্নের পরিচয়। লোকদের সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করে। শমসের চেয়ারম্যানের মায়ের সাথে দেখা করে। পুরোহিতের ভাই ও শমসের চেয়ারম্যানের মা, এই দুজনের সাথে তার কম হলেও কথা হত। তার চোখে ছিল দ্যুতি, গলায় যেন কথাকে ভারি করবার মেশিন ও প্রচন্ড ব্যাক্তিত্ব। স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন। এরপরে রসুলনগরে যখন জমি কিনে ঘর তুললেন, তখনই সবাই বুঝল মন্তাজ মাষ্টার জীবনটা এখানেই কাটাবেন। এখানেই তো উনি তার সর্বস্ব হারিয়েছেন।
রসুলনগর আগে ছিল নারায়নের হাট, মোঘলের হাট ও বাসুর হাট নামক তিনটি হাট। পূর্ব পাকিস্তান হবার পরপরেই গোলাম রসুল নামক এক মুসলিম লীগ নেতার নামে এই গ্রামের নামকরণ করা হয়। তার বড় ছেলে গোলাম দস্তগীর ও দস্তগীরের বড় ছেলে গোলাম শামস ছিল এই এলাকার নামকরা রাজাকার। তারা এখনও সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁচা দেয়। মনের ভিতরে এখনও ছিঁড়ে ফেলবার ইচ্ছে থাকলেও, মুখে মিষ্টি কথা বলে আজ। দেশের সব দায়িত্বের কাজগুলিকেই এদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়, যেন সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক তাঁরাই।
শমসের চেয়ারম্যানের পিতা ছিলেন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু শমসের চেয়ারম্যান কেমন জানি অর্থলোভী মানুষ হয়ে উঠেছেন। সবার কাছে এটিই আশ্চর্য্যের বিষয়। শমসের চেয়ারম্যানের এক ভাইও যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
রসুলনগরে আসার পরে মন্তাজ মাষ্টারকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে -
- যুদ্ধের সময় কই ছিলেন?
তিনি উত্তর দিতেন না। দুই একজন বলে -
- সেদিন রাতে মন্তাজ মাষ্টার কপালগুলে কোনভাবে বেঁচে যান। তারপরে দেশের বাড়ীতে গিয়ে অপ্রকৃতিস্থ হলে, তাকে সেখানেই গৃহবন্দী করে রাখা হয়। আবার অনেকে বলেন মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে এক পর্য্যায়ে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে পাগলের ন্যায় ঘুরে বেরোন। তবে, যে যাই বলুক, এটি ঠিক যে, বাপ মা ভাই বোন মারা যাবার পরে ওনার মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না। বেঁচে যে ছিলেন, সেটিই বেশী। মাথা ঠিক ছিল না।
এরপরেই মন্তাজ মাষ্টার রসুলনগরে থেকেও যেন হারিয়ে গেলেন। ওনার খবর পাওয়া যেত সব্জি বাজারের মানুষের কাছে। শুরুতে মাছ মাংস কম খেলেও পরবর্তীতে মন্তাজ মাষ্টার নিরামিষভোজী হন। তাই, তার খবর সব্জীর দোকানদাররাই জানত। এর মাঝে স্থানীয় কলেজে ডিগ্রীতে আর্টসে ভর্তি হলেন। তবে, শোনা গেল, তিনি ম্যাথ নিয়েছেন। এটিই ছিল একমাত্র বলার মত খবর। স্বাধীনতার পরে ভঙ্গুর দেশ গড়ার কাজ চলছে। কলেজে সেরকম ছাত্র ছাত্রী ছিল না। কদাচিৎ মন্তাজ মাষ্টার কলেজে গেলেও সেরকম কথাবার্তা হত না কারও সাথে। তার ঘর ছিল একটি। বারান্দায় রান্না বান্নার ব্যবস্থা। ঘর ভর্তি বই। দুই একজন ছাত্র শুধু তার বাসার বারান্দা অবধি গিয়েছিল। কেউই রুমে ঢুকেনি। তবে, বাইরে থেকে দেখেছে - অনেক বই। সারাদিন গল্পের বই, ইংরেজী বই, ইতিহ্সের বই ইত্যাদি পড়তেন। তিনি একদিনের জন্যও কোন কাজে সাহায্যকারী মানুষ রাখেননি। একবেলাও অন্য কাউকে তিনি রাঁধতে দেননি। নিজেই রাঁধতেন। তাই রসুলপুরের মানুষ তার সম্মন্ধে জানত খুবই কম। রসুলপুরে মন্তাজ মাষ্টারকে নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেল, যখন তিনি -
- এলাকার ডিগ্রী কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন।
এরপরে সবাই ভাবল যে, তিনি শহরে যাবেন মাষ্টার্স করতে, যেহেতু মেধাবী ছাত্র তিনি। কিন্তু তিনি গেলেন না। এমনকি দুই একবার নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তিনি শহরে যান নাই। দেশের বাড়ী দুই একবার গিয়েছেন, বিষয় সম্পত্তির ব্যপারে। তবে, এক পর্য্যায়ে সমস্ত সম্পত্তির হিসেব তিনি চুকে ফেলেন ও তারপর আর গ্রামের বাসায় যান নাই। সবাই বলে গিয়ে কি করবেন? মানুষ যায় জীবিত পিতা মাতার সাথে দেখা করতে অথবা তাদের গোর জেয়ারত করতে। পুরো রসুলপুর জুড়েই তো ওনার পরিবারের স্মৃতি, গোরস্থান।
ডিগ্রী পাশের বছরেই স্থানীয় হাই স্কুলে তিনি অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপরে শুরু হয় তার অংক নিয়ে গবেষনা, প্রতিটি অংকের সমাধান কাগজ কলমে নয়, ব্যবহারিকের মত বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বোঝান। সারাটা দিন তিনি এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। বিয়ে শাদি করেন নাই এবং করবেন না যে, তা সকলেই বুঝে গিয়েছিল।
৪।
মন্তাজ মাষ্টার কোনদিন কোন ছাত্রের গায়ে হাত তুলেননি, কিন্তু ছাত্ররা তার ভয়ে কাঁপত। তিনি কোনদিনই কোন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াননি। মন্তাজ মাষ্টারের অনেক গল্প এলাকায় প্রচলিত ছিল। মন্তাজ মাষ্টারকে নাকি একবার একজন অবিভাবক হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, ছেলের প্রস্রাব হচ্ছে না, তাই। মন্তাজ মাষ্টার হাসপাতালে ছেলেটির কাছে গিয়ে বললেন -
- কোন ক্লাসে পড়িস?
- স্যার সেভেনে।
- প্রস্রাবের বেগ কেমন?
- স্যার হবে মনে হচ্ছে।
- সামান্য প্রস্রাব করতে না পারলে গণিত পারবি কি করে?
- স্যার হয়ে গেছে।
দীর্ঘ দেড়দিন পরে ছেলের প্রস্রাব হল।
আবার অবাক করার বিষয় - মন্তাজ স্যারই ছিল সবার প্রিয় স্যার। শমসের চেয়ারম্যান তার কারণ বোঝেন না। কারও বাসা সেরকম যেতেন না। মাঝে মাঝে মন্দিরের পুরোহিতের ভাইয়ের বাসায় যেতেন। এছাড়া শমসের চেয়ারম্যানের বাসার সামনে হাঁটতে হাঁটতে এলে কি মনে করে জানি থামতেন। অবশ্য হাঁটা পথে তিনি প্রায়শই উদাস ভঙ্গিতে হাঁটতেন। অনেকখানেই থামতেন। মন্তাজ মাষ্টারকে এলাকায় অনেকেই বলত, তার চেয়ে ভাল গণিতে মাথা নাকি অত্র অঞ্চলের আশে পাশে আর কারও ছিল না। এমনকি দেশেও কারও আছে কিনা সন্দেহ। তিনি অংকের অর্ধেক ক্লাস নিতেন মাঠে এবং পুকুর পাড়ে। তার পেছন পেছন হাঁটত দপ্তরি শ্যামাপদ বেশ কিছু লাঠি কাপড় নিয়ে। কখনও মাঠে, কখনও পুকুর পাড়ে আবার কখনও ফলের বাগানে নিয়ে গিয়ে অংক বোঝাতেন। এই স্কুল থেকে প্রতিবার দেড়শ জনের মত পরীক্ষা দেয় মেট্রিক। ফেল যারা করে, কেউই এখন পর্যন্ত অংকে ফেল করে নাই। বেশীরভাগ ইংরেজীতে। পঞ্চাশজনের কাছাকাছি অংকে লেটার মার্কস পেত।
শমসের চেয়ারম্যান এলাকায় ১৫ বছর ধরে চেয়ারম্যান। পাশের জেলার একটা ছোকরা, বয়স তার ৩৬, পেশায় ডাক্তার, শুরু করেছেন জনসেবা। তবে, তিনি ইলেকশন করবেন না। ইলেকশন না করলে জনসেবা করে কি লাভ? শমসের চেয়ারম্যান বুঝেন না। ছেলেটা মাঝে মাঝে মন্তাজ মাষ্টারের কাছে যায়। মন্তাজ মাষ্টারের চিকিৎসা ছাড়াও এমনিতেই নাকি অনেক গল্প করে। উদ্দেশ্য কি? শমসের চেয়ারম্যান বোঝেন না। চার বছর আগে এই ডাক্তার সাহেবের মা মারা যান। এরপরে থেকে ডাক্তার এই গ্রামে জনসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। জনসেবা করলে করুক। তবে, ইলেকশন করলে শমসের চেয়ারম্যানের সাথে তো সে দুগ্ধপোষ্য শিশু।
শমসের চেয়ারম্যান নিজেও বোঝেন না, কেন তিনি মন্তাজ মাষ্টারকে ভয় পান? লোকটার কিছু আজিব কর্মকান্ড ছিল। এই লোকটি সবসময় খালি পায়েই হাঁটত বলা যায়। শুধু স্কুলে আসতেন স্যান্ডাল পায়ে। নামাজ পড়তেন না, কিন্তু নাস্তিক ছিলেন না। আবার উনি একমাত্র পুরোহিতের ভাইয়ের বাসাতেই যেতেন, তবে বছরে এক দুইবার। তিনি বাসা থেকে বের হয়ে ঝুমকা নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরোহিতের ভাইয়ের বাসায় যেতেন। এ ব্যপারে পুরোহিত ও তার ভাইকে জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি যে, কেন তিনি নদীর পাড় দিয়ে যেতেন? এটি কি হিন্দু ধর্মীয় কোন ব্যপার? তা নয়। অবশ্য তার এ জাতীয় পাগলামো আরও ছিল। তিনি সারাজীবন সোজা রাস্তায় স্কুল না যেয়ে, ঘুরে যেতেন আধা কিলো পথ। মানুষটা বড্ড আশ্চর্য্যের মানুষ।
৫।
শমসের চেয়ারম্যানের কাছে দুই একজন লোক এসেছে। তারা মিনমিন করে বললেন -
- স্বাধীন দেশে একজন মানুষের বাসা লোকজন ভেঙ্গে দিল, এটি কি করে হয়? দেশে কি আইন নাই।
- ব্যপারটা আমি দেখছি।
- শুনলাম, আসামীর নাকি জামিন হচ্ছে।
- আচ্ছা দেখি।
শমসের চেয়ারম্যান একটু অবাকই হয়। তারা কথা তো ভুল বলে নাই। কিন্তু, মিনমিন করে কেন? গলায় জোর নাই কেন? উত্তরটা শমসের চেয়ারম্যান জানেন। কিন্তু, চেয়ারম্যান হওয়াতে তাকে সবার বিচার গ্রাহ্যে নিতে হয়। কিন্তু, শমসের চেয়ারম্যানের একটু ধাক্কা লাগে জীবনে এই প্রথম, যখন লোকগুলো চলে যাবার পরে, তার বৃদ্ধা মা এসে তাকে বলেন -
- শমসের, তোর বয়স কম ছিল। তুই কি ভুইলা গেছস? তোর বড় ভাইটারে যখন পাকিস্তানীরা গুলি করে মারছিল এই বাসায়, তখন ঐ জানোয়ারটা পেছনে দাড়ায় ছিল। আমি ভাত রাইন্ধা রাখছি। পোলাটার পছন্দের বেগুন দিয়া পুটি মাছের সালুন রান্না কইরা রাখছি, পোলাটা খাইয়াও মরতে পারল না আল্লাহ!
এই বলে মেঝেতে বসেই শমসের চেয়ারম্যানের মা কাঁদতে লাগলেন। শমসের চেয়ারম্যান এসে মাকে ধরতে গেলে মা বলেন -
- শমসের, তুই আমারে ধরবি না। তুই পারিস নাই, কিন্তু অন্যায় হোক আর যাই হোক, জানোয়ারটার বাড়ী তো গ্রামের লোক ভাঙছে, আমি খুশী হইছি। আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পইড়া হ্যাগো জন্য দোয়া করছি। তুই যদি আমার পোলা হইস, পারলে যারা ভাঙছে তাদের সাহায্য করবার চেষ্টা করবি। না পারিস, তাগো কোন ক্ষতি যদি করিস, তাইলে তোরে মা হইয়া আমি বদ দোয়া দিমুরে শমসের।
শমসের চেয়ারম্যানের মা এই বলে কাঁদতেই থাকেন। মায়ের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সন্তান ও স্বামীর শোক বেড়েই চলছে। আগে এতটা ভেঙ্গে পড়তেন না, শমসের চেয়ারম্যান বোঝে। বাসার বাইরে এসে শমসের চেয়ারম্যানের মনটা একটু উদাস হয়। যেদিন এই ঘটনা ঘটে, সেদিন তিনি জেলা শহরে। গত রবিবারের ঘটনা। এলাকায় একটি বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে। নতুন ডাক্তার, তাকে নাকি মন্তাজ মাষ্টার বলেছে -
- স্বাধীন দেশে এত বড় একটা রাজাকারের বাড়ী! এখনও আছে?
মন্তাজ মাষ্টারকে স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে কেউ কখনই শোনেন নাই। হটাৎ করে বললেন, তাও আবার পাশের জেলার ডাক্তারকে, এই গ্রামের কাউকে নয়? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তারপরেও মন্তাজ মাষ্টার বলেছেন শুনে কোথা থেকে শ পাঁচেক লোক লাঠিশোটা নিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে এল রাজাকার দস্তগীরের বাসা। পুলিশ এসে ডাক্তার ও জনা দশেক ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। সবাইকে পরে ছাড়লেও পুলিশ ডাক্তারকে ছাড়ল না, জেরা করবার জন্য। শমসের চেয়ারম্যান খেয়াল করে, এই প্রথম এই ডাক্তার ছেলেটাকে তার কেন জানি খুব ভাল লাগল। যুদ্ধের সময় তার বয়স ১০। তার চোখের সামনেই ১৮ বছরের টগবগে তরুন, তার বড় ভাইকে পাক আর্মিরা গুলি করে মারল। পেছনে দাড়ান ছিল এই দস্তগীর শুয়োরের বাচ্চা। মন্তাজ মাষ্টার কেন তাকে এই কথাটা বললেন না? এটি ভেবে চেয়ারম্যানের খারাপ লাগে। নিজেকে নপুংসক মনে হয়। আজ মায়ের কথায় তার মনে হয়, কেন মন্তাজ মাষ্টার তাকে বলেন নাই। নিজের অজান্তেই কখন যে শমসের চেয়ারম্যান তার হাতে থাকা চাবির রিংটাকে চেপে বাঁকা করে ফেলেছেন, জানেন না। তার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে।
শমসের চেয়ারম্যান শনিবারের অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন ও তাদের সংবর্ধনা দেবার ব্যপারে প্রস্তুতি গ্রহন সম্পন্ন করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে শমসের চেয়ারম্যানের কাছে খবর এল, মন্তাজ মাষ্টার শুক্রবার সকালে তার সাথে দেখা করতে চান। শমসের চেয়ারম্যান আকাশ থেকে পড়লেন। এলাকার এত লোক থাকতে, মন্তাজ মাষ্টার কেন তাকে ডাকল? শমসের চেয়ারম্যানের মত চালাক চতুর মানুষ, সেটি বোঝা তো পরের ব্যপার, ধারনাও করতে পারলেন না। সারাটা রাত ঠিকমত ঘুমুতেও পারলেন না। শুক্রবার সকালে উঠে রওনা করলেন।
হাসপাতালের সবচেয়ে ভাল কেবিনটাতে মন্তাজ মাষ্টারেকে রাখতে বলা হয়েছে। শমসের চেয়ারম্যানের মনটা আবার খারাপ হয়। এই ভাল কেবিনে রাখার জন্য ঢাকা থেকে কেউ একজন ডিসি সাহেবকে অনুরোধ করেছেন। ডিসি সাহেব সরাসরি সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দিয়েছেন। একটা ভাল কেবিন তো চাইলে শমসের চেয়ারম্যান নিজেই ব্যবস্থা করতে পারত। একটু কষ্ট ও অপমানবোধ হয় তার। মন্তাজ মাষ্টার তার ছয় সাত বছরের বড়। তার শহীদ বড় ভাইয়ের সমবয়সী। শুরুতে মন্তাজ ভাই বলে ডাকলেও, কখন যে স্যার বলে ডাকা শুরু করেছিল? তা শমসের চেয়ারম্যান জানেন না। আর এলাকাতে মন্তাজ মাষ্টার হিসেবেই তার নামের পরিচিতি পায়।
মন্তাজ স্যার শুয়ে আছেন সাদা ধবধবে চাদর বিছানো বিছানাতে। তার এলাকাতে এত সুন্দর ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সরকারী হাসপাতালের কেবিন হতে পারে, চেয়ারম্যানের ধারনাই ছিল না। মন্তাজ মাষ্টার চোখ খোলার সাথে সাথেই চেয়ারম্যান সালাম দিলে, মন্তাজ মাষ্টার সালামের উত্তর দিয়ে ইশারায় চেয়ারটি দেখিয়ে তার সামনে এসে বসতে বলেন। বসার পরেই শমসের চেয়ারম্যান মন্তাজ মাষ্টারের প্রথম প্রশ্ন শুনে একটু অবাকই হন -
- শমসের, তোর পরিচয় কিরে?
- স্যারের শরীর কি খারাপ?
এই বলে, চেয়ারম্যান মন্তাজ স্যারের দিকে উঠে এগোতে গেলে, মন্তাজ মাষ্টার হাত তুলে নিষেধ করে বলেন -
- শরীর ভাল। কেন?
- স্যার, কি বললেন? ঠিক বুঝলাম না।
- প্রতিটি মানুষ তার পরিচয় দেয়। কোন পরিচয়টা দিতে তোর ভাল লাগবে?
- কেন স্যার? আমি তো চেয়ারম্যান।
- আমি তোরে বিশেষ পছন্দ করি জন্যই ইচ্ছে করছে একটা চড় মারি তোরে। একজন শহীদ পিতার গর্বিত সন্তান, একজন শহীদ ভাইয়ের গর্বিত ভাই তুই। এরচেয়ে বড় করে পরিচয় কজন মানুষ দিতে পারবে দেশে?
শমসের চেয়ারম্যানের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে এবং পরবর্তী চল্লিশ মিনিট একের পর এক চক্করই দিকে থাকে।
৬।
মন্তাজ মাষ্টারের সাথে দেখা করে শমসের চেয়ারম্যান যখন হাসপাতালের বাহিরে বের হলেন, তখন তাকে উদভ্রান্ত লাগছিল। মটর সাইকেল ফেলে তিনি একবার ডানে গজ বিশেক এগিয়ে, আবার বাঁয়ে গজ পঞ্চাশেক গিয়ে, হটাৎ করেই মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। দিন দুপুরে শমসের চেয়ারম্যানের মত মানুষের এ জাতীয় অস্বাভাবিক কর্মকান্ড, বাতাসের আগেই প্রচার হয়ে গেল।
মাঠ পেরিয়ে শমসের চেয়ারম্যান সরাসরি গোরস্থানে তার ভাইয়ের কবরে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফেরবার পরে শমসের মাষ্টারের মধ্যে আর কোন পাগলামো দেখা গেল না। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কিন্তু চোখ দুটো অসম্ভব স্থির। এই স্থির চোখ জোড়াই যেন তাকে সম্পুর্ণ অন্যরকম করে ফেলেছে। তিনি তার কর্মীদের তাকে একা থাকবার আদেশ নয়, এই প্রথম অনুরোধ করলেন। তিনি রিক্সায় চেপে থানায় গেলেন। আগের দিন শেষ মুহুর্তে ডাক্তারের জামিন মঞ্জুর হলেও এলাকার কিছু রাজাকারের বীজ রয়েছে, তাকে বের হতে দেয়নি। শমসের চেয়ারম্যান কোর্টের উকিলকে ও জাজ সাহেবকে ফোন করলেন। সবাই শমসের চেয়ারম্যানের কণ্ঠে বড় ধরনের পরিবর্তন বুঝলেন। আগের মত চঞ্চলতা নেই। কেউ কেউ বলছিল - মন্তাজ মাষ্টারের এক আনা পরিমান শক্তি মনে হয় শমসের চেয়ারম্যান আজ পেয়েছেন। তিনি ডাক্তার সাহেবকে থানা থেকে বের করে জড়িয়ে ধরলেন। ঠিক সেই মুহুর্তেই রহমত, চেয়ারম্যানের ডান হাত, হাপাতে হাপাতে এসে বলল -
- চেয়ারম্যান সাব, মন্তাজ স্যারে মারা গেছেন।
শুক্রবার বাদ জুম্মা হাজার দুয়েক লোক জানাজায় অংশ নিলেও, পিলপিল করে আশে পাশের এলাকা থেকে লোকজন এসে, প্রায় হাজার পাঁচেক লোকের জমায়েত হল গোরস্থানে। এই প্রথম হিন্দু পুরোহিতের ভাই সহ অনেক হিন্দু মানুষকেই গোরস্থানে আসতে দেখা গেল। মন্তাজ মাষ্টারের দাফন পরবর্তী দোয়ার শেষের দিকে কিছুটা কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলেও, দোয়া শেষে শুধু একটি শব্দ "আমিন" আকাশ বাতাস কাপিয়ে শোনা গেল।
শনিবার এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যারা মন্তাজ মাষ্টারকে দেখতে আসতে চেয়েছিলেন, তারা তাদের প্রোগ্রাম বাতিল করলেন না। শমসের চেয়ারম্যান স্কুলের মাঠের পরিবর্তে স্থানীয় বিশাল ঈদগাহ ময়দানে শোকসভায় সেটিকে পরিবর্তিত করলেন।
৬।
দেশের সব মানুষই কি এসেছে নাকি? এত বড় ঈদগাহ মাঠে, এলাকার সমস্ত মানুষ আসলেও স্থানের সংকুলান হবে, সেখানে ঈদগাহ মাঠের বাইরেও লোকের ভিড়। শোক সভায় সবাই শমসের চেয়ারম্যানকে দেখে অবাক। মানুষটির হাঁটা চলা, কথা বার্তা সব একদিনেই পরিবর্তিত। সবচেয়ে বড় দুটো চোখে পড়বার মত আশ্চর্য্যের ব্যপার সবাই দেখল -
- ডিসি ও এসপি সাহেবকে খুবই ভদ্রতা ও বিনয়ের সাথে শমসের চেয়ারম্যান সালাম দিলেন, কিন্তু আগের মত হাত জোড় করে কোন তোষামেদি নেই। কুশল বিনিময় করেই তাদের রেখে তার কাজে তিনি হাঁটতে শুরু করেছেন।
- শমসের চেয়ারম্যানের সবচেয়ে কাছের মানুষ আজ ডাক্তার সাহেব। অথচ, এই জনদরদী ডাক্তার সাহেবকে শমসের চেয়ারম্যান বিশেষ অপছন্দ করতেন।
শমসের চেয়ারম্যান অনুষ্ঠান শুরু করলেন। ওনার এই কথার ভঙ্গি আগে কেউ দেখেনি। উনি সরকারের উচ্চপদস্থ কয়েকজনকে ও স্কুলের হেডমাষ্টারকে সংক্ষেপে কিছু বলতে বললেন। ওনাদের কথা থেকে জানা গেল যে, ক্লাস সিক্স থেকে টেন, যে সমস্ত ছাত্ররা ৮০ এর নীচে নাম্বার পেত, তাদের খাতাগুলি তিনি বাসায় রাখতেন। বিকেলে বের হয়ে বিভিন্ন ছাত্র ছাত্রীর বাসায় যেতেন ও কেন অংকটি ভুল করেছেন সেই কারণ বের করে শেখানো না পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হতেন না। তিনি বিভিন্ন উদাহরন দিয়ে, ছবি এঁকে বাসায় বিনা পারিশ্রমিকে অংক বোঝাতেন।
সবাই অবাক হল, এরপরেই শমসের মাষ্টার স্থানীয় জামে মসজিদের ঈমাম সাহেব ও মন্দিরের পুরোহিত দুজনকেই একসাথে ডেকে পাশাপাশি দাড় করিয়ে দোয়া করতে বললেন। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে, মারা যাবার আগে মন্তাজ মাষ্টার, শমসের চেয়ারম্যানের মাথার ভেতরের স্ক্রু কিছু ঠিক করে দিয়েছেন।
এরপরেই চেয়ারম্যান বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন -
সবাইকে সম্ভাষন জানিয়ে বললেন -
- আমি চেয়ারম্যান শমসের আলী, চারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। প্রথম দুবার জেতাটা আমি আশা করেছিলাম। কিন্তু, পরের দুবার কিছুটা আশ্চর্য্য হয়েছিলাম। আমি সেরকম খারাপ মানুষ না হতে পারি, ভাল মানুষও না। পয়সা পাতি চেয়ারম্যান হিসেবে খারাপ রোজগার করি নাই। এই সব অন্যায়। তারপরেও পরের দুবার জিতলাম কেন? প্রতিবারই মন্তাজ স্যার আমারে ওনার ভোটটা দিছেন। স্যার আমার বাসার সামনে দাড়ায় থাকতেন, আমার ভয় করত। কেন স্যার দাড়াত? আপনারা অনেকেই বলেন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে স্যারের মাথা খারাপ ছিল যুদ্ধের সময়। স্যারের মাথা দেশের সেরা মাথাদের একটি। উনি দেশের সীমান্ত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
- সবাই নিশ্চুপ হয়ে থাকে এটি জেনে যে, মন্তাজ স্যার মুক্তিযোদ্ধা।
৭।
শমসের চেয়ারম্যানের চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে, তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন -
- আমি আমার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এই ডাক্তার সাহেবের জনসেবায় দান করলাম। এই দেহটা বাকী রাখলাম না, মেডিকেল কলেজে দান করে দিলাম। আমি অন্যায় সেরকম করিনি, কিন্তু অবমাননা করেছি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাই। যে কারণেই মন্তাজ স্যার আমাকে প্রতিবার ভোট দিয়েছেন এবং আমি জিতেছি। আমার চলার পথ অন্য, মন্তাজ স্যার চিনিয়ে দিয়েছেন সে পথ। আমি সেই পথে হাঁটব। রাজনীতি স্যার করতে বলেছেন, করব। ভোট দেবার মালিক আপনারা, সেটি নিয়ে আমি চিন্তিত না।
মন্তাজ স্যারকে আমি ভয় পাইতাম ওনার ব্যক্তিত্বের জন্য। উনি আমার বাসার সামনে দিয়ে গেলেই দাড়াতেন। এদিক ওদিক তাকাতেন। স্যার শুধু আমার বাসায় না, অনেক জায়গাতেই এই কাজ করতেন। আমাকে ডেকে যখন জিজ্ঞেস করলেন আমার পরিচয়? আমি মনে করলাম স্যারের শরীর বেশী খারাপ, কিছু মনে করতে পারছেন না। আমি স্যারকে ধরতে গেলে বললেন -
- আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
- স্যার, আমি চেয়ারম্যান শমসের।
- এক চড় দিয়ে তোর দাঁতগুলা ফালায় দিব। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে তুই, একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাই তুই। এই পরিচয় কয়জনের আছে?
আমি অবাক হইলাম ভাইসব। আপনারা তো কখনও খেয়াল করেন নাই, আমার বাসার সামনে সহ বিভিন্ন যে বাসাগুলোর সামনে স্যার থামতেন, সব বাসায় একজন শহীদ অথবা জীবিত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বুঝি না। মন্তাজ স্যারের মাথা যুদ্ধের সময় খারাপ হয় নাই। ওনার মাথা অংক বই দিয়া তৈরী। গুনে গুনে উনি ২২২ জন পাক সেনা আর রাজাকার মারছেন যুদ্ধে।
এই পর্য্যায়ে শমসের চেয়ারম্যান একটু থামেন। হাজার হাজার লোক এই কথা শুনে স্তম্ভিত। এরই মাঝে ডাক্তার পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আসেন, একজন হুইল চেয়ারে।
- মন্তাজ ভাইয়ের মত সাহসী মানুষ আমি যুদ্ধে শুধু নয়, জীবনে আর দেখি নাই - হুইল চেয়ারে বসা মানুষটি বলেন। পাঁচজনের একজন শ্লোগান দেন -
মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার
হাজার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় -
গর্জে উঠুক আরেকবার।
৮।
শমসের চেয়ারম্যানের মুখ আজ লাল ও কাঁপছে। এই চেহারা আগে কেউ দেখে নাই। তিনি বলেন -
- অনেকের মত আমিও বলতাম মন্তাজ স্যারের মাথায় সমস্যা। মাথা ঠান্ডা রাখতে খালি পায়ে হাটে। গ্রামের প্রতিটি রাস্তায় কোন না কোন মুক্তিযোদ্ধার বসতভিটা বা কবর আছে। উনি স্যান্ডাল পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের সামনে দিয়ে হাঁটতে চাইতেন না।
জনগন নিঃস্তব্ধ। এতগুলো মানুষ যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। চেয়ারম্যান বলেন -
- স্যার, সারাটা জীবন আধা কিলো রাস্তা বেশী হেঁটে স্কুলে আসতেন। স্কুলে স্যান্ডাল পায়ে আসত হত তাই। উনি নদীর পাড় ঘেষে এতদুর হেঁটে পুরোহিতের ভাইয়ের বাড়ীতে কেন যেতেন?
হাজার জনতা কথা বলতে ভুলে গেছে। শমসের চেয়ারম্যানই বলেন -
- এছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না, ঐ শুয়োরের বাচ্চা দস্তগীর রাজাকারের বাড়ীর সামনে দিয়া না হেঁটে পুরোহিতের বাড়ী যেতে।
মন্তাজ স্যারের বাবা মা আর ভাইরে তো বেজন্মারা খুন করে গাঙ্গে ভাসায় দিল। আর ছয় মাসের ছোট বোনটারে ছুইরা ফেলল কুকুর শেয়ালের আস্তানার জঙ্গলে। রাখে আল্লাহ মারে কে? তিনি বাঁচালেন ভগবানের কোলে পাঠিয়ে। পুরোহিতের ভাইয়ের বৌ মুসলমান বাচ্চারে নিয়ে গিয়া নিজের বুকের দুধ খাওয়াইল। পুরোহিত হিন্দু হয়ে মুসলমান বাচ্চা মানুষ করে বড় করল। আমাদের গর্ব - আমাদের গ্রামে এইরকম ঘটনা ঘটে। সেই মেয়ের বিয়ে ঠিকই দিলেন মুসলমানের ছেলের সাথে। মন্তাজ স্যার সবই জানতেন। স্যারের প্রানপ্রিয় এই বোনটা স্যাররে বাঁচায় রাখছিল। বোনটা মারা যাবার পরেই তো স্যারের এই অবস্থা। তবে, তবে ভাইসব, স্যারের বোন রেখে গেছেন স্যারের আদর্শের মানুষ - এই ডাক্তার সাহেবকে। উনি এই গ্রামে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবেন জনসেবায়। যেমন মামা, তেমনি ভাগ্না।
শোক সভার অনুষ্ঠানে আকাশ কাপিয়ে জনতার হাততালির আওয়াজ আসে।
ভাইসব, শেষ একটা কথা বলি -
- এই গ্রামের নামটা রাজাকার না হইলেও রাজাকার জন্ম দেয়া একজন মানুষের নামে। স্যার তার নামে কোন কিছুর নাম রাখতে মানা করে গেছেন। কিন্তু স্যারের জায়গা পূরণে ডাক্তার সাহেবের জন্মদাত্রী মাতা ও স্যারের বেঁচে থাকার শক্তি এই বোনের নাম ছিল তাজ। স্যারের নামের সাথে মিল আছে। এই গ্রামের নাম তাজনগর দিতে কারও আপত্তি আছে?
- হ্যাঁ বা না শোনা যায় না। আকাশ বাতাস কাপিয়ে শুধু তাজনগর নামটিই ভেসে আসে।
আমি শেষ করছি ভাইসব। তবে, আপনাদের উদ্দেশ্যে স্যারের কিছু কথা ছিল। অনুরোধ করব, স্যারের কথাগুলো ওনার রেখে যাওয়া শক্তি, ডাক্তার সাহেবকে বলতে।
৯।
ডাক্তার মোঃ স্বাধীন দাড়িয়ে কোন ভনিতা না করেই বলেন -
- মৃত্যুর আগে দিয়ে, আপনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আপনাদের প্রানপ্রিয় মন্তাজ স্যারের কথাগুলি আমি পড়ে শোনাচ্ছি -
**"আমি সেই দেশের মানুষ, যে দেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় কোনো অহঙ্কার নেই, স্বাধীনতার চেয়ে বড় কোনো প্রাপ্তি নেই, দেশের চেয়ে বড় গর্বের কোনো ঠিকানা নেই, জন্মভূমির চেয়ে পবিত্র কোনো মৃত্তিকা নেই, জাতীয় সঙ্গীতের চেয়ে সুন্দর কোনো গান নেই, জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের চেয়ে প্রিয় কোনো রঙ নেই, জাতির জনকের চেয়ে বড় কোনো নেতা নেই, মানবতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই, দেশপ্রেমের চেয়ে বড় কোনো বর্ম নেই, শক্ত ভিতের 'পরে দেশকে দাঁড় করানোর চেয়ে বড় কোনো কর্ম নেই, ইতিহাসবিকৃতির চেয়ে ঘৃণ্য কোনো অপরাধ নেই এবং যুদ্ধাপরাধীর চেয়ে নষ্ট কোনো প্রাণী নেই। আমরা সবাই আমাদের পূর্বপুরুষের গর্বিত উত্তরাধিকারী।
জন্মস্থানের চেয়ে সুন্দর কোনো ছবি নেই, শহীদ মিনারের চেয়ে বড় কোনো তীর্থ নেই, শহীদের তুলনায় বড় কোনো নমস্য নেই এবং কাঁদার জন্য বধ্যভূমির চেয়ে উপযুক্ত কোনো জায়গা নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে বড় কোনো বীর নেই, আদর্শচ্যুত মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে বর্জ্য কোনো প্রাণী নেই, ধর্মান্ধজনের চেয়ে বিষাক্ত কোনো কীট নেই।..."**
আপনাদের ধন্যবাদ।
শমসের চেয়ারম্যান মাইক ছাড়াই খোলা ময়দানে খালি গলায় চিৎকার করে শ্লোগান দেন -
- মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার
গর্জে উঠুক আরেকবার
জনতার গগন বিদারী কণ্ঠে বাতাস কম্পিত হয়। সূর্যাস্তের আগে দিগন্ত লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তার নীচেই দুরের সবুজ বৃক্ষরাজি দেখে মনে হয় -
- লাল সবুজের ছায়ায় তাজনগরের সব মানুষ নতুন চেতনায়, নতুন শক্তিতে পথ চলতে একত্রিত।
কোন কল্পলোকের বাতাসে ভেসে হলেও, আজ বাংলার প্রতিটি ধুলিকণায় এই শক্তির আলো নিঃসরনে পুরো দেশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে -
- ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশের মানুষের আশা, আজ প্রতিধ্বনিত হয় -
- "তাজনগর গ্রামে"।
** - ** অংশটুকু সংস্কৃতি সচিব স্বর্গীয় রনজিৎ বিশ্বাসের লেখা থেকে নেয়া।
মন্তব্য
এক কথায় অসাধারণ একটি গল্প। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে এত চমৎকার গাঁথুনীর একটি গল্প অনেকদিন পরে পড়লাম। লেখককে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভাল লাগল, ভাল লেখার তাগিদ থেকে।
ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক ধন্যবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার
গর্জে উঠুক আরেকবার
জনৈক অমুক।
অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন